উন্মুল মোমেনীন হযরত খাদীজা (রা) ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে মরুময় আরব দেশের মক্কা নগরে সুবিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল খুওয়াইলিদ ও মাতার নাম ফাতেমা। মাতা ফাতেমাও ছিলেন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশীয় রমণী।
আরব দেশে তখন প্রধান দুটি গোত্র বিখ্যাত ছিল। তার মধ্যে একটির নাম আদনান ও অপরটির নাম কাহতান। আদনান ছিল একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম, তারই নামানুসারে তার বংশাবলিকে বলা হত আদনান বংশ। এ আদনান বংশের দশম পুরুষের নাম ছিল ফিহির ইবনে-মালিক। তিনি সর্বসাধারণের নিকট কুরাইশ নামে পরিচিত। যদিও কুরাইশ বংশ বহু গোত্রে বিভক্ত ছিল, তথাপি বাইরে তাঁরা একমাত্র কুরাইশ নামেই পরিচিত ছিলেন।
কুরাইশ বংশের ষষ্ঠ পুরুষের নাম ছিল কুসাই ইবনে-কিলাব। তিনি কুরাইশ বংশীয়দের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। কুসাই ইবনে-কিলাবের তিন পুত্র ছিল। যথা- আবদুল মান্নাফ, আবদুদ্দার ও আবুল ওজ্জা।
হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ব পুরুষ এবং হযরত খাদীজা (রা)-এর পূর্ব পুরুষ কুসাই-ইবনে কিলাব পর্যন্ত একই ছিল। কুসাই-ইবনে কিলাবের এক পুত্র আবদুল মান্নাফ হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ব পুরুষ এবং অপর পুত্র আবুল ওজ্জা হযরত খাদীজা (রা)-এর পূর্ব পুরুষ।
কুসাই-ইবনে কালিবের পুত্র ওজ্জা, ওজ্জার পুত্র আসাদ, আসাদের পুত্র খুওয়াইলিদের কন্যা খাদীজা।
অপরপক্ষে কুসাই-ইবনে কিলাবের পুত্র আবদুল মান্নাফ, মান্নাফের পুত্র হাশেম, হাশেমের পুত্র আবদুল মোত্তালিব, আবদুল মোত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহর পুত্র হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত খাদীজা (রা)-এর মাতার নাম ফাতেমা। ফাতেমার পিতার নাম জায়েদ। তিনি হযরত রাসূলে আকরামের উর্ধ্বতন দশম পুরুষ গালিবের বংশধর। কাজেই পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়েই খাদীজা (রা) ছিলেন কুরাইশ বংশীয়া। আর তৎকালে কুরাইশ বংশীয়গণই ছিলেন আরবের সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত, সকল গোত্রের কর্তৃত্ব এরাই করতেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা-মাতার পূর্ব পুরুষগণ কয়েক পুরুষ পর্যন্ত উর্ধ্বে গিয়েই হযরত খাদীজার পিতা ও মাতার উভয়ের বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং হযরত খাদীজা (রা) যে বংশ মর্যাদায় সর্বদিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ ছিলেন সেকথা বলাই বাহুল্য। কুরাইশ বংশ ছাড়াও আরব দেশে তৎকালে আরও অনেক বংশ ছিল। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষায়, ধন-সম্পদে ও মান-সম্মানে কুরাইশদের সামনে অন্য কোন বংশেরই মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না।
হেজাজ ছিল সারা আরবের সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। পবিত্র খানায়ে কাবা হেজাজে অবস্থিত ছিল বলে শুধু আরবেই নয়, বরং আরও অন্যান্য দেশের লোকের নিকটে হেজাজ পূত-পবিত্র পুণ্যভূমি বলে বিবেচিত ছিল। কুরাইশ বংশের লোকগণই বংশ পরম্পরায় চিরদিন খানায়ে কাবার তত্ত্বাবধান করে আসছিল। ফলে আরবের সবাই কুরাইশদিগকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করত।
কুরাইশদের মধ্যেও আবার অনেকগুলো গোত্র ছিল এবং সকল গোত্রের লোকের মর্যাদা সমান ছিল না। কুরাইশদের মধ্যে হাশেমি বংশই ছিল মান-মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে সকলের নেতৃস্থানীয়। এ হাশেমি বংশেই আমাদের নূরনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের ১৫ বছর পূর্বে এবং ইসলাম প্রচারিত হওয়ার ৫৫ বছর পূর্বে হযরত খাদীজা (রা) জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালে আরবে নারীদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হত না, তথাপি হযরত খাদীজার পিতা-মাতা অত্যন্ত যত্নের সাথে তাঁদের একমাত্র কন্যা খাদীজাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে এমন আদর্শ নারীরূপে গড়ে তুলেছিলেন যে, তখনকার অন্ধকার যুগে কেন, বর্তমান সভ্যতার যুগেও সেরূপ আদর্শ শিক্ষা কোন নারী পায় বলে মনে হয় না।
হযরত খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ যে কেবল বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, বরং তিনি তদীয় বংশের সর্বাপেক্ষা ধনী, সুশিক্ষিত ও বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সিরিয়া ও ইয়ামেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। খুওয়াইলিদ ছিলেন তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম।
হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন অতুলনীয় সুন্দরী ও গুণবতী; অবশ্য রূপের প্রশংসা সকল দেশে সকল জাতির নিকটে এক রকম নয়। রূপের প্রশংসা বিভিন্ন জাতির নিকটে বিভিন্ন প্রকার। কেবল শরীরের রং ফরসা বা লাল হলেই তাকে সুন্দরী বা রূপবতী বলা চলে না। আফ্রিকার অধিবাসী সবাই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু তাই বলে যে তাদের মধ্যে রূপবতী বা গুণবতী নারী নেই এরূপ ধারণা করা ভুল। তাদের ভিতরেও রূপের প্রতিযোগিতা চলে। নারীর সৌন্দর্যের মূল কথা তার দেহের গঠন ও কমনীয়তা। হযরত খাদীজা (রা)কে সেদিক দিয়ে একেবারে নিখুঁত সুন্দরী বলা চলে। আরব দেশের মানুষ এমনিতেই শ্বেতাঙ্গ, কাজেই তাদের নিকট মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রশংসা হল দেহের লাবণ্য, কমনীয়তা ও গঠন প্রকৃতির নৈপুণ্য। এদিক দিয়ে হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন অতুলনীয়া।
তিনি যেমন ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, তেমনি ছিলেন বিশেষ গুণসম্পন্ন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর স্বভাব চরিত্র ছিল অত্যন্ত নিখুঁত ও সরল-সুন্দর। তাঁর অনুপম সৌন্দর্য ও ব্যবহারের মাধুর্যতায় সকলেই তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করত। যৌবনকালে তিনি অশেষ গুণবতী, সত্যপিপাসু ও নির্মল চরিত্রের অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর স্বচ্ছ চরিত্রের জন্য সকলে তাঁকে 'তাহেরা' (পবিত্র) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
বিবাহ
উন্মুল মুমেনীন খাদীজা (রা) রূপে-গুণে, চরিত্রে, বংশ মর্যাদায়, বিদ্যা-বুদ্ধিতে ও ধন-দৌলতে সবদিক দিয়েই ছিলেন তৎকালীন আরবের সেরা রমণী। বিপুল ধন ভাণ্ডারের মালিক খুওয়াইলিদের একমাত্র স্নেহের দুলালী ছিলেন তিনি। এজন্য তিনি যৌবনবতী হওয়ার সংগে সংগে কুরাইশ বংশের বহু উচ্চ পরিবার হতে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। যখন যেখান হতেই বিয়ের প্রস্তাব আসছিল, খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ তাঁর প্রত্যেকটির দোষ-গুণ সম্বন্ধে বিবেচনা করে দেখছিলেন। যেহেতু হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন তাঁর একমাত্র আদরের দুলালী। অবশেষে তুলনামূলকভাবে আবু হালা ইবনে-জাহ্য়াহ নামক জনৈক কুরাইশ বংশীয় যুবককেই তাঁর কন্যার জন্য সর্বাপেক্ষা অধিক যোগ্য পাত্র বিবেচনা করে তার হাতেই খুওয়াইলিদ তাঁর একমাত্র কন্যা খাদীজাকে সমর্পণ করেন।
হযরত খাদীজা (রা) আবু হালাকে স্বামীরূপে পেয়ে সত্যই সুখী হয়েছিলেন। যেহেতু আবু হালা ছিলেন পরম সুন্দর, সুশিক্ষিত ও অত্যন্ত বিনয়ী।
আবু হালার ঔরসে হযরত খাদীজার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁরা পুত্রটির নাম রাখলেন হিন্দ। তিনি পরবর্তীকালে হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সাহাবী ও হাদীস বর্ণনাকারীরূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
হযরত খাদীজার অদৃষ্টে দাম্পত্য সুখভোগ অধিক দিন স্থায়ী হল না। পুত্রটির জন্যের কিছুকাল পরেই আবু হালা পরলোকগমন করলেন। শিশু পুত্র হিন্দকে নিয়ে হযরত খাদীজা (রা) পিতৃগৃহে ফিরে এলেন। যৌবনের প্রারম্ভে এ নিদারুণ আঘাত হযরত খাদীজার কোমল হৃদয়কে নিতান্তই বিহ্বল করে ফেলল। খুওয়াইলিদও অন্তরে বিশেষ আঘাত পেলেন, তাঁর একমাত্র আদরের কন্যা খাদীজার-ভাগ্য বিপর্যয়ে। মেয়ের শোকতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর অন্তর হাহাকার করে উঠল। এ কি তিনি আশা করেছিলেন? রূপে-গুণে, বিদ্যায় বুদ্ধিতে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁর কন্যা। তাঁর একমাত্র আদরের দুলালী, স্নেহের পুত্তলিকে কত দেখে-শুনে, ভেবে-চিন্তে বিয়ে দিলেন ভদ্র পরিবার ও ভাল বর দেখে; আর তারই পরিণতি হল এমন শোচনীয়।
আবার তিনি বহু চেষ্টা করে, অনেক দেখে-শুনে আতিক ইবনে আয়াজ নামক জনৈক ধনী, সুশিক্ষিত, সুন্দর, সচ্চরিত্র কুরাইশ যুবকের হাতে পরিণয় সূত্রে তুলে দিলেন হযরত খাদীজাকে।
জীবনের প্রথম আঘাত অনেকটা ভুলে গেলেন হযরত খাদীজা তাঁর দ্বিতীয় স্বামী আতিকের গৃহে এসে। আতিকও গুণবতী হযরত খাদীজাকে জীবন সঙ্গিনীরূপে লাভ করে নিজের জীবনকে ধন্য মনে করলেন। এবার একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করল হযরত খাদীজার গর্তে। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত সাহাবী মুহাম্মাদ ফখরুবী হযরত খাদীজার এ কন্যাটির গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহর মহিমা বুঝার ক্ষমতা মানুষের নেই। তিনি কি উদ্দেশ্যে যে কি করেন তা শুধু তিনিই জানেন। তাঁর লীলা-খেলার অন্ত নেই, তাইতো লোকে তাঁকে বলে লীলাময়।
দ্বিতীয়বারেও হযরত খাদীজার কপাল হল প্রথম বারের মতই। কন্যাটি জন্মগ্রহণ করার অল্পকাল পরেই আতিকও পরপারে চলে গেলেন হযরত খাদীজাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে। পূর্ণিমা চাঁদের মত রূপবতী হযরত খাদীজা দু'চোখের পানি মুছতে মুছতে পুনরায় চলে এলেন পিতৃগৃহে। প্রথমবারের আঘাত তিনি অনেকটা ভুলে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় স্বামী আতিককে পেয়ে। কিন্তু এবারে সু-কোমল হৃদয়খানি একেবারেই ভেঙে পড়ল। প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি জীবনে আর স্বামী গ্রহণ করবেন না। স্বামী সুখ তাঁর অদৃষ্টে নেই।
0 Comments