বদরের যুদ্ধে কুরাইশরা যে চরম আঘাত পেয়েছিল তা স্থায়ী ক্ষতের আকার ধারণ করল। কেননা এই যুদ্ধের মারাত্মক আঘাতে কুরাইশদের প্রতিটি ঘরে শোকের ছায়া নেমে আসে। এতে আরবের পৌত্তলিক গোত্রসমূহও মর্মাহত হয়। আবু সুফিয়ান তো শপথ করেই বললেন, যতক্ষণ বদরের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে না পারব ততদিন গোসল করব না এবং পরিধেয় বস্ত্রও পরিবর্তন করব না। ইকরামা ইবনে আবী জাহল ও অন্যান্য যুবকের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং স্ত্রীলোকদের বিলাপ কুরাইশ গোত্র এবং অপরাপর আরব গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত করল। এভাবে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজার জানবাজ বীর সৈনিক মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য মক্কা থেকে রওয়ানা হল এবং উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে এসে ছাউনি ফেলল।
নবী (সাঃ) আবু সুফিয়ানের যুদ্ধ-প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করলেন। বয়জ্যৈষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ সাহাবাগণ এই মত প্রকাশ করলেন যে, মদীনার বাইরে গিয়ে আমাদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। বরং কার্যকরী পন্থা হচ্ছে এই যে, আমরা মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করেই শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকব এবং তারা যখন মদীনা আক্রমণ করবে তখন তার সমুচিৎ জবাব দেয়া হবে। আমাদের এরূপ কর্মপন্থা অবলম্বনের ফলে প্রথমত শত্রু বাহিনী মদীনা আক্রমণ করতে সাহসী হবে না। আর যদি তারা পদক্ষেপ নেয়ই তবে পরাজিত হয়ে পালাবার পথ খুঁজবে।
কিন্তু যেসব সাহাবী বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি এবং এই সমরে বদরের সম্মান ও মর্যাদা অর্জনে লালায়িত ছিল। তারা উপরোক্ত অভিমত পছন্দ করেননি। যুব-সম্প্রদায়ও এই শেষোক্ত দলের সংগে যোগ দিল। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েই আমাদের শত্রুর মোকাবিলা করা উচিৎ। নবী (সাঃ) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের অনুকূলে সম্মতি প্রকাশ করে নিজের হুজরা মুবারকে চলে যাওয়ার পর অভিজ্ঞ ও প্রবীণ সাহাবীগণ যুবকদের এই বলে তিরষ্কার করেন যে, তারা কেন নবী (সাঃ)-এর ঝোঁক প্রবণতার বিরুদ্ধে স্বাধীন মত প্রকাশ করে তাঁকে চিন্তান্বিত করল? অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন বাইরে বের হয়ে এলেন তখন যুবকরা তাদের মত প্রকাশের জন্য তাঁর কাছে অনুতপ্ত হয় এবং বলে যে, মদীনার ভেতরে থেকেই শত্রুর মোকাবিলা করা যুক্তিযুক্ত।
এই কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, " আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর হক বাতিলের সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়েই তা খুলে রাখা নবীর পক্ষে শোভা পায় না। এখন আল্লাহর নাম নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা হও।"
রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদীনা থেকে যুদ্ধ-যাত্রা করেন তখন সৈন্যসংখ্যা ছিল একহাজার। এর মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর নেতৃত্বাধীন তিশত মোনাফেক ও ছিল। এরা মদীনায় থাকতেই মক্কার মুশরিকদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং বলে যে, তারা নিষ্ঠাবান মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে এই পন্থা অবলম্বন করবে যে, তারা প্রথমত মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করবে এবং পথিমধ্যে মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মদীনায় ফিরে আসবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মোনাফেক সরদার এই অজুহাত তুলে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মদীনায় ফিরে আসে যে, নবী (সাঃ) যখন আমাদের মত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মত উপেক্ষা করে অর্বাচীন যুবকদের মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তখন আমাদের নিজেদের জীবনকে অযথা ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করার এমন কি প্রয়োজন আছে।
কিন্তু মোনাফিকদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। পথিমধ্য থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দীনের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ মুসলমানদের মধ্যে মূলত কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। ইসলামের জন্য জীবনকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত এই ধরনের মুমিনদের উপর এর কিইবা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যাদের অল্প বয়স্ক যুবকরা পর্যন্ত আল্লাহর দীনের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মদীনার বাইরে গিয়ে নবী (সাঃ) মুজাহিদদের যাচাই বাছাই করলেন এবং অল্প বয়স্কদের মদীনায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এ অবস্থা দেখে নব্য যুবক রাফে ইবনে খাদীজ যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য নিজেকে দৈর্ঘ্যে উচ্চ দেখানোর উদ্দেশ্যে পায়ের আংগুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর এই বুদ্ধি ফলপ্রসূ হল। অনুরূপভাবে অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে হযরত সামুরা ইবনে জুনদব (রাঃ) কে ফেরত পাঠানো হলে তিনি কান্নাকাটি করতে থাকেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রসূল। রাফে যদি যুদ্ধে শরীক হতে পারে তবে আমাকে কেন ফেরত পাঠানো হচ্ছে? অথচ আমি মল্লযুদ্ধে তাকে চিৎপাত করে ফেলে দিতে সক্ষম। অবশেষে উভয়ের মধ্যে মল্লযুদ্ধের ব্যবস্থা করা হল। সামুরা (রাঃ) রাফে (রাঃ) কে ভূমিস্যাৎ করে ফেললেন। অতঃপর তাঁকেও সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবশ্য দুই মুসলিম গোত্র বন্ধু সালামা ও বনু হারিসার মধ্যে কিছুটা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর দীনের জন্য উৎসর্গীকৃত-প্রাণ মুসলমানদের আবেগ-উত্তেজনা দেখে তাদের মনোবলও বেড়ে যায়।
মোটকথা উঃসাহ উদ্দীপনা সহকারে মুসলিম বাহিনী উহুদ প্রান্তরে এসে উপস্থিত হল এবং উভয় পক্ষ পরস্পরের সম্মুখে কাতারবন্ধী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নবী (সাঃ) উহুদ পর্বত পেছনে রেখে মুসলিম বাহিনীকে শ্রেণীবদ্ধ করলেন এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে পঞ্চাশজন তীরন্দাজকে একটি পাহাড়ী পথের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করলেন। তিনি এদের নির্দেশ দিলেন, জয়-পরাজয় কোন অবস্থায় তোমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না। কারণ এ পথ দিয়ে শত্রু বাহিনী এসে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারে।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং উভয় পক্ষ জীবন বাজি রেখে সামনা সামনি বীরত্ব প্রদর্শন করতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র মুসলিম বাহিনীর অনুকূলে এসে গেল এবং মক্কার মুশরিক বাহিনী ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। মুসলিম বাহিনী শত্রুদের ফেলে যাওয়া সম্পদ কুড়িয়ে একত্রে জমা করতে লাগল। তীরন্দাজ বাহিনী এই দেখে ধৈর্য ধারণ করতে পারল না এবং তারা গিরিপথ পরিত্যগ করতে প্রস্তুত হয়ে গেল। অধিনায়ক আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) তাদের বারবার নিষেধ করলেন এবং বললেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশের পরিপন্থী কাজ কর না। কিন্তু তারা এই কথা বলে স্থান ত্যাগ করল যে, যুদ্ধ চলাকালীন সময় পর্যন্ত তাঁর নির্দেশ সীমাবদ্ধ ছিল। অতএব এখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর নির্দেশের বিরোধিতা হচ্ছে কোথায়?
এদিকে গণীমতের সম্পদ লাভের লালসায় তীরন্দাজ বাহিনী নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করণ, অপরদিকে খালিদ ইবনে ওলীদ (তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি) তার কামান্ডো বাহিনী নিয়ে উন্মুক্ত গিরিপথ দিয়ে মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। মুসলমানরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়'ল এবং এই আকস্মিক আক্রমণে তাদের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। এভাবে একটি বিজয় মুহূর্তের মধ্যে পরাজয়ের রূপ ধারণ করল। নবী (সাঃ)-এর চারপাশে যদিও আবু বাকর, উমর ও আলী (রাঃ)-র মত উৎসর্গীকৃত প্রাণ সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের পলায়ন শত্রুর জন্য বাড়তি সুযোগ এনে দিল। এক হতভাগ্য পাপিষ্ট একটি পাথর তুলে নবী (সাঃ)-এর উপর নিক্ষেপ করল। ফলে তাঁর একটি দাঁত শহীদ হয়ে যায়। তিনি পাথরের আঘাতে নিকটস্থ একটি গুহার মধ্য পড়ে গেলেন। তিনি নিজেকে সামলিয়ে নিতে না নিতেই এক মুশরিক ডাক দিয়ে বলল, 'মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে'।
এই ঘোষণা মুসলমানদের মধ্যে চরম বিচ্ছিন্নতা ও সীমাহীন ব্যাকুলতা সৃষ্টি করল। কিন্তু তারা অবিলম্বে নিজেদের সামলে নিল এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী সাহাবাগণ ডাক দিয়ে বললেন, এই কথা যদি সত্য হয় তবে আমাদের এখন আর জীবিত থেকে লাভ কি? এসো জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করে জীবন দেই। সত্যের এই আহবান মুসলমানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। তারা প্রবল আবেগে উদ্বেলিত হয়ে আবার ফিরে এসে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হল এবং পুনরাক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু ততক্ষণে যুদ্ধের চিত্র পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কুরাইশ বাহিনী নিজেদের বিজয়ে আত্মহারা হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। মুসলমানরা হুযুর (সাঃ)-কে খোঁজ করতে লাগলেন। সর্বপ্রথম হযরত কা'ব বিন মালিক (রাঃ) হুযুর (সাঃ)-কে দেখলেন। তিনি আনন্দে চীৎকার করে উঠে বললেন "বরকত হোক, হুযুর (সাঃ) নিরাপদেই এখানে অবস্থান করছেন।"
এ খবর শুনেই সাহাবায়ে কিরাম হযরত (সাঃ)-এর দিকে দৌড়ে আসেন। কিন্তু সাথে সাথে কাফিররা চতুর্দিক হতে এদিকে আসতে লাগলো। কয়েকবার হযরত (সাঃ)-এর উপর আক্রমণ করা হলো। কিন্তু তিনি নিরাপদেই রইলেন।
একবার যখন কাফিররা কোলাহল শুরু করে, তখন জীবন দিতে প্রস্তুত?" হযরত জিয়াদ বিন সাকান ৪ জন সাহাবী নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং সবাই মরণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। যখন জিয়াদ (রাঃ) আহত হয়ে পড়ে গেলেন, তখন হুযূর (সাঃ) বললেন "তাঁর লাশ আমার নিকট নিয়ে এস।" লোকেরা তাঁর লাশ কাছে নিয়ে গেল। তখনো কিছুটা প্রাণ অবশিষ্ট রয়েছে। হুযুর (সাঃ)-এর পবিত্র পা-এর উপর মুখ রাখা অবস্থায়ই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুবহানাল্লাহ।
0 Comments