কুরআন পাঠের আদব বা রীতি নীতি

        পবিত্র কুরআন পাঠের দশটি বাহ্যিক নিয়ম বা আদব আছে। নিয়মগুলো ধারাবাহিকভাবে পেশ করা হচ্ছে। যথা:

        (১) প্রথম অজু করে (পবিত্র হয়ে) আদবের সাথে বসে বা দাঁড়িয়ে কিবলামুখী হয়ে মস্তক অবনত করে চারজানু না বসে, হেলান কিংবা ঠেস না দিয়ে, দেমাগী ভাবে না বসে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করবে। ওস্তাদের সামনে বসার অনুরূপ বসবে। (কুরআন পাঠের ক্ষেত্রে মসজিদে নামাযের মধ্যে) দাঁড়িয়ে কিরাত পাঠই সর্বোত্তম কাজ। যদি অজু ছাড়া শয্যায় শায়িতাবস্থায় কুরআন পাঠ করা হয়, তাতেও অবশ্য ফজীলত আছে। তবে তা' প্রথম পর্যায়- ভুক্ত নয়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেনঃ "যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শয্যায় শায়িত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে; এবং ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টির বিষয় চিন্তা করে"। অত্র আয়াতে প্রত্যেক অবস্থার কথা বলা হলেও লক্ষ্যণীয় যে, প্রথম দাঁড়ানো অবস্থায় তারপর বসা অবস্থায়, তারপর শায়িত্যবস্থায় যিকির করার কথা বলা হয়েছে।

        হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে, তার জন্য প্রত্যেক অক্ষরের বিনিময়ে একশত করে নেকী লিখিত হয়। যে ব্যক্তি উপবিষ্টাবস্থায় নামায আদায়কালে কুরআন পাঠ করে, তার জন্য প্রত্যেক অক্ষরের বিনিময়ে পঞ্চাশ করে নেকী লিখিত হয়। যে ব্যক্তি অজু করে নামায ব্যতীত কুরআন পড়ে, তার জন্য প্রত্যেক অক্ষরের বিনিময়ে পঁচিশ করে নেকী লিখিত হয়। যে ব্যক্তি অজু ব্যতীত কুরআন পাঠ করে, তার জন্য দশ করে নেকী লিখিত হয়। রাত্রের নামাযে কুরআন তিলাওয়াত অত্যুত্তম। কেননা তখন মন বেশী শান্ত থাকে। হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেন, দিবসের নামাযে অধিক সিজদাহ করা ও রাত্রের নামাযে অধিক কুরআন পড়া বেশী উত্তম।

        (২) কিরাতের পরিমাণ: কুরআন পাঠের পরিমাণের ক্ষেত্রে হাফেজ ও কারীদের মাঝে নানাবিধ নিয়ম আছে। কেউ কেউ একদিন একরাতে কুরআন খতম করে। কেউ দুবার, আবার কেউ তিনবারও করে থাকে। আবার অনেকে এক মাসে একবার কুরআন খতম করে। তবে নিম্নোক্ত হাদীসে হুযুর (দঃ) কর্তৃক এর সর্বোত্তম নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করে, সে দ্বীন বিষয়ক জ্ঞানার্জনে বঞ্চিত থেকে যায়। কারণ হল, দ্রুত পাঠের দ্বারা বাক্যসমূহ স্পষ্ট বুঝা যায় না। একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) এক ব্যক্তিকে তাড়াতাড়ি কুরআন পড়তে দেখে বললেন যে, এ ব্যক্তি কুরআনও পড়ে না আবার চুপ করেও থাকে না। হুযুরে পাক (দঃ) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) কে সপ্তাহে একবার কুরআন শরীফ খতম করতে আদেশ করেছিলেন। এভাবে কতিপয় ছাহাবী প্রত্যেক জুমআয় এক এক খতম করতেন। এরা ছিলেন হযরত ওছমান (রাঃ), হযরত যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) এবং আরও কতিপয় ছাহাবী। কুরআন খতমের ব্যাপারে চারটি রীতি আছে। যেমন (১) এক দিন এক রাতে এক খতম। এ রীতিকে কেউ কেউ মাকরূহ বলেছেন। (২) প্রত্যেক মাসে এক খতম এবং প্রত্যেক দিনে এক সূরা পাঠ। এ দুটো রীতির মধ্যে আরও দুটো রীতি আছে। একটি রীতি হল, এক সপ্তাহের মধ্যে এক খতম এবং দ্বিতীয় রীতি হল, এক সপ্তাহের মধ্যে দু' খতম এবং প্রায় তিন দিনে এক খতম। রাত্রে এক খতম এবং দিনে এক খতম করাই অধিক উত্তম। দিনের খতম সোমবার ফজরের দু' রাকাত নামাযে অথবা তারপর এবং রাত্রের খতম জুমআর রাত্রে মাগরিবের দু' রাকাত নামাযে অথবা তারপর। সুতরাং দিনের বা রাত্রের প্রথম ভাগে খতম করবে। কেননা ফিরেশতাগণ তার রাত্রের খতমে ফজর পর্যন্ত দোয়া করে ও দিনের খতমে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোয়া করে। এভাবে সারা রাত ও দিন তার বরকত জারী থাকে।

        কিরাতের ব্যাখ্যাঃ আবেদ এবং দ্বীনের পথিকদের এক সপ্তাহে কুরআন দু' খতমের কম করা উচিত নয়। আর যারা দিনের আমলে অভ্যন্ত এবং আল্লাহর চিন্তায় মশগুল থাকে, তাদের এক সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করা উচিত। আর যে ব্যক্তি কুরআনের তাফসীর নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় থাকে, তার জন্য মাসে এক খতম করাই যথেষ্ট।

        এক সপ্তাহে একবার কুরআন খতমঃ কুরআনকে সাত ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। ছাহাবীগণ থেকে এরূপ করার প্রমাণ রয়েছে। বর্ণিত রয়েছে, হযরত ওছমান (রাঃ) জুমআর রাত্রে সূরা বাকারাহ থেকে সূরা মায়েদা পর্যন্ত, শনিবার রাত্রে সূরা আনআ'ম থেকে সূরা ইউসুফ পর্যন্ত, রবিবার রাত্রে সূর। ইউসুফ থেকে সূরা মরিয়ম পর্যন্ত, সোমবার রাত্রে সূরা ত্বহা থেকে সুরা কাছাছ পর্যন্ত, মঙ্গলবার রাত্রে সূরা আনকাবূত থেকে সূরা ছাদ পর্যন্ত, বুধবার রাত্রে সূরা ঘুমার থেকে সূরা রাহমান পর্যন্ত এবং বৃহস্পতি বার রাত্রে সূরা ওয়াক্বিয়া থেকে কুরআনে পাকের শেষ পর্যন্ত বাকী সূরাসমূহ পাঠ করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)ও এই নিয়মানুযায়ী কুরআনকে সাত ভাগ করে নিতেন, প্রথম ভাগে তিন সূরা, দ্বিতীয় ভাগে পাঁচ সূরা, তৃতীয় ভাগে সাত সূরা, চতুর্থ ভাগে নয় সূরা পঞ্চম ভাগে এগার সূরা, ষষ্ঠ ভাগে ত্রিশ সূরা, সপ্তম ভাগে ছোট সূরা কাফ থেকে শেষ পর্যন্ত। ছাহাবীগণ কুরআনকে এভাবেই ভাগ করে নিয়ে তা' পাঠ করতেন।

        লিখা প্রসঙ্গঃ সুন্দর ভাবে কুরআন লিখা ও তার ব্যাখ্যা করা মুস্তাহাব। নোকতা করা বা লাল কালিদ্বারা অন্যান্য চিহ্ন দেয়ায় কোন দোষ নেই। কেননা তাতে কুআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। পরিষ্কৃতি আসে। দোষমুক্তি ঘটে। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) এবং মহাত্মা ইবনে সীরীন (রহঃ) কুরআনকে পাঁচ ভাগ বা তের ভাগ বা যে কোন ভাবে ভাগ ভাগ করাকে মাকরূহ জানতেন। মহাত্মা শা'বী (রহঃ) ও লাল চিহ্ন দ্বারা নোকতা দেয়া এবং সে বাবদে মূল্য লওয়া মাকরূহ বলতেন। তাঁরা বলতেন, কুরআনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। তবে সম্ভবতঃ তাঁরা এ বিষয় অবলম্বন করা অপছন্দ করতেন। কেননা এতে এটা ক্রমশঃ বৃদ্ধিকরণ ও পরিবর্তনের প্রবর্তন ঘটতে পারে। তাঁরা এ পন্থা বন্ধ এবং কুরআনকে পরিবর্তন থেকে হেফাজত করার জন্যই এই মনোভাব পোষণ করতেন। সবাই জেনে-বুঝে কোন ভাল কাজ করলে তাতে ক্ষতির কারণ নেই, যদিও তা' কোন নতুন কার্য হয়। এরূপ অনেক নতুন ব্যাপার আছে যা' উত্তম। আবার অনেক নতুন ব্যাপার আছে, যা' তার বিপরীত তথা অনুত্তম। যেমন হযরত ওমর (রাঃ) প্রবর্তিত তারাবীহর জামাত। এটা উত্তম নব বিধান। কিন্তু অধম অর্থাৎ নিকৃষ্ট নব বিধান (বেদআতে সাইয়্যেয়াহ) পুরাতন উত্তম বিধানকে বিলুপ্ত করে দেয় অথবা তা' পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। কোন প্রাচীন বুযর্গ বলেছেন, আমি নোকতা লাগানো কুরআন পাঠ করি, তবে নিজে নোকতা লাগাই না। আওযায়ী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, প্রথমে কুরআন নোকতামুক্ত ছিল। প্রথম যে নতুন ব্যাপার প্রবর্তিত হল, তা' হল 'বা' এবং 'তা' তে নোকতা প্রদান করা। নোকতা প্রবর্তকগণ বলতেন যে, এটা দোষের কাজ নয় বরং এটা নূর। তারপর তারা বাক্যের শেষে বড় করে নোকতা লাগানো প্রবর্তন করলেন। তারা বলতেন, আয়াতের মূল জানার জন্য এরূপ করায় কোন দোষ নেই। এরপর আয়াতের শুরু ও শেষের চিহ্নও প্রবর্তন করা হল। হযরত আবুবকর হাযলী (রহঃ) বলেন, আমি হযরত হাসান বছরী (রহঃ) কে কুরআন পাকে নোকতা প্রদান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, নোকতা কি জিনিস? আমি বললাম, কুরআন পাকে এ'বাব চিহ্নিত করা। তিনি শুনে বললেন, কুরআনে এ'বাব লাগানো দোদের কাজ নয়। খালেদ (রহঃ) বলেন, আমি হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) এর নিকট গিয়ে দেখলাম, তিনি এ'রাব লাগানো কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করছেন। অথচ তিনি কুরআনে এ'রান দেয়াকে মাকরূহ মনে করতেন। তিনি এও বলতেন যে, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কারীগণকে ডেকে এনে তাদের দ্বারা এর প্রবর্তন করেছেন। এমনকি তাঁরা কুরআনে পাকের বাক্যগুলো ও শব্দগুলো গণনা করেছেন, কুরআনকে ত্রিশটি পারায় বিভক্ত করেছেন, তাছাড়া অন্যান্য ভাবেও ভাল করেছেন। কুরআন মজীদ অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাবে বুঝে-শুনে পাঠ করা মুস্তাহাব। কেননা কুরআন পাঠের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই হল, তার উপর চিন্তা-ভাবনা করা। কুরআন মজীদ ধীরে সুস্থে পাঠ করাই হল এ কাজের অনুকূল এবং সহায়ক। হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) প্রত্যেকটি বাক্য, শব্দ এবং হরফকে পৃথক পৃথক এবং স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আমি সমস্ত কুরআনকে দ্রুততার সাথে পাঠ করার চেয়ে শুধু সূরা বাকারাহ এবং সুরা আলে এমরানকে বুঝে শুনে ধীরে ধীরে পড়াকে উত্তম মনে করি। এমনি ভাবে তাড়াহুড়ো করে সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে এমরান পড়ার চেয়ে ধীর-স্থির ভাবে সূরা যিলযাল এবং সূরা আলক্বারিয়। পড়াকে উত্তম মনে করি। মুজাহিদ (রহঃ) এর নিকট এমন দুটো লোকের কথা জিজ্ঞেস করা হল, যারা উভয়ই নামাযে দাঁড়িয়ে একজনে দ্রুততার সাথে সমস্ত কুরআন পড়ে ফেলল, অন্য জনে ধীরে ধীরে শুধু সুরা বাকারাহ পাঠ করল। এদের মধ্যে অধিক ছওয়াব কে লাভ করবে? মুজাহিদ (রহঃ) বললেন, দুজনেই সমান ছওয়াব পাবে।

        পাঠক। জেনে রাখবে, ধীরে ধীরে কুরআন পাঠ করা মুস্তাহাব, তা' তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করবে এজন্যই নয়; বরং এদ্বারা কুরআনের সম্মান, মর্যাদা এবং তার প্রতি গাম্ভীর্য রক্ষা করা হয় এবং তাতে পাঠকের মন কুরআন দ্বারা বেশী প্রভাবিত হয় থাকে।

        কুরআন পাঠকালে ক্রন্দন করাঃ কুরআন পাঠকালে কুরআন পাঠকারীর ক্রন্দন করা মুস্তাহাব, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেনঃ কুরআন পাঠ কর এবং ক্রন্দন কর। ক্রন্দন করতে না পার, অন্ততঃ ক্রন্দনের ভাব কর। তিনি আরও বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সুললিত স্বরে কুরআন পড়ে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ছালেহ মারবী (রহঃ) বলেন, আমি স্বপ্নে হুযুরে পাক (দঃ) এর সামনে কুরআন পড়লাম। তিনি আমাকে বললেন, ছালেহ। তোমার কুরআন তিলাওয়াতে কান্না কোথায়? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন তোমরা সিজদাহর আয়াত পড়, তখন চোখে কান্না না আসা পর্যন্ত সিজদায় গমন করো না। যদি তোমাদের কারও চোখ কান্নায় অশ্রুপ্লাবিত না হয়, তার অন্তরে ক্রন্দন আনা চাই। এভাবে অন্তরে ক্রন্দন আনার উপায় হল, দুঃখ-বাথা আনয়ন করা। দুঃখ আনয়নকারী ব্যক্তি অন্তরে ক্রন্দনও আনতে পারে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেনঃ দুঃখের জন্যই কুরআন নাযিল হয়েছে। কুরআন পাঠকালে নিজেকে দুঃখিত এবং ব্যথিত মনে করবে। অন্তরে দুঃখ আনয়নের ওপর কুরআনে পাকে যে সতর্কীকরণ-সূচক শাস্তি, ধমতি এবং ওয়াদাহসূচক উক্তি সমূহ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করবে। তাতে ক্রন্দন এবং ভয়-ভীতির উদয় হওয়া স্বাভাবিক। স্বচ্ছহৃদয় ব্যক্তির মত যদি অন্তরে দুঃখ ও কান্না না আসে, তা হলে সে ক্ষেত্রে চেষ্টা সাধ্যের দ্বারা ক্রন্দন করবে। কেননা কান্নার অনুপস্থিতি বিপদের হেতু বৈকি।

        প্রত্যেক আয়াতের প্রতি কর্তব্য সঠিক ভাবে পালন করবে। সিজদাহর আয়াত পাঠ করে কিংবা অন্যের মুখ থেকে সিজদাহর আয়াত শুনে সিজদাহ করবে, যদি অনো সিজদাহ করে। বে-অজু অবস্থায় সিজদাহ করবে না। কুরআনে পাকে চৌদ্দটি সিজদাহ আছে। সূরা হজ্জে দুটো সিজদাহ আছে. সূরা ছোয়াদে কোন সিজদাহ নেই। তিলাওয়াতে সিজদাহর নিম্নতম পর্যায় হল, ললাট যমিনে স্থাপন করা আর এর সর্বোত্তম এবং পরিপূর্ণ পর্যায় হল, তাকবীর বলে যথারীতি সিজদাহ করা, কুরআনে পাকের যা' সে পাঠ করেছে বা যা সে কানে শুনেছে, সেই আয়াতের সাথে মুনাছিব কোন দোয়া বা কালাম সিজদাহর মধ্যে পাঠ করবে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ "অ খাররু সুজ্জাদ্যও অ সাব্বিহ্ বি হামদি রাব্বিহিম অহুম লা ইয়াসতাকবিরন" অর্থাৎ সিজদায় পড়ে যাও এবং তাদের প্রভুর প্রশংসা ঘোষণা কর-তারা তাতে অহংকার করে না। এরূপ স্কুলে সিজদায় বলবে, হে মাবুদ। আমাকে সিজদাহকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। যেন আমি তোমার প্রশংসা ঘোষণাকারীদের অন্যতম হই এবং তোমার আদেশ ও তোমার বন্ধুদের অবাধ্য হওয়া থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই।

        যখন সিজদাহর এই আয়াত পড়বেঃ "অ ইয়াখিরকুন। লিল আযকানি ইয়াবা অ ইয়াযীদু হুম খুশৃআ" অর্থাৎ তারা মুখের ওপর ক্রন্দনরত অবস্থায় পড়ে যায় ও তাদের ভয় বৃদ্ধি পায়, তখন সিজদায় বলবে, আমাকে তোমার ক্রন্দনকারীদের ও ভয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। প্রত্যেক সিজদায় এরূপ আমল করবে। এই সিজদাহর শর্তসমূহ নামাযের শর্তেরই অনুরূপ। যেমন সতরে আওরাত (লজ্জাস্থান আবৃত) করা, কিবলামুখী হওয়া, শরীর ও কাপড় পাক হওয়া। যদি কেউ বেঅজু অবস্থায় অন্যের থেকে সিজদাহর আয়াত শোনে, তবে অজু করে নিয়ে সিজদাহ আদায় করবে। কেউ কেউ সিজদাহ পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে বলেছেন যে, প্রথম হাত উপরে তুলে তাকবীরে তাহরীমা অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলবে। তারপর সিজদাহ করার জন্য তাকবীর বলবে। তারপর মাথা উঠাবার কালে তাকবীর বলবে। তারপর সালাম ফিরাবে। কোন কোন বৃদ্ধিকারী বলেছেন যে, সিজদায় তিলাওয়াতের মধ্যে তাশাহহুদ পাঠ করার কথাও উল্লেখ করেছেন। এটা শুধু নামাযের উপর কেয়াছ করা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে এর কোন ভিত্তি নেই। এ সিজদাহকে নামাযের উপর কেয়াছ করা কোনরূপেই সঙ্গত নয়। কেননা যখন সিজদাহ আদায় করার জন্য হুকুম হয়েছে তখন শুধু নামাযের সিজদাহর অনুরূপই এটা আদায় করবে। আর সিজদায় যাওয়া কালে অবশ্য তাকবীর উচ্চারণ করবে। তা' শরয়ী বিধানের সাথে সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু এছাড়া অন্যান্য কাজ বিধিসঙ্গত নয়। মুক্তাদীগণ ইমামের সাথে তিলাওয়াতে সিজদাহ আদায় করবে। কিন্তু নিজেদের তিলাওয়াতের সিজদাহ ইমামের উন্ডোদার অবস্থায় আদায় করবে না।

        কিরাত পাঠের শুরুতে তাআয়ুয পাঠ করাঃ যেমন কুরআনে পাক পাঠ শুরুকালে পড়ে নেবেঃ আউযুবিল্লাহিস সামীইল আলীমি মিনাশ শাইত্বাদির রাজীমি। আউযুবিকা মিন হামাযারিশ পাইয়াত্বীনি অর্থাৎ আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞতা আল্লাহর নিকট সাশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে মাবুদ। আমি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে তোমার নিকট পানাহ চাচ্ছি।

        কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে পড়বেঃ "ছাদ্যন্ডাল্লাহু তাআলা অ বালাগা রাসুলুল্লাহি (দঃ) আল্লহম্মা আনফা'না বিহী অ বারিক লানা ফীহি অলহামদু লিল্লাহি রাকিন্সল আ'লামীন অসতাগফিরুল্লাহাল হাইয়্যুলক্বাইয়্যুম"

        অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন এবং হুযুরে পাক (দঃ) পৌঁছে দিয়েছেন। হে মাবুদ। এর দ্বার। আমাদেরকে উপকৃত কর এবং তাতে আমাদেরকে বরকত দাও। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জনা, যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। কিরাত পাঠকালে যখন তাসবীহর আয়াত পড়বে, তখন সুবহানাল্লাহি আল্লাহু আকবার পড়বে। যখন দোয়া ও ক্ষমার আয়াত তিলাওয়াত করবে, তখন দোয়া চাইবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যখন আশার আয়াত পাঠ করবে, তখন আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা পেশ করবে, যখন ভীতি- ব্যঞ্জক আয়াত পাঠ করবে, তখন তাঁর দরবারে আশ্রয় চাইবে। এ সব প্রার্থনা ও আশ্রয় কামনা। চাই যবানে উচ্চারণ করবে অথবা মনে মনে বলবে। যেমন "সুবহানাল্লাহি, নাউযুবিল্লাহি, আল্লাহুম্মারহামনা

            হযরত হোযায়ফা (রাঃ) বলেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) এর সাথে নামায পড়েছিলাম। তিনি সুরা বাকারাহর দ্বারা নামায পড়লেন। তিনি যখন কোন রহমতের আয়াত পাঠ করলেন, তখন তিনি আল্লাহর দরবারে রহমত চাইলেন, কোন শাস্তির আয়াত পাঠকালে তিনি তা' থেকে পানাহ চাইলেন এবং সতর্কতাসূচক আয়াত পাঠ করে তিনি তাসবীহ পড়লেন। নামায শেষ করে আল্লাহ পাকের ছালাত ও সালাম পড়লেন। যা ছিল এরূপঃ "আল্লাহুম্মারহামনী বিল কুরআনি অজআলহু লী ইমামাও অনূরাও অহুদাও অরাহমাতান আল্লাহুম্মা যাককিরনী মিনহু মা নাসীতু অ আল্লিমনী মিনহু মা জাহিলতু অরযুকুনী তিলাওয়াতাহু আনআমাল্লাইলি অ আতরাফান্নাহারি অজআলহু হুজ্জাতাল্লী ইয়া রাব্বাল আ'লামীন"

        অর্থাৎ হে মাবুদ। তুমি কুরআনে পাকের উসিলায় আমার প্রতি অনুগ্রহ কর। তাকে আমার পরিচালক, আলো, পথপ্রদর্শক ও রহমত স্বরূপ কর। হে মাবুদ। তা' থেকে আমি যা' বিস্মৃত হয়েছি তা' আমাকে স্মরণ করিয়ে দাও, আর যা কিছু আমি জানিনা, তা' আমাকে শিখিয়ে (জানিয়ে) দাও। আর একে দিবারাত্রি পড়ার তাউফীক আমাকে দান কর। হে জগতের প্রতিপালক। একে আমার জন্য দলীল করে দাও।

        (৯) কিরাত প্রকাশ্য ভাবে পাঠ করাঃ নিজ কানে শোনা যায় এরূপ প্রকাশ্য ভাবে (স্পষ্টস্বরে) কুরআন পাঠ করবে। পাঠ করাই বলা হয় যা পড়া হয় তা' কর্ণে শ্রুতিগোচর হওয়াকে। তোমার মুখ থেকে এমন স্বর উচ্চারিত হওয়া চাই, যা নামাযের মধ্যে তুমি নিজ কানে শুনতে পাও। নিজে শুনতে না পেলে তোমার নামায অশুদ্ধ হবে। তোমার মুখের স্বর জন্যে শুনতে পাওয়াও একদিক থেকে উত্তম। তবে আবার অন্য দিক থেকে তা' মাকরুহ প্রমাণিত। যেমন হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেনঃ গোপন দান যেমন প্রকাশ্য দান অপেক্ষা অধিক পুণ্যজনক, তেমনি নীরবে কুরআন পাঠ সরবে পাঠ অপেক্ষা অধিক পুণ্যজনক। অন্য হাদীসে আছেঃ প্রকাশ্য কুরআন পাঠ প্রকাশ্য দানের ন্যায় এবং নীরবে কুরআন পাঠ গোপন দানের ন্যায়। আর এক হাদীসে আছেঃ প্রকাশ্য আমল অপেক্ষা গোপন আমলের মাহাত্ম্য সত্তর গুণ অধিক। হাদীসে আরও বর্ণিত আছে যে, উত্তম রিযিক যা তৃপ্তিদায়ক, আর উত্তম যিকির য্য গোপনীয়। 

        কোন এক হাদীসে বর্ণিত আছে, মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে একে অন্যের নিকট উচ্চৈঃস্বরে কুরআন পড়ো না। হযরত সাইয়্যিদ ইবনে মুসাইয়্যিব (রহঃ) এক রাতে খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযকে নামাযে সরবে কিরাত পড়তে শুনলেন। তাঁর স্বর মধুর ছিল। হযরত সাইয়্যিদ (রঃ) তাঁর গোলামকে বললেন, এই নামাযীর কাছে গিয়ে তার স্বর নিম্ন করতে বল। গোলাম বলল, হুযুর। মসজিদ তো শুধু আমাদের জন্য নয়। এতে ঐ ব্যক্তিরও হক আছে। তখন সাইয়্যিদ নিজেই উচ্চৈঃস্বরে বললেন, হে নামাযী। যদি তুমি তোমার নামায দ্বারা আল্লাহকে পেতে চাও, তবে তোমার স্বর নীচু কর। আর যদি তুমি নামায দ্বারা মানুষ আকৃষ্ট করতে চাও, তবে সে নামায আল্লাহর দরবারে তোমার কোন কাজে আসবে না। তাঁর কথা শুনে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) নীরব হয়ে গেলেন এবং সংক্ষেপে নামায শেষ করে সালাম ফিরিয়ে জুতো পরিধান করে বাড়ী ফিরে এলেন। এসময় তিনি খোদ মদীনা মুনাওয়্যারার শাসক ছিলেন। পক্ষান্তরে সরবে কুরআন পাঠ মুস্তাহাব হওয়ার দলীলও মৌজুদ রয়েছে। যেমন হুযুরে পাক (দঃ) স্বীয় কতিপয় ছাহাবীর সরবে কুরআন পাঠের কথা শুনলেন এবং তা' তিনি সঙ্গত মনে করলেন। অন্য হাদীসে আছে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ রাতে উঠে নামাযে দাঁড়ায় সে যেন সরবে কুরআন পড়ে, কেননা ফিরেশতা এবং ঐ ঘরের জ্বিনেরা তার কিরাত শ্রবণ করে ও তারাও ঐ নামায আদায় করে। বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত রাসূলে করীম (দঃ) তিনজন ছাহাবীর কাছে গিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) কে অস্ফুট স্বরে তিলাওয়াত করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এরূপ নীরবে পড়ছ কেন? হযরত আবুবকর (রাঃ) জবাবে বললেন, আমি যাঁর কালাম পাঠ করছি, তিনি আমার এই নিম্নস্বরও শুনতে পান। হযরত ওমর (রাঃ) কে উচ্চৈঃস্বরে কুরআন পড়তে দেখে হুযুরে পাক (দঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এত উচ্চৈঃস্বরে কুরআন পাঠের কারণ কি? তিনি জবাব দিলেন, আমি নিদ্রিত ও অমনোযোগী লোকদেরকে জাগিয়ে তুলছি এবং শয়তানকে দূরে তাড়াচ্ছি। হুযুরে পাক (দঃ) হযরত বেলাল (রাঃ) কে একদা এক সূরার কতক আয়াত অন্য সূরার কতক আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে দেখে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আমি উত্তম আয়াতকে উত্তম আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়ছি। শুনে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা সকলেই উত্তম কাজ করছ। সার কথা হল, হুযুরে পাক (দঃ) থেকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে উভয় রকম কুরআন পাঠের নির্দেশ রয়েছে। এর সমাধান হলো গোপন কাজে রিয়া ও লোভ দেখানোর বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়: সুতরাং যে ব্যক্তি সে বিপদের আশঙ্কা করে, তার কুরআন পাঠ নীরবে হওয়া উচিত। আর যদি কারও সে ভয় না থাকে এবং তার পড়ার দ্বারা অন্য মুখল্লির নামাযের ব্যাখাত না হয় তাহলে কিরাত উচ্চৈঃস্বরে পড়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা, এর ভিতর আমল অধিক হয় এবং প্রকাশ্যে পড়ার কারণে অন্যান্য কিছু উপকারও সাধিত হয়। প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ মনকে জাগ্রত করে, নিদ্রা দূর করে, আনন্দ বৃদ্ধি করে, অলসতা, হ্রাস করে, নিদ্রিতকে জাগিয়ে দেয়, অমনোযোগীকে মনোযোগী করে তোলে। মনে এসব নিয়ত থাকলে উচ্চৈঃস্বরে কিরাত পড়া উত্তম। আর যদি মনে এসকল নিয়তের সমাবেশ ঘটে তবে কুরআন পাঠের ছওয়ারও বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু এসব নিয়তের জন্য কাজটিও পবিত্র হয়। জেনে রাখ, যদি একটি আমলের ভিতর দশটি তাল নিয়ত থাকে, তবে তার বদলে দশটি পুণ্য হাছিল হয়। একারণেই কুরআন মজীদ চোখে দেখে পড়া উত্তম। কেননা, এ আমলের মধ্যে পাঠকের চোখও কর্মরত থাকে। তাছাড়া মনে কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা করার অবকাশ ঘটে। বর্ণিত রয়েছে যে, চোখে দেখে কুরআনে পাক এক খতম করা অন্যভাবে সাত খতম করার সমতুল্য। কেননা, কুরআনে পাকের দিকে দৃষ্টি করা ও লক্ষ্য রাখাও ইবাদাত তুল্য। এরূপ ঘটনা উল্লেখ আছে যে, একবার হযরত ওছমান (রাঃ) কতক কুরআনকে ছিড়ে ফেললেন। কেননা, তখন লিখিত কুরআন অধিক পড়া হত। অনেক সাহাবীই কুরআন মজীদ দেখে পাঠ করতেন। কুরআন মজীদ পাঠ না করে কোনদিন বাইরে যাওয়া তাঁরা মাকরূহ মনে করতেন।

        মিসরবাসী জনৈক ফকীহ ইমাম একদা ইমাম শাফেয়ীর নিকট ভোরে এসে দেখলেন, তাঁর সম্মুখে লিখিত কুরআন রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) উক্ত ফকীহকে বললেন, ফিকাহ আপানাকে কুরআন পাঠ থেকে বিরত রেখেছে। কিন্তু আমি এশার নামায আদায় করে কুরআনকে আমার সামনে রাখি। এমন কি ফজর পর্যন্ত আমি তা' বন্ধ করি না।

        (১০) কিরাত সুমধুর কন্ঠে এবং ধীরে ধীরে পাঠ করাঃ কুরআন মজীদ সুললিত স্বরে এবং ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করা সুন্নত। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন সুমধুর কণ্ঠে কুরআন পড়। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র কুরআন পাঠ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে মধুর স্বর প্রয়োগের নির্দেশ দেন নি। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআনকে সুললিত স্বরে পাঠ না করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। এ হাদীসের ব্যাখ্যাকারদের কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা গানের সুরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা শুধু সুন্দর ও পরিমার্জিত স্বরের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হাদীসে আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এক রাত্রে হযরত আয়েশার (রাঃ) জন্য অপেক্ষা করতেছিলেন। কিন্তু তাঁর আসতে দেরী হয়ে গেল। হুযুর (দঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কে আটকে রেখেছিল? হযরত আয়েশা জবাবে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটি লোকের কুরআন তিলাওয়াত শুনতেছিলাম। তার চেয়ে সুমধুর স্বর আমি কখনও শুনি নি। বিবি আয়েশার কথা শুনে খোদ হুযুরে পাক (দঃ)ও লোকটির কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কুরআন পাঠ শুনলেন। তারপর ফিরে এসে বললেন, এ লোকটির নাম সালেম। সে আবু হোরায়রার ক্রীতদাস। আলহামদু লিল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমার উম্মতের ভিতর এরূপ লোক সৃষ্টি করেছেন। একদা হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ) সহ হযরত আবুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর কুরআন তিলাওয়াত শুনতেছিলেন এবং সেখানে বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। অবশেষে তিনি বলেছিলেন, যে ব্যক্তি কুরআন মজীদ সুললিত স্বরে এবং দীরে ধীরে পড়া শুনতে চায় সে যেন ইবনে উম্মে আবদের কুরআন পাঠ শুনে। তিনি ইবনে মাসউদকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে ইবনে মাসউদ। তুমি আমার নিকট কুরআন পড়। ইবনে মাসউদ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি পড়ছি। আপনার নিকটই তা' নাযিল হয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তবু আমি তা' অন্যের নিকট শুনতে চাই। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখন তাঁর সামনে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন, তাঁর চোখ থেকে তখন অশ্রুপাত হতে লাগল।

        হুযুরে পাক (দঃ) একদা হযরত আবু মুসা আশআরীর কিরাত শুনে বললেন, তাকে এই স্বর হযরত দাউদ (আঃ) এর স্বরের ঝঙ্কার থেকে প্রদত্ত হয়েছে। একথা শুনে হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। যদি জানতাম যে. আপনি আমার তিলাওয়াত শুনবেন, তাহলে আমি আরও বেশী সুন্দর করে তিলাওয়াত করতাম। হাইছাম (রহঃ) হযরত রাসূলে করীম (সঃ)কে একরাতে স্বপ্নে দেখলেন। তাকে হুযুরে পাক (দঃ) জিজ্ঞেস করলেন। তুমি কি হাইছাম? যে কুরআনে পাককে সুমধুর স্বরে পাঠ করে থাকে। হাইছাম বললেন, হাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ। তখন হুযুরে পাক (দঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।

        হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর ছাহাবীগণ যখন একস্থানে সমবেত হতেন, একে অন্যকে কুরআন তিলাওয়াত করতে বলতেন। একদা হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরীকে বললেন, আমাদের মহান প্রভুকে স্মরণ কর। তিনি তখন হযরত ওমর (রাঃ) এর সামনে কুরআন পাঠ শুরু করলেন। এমন কি নামাযের প্রায় মধ্যবর্তী সময় হয়ে গেল। তখন হযরত ওমর (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বলা হল, হে আমীরুল মু'মিনীন। নামায, নামায। চমকিত ভাবে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, আমরা কি নামাযের মধ্যে নই? "অলা যিকরুল্লাহি আকবার" অর্থাৎ আল্লাহর যিকরই সর্বশ্রেষ্ঠ।" আল্লাহর এই আয়াতে তার ইশারা রয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতও শ্রবণ করে তার জন্য রোজ কিয়ামতে একটি আলো নছীব হবে। হাদীসে রয়েছে, তার জন্য দশটি নেকী লিখিত হবে। যখন কুরআন মজীদ পাঠ শুনার ছওয়াব এরূপ উত্তম, তখন যে পাঠকারী এই ছওয়াবের মূল কারণ, নিশ্চয় সেও এই ছওয়াবের শরীক হবে, যদি তার পাঠের মধ্যে কোনরূপ রিয়া না থাকে।

Post a Comment

0 Comments