সৎ চিন্তা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যাঁর গৌরবের কোন শেষ ও সীমা নেই। যিনি তাঁর গৌরব ও মাহাত্ম্যকে উপলব্ধি করবার জন্য মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি এবং চিন্তা শক্তি দান করেছেন, যিনি আল্লাহ প্রেমিকের হৃদয়কে তাঁর মহত্ত্ব ও গৌরবের বিস্তৃত ও বিশাল প্রান্তরে বিচরণের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। যখনই মানব তার সন্ধান পেয়ে উৎফুল্ল হয়, তখনই তিনি তাকে তাঁর গৌরবের ঝরণায় অবগাহন করিয়ে দেন। যখনই সে নৈরাশ্যের ময়দানে যেতে উদ্যত হয়, তখনই সৌন্দর্যের গুপ্ত আগার থেকে ঘোষণা করা হয়, ধৈর্য্য ধারণ কর। তারপর তাকে বলা হয়, তোমার দাসত্বের দীনতার মধ্যে চিন্তা করতে থাক, কেননা যদি তুমি তোমার প্রভুর গৌরব ও ঐশ্বর্যের বিষয় চিন্তা করতে থাক তবে তার কূল-কিনারা পাবে না। যদি এই চিন্তার পেছনে তোমার প্রকৃতির বিষয় দৃষ্টিপাত কর, কিরূপে তোমার উপর অনবরত দয়া বর্ষিত হচ্ছে, তন্মধ্যে প্রত্যেক নিয়ামতকে নতুনভাবে স্মরণ কর এবং তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁর শক্তি ও ক্ষমার সমুদ্রের বিষয় চিন্তা কর যে, কিরূপে সমগ্র জগতে মঙ্গল ও অমঙ্গল, উপকার ও অপকার, স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতা, কৃতকার্যতা ও অকৃতকার্যতা, ঈমান ও কুফরী, জানা ও অজানা, আনন্দ ও দুঃখের নদী প্রবাহিত হচ্ছে। যদি তাঁর কার্যের প্রতি দৃষ্টি অতিক্রম করতঃ তাঁর জাত ও সত্তার দিকে দৃষ্টিপাত কর এবং তন্ন তন্ন করে প্রত্যেক ব্যাপার পর্যবেক্ষণ কর তখন দেখবে যে তোমার মন অত্যাচার ও অন্ধকার দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেছে। তোমার বুদ্ধি উদয়ের প্রারম্ভেই তা' চিন্তা করে পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। উপসংহারে নবীশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর হাজার দরূদ ও সালাম তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীদের উপর সালাম।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, এক ঘন্টা সৎ চিন্তা করা এক বছরের ইবাদাত অপেক্ষাও উত্তম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা তাদাব্বুর (গুণাগুণ চিনবার চেষ্টা), এ'তেবার (উপদেশ গ্রহণ), নজর (সূক্ষ্ম দৃষ্টিপাত) এবং ইফতেকার (চিন্তা করা) করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। একথা গুপ্ত নয় যে, সৎ চিন্তা করা আলোর কুঞ্জি এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রারম্ভ তা' বিভিন্ন জ্ঞানের গবাক্ষ এবং মারেফাত ও বুঝের স্বীকার। অধিক সংখ্যক লোক তার কল্যাণ ও মর্যাদা জানতে পেরেছে বটে; কিন্তু তারা তার প্রকৃত পরিচয়, তার ফলাফল, মূল, পন্থা এবং বিশেষ বিবরণ জানতে পরেনি। কি প্রকারে সৎ চিন্তা করতে হবে, কোন বস্তুর সাহায্যে তার অন্বেষণ করতে হবে, সে বিষয় তারা মোটেই জানতে পারেনি। চিন্তার জন্যই কি চিন্তা করতে হবে বা তা' থেকে ফল পাবার জন্যই কি চিন্তা করতে হবে? যদি তা' থেকে ফল পাবার জন্যই চিন্তা করতে হয় তবে সেই ফল কি, তা' কি নানাবিধ জ্ঞান অথবা দুটো-ই? এর বিশদ ব্যাখ্যা অবগত হওয়া অত্যাবশ্যক। প্রথম আমরা সৎ চিন্তা করার কল্যাণ সম্পর্কিত বর্ণনা পেশ করব।
সৎ চিন্তার কল্যাণ
আল্লাহতায়ালা সৎ চিন্তা ও তাদাকলুর (গুণাগুণ চিনবার চেষ্টা) করবার জন্য কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সৎ চিন্তাশীলদেরকে প্রশংসা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, • "আল্লাযীনা ইয়াযকুরুনাল্লাহা জ্বিয়ামাও ওয়াজুউদাও ওয়া আলা জুনুবিহিম ওয়া ইয়াতাফাক্কারনা ফী খালব্ধিসসামাওয়াতি ওয়াল আরছি রাব্বানা মা খালাস্তুতা হাযা বাতিলা" অর্থাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে, উপবিষ্ট হয়ে এবং তাদের পার্শ্বে শায়িত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের মধ্যে কি আছে তদ্বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করে বলে, হে মহান প্রভু। তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করনি।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, একদল লোক আল্লাহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে শুরু করেছিল; তখন হুযুরে পাক (দঃ) তাদেরকে বললেন, তোমরা আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা কর, আল্লাহ সম্বন্ধে চিন্তা করো না। কেননা তোমরা তাঁর ক্ষমতা ও গুপ্ত রহস্য উদঘাটন করতে পারবে না। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, তিনি একদা একদল লোকের নিকট আগমন করে দেখলেন যে, তারা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তিনি তখন তাদেরকে বললেন, তোমরা কথাবার্তা বলছ না কেন? তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আল্লাহর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করছি। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হাঁ, তা-ই করতে থাক। তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করাই তোমাদের জন্য লাভজনক। কিন্তু আল্লাহতায়ালার জাত বা অস্তিত্ব সম্বন্ধে কখনও চিন্তা করতে যেওনা। কেননা ঐ পাশ্চাত্য দেশের নিকটবর্তী এক শ্বেতবর্ণ বিশিষ্ট দেশ আছে, যার জ্যোতি শ্বেতবর্ণ বিশিষ্ট এবং শ্বেত বর্ণই তার জ্যোতি। তার দূরত্ব সূর্যের গতির চল্লিশ দিনের পথ। তথায় কতকজন এমন আছেন যাঁরা একটি পলকের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয় না। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! শয়তান তাদের নিকট থেকে কত দূরে থাকে? তিনি বললেন, শয়তান সৃষ্টি হয়েছে কি, না হয়েছে তা' তাদের জানা নেই। ছাহাবীগণ পুনরায় আরজ করলেন, তারা কি মানব সন্তান ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, মানব জাতি সৃষ্টি হয়েছে কি, না হয়েছে তারা তা-ও জানে না।
হযরত আতা (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে, একদিন আমি এবং হযরত ওবায়েদ ইবনে আমের হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট গিয়ে তাঁর সাথে কথাবার্তা বলতেছিলাম। তখন তাঁর ও আমাদের মধ্যে পর্দা লটকানো ছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, হে ওবায়েদ। তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ কর না কেন? হযরত ওবায়েদ (রহঃ) বললেন, আপনার সাথে সাক্ষাৎ করি না হুযুরে পাক (দঃ) এর একটি বাণীর জন্য। তিনি এরশাদ করেছেন যে, মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ কর, তাতে ভালবাসা বৃদ্ধি হবে। একথা বলার পর তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি হুযুরে পাক (দঃ) থেকে যে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখেছেন তার বিষয় আমাকে জ্ঞাপন করুন। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) ক্রন্দন শুরু করলেন। তারপর তিনি। বললেন, হযুরে পাক (দঃ) এর যে কোন কাজই ছিল আশ্চর্যজনক ।আমার নির্ধারিত রাত্রে তিনি আমার নিকট উপস্থিত হলেন। এমন কি তাঁর শরীর ও আমার শরীর পরস্পর স্পর্শিত হয়েছিল তারপর তিনি আমাকে বললেন, ইবাদাত করবে? আমাকে এই কথা বলে তিনি পানির পাত্রের নিকট গিয়ে অজু করলেন এবং তারপর নামাযে দণ্ডায়মান হয়ে রোদন করতে লাগলেন। যার ফলে তাঁর দাড়ি মুবারক সিক্ত হয়ে গেল। অতঃপর তিনি সিজদায় পতিত হলেন এবং তাতে তাঁর ললাট দেশের নিম্নস্থ মৃত্তিকা পর্যন্ত ভিজে গেল। নামায শেষ করার পর তিনি একপার্শ্বে শয়ন করে রইলেন। একটু পরেই বেলাল এসে তাঁকে ফজরের নামাযের জন্য ডেকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল। আপনি ক্রন্দন করছেন কেন? আল্লাহতায়ালা আপনার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহই তো ক্ষমা করে দিয়েছেন। বেলালের কথার উত্তরে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমার জন্য আক্ষেপ হে বেলাল। আমার ক্রন্দন আসবে না কেন বলতো? আল্লাহতায়ালা এই রাত্রেই অত্র আয়াত অবতীর্ণ করেছেন-- "ইন্না ফী খালক্ট্রিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি ওয়াখতিলাফিল লাইলি ওয়ান্নাহারি লা আইয়াতিল লিউলিল আলবাব" অর্থাৎ নিশ্চয়ই আসমান ও যমিনের সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে, জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তারপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি এই আয়াত পাঠ করে তার বিষয় চিন্তা করে না তার জন্য আক্ষেপ।
হযরত আওযায়ীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কুরআনে পাকের এই আয়াতের মধ্যে সৎ চিন্তা করার কি সীমা আছে? তিনি জবাবে বললেন, তারা এ আয়াত পাঠ করবেন এবং চিন্তা করে দেখবেন। হযরত মুহাম্মদ ইবনে ওয়াসে' (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, বছরার একজন অধিবাসী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) এর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী উম্মে যরের নিকট গিয়ে হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) এর ইবাদাত সম্বন্ধে কিছু কথা জানতে চাইলেন। উম্মে যর বললেন, তিনি সারাদিন গৃহের কোণায় বসে চিন্তায় কাটিয়ে দিতেন।
হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, একটা সৎ চিন্তা করা একরাত্র নামায আদায় করা থেকেও উত্তম। হযরত ফোজায়ল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেছেন, সৎ চিন্তা করা একটি দর্পণ সদৃশ। একাজ তোমাকে পাপ ও পুণ্য দেখিয়ে দেয়। হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি একাধারে দীর্ঘসময় পর্যন্ত বসে কোন চিন্তা করতে থাকেন? তিনি জবাবে বললেন, জেনে রাখবে, সৎ চিন্তা করা মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির মস্তিষ্কস্বরূপ। বর্ণিত আছে যে, হযরত সুফিয়ান ইবনে আইনিয়া (রহঃ) নিম্নোক্ত পংক্তি দুটো প্রায়শঃ আবৃত্তি করতেনঃ
"মানুষ যখন সৎ চিন্তা ও যিকিরে নিমজ্জিত হয়, সে তখন আল্লাহর প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে বহু অমূল্য উপদেশের বিষয় দেখতে পায়।"
হযরত তাউস (রহঃ) বলেছেন যে, একবার হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা (আঃ)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রহুল্লাহ! এই জগতে বর্তমানে আপনার ন্যায় কেউ আছে কি? তিনি বললেন, হাঁ আছে। যাঁর প্রত্যেকটি বাক্য আল্লাহতায়ালার যিকির উপলক্ষ্যে বলা হয়, যার সৎ চিন্তায় দুনিয়ায় শান্তি ও শৃংখলা রক্ষিত হয়, যার প্রত্যেকটি দৃষ্টিপাতে উপদেশ পাওয়া যায়, সে ব্যক্তিই আমার সমান। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, যার বাক্যে কোন জ্ঞানের সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায় না, তা' অনর্থক বাক্য এবং যার মৌনতায় কোন সৎ চিন্তা নেই, সে নির্ভরশীল নয় এবং সে সৎ ব্যক্তিরূপেও গণ্য নয়। তার উপদেশও উপকারী নয়।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আমাদের নিদর্শন থেকে শীঘ্রই ঐ সব লোককে ফিরিয়ে নেব, যারা দুনিয়ায় অন্যায়ভাবে সাহস্কারে চলে।" হযরত হাসান বছরী (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তার ব্যাপারে তাদের হৃদয়কে সৎ চিন্তা থেকে বিরত রাখবেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের চক্ষুদ্বয়কে ইবাদাতের অংশ দান করো। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। ইবাদাতে চক্ষুর অংশ কি? তিনি বললেন, কুরআনে পাকের দিকে দৃষ্টিপাত করা এবং তদ্বিষয়ে চিন্তা করা। তাঁর আশ্চর্যজনক বিষয়গুলো থেকে অভিজ্ঞতা ও নীতি বের করে নিয়ে তদনুরূপ কাজ করে যাওয়া। জনৈক রমণী মক্কা মুয়াযযামার নিকটবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বসবাস করত। সে বলেছিল যে, যদি আল্লাহ-ভীরুদের মন চিন্তার ফলে পারলৌকিক মঙ্গল সম্পর্কিত অদৃশ্য সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে তবে কোনক্রমেই তাদের পার্থিব জীবন সুখময় হয় না এবং তাদের বাহ্যিক দৃশ্য দেখে সংসারাসক্ত লোকদের চক্ষু শীতল হয় না।
কথিত আছে যে, হযরত লোকমান কখনও কখনও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একাকী বসে থাকতেন। তাতে তার মনিব নিকটে এসে তাকে বলত, হে লোকমান। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তুমি একাকী বসে আছ এর চেয়ে যদি তুমি লোকের মধ্যে থাকতে তবে তা' তোমার জন্য উত্তম হত এবং লোকগণও তোমা থেকে উপকৃত হত। লোকমান তার মনিবকে বললেন, এভাবে দীর্ঘ সময় একাকী বসে থাকা সৎ চিন্তা করার জন্য অত্যন্ত ফলপ্রদ। আর বেহেশতের পথে দীর্ঘ সময়ের সৎ চিন্তা একটি মঞ্জিল। হযরত ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তির সৎ চিন্তা দীর্ঘ হয় তার মধ্যে পরিপক্ক জ্ঞানের উদয় হয়। যার মধ্যে পরিপক্ক জ্ঞানের উদয় হয় সে সৎ কার্যে অভ্যন্ত হয়।
খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) বলেছেন, সৎ চিন্তা করা উত্তম ইবাদাতসমূহের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) একদা হযরত ছহল ইবনে আলী (রহঃ)কে সম্পূর্ণ নীরব ও চিন্তাযুক্ত দেখে বলেছিলেন, জনাব। আপনি এখন কোথায় পৌঁছেছেন? তিনি বললেন, পুলছিরাতের ওপরে। হযরত বাশার হাফী (রহঃ) বলেছিলেন, মানুষ যদি আল্লাহর গৌরবের বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করে, কস্মিনকালে তারা আল্লাহর অবাধ্য বান্দারূপে গণ্য হতে পারে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, চিন্তার সাথে মধ্যম রকমের দু'রাকাত নামায অমনোযোগের সাথে সারারাত নামায আদায়ের চেয়ে বহু গুণে উত্তম। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আবু শারীহ (রহঃ) এক প্রান্তরে ভ্রমণ করতেছিলেন। কিছুক্ষণ ভ্রমণ করার পর হঠাৎ তিনি এক স্থানে বসে পড়ে নিজেকে একখানি বস্তু দ্বারা আবৃত করে ফেললেন এবং রোদন শুরু করলেন। তখন কোন লোক তাকে জিজ্ঞেস করল যে, হুযুর। হঠাৎ আপনি এভাবে বসে পড়লেন কেন এবং ক্রন্দন করতে শুরুই বা করলেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, দেখ আমার জীবনের শেষ সময় উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু আমার সৎ কার্য বড়ই অল্প, অথচ মৃত্যু নিকটবর্তী। সুতরাং আমার কি অবস্থা হবে? হঠাৎ সেই কথা আমার মনে উদিত হয়েছে।
হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন, সাংসারিক বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা পারলৌকিক চিন্তা-ভাবনার পক্ষে প্রধান অন্তরায় এবং আল্লাহর বন্ধুদের জন্য একটি ভীষণ জঞ্জাল। পক্ষান্তরে পারলৌকিক বিষয়ের চিন্তা-ভাবনা মানুষের জন্য প্রকৃত জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায় এবং তদ্বারা হৃদয় সজীব হয়। হযরত হাতেম আছেম (রহঃ) বলেছেন, অভিজ্ঞতায় মানুষের প্রকৃত জ্ঞান বৃদ্ধি হয়, বন্ধুকে অধিক স্বরণ করলে তার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি হয় এবং ভয়-ভীতির বিষয় সম্পর্কে যত বেশী চিন্তা করা হয় ভয়-ভীতি ততই বৃদ্ধি পায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, সৎ বিষয়ের চিন্তা মানুষকে কাজে উৎসাহ যোগায়। অসৎ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যদি অনুতাপ আসে, তবে তা' উপকারে আসে। আর অনুতাপের সৃষ্টি না হলে, সে চিন্তা-ভাবনা মঙ্গলদায়ক হয় না। কথিত আছে যে, আল্লাহতায়ালা তাঁর কোন এক ধর্মগ্রন্থে বলেছেন, "আমি প্রত্যেক আলিমের আবেদন গ্রাহ্য করি না। কিন্তু আমি তার উদ্দেশ্য ও হৃদয়ের লোভের দিকে লক্ষ্য করি। যদি দেখি তার উদ্দেশ্য সৎ এবং লোভ আমার পথে, তবে তার আবেদন আমি মঞ্জুর করে নেই।
হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, প্রকৃত আলিমগণ যিকিরের চিন্তার এবং চিন্তার সাথে যিকিরের অভ্যাস করে থাকে, যে পর্যন্ত তারা তাদের হৃদয় থেকে কথা না বলে। তার ফলে তাদের হৃদয় থেকে আপনা আপনি হেকমতের বাণী উচ্চারিত হয় এবং এরূপ বাণীই আমার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়। হযরত ইসহাক ইবনে খাল্ল্ফ (রহঃ) বলেছেন, একদা হযরত দাউদ তায়ী (রহঃ) জ্যোৎস্না রাত্রে ছাদের উপর বসে স্বর্গ ও মর্ত্য রাজ্য সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলেন, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদন করতে লাগলেন। যার ফলে তিনি আত্মবিস্মৃত হয়ে এক অঘটন ঘটিয়ে দিলেন অর্থাৎ আত্মবিস্মৃত অবস্থায় তিনি তাঁর পার্শ্ববর্তী গৃহে পতিত হলেন। ঐ গৃহবাসী জাগরিত হয়ে তরবারী হস্তে নিয়ে তার নিকটবর্তী হল। সে মনে করল যে, নিশ্চয়ই এলোক একটি চোর। কিন্তু যখন হযরত দাউদ তায়ী (রহঃ) এর দিকে তার দৃষ্টি পড়ল, সে তার তরবারী কোষাবদ্ধ করে বলল, হুযুর। আপনাকে গৃহের ছাদ থেকে কে এভাবে ফেলে দিয়েছে? তিনি বললেন তা' আমি বলতে পারব না।
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ) বলেছেন, সর্বাপেক্ষা উচ্চ এবং সম্মানিত কাজ হল, চিন্তার সাথে তাওহীদের ময়দানে উপবিষ্ট থেকে মারেফাতের হাওয়া উপভোগ করা, ভালবাসার পিয়ালায় যিকিরের সমুদ্র থেকে পানি পান করা এবং আল্লাহ সম্বন্ধে উত্তম ধারণা পোষণ করে তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করা। এই কথা বলে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ওহে। এই কার্য কি উজ্জ্বল, কি আলোময়!
হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেছেন, তোমরা নীরবতার সাথে বাক্যের এবং চিন্তার সাথে আবিষ্কারের সাহায্যে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা কর। তিনি আরও বলেছেন, কার্যের ব্যাপারে সূক্ষ্ম দৃষ্টি মানুষকে প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত রাখে এবং প্রকৃত ও সঠিক মতে দৃঢ় থাকার ফলে অতিরঞ্জন থেকে নিরাপদ থাকা যায়। দৃষ্টি ও চিন্তা থেকে জ্ঞান এবং সহিষ্ণুতা জন্মে। অবশ্য জ্ঞানী লোকদের সাথে পরামর্শ করলে নিজের অন্তর্দৃষ্টির শক্তি বৃদ্ধি হয়; সুতরাং কোন ব্যাপারে প্রতিজ্ঞার পূর্বে চিন্তা কর। কার্যের পূর্বে জেনে-শুনে ও ভেবে-চিন্তে লও। সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে সৎ ও অভিজ্ঞলোকের নিকট পথের খবর জেনে লও। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) আরও বলেছেন, মানুষের জন্য চারটি বিষয় অতীব কল্যাণকর। প্রথমতঃ হেকমত এবং তার জীবিকা চিন্তা। দ্বিতীয়তঃ সহিষ্ণুতা এবং তার জীবিকা লোভ। তৃতীয়তঃ শক্তি এবং তার জীবিকা ক্রোধ। চতুর্থতঃ বিচার শক্তি এবং তার জীবিকা শক্তিকে মধ্য পথে প্রবৃত্তির আওতা থেকে রক্ষা করা। বিজ্ঞ লোকগণ লোকের জন্য এ চারটি বিষয় বিশেষ কল্যাণকর বলে মন্তব্য করেছেন।
0 Comments