প্রিয়নবী (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরত

        কুরায়শ কাফিরগণ যখন এ অবস্থা জানতে পারলো, তখন দারুন নদওয়ায় সবাই পরামর্শের জন্য বসলো যে, এখন হযরত (সাঃ) সম্পর্কে কি করা যায়। কেউ গ্রেফতার করার পক্ষে অভিমত দিল, কেউ দেশান্তর করার পরামর্শ দিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ধূর্ত লোকেরা বললো এটা সম্ভব নয়; কেননা গ্রেফতার করা হলে তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতাকারিগণ আমাদের উপর আক্রমণ করবে এবং তাঁকে ছাড়িয়ে নেবে। আবার দেশান্তর করার চিন্তাও আমাদের জন্য সম্পূর্ণ ক্ষতিকর। কেননা এ অবস্থায় মক্কার চতুর্দিকের আরবগণ হযরত (সাঃ)-এর নৈতিক চরিত্র ও মিষ্টি কথা শুনে পবিত্র কালামের ভক্ত হয়ে পড়বে এবং তিনি তাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসবেন।

        অবশেষে পাষণ্ড আবু জাহল হযরত (সাঃ)-কে হত্যা করার জন্য নিজের মতামত পেশ করল যে, প্রতিটি গোত্রের এক-একজন লোক এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকবে। তাহলে বনী আবদে মান্নাফ (হযরত (সাঃ)-এর গোত্র প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে। সবাই এ মত পছন্দ করল এবং প্রত্যেক গোত্র হতে একজন করে যুবক এ কাজের জন্যে নির্ধারণ করা হলো যে, অমুক রাতে এ কাজ সমাধা করতে হবে।

        এদিকে আল্লাহ তা'আলা হযরত (সাঃ)-কে তাদের পরামর্শ সম্পর্কে সংবাদ জানালেন এবং হিজরতের নির্দেশ দিলেন। সে রাতে কুরায়শ কাফিরগণ তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার ইচ্ছা করল এবং বিভিন্ন গোত্রের বহু যুবক হযরতের বাড়ী অবরোধ করে বসল। হুযুর (সাঃ) তখনই হিজরতের ইচ্ছা করলেন এবং হযরত আলী (রাঃ)-কে চাদর মুড়ি দিয়ে চৌকির ওপর শুয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন, যেন কাফিরগণ বুঝতে না পারে যে, হযরত (সাঃ) ঘরে নেই।

        এর পর হযরত (সাঃ) যখন ঘর হতে বাইরে তশরীফ আনলেন, তখন দরজায় কাফিরদের এক বিরাট জটলা দেখলেন। তিনি সূরা ইয়াসীন পড়তে পড়তে বাইরে আসলেন এবং যখন "ফাআগশাইনাহুম ফাহুম লা ইউবসিরুন" পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন এটা কয়েকবার পড়লেন: ফলে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের চোখে পর্দা ফেলে দিলেন এবং তারা হুযুর (সাঃ)-কে দেখতে পেল না। তিনি সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর ঘরে পৌঁছে গেলেন। হযরত আবকর (রাঃ) প্রথম থেকেই তৈরী ছিলেন এবং পথপ্রদর্শক হিসাবেও একজনকে তৈরী করে রেখেছিলেন।

        হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) হযরত (সাঃ)-এর সাথে চললেন। তিনি বাড়ীর পেছন দিককার একটি জানালা দিয়ে ঘর থেকে বের হলেন এবং 'সাওর' নামক মক্কার নিকট একটি পাহাড়ের গুহার দিকে রওয়ানা হলেন।

সাওর গুহায় অবস্থান

        হযরত (সাঃ) এই পাহাড়ের একটি গুহায় গিয়ে অবস্থান করলেন। এদিকে কুরায়শ যুবকরা ভোর পর্যন্ত হযরতের বাইরে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে যখন জানা গেল যে, সেখানে নবীর জায়গায় হযরত আলী (রাঃ) শুয়ে আছেন, তখন তারা অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হল এবং চতুর্দিকে হযরত (সাঃ)-এর খোঁজে দূত পাঠাল। হুযুর (সঃ)-এর গ্রেফতারকারীর জন্য একশত উট পুরষ্কার নির্ধারণ করা হল। অনেক লোক হযরত (সঃ)-এর খোঁজে বের হল। কোন কোন পদচিহ্ন সনাক্তকরণ বিদ হযরতের কদম মুবারকের চিহ্ন দেখে দেখে ঠিক ঐ গুহার নিকট এসে পৌঁছে গেল। তারা যদি একটু ঝুঁকে দেখত, তা হলে হুযুর (সাঃ)-কে সামনে দেখতে পেত। এই সময় হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

        হুযুর (সাঃ) বললেন বিচলিত হয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে আছেন।

        আল্লাহর কুদরতে সবার দৃষ্টি এ গুহা হতে ফিরিয়ে দেয়া হলো। কেউ ঝুঁকেও দেখলো না: বরং তাদের সবচেয়ে চালাক লোক উমাইয়া বিন খালফ বলল, 'এখানে তাঁর থাকা অসম্ভব।' কেননা আল্লাহর হুকুমে গুহার দরজায় রাতের মধ্যেই মাকড়সা জাল বুনে রেখেছিল এবং জংলী কবুতর বাসা তৈরী করে নিয়েছিল।

        রসূল (সাঃ) এবং সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) একাধারে তিন রাত ঐ গুহায় লুকিয়েছিলেন: ফলে অন্বেষণকারী দল নিরাশ হয়ে থেমে গেল। এ তিন রাত হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর ছেলে আবদুল্লাহ্ গোপনে সেখানে আসতেন এবং ভোর হওয়ার পূর্বেই মক্কায় চলে যেতেন। সারাদিন কুরাইশদের কার্যক্রমের খবর শুনে রাতে তা হযরত (সাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করতেন। তাঁর বোন আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) প্রতি রাতে হযরতের নিকট খাবার পৌছাতেন। যেহেতু আরববাসী পায়ের চিহ্ন সূতীক্ষ্ণ ভাবে চিনে ফেলে, তাই আবদুল্লাহ স্বীয় ভৃত্যকে বলে দিয়েছিলেন যে, প্রতিদিন ঐ গুহা পর্যন্ত বকরী চরাতে নিয়ে যাবে, যেন তাদের পায়ের চিহ্ন মুছে যায়।

গুহা হতে মদীনার দিকে যাত্রা

        সওর গুহায় অবস্থানের তৃতীয় দিন ১ম হিজরীর ৪ঠা রবিউল আউয়াল সোমবার হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর গোলাম আমের বিন ফাহিরা (রাঃ) দুটি উট নিয়ে হাযির হল, যা ঐ সফরের জন্য হযরত সিদ্দীকে আকবর তৈরী করে রেখেছিলেন এবং তাদের সাথে আবদুল্লাহ্ বিন আরিকিতও পৌঁছলেন, যাঁকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

        নবী করীম (সাঃ) একটি উটের উপর আরোহণ করলেন এবং হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) দ্বিতীয়টির উপর। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) নিজের সাথে আমের বিন ফাহিরাকে নিলেন। আবদুল্লাহ্ বিন আরিকিত পথপ্রদর্শনের জন্য সামনে চলছিলেন।

Post a Comment

0 Comments