বুঝের প্রতিবন্ধক থেকে মুক্ত হওয়া

          (৬) বুঝের প্রতিবন্ধক থেকে মুক্ত হওয়াঃ অধিকাংশ লোকই কুরআনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। তার কারণ হল শয়তান তাদের দিলের তালা বন্ধ করে রাখে এবং তজ্জন্য কুরআনে গুপ্ত তত্ত্বসমূহের আশ্চর্য জিনিসগুলো থেকে তারা অন্ধ থাকে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, শয়তান যদি বনি আদমের দিলের ভিতর যাতায়াত না করত, তাহলে তাদের চোখের সামনে অদৃশ্য জগৎ ভেসে উঠত। মনে রাখবে কুরআনে পাকের অর্থ, তাৎপর্য অদৃশ্য জগতের শামিল যা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত নয়। যা সূক্ষ্ম দৃষ্টির নূর ব্যতীত নাগাল পাওয়া যায় না। এটাই হল অদৃশ্য জগতের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে পাকের অর্থও অবিকল তদ্রূপ। কুরআন বুঝার প্রতিবন্ধক বার প্রকারঃ-

        (ক) প্রথম প্রতিবন্ধকঃ অক্ষরের মূল থেকে অক্ষর বের করবার চেষ্টায় থাকা। এ ব্যাপারে শয়তান কর্তৃত্ব করে। সে প্রত্যেক কারীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে যেন আল্লাহর বাণীর অর্থ বুঝবার পথ থেকে কারী বা কুরআন তিলাওয়াতকারীকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। কারী বার বার অক্ষর আওড়াতে থাকে, তবু সে মনে করে যে, অক্ষর যথাযথ মাখরাজ থেকে আদায় হল না। এ ভাবে তার সমস্ত চিন্তা অক্ষরের যথার্থ উচ্চারণের মধ্যে নিবদ্ধ থাকে। এমনি অবস্থা হলে কিভাবে তার নিকট কুরআন পাকের অর্থ প্রকাশ পাবে? শুধু উচ্চারণের ক্ষেত্রে যে এভাবে সন্দেহ ও সংশয়ের মধ্যে নিমগ্ন থাকে, প্রকৃত পক্ষে সে শয়তানের অধিক হাসির খোরাক হয়।

        (খ) দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকঃ মাযহাবের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রাখাঃ যে কুরআন পাঠক মাযহাবকে অভংসা করে এবং কতব্যকা অনুসরণ করতে করতে তার দ্বীন জমাট বেঁধে যায়। মাযহাবের মতবাদের সত্যাসত্য অনুসন্ধান না করে এবং অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা তা' পরীক্ষা না করে সে তা' বিশ্বাস করে বসে। এরূপ ব্যক্তি মাযহাবের অন্ধ বিশ্বাসের জিঞ্জীর দ্বারা আবদ্ধ হয়ে যায় এবং তা' ছিন্ন করার এতটুকু প্রয়াস পায়াময়্যাতার মন থেকে দৃঢ় ঈমান ব্যতীত তা' দূর করতে অন্য কোন কিছুই সমর্থ হয় না। এরূপ ব্যক্তিত্তারক্ষা রতকথার দিকেই আকৃস্ট এবং নিবদ্ধ থার্কের যদি দূর থেকে বিদ্যুৎ চমকায় এবং হঠাৎ তার নিকট এমন কোন অর্থ প্রকাশ পায় যা তার শ্রুতবাক্যের বিরোধী, তখন শয়তান তার কাছে তাকলীদ বা অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে হাজির হয়ে যায় এবং বলতে থাকে যে, তোমায় অন কারা কিরূপে উদয় হল? এসে তোমার পূর্বপুরুষদের বিরোধী। তখন সে ব্যক্তির ঈমান সদৃঢ় হলে সে বুঝতে পারে যে, এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা; সুতরাং সে তখন তা' থেকে দূরে থাকে এবং সতর্কতা অবলম্বন করে। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, কখনও কখনও মানুষের জন্য যবনিকা হয়ে যায়। তারা এই ইলম ঐরূপ ধর্ম বিশ্বাসকে বুঝেছেন যার উপর অধিকাংশ লোক মাযহাবের তাকলীদের দ্বারা চলে যাচ্ছে বা মাযহাবের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ মাযহাব সম্পর্কিত কিতাব রচনা করে যা শিক্ষা দিচ্ছে অথচ যে প্রকৃত ইলম অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা দেখা যায় তা' কিরূপ প্রতিবন্ধক হতে পারে। এটাই মানুষের জন্য অনুসন্ধানের শেষ সীমা। এই তাকলীদ বা অন্ধ বিশ্বাস অনেক সময়ই ব্যর্থ হয় এবং এভাবেই আল্লাহর কালাম বুঝবার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন কোন ব্যক্তি স্থিতিশীল আরশের উপর আল্লাহর সীমাবদ্ধ স্থান গ্রহণ করা এবং তথায় অবস্থান করাকে বিশ্বাস করে, যদিও তিনি স্থান ও বিশ্রাম গ্রহণ থেকে পবিত্র। যে ব্যক্তি চিন্তাশীল, তার মনে তাকলীদ বা অন্ধ বিশ্বাস জমতে পারে না। আর যদি ধরে নেয়া যায়, তা' দিলে জমে যায়, স্বাধীন চিন্তাশীল ব্যক্তি স্বীয় মন থেকে সে ব্যাপারকে বাতিল করে দেয়। কখনও কখনও সত্য বিষয়ের উপরেই তাকলীদ বা অন্ধ বিশ্বাস হয়। কিন্তু তবু তা' বুঝার পক্ষে এবং দিনের স্বচ্ছতার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, যে সত্য বিষয় বিশ্বাস করার জন্য মানুষকে আদেশ দেয়া হয়েছে, তার বহুত স্তর বা সোপান রয়েছে এবং একটি প্রকাশ্য প্রারম্ভ এবং আর একটি গুপ্ত প্রারম্ভ আছে। প্রকাশ্য প্রারম্ভের উপর যখন উক্ত স্বভাব আস্তানা গাড়ে তখন তাও মনযোগ ও একাগ্রতার পক্ষে প্রতিকূল হয়। 

        (গ) তৃতীয় প্রতিবন্ধকঃ কোন গুনাহ বার বার করা অথবা অহঙ্কারী হওয়া: অথবা এক কথায় পার্থিব মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকা। কারণ এগুলো দিলে অন্ধকার এবং মরিচা পড়ার কারণ। এগুলো স্বচ্ছ আয়নার উপর ধূলা-বালির ন্যায়, ধূলা-বালি, ময়লা সত্যের উজ্জ্বল তারার আলোর প্রতিবন্ধক। বস্তুতঃ বার বার গুনাহ করা দিলের উপর বড় পর্দা এবং এটা অধিকাংশ লোকের মনের উপর পর্দাস্বরূপ। যতই লোভ এবং মোহ হৃদয়ে পুঞ্জিভূত হয়, কালামে কুরআনের অর্থের উপর পর্দা পড়ে যায়; এবং যতই পার্থিব বোঝা মন থেকে দূরে সরে যায়, ততই কালামে কুরআনের অর্থের জ্যোতি মানুষের মনের নিকটবর্তী হয়। দিল বা অন্তর স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় এবং লোভ ও মোহ মূলতঃ ময়লার ন্যায়। কুরআনের অর্থ একটি রূপ বা আকারের ন্যায়, যা আয়নায় দেখা যায়। সকল লোভ ও যোহ দূর করবার চেষ্টা আয়নার উপর হতে সমস্ত সরল্য দূর করে দেয়ার ন্যায়। এজন্য হযরত রাসূলে করীম (দঃ) বলেন যে, যখন আসার উন্নরগন ধন-সম্পদকে বড় করে দেখবে তখন তাদের নিকট থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে। কখন তারা সৎ কাজে নির্দেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা ত্যাগ করবে তখন তারা অহীর সরকত লেভে বঞ্চিত হবে। হযরত ফোজায়েল (রহঃ) বলেছেন যে, তখন তারা কুরুঙ্গানে পাকের অর্থ দেকে মাহজম হবে। উপলব্ধি ও স্মরণ করার উপর আল্লাহ তায়ালা তাওবাহর কবুলিয়তের শর্তারূেণ করেছেন। যেমন এরশাদ হয়েছে, "তাবস্থিরাত্বও অধিকরা লিকুল্লি আসলিম সুনীব।" "ওয়াজ ইয়াতাযাঙ্গারু ইল্লা মাইয়ানীব" অর্থাৎ প্রত্যেক তাওবাহকারী বান্দার জন্য একটি যুদ্ধ বুক্ত এবং স্মারকলিপিতুল্য। আর তাওবাহকারী ব্যতীত অন্য কেউ স্মরণ করে। না। আরো এরশাদ হয়েছে যে, "ইন্নামা ইয়াতাযাকারু উলুল আলবাব অর্থাৎ জ্ঞানী লোকগণই স্মরণ করে থাকে। পারলৌকিক সুখ-শান্তি অপেক্ষা পার্থিব লোভ যার উপর প্রবল, সে জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর এজন্যই কুরআনে পাকের গুপ্ত তত্ত্ব তার নিকট প্রকাশ পায় না।

        (ঘ) চতুর্থ প্রতিবন্ধকঃ প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা এবং কুরআনে পাকের বাক্যের প্রকাশ্য অর্ণ ব্যতীত অন্য কোন অর্থ নেই বলে ধারণা করাঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), বুজাহিদ (রাঃ) এবং অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম বলেছেন যে, এর পিছনে নিজের মতানুযায়ী অর্থ করার কথা রয়েছে এবং যে নিজের মতানুযায়ী কালামে কুরআনের অর্থ করে, সে যেন তার স্থান দোযখের মধ্যে অনুসন্ধান করে। মনে রাখবে এটাই সর্বপ্রধান প্রতিবন্ধক। আমি শীঘ্রই চতুর্থ অনুচ্ছেদে নিজের মতানুযায়ী কালামে কুরআনের অর্থ করার বিষয় বর্ণনা করব। উপরোক্ত মত হযরত আলীর (রাঃ) বাণীর পরিপন্থী নয়। তবে আল্লাহ যাকে কুরআন বুঝার শক্তি প্রদান করেন, সেই শুধু তা' পেয়ে থাকে। আর এরূপ একটি প্রশ্নও হতে পারে যে, যদি প্রকাশ্য অর্থই গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তাতে কেন মানুষের মধ্যে মতভেদ ঘটে?

Post a Comment

0 Comments