হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছঃ)-কে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কি? তিনি বললেন, 'সময়মত নামায আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, অতঃপর কোনটি? তিনি বলেন, মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। বুখারী, মুসলিম
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'কোন মানুষই পিতার হক আদায় করতে পারে না, তবে হ্যাঁ, যদি কোন সময় তাঁকে ক্রীতদাস অবস্থায় দেখতে পায় এবং খরিদ করে মুক্ত করে দেয়, তাতে পিতার হক (কিঞ্চিৎ) আদায় হতে পারে।'
মুসলিম শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, একদিন এক লোক নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলঃ 'হে আল্লাহর রাসূল। আমি হিজরত এবং জিহাদের অঙ্গীকারে আপনার হাতে বায়আত হচ্ছি।' তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মার মধ্যে কেউ কি বেঁচে আছেন? লোকটি বলল, তাঁরা উভয়েই বেঁচে আছেন। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'তুমি আল্লাহর কাছে সওয়াব পেতে চাইলে তোমার বাবা-মা'র খেদমতে ফিরে যাও এবং তাঁদের কাছে উপস্থিত থেকে উত্তম ব্যবহার কর।'
একদা এক লোক নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মনে তীব্র বাসনা থাকা সত্ত্বেও আমি জিহাদে যেতে অক্ষম। কেননা, আমার সেই শক্তি সামর্থ্য নেই। আল্লাহর রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মার মধ্যে কি কেউ বেঁচে আছেন? লোকটি বলল, আমার মা বেঁচে আছেন। নবী করীম (ছঃ) বললেন, 'তুমি গিয়ে তোমার মায়ের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখ; তাহলে তুমি ওমরা এবং জিহাদের সওয়াব পাবে।' -মোসনাদে আবু ইয়ালা, তাবারানী
তাবারানী গ্রন্থে আরও বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল। আমি জিহাদে যেতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার মা কি বেঁচে আছেন?' লোকটি বলল, বেঁচে আছেন। নবী করীম (ছঃ) বললেন-
الزَمْ رِجُلُهَا فَثَمَّ الْجَنَّةَ .
-'তুমি তোমার মায়ের পায়ের নিচে পড়ে থাক, সেখানেই তোমার জান্নাত।'
ইবনে মাজা শরীফে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে প্রশ্ন করল, 'সন্তানের উপর বাবা-মা'র কি কি অধিকার রয়েছে।' রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন:
- هُمَا جَنَّتُكَ وَ نَارُكَ-'
তাঁরাই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।'
হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে, একদা এক লোক হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর কাছে এসে বলল, আমার বাবা আমার স্ত্রীকে তালাকের হুকুম করেছেন, এমতাবস্থায় আমার কি করণীয়? হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) বললেন, 'আমি নবী করীম (ছঃ)-এর পবিত্র জবানে শুনেছি, তিনি বলেছেন-
الْوَالِدُ أَوسَطُ أَبْوَابَ الْجَنَّةَ فَحَافِظُ عَلَى ذَلِكَ إِنْ شِئْتَأو دع .
-'পিতা হলেন বেহেশতের মধ্যবর্তী দরজা, ইচ্ছা হলে তুমি সে দরজা সংরক্ষণ কর, অথবা স্বেচ্ছায় তা ধ্বংস কর। -তিরমিযী
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, 'আমার এক স্ত্রীর সাথে খুবই মহব্বত ছিল; কিন্তু আমার পিতা হযরত ওমর (রাঃ) তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। একদিন তিনি স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দেন, কিন্তু আমি তাতে অস্বীকৃতি জানাই। তিনি নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বিষয়টি উল্লেখ করলেন। তারপর তিনি আমাকে ডেকে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার হুকুম দেন।' -ইবনে হেব্বান, তিরমিযী
'মোসনাদে আহমদ' গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, 'নবী করীম (ছঃ) বলেছেন-
-'যে ব্যক্তি স্বীয় দীর্ঘ জীবন ও সচ্ছল জীবিকার আশা পোষণ করে, সে যেন বাবা মায়ের সাথে উত্তম ব্যবহার করে এবং আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করে।
' হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, 'যে সন্তান বাবা-মায়ের খেদমত করবে, তার জন্য সুসংবাদ যে, আল্লাহ তাআলা তাকে দীর্ঘ জীবন দান করবেন।'
'ইবনে মাজাহ' শরীফে বর্ণিত আছে, 'নবী করীম (ছঃ) বলেন, পাপাচার মানুষের জীবিকায় অভাব ও দরিদ্রতা আনে। একমাত্র দোয়াই তকদীর ফিরিয়ে রাখতে পারে, আর একমাত্র বাবা-মায়ের খেদমত দ্বারাই দীর্ঘ জীবন লাভ হতে পারে।
বর্ণিত আছে, 'পরস্ত্রী'র দিকে তাকাবে না। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ পবিত্র ও সংযমশীল থাক। তাহলে তোমার স্ত্রীও পবিত্র সতী সাধ্বী থাকবে। অনুরূপ বাবা-মায়ের সাথে উত্তম ব্যবহার কর, তাহলে তোমার সন্তান-সন্ততি তোমার সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। তোমার কোন ভাই তোমার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে এলে সে ন্যায়ভাবে আসুক বা অন্যায়ভাবে আসুক, অবশ্যই তুমি তাকে অভিনন্দন জানাও এবং তার ইচ্ছা কবুল করে নাও। অন্যথায় হাশরের ময়দানে হাউজে কাউসারে তোমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ থাকবে।'
একদা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) পুনঃ পুনঃ বলতে লাগলেন, 'লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক, নাকে খত লাগুক।' লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল। এহেন অপমানকর বদদোয়া আপনি কার জন্য করলেন? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তির জন্য যে তার বাবা-মায়ের উভয়কে অথবা যেকোন একজনকে দুনিয়াতে বৃদ্ধাবস্থায় পাওয়া সত্ত্বেও তাদের সেবা-শুশ্রূষা দ্বারা নিজের জন্য জান্নাতের ব্যবস্থা করে নিতে পারল না। -মুসলিম
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, 'একদিন রাসূলুল্লাহ (ছঃ) মিম্বরের উপর আরোহণ করে বললেন, আমীন, আমীন, আমীন। অতঃপর বললেন, এমাত্র হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে আমাকে বললেন, ওই ব্যক্তির উপর আল্লাহর লা'নত যে রমযান মাস পেল অথচ নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারল না। আমি বললাম আমীন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, ওই ব্যক্তির উপর আল্লাহর লা'নত যে ব্যক্তি তার বাবা-মায়ের উভয়কে অথবা যে কোন একজনকে পাওয়া সত্ত্বেও জাহান্নামী হয়েছে, আমি বললাম আমীন।
হাকেম বর্ণনাটি পূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন। তাতে সর্বশেষ অংশ এভাবে রয়েছে, নবী করীম (ছঃ) যখন মিম্বরের তৃতীয় সিঁড়িতে কদম মোবারক রাখলেন, তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করে বললেন, যে সন্তান বাবা-মাকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও তাদের সেবা-শুশ্রঃযার দ্বারা নিজে জন্নাত লাভ করতে পারল না, তার প্রতি ধিক্, 'সে বিতাড়িত হোক।' আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বললেন, 'আমীন'।
'যদি কেউ কোন মুসলমানকে খরিদ করে মুক্ত করে দেয়, তাহলে আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। আর যে ব্যক্তি বাবা-মাকে জীবিত পেয়েও তাদের খেদমত করে আল্লাহর নিকট থেকে মার্জনালাতে ব্যর্থ হল, তার প্রতি ধিক্, আল্লাহর রহমত থেকে সে বহু দূরে।' -মোসনাদে আহমদ
এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমার সেবা ও সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা অধিক হকদার কে? রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'তোমার মা।' লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? বললেন, 'তোমার মা।' লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এরপর তোমার পিতা তোমার সেবা ও উত্তম ব্যবহারের হকদার। -বুখারী ও মুসলিম
হযরত আসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর যুগে একবার আমার মা আমার নিকট এলেন। তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। আমি আরজ করলাম 'হে আল্লাহর রাসূল। আমার মা অমুসলিম; এমতাবস্থায় আমি কি তাঁর সাথে উত্তম ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'নিশ্চয়ই তুমি তোমার মা'র খেদমত করবে এবং তাঁর সাথে সদ্ব্যবহার করবে।' বুখারী ও মুসলিম
হাদীসে আরও বর্ণিত আছে-
-'আল্লাহর সন্তুষ্টি বাবা-মায়ের সন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত রয়েছে। অনুরূপ বাবা-মাকে অসন্তুষ্ট করলে আল্লাহ্ তা'আলা অসন্তুষ্ট হন।' -ইবনে হেব্বান ও হাকেম
এক ব্যক্তি আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনেক বড় গুনাহ করে ফেলেছি, আমার জন্য কি তওবার কোন সুযোগ আছে? রাসুলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'তোমার মা কি বেঁচে আছেন?' সে বলল, 'জ্বি না।' নবীজী (ছঃ) বললেন, তোমার খালা কি বেঁচে আছেন? সে বলল, 'জ্বি হ্যাঁ।' নবীজী (ছঃ) বললেন, 'তুমি তোমার খালার খেদমত কর এবং তাঁর সাথে সদ্ব্যবহার কর।' -তিরমিযী, ইবনে হেব্বান, হাকেম
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল। আমার বাবা-মায়ের ইন্তেকালের পর তাঁদের জন্য আমার কি হক পালন করতে হবে। তিনি বললেন, 'তাঁদের পাপ মোচনের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে দোয়া কর, তাঁদের সাথে তোমার কৃত ওয়াদা এবং তাঁদের কৃত অসিয়ত পালন কর। তাঁদের বন্ধু-বান্ধবের সম্মান কর এবং তাঁদের আত্মীয় ও প্রিয়জনের জনের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।' -আবু দাউদ ও ইবনে মাজা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর সাথে মক্কার এক স্থানে জনৈক গ্রাম্য লোকের সাক্ষাত হয়। তাকে দেখে তিনি সালাম দিয়ে নিজের উষ্ট্রীর উপর আরোহণ করান এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে নিজের মাথার পাগড়িখানা উপহার দেন। সফরসঙ্গী হযরত ইবনে দীনার জিজ্ঞেস করলেন, 'এরা গ্রাম্য লোক, সামান্য সম্মানেই তুষ্ট হয়, আপনার এত বেশি সম্মান প্রদর্শনের কারণ কিং' হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বললেন, এই গ্রাম্য লোকটির পিতা আমার পিতা (হযরত ওমর)-এর দোস্ত ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-কে বলতে শুনেছি, পিতার প্রতি সন্তানের সর্বাপেক্ষা বড় হক ও কর্তব্য হচ্ছে, পিতার বন্ধু-বান্ধব ও তাদের আত্মীয়- প্রিয়জনদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। মুসলিম শরীফ
0 Comments