হাতিব ইবনে আবী বালতাআ (রাঃ) বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সাহাবী ছিলেন। তাঁর পরিবার-পরিজন মক্কায় ছিল এবং এই সময়ই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। তিনি ধারণা করলেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে মক্কার মুশরিকরা তো অবহিত হয়েই যাবে অতএব আমি যদি তাদের এ সম্পর্কে অবহিত করে দেই তবে আমাদের (মুসলমানদের) কোন ক্ষতিও হবে না এবং আমিও তাদের সহানুভূতি লাভ করে আমার পরিবার-পরিজনকে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারব। অতএব তিনি এ সম্পর্কে মক্কার মুশরিকদের একটি পত্র পাঠান। নবী (সাঃ) ওহীর মাধ্যমে তা জানতে পারলেন এবং হযরত আ নামক স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন আলী, মিকদাদ ও যুবায়ের (রাঃ)-কে রওদায়ে খাখ : সেখানে পৌছে তোমরা উষ্ট্রীর উপর আরোহী আঙটি স্ত্রীলোকের সাক্ষাত পাবে। সে গোয়েন্দা বৃত্তিতে ায়েন্দা বৃত্তিতে লিপ্ত আছে এবং তার কাছে একটি চিঠি আছে, তা তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সাক্ষাত পেয়ে তার কাছে চিঠি দাবী করলেন আসবে। তাঁরা উল্লো ল্লখিত স্থানে গিয়ে মহিলার কিন্তু সে অস্বীকার করে বলল যে, তার নিকট কোন চিঠি নেই। কিন্তু যখন তাঁরা তার জামার মধ্যে চিঠি অনুসন্ধান এন এবং করলেন দিলেন তখন সে বাধ্য হয়ে তার চুলের বেণীর মধ্য থেকে একটি চিঠি বের করে দিল।
এই চিঠি নবী (সাঃ)-এর হাতে পৌঁছানোর পর দেখা গেল তা হাতিব (রাঃ)-র লেখ চিঠি। তিনি হাতিব (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেনঃ হাতিব। কি ব্যাপার? তিনি বললেন, ন, হে হানরত আল্লাহর রসূল। এই চিঠি আমি এই উদ্দেশ্যে লিখেছিলাম যে, আমি জানি মদীনায় সব মুহাজিরদের কোন না কোন পর্যায়ে মক্কার কুরাইশদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়ে কেবল আমারই তাদের সাথে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। আমি কেবল এই বিশ্বাসে চিঠি লিখেছিলাম যে, এতে মুসলমানদের কোন ক্ষতি হবে না এবং আমি এভাবে কুরাইশত শদের সহানুভূতি লাভ করে নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা বিধান করতে পারব। হে আল্ল মাল্লাহর রাসূল। ধর্মত্যাগী অথবা কুফরীর প্রতি সন্তুষ্টির ভিত্তিতে আল্লাহর শপথ। আমি এ কাজ করি করিনি। আমি এখনও ইসলামের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত।
মহানবী (সাঃ) সবকথা শুনে বললেনঃ "হাতিব তোমাদের সামনে সত্য কথা বলেছে। হযরত উমর (রাঃ) আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এই মুনাফিকের ঘাড় উড়িয়ে দেই। নবী (সাঃ) বললেন: হাতিব বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণক ণেকারী মুজাহিদ। আল্লাহ্ তা'আলা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন: "তোমরা যা চাও তাই কর। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি"
হাতিব (রাঃ)-র ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়েছে: "হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে না... নিশ্চিতই সে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।" যাই হোক রমযান মাসের প্রথম দিকে রসূলুল্লাহ (সাঃ) দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনীসহ মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, 'কাদীদ' ও 'উসফান' এর মধ্যবর্তী স্থান 'কুদাইদ' পর্যন্ত পৌঁছে নবী (সাঃ) দেখলেন, মুসলমানদের জন্য রোযা রাখা অতীব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তিনি পানি চেয়ে নিলেন এবং জনতার সামনে তা পান করলেন। যাতে সাহাবীগণ দেখে বুঝে নেন যে, সফর এবং জিহাদের সময় রোযা ভংগ করার অনুমতি আছে এবং কুরআন মজীদ প্রদত্ত অনুমতির অর্থও তাই।
এই সফরে নবী (সাঃ)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হন। তিনি তাঁকে নিজ পরিবারবর্গের সাথে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়ে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মুসলিম বাহিনী মক্কার কাছাকাছি পৌঁছলে আবু সুফিয়ান তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য ছদ্মবেশে আগমন করে মুসলমানদের হাতে ধরা পড়ে। তারা তাকে নবী (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত করলেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা করে বন্ধনমুক্ত করে দেন। আবু সুফিয়ান তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করেন। অনুরূপভাবে আবদুল্লাহ ইবনে আবী উমাইয়াও ইসলাম গ্রহণ করে নবী (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হন। তিনি এতে আনন্দিত হয়ে বললেনঃ "আজ তোমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না। আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনিই সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী।"
নবী (সাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে বললেনঃ আবু সুফিয়ানকে এখন মক্কায় যেতে দিও না এবং সামনের পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে যাও। আবু সুফিয়ান ও আকব্বাস (রাঃ) পাহাড়ের উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে মুসলিম বাহিনীর সমাবেশ দেখছিলেন। মুহাজির ও আনসারদের পৃথক পৃথক বাহিনীর নিজ নিজ পতাকা উত্তোলিত অবস্থায় একের পর এক সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। আর আবু সুফিয়ান তা অবলোকন করে প্রভাবিত হচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আনসারদের একটি বাহিনী তাঁর সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিল। এই বাহিনীর পতাকা হযরত সা'দ ইবনে উবাদা (রাঃ)-এর হাতে ছিল। তিনি আবু সুফিয়ানকে দেখেই আবেগে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন,"আজকের দিন যুদ্ধের দিন, আজ কা'বার চত্বরেও যুদ্ধ বৈধ।"
আবু সুফিয়ানের গোত্র-বিদ্বেষ মাথাচারা দিয়ে উঠল এবং তিনি বলতে লাগলেন, "হে আব্বাস। যুদ্ধের দিন কল্যাণকর হোক।"
এভাবে গোটা মুসলিম বাহিনী অতিক্রম করার পর একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে মহানবী (সাঃ) সামনে অগ্রসর হলেন। হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে পতাকা ছিল এবং তিনি সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আবু সুফিয়ান নবী (সাঃ)-কে দেখেই তাঁর ও সা'দ (রাঃ)-এর মধ্যকার বচসার কথা তাঁর কাছে ব্যক্ত করলেন। তা শুনেই নবী (সাঃ) বললেন: সা'দ মিথ্যা বলেছে,
"আল্লাহ্ আজকের এই দিনে কা'বার মর্যাদা সমুন্নত করবেন এবং আজ কা'বাতে গেলাফ আচ্ছাদন) পরানো হবে।" এই কথা বলে নবী (সাঃ) সা'দ (রাঃ)-কে বরখাস্ত করে পতাকা ও সৈন্যদের নেতৃত্ব তাঁর পুত্রের হাতে অর্পণ করলেন।
মহানবী (সাঃ) হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-কে মক্কার নিম্ন ভূমি দিয়ে মক্কায় প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করে দিলেন। অবশ্য কেউ বাধা দিলে তা প্রতিহত করার অনুমতি দেয়া হল। তিনি নিজে উচ্চ ভূমি দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। কতিপয় গোত্রের কিছু লোক খালিদ বাহিনীর পথরোধ করলে সংঘর্ষে তাঁর হাতে কয়েক ব্যক্তি নিহত হয়। কিন্তু নবী (সাঃ) বিনা বাধায় মক্কায় প্রবেশ করেন।
হযরত আব্বাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে ইসলাম গ্রহণের জন্য নবী (সাঃ)-এর সামনে পেশ করেছিলেন। তখন তিনি এই আবেদনও করেছিলেন, হে আল্লাহর রসূল। আবু সুফিয়ানের মধ্যে জাত্যাভিমানের উপাদান বর্তমান আছে। অতএব তাকে যদি বিশেষ পুরষ্কৃত করা হয় তবে ভালই হত। নবী (সাঃ) বললেনঃ "যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ।
" নবী (সাঃ) জাঁকজমক সহকারে মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা দিলেনঃ
(১) যে ব্যক্তি ঘরের দরজা বন্ধ করে অভ্যন্তরে অবস্থান করবে সে নিরাপদ;
(২) যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ এবং
(৩) যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।
কতিপয় লোককে এই সাধারণ ক্ষমা ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি যারা ইসলাম ও মুসলমানদের চরম ক্ষতি সাধনে তৎপর ছিল। কিন্তু তখন এদের অধিকাংশই পলায়ন করে অন্যত্র চলে গিয়েছিল অথবা নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করেছিল। পরে তারা সাধারণ ক্ষমার সুযোগে ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করে।
বসুলুল্লাহ (সাঃ যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর হাতের বর্শা ছিল সাদা রং-এর, তার পতাকার রং ছিল কালো, মাথায় ছিল লৌহ শিরস্ত্রান ও তার উপর কালো পাগড়ি বাঁধা ছিল। তিনি সূরা আল-ফাতহ-এর প্রাথমিক আয়াতগুলি বারবার উচ্চস্বরে পড়ছিলেন আর সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তিনি এতটা বিমুগ্ধ ছিলেন যে, মাথা কখনও কখনও নিজ উষ্ট্রীর পিঠের সাথে ঠেকে যেত।
0 Comments