কুরআনের আদব কুরআন কে হৃদয়ঙ্গম করা


        (৫) কুরআন হৃদয়ঙ্গম করাঃ প্রত্যেক আয়াতের যথাযথ অর্থ উপলব্ধি এবং হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। কুরআনে পাকে স্থান লাভ করেছে আল্লাহ তয়ালার গুণাগুণ ও তাঁর কারুকার্যগুলোর বর্ণনা। নবী-রাসূলদের বিবরণ, মিথ্যাবাদীদের অবস্থার বিবরণ, তাদেরকে কিভাবে ধ্বংস করা হল, রিরূপে হেদায়েত করা হল, তাছাড়া আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ এবং সতর্কীকরণের বিবরণ আর বেহেশত ও দোযখ সম্মর্কিত বর্ণনা।

        আল্লাহর গুণাগুণ সম্পর্কিত বর্ণনা যথাঃ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, "লাইসা কামিছলিহী শাইয়ুন" অর্থাৎ তাঁর সাথে তুলনীয় কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা। তিনি বলেছেনঃ তিনি রাজাধিরাজ, পরম পবিত্র। শান্তি প্রদানকারী, নিরাপত্তাদায়ক অভিভাবক, মহাপরাক্রমশীল, করুণাময়, প্রতাপশালী, মহাগৌরবান্বিত। এখন এ সব গুণবাচক নামের অর্থের বিষয় চিন্তা কর যেন তার গুণ ও নিগূঢ় অর্থ প্রকাশ পায়। তাউফীক প্রাপ্ত লোকগণ ছাড়া তা' অন্যের নিকট প্রকাশ পায় না। হযরত আলী (রাঃ) এ কথার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, হযরত রাসূলে করীম (দঃ) আমাকে এমন গোপন তত্ব জানান নি, যা' মানুষের কাছে প্রকাশ করা হয় নি; বরং আসল কথা হল, আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দাকে নিজ কিতাবের বোধ-জ্ঞান এনায়েত করে থাকেন; সুতরাং সেই বুঝের অন্বেষণে লালায়িত থাকা চাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদের সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে চায়, সে যেন কুরআনে পাকে তা' অন্বেষণ করে। আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর মধ্যে কুরআনে পাকের অধিক ইলম নিহিত। অনেক মানুষই সেই ইলম অর্জন করতে পারে না। শুধু যেটুকু তাদের বুদ্ধির আয়ত্তে থাকে, ততটুকুই জানতে পারে। তারা তার অন্তর্নিহিত গভীর তত্ত্বে প্রবেশ করতে পারে না।

        আল্লাহর কার্যক্রম সম্পর্কিত বর্ণনাঃ আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেনঃ তিনি আসমান, যমিন ও অন্যান্য বস্তু সৃষ্টি করেছেন। কুরআন পাঠকারী তা' থেকে আল্লাহর গুণাবলী ও তাঁর গৌরব বুঝে নেবে। কেননা কাজই কার্যকর্তার পরিচয় দেয় এবং কাজের মাহাত্ম্যই তাঁর মাহাত্ম্য প্রকাশ ও প্রদর্শন করে। যে প্রকৃত সত্য চিনতে পারে, সে তা' প্রত্যেক বস্তুতে দেখতে পায়। কেননা প্রতিটি বস্তুই তাঁর থেকে আগত এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনীয়। তাঁরই সাহায্যে ও তাঁরই জন্যে প্রত্যেক জিনিস সত্য অনুসন্ধানের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে ব্যক্তি প্রত্যেক দৃষ্ট জিনিসে তাঁকে দেখে না, সে তাকে চিনতে পারে না। যে তকে চিনতে পারে, সে জানে যে, তিনি ছাড়া প্রত্যেক জিনিসই বাতিল এবং তিনি ছাড়া প্রত্যেক জিনিসই লুপ্ত হবে। দ্বিতীয় অবস্থায় তার ধবংস হবে না; বরং তার আশু বাংস অবধারিত। যদি তার অস্তিত্বকে আল্লাহরই সত্তার দিকে লক্ষ্য করে দেখে, সে দেখবে যে, সে আল্লাহ তায়ালা থেকে ও আল্লাহর কুদরতের উসিলায়ই এসেছে। দাসত্বের পথে তার স্থিতি রয়েছে এবং আজাদীর পথে স্থিতি নেই বরং সে ব্যর্থ। এ হল ইলমে মুকাশাফাহ বা আধ্যাত্মবাদের সূচনা মাত্র। এজন্যই একান্ত উচিত যে, যখন কুরআন তিলাওয়াতকারী নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তখন সে যেন নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তায় নিবিষ্ট হয়। যেমন এরশাদ হয়েছেঃ "আফারায়াইতুম মা তাহরুছন অর্থাৎ তোমরা যা বপন কর সে দিকে কি লক্ষ্য কর না? "আফারায়াইতুম মা তুমনূন" অর্থাৎ তোমরা যে মানব বীজ বপন কর সেদিকে কি লক্ষ্য কর না? "আফারায়াইতুমল মায়াল্লাযী তাশরাবুন" অর্থাৎ তোমরা যে পানি পান কর, সে দিকে কি লক্ষ্য কর না?

        "আফারায়ইতুমুল্লারাল্লাতী তৃজ্বন" অর্থাৎ তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর, সেদিকে কি লক্ষ্য কর না? তোমাদের উচিত পানি, অগ্নি, শস্য বীজ ও মানববীজ শুক্রকে বিশ্লেষণ করে দেখা। মানব বীজের বিষয় চিন্তা করবে যে, এ তো এক ফোঁটা শুক্র মাত্র। এটা কতগুলি উপদানাংশ দ্বারা গঠিত। যার ফলে মানব দেহ, মাংস, হাঁড়, শিরা পৃষ্ঠ এবং অন্যান্য বিভিন্ন বস্তুতে রূপ লাভ করেছে। তাছাড়া আবার সেগুলোতে কিভাবে মস্তক, হাত পা, পিত্ত, কলিজা ইত্যাদি গঠিত হয়েছে। অতঃপর এর ভিতর আবার সম্মানিত প্রকাশ্য গুণাবলী প্রদত্ত হয়েছে। যেমন শ্রবণ শক্তি, দর্শন শক্তি, অনুভূতি ও বোধশক্তি প্রভৃতি। তাছাড়া এতে প্রকাশ্য নিন্দনীয় দোযাবলী দান করা হয়েছে। যেমন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মূর্খতা, অহংকার মিথ্যাবাদিতা, ছলনা, প্রতারণা, তর্ক বিতর্ক এবং কলহ-কোন্দল স্পৃহা ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, "আওয়ালাম ইয়ারাল ইনসানু ইন্না খালাকুনাহু মিন নুৎফাতিন ফাইযা হুয়া খাছীমুম মুবীন" অর্থাৎ মানুষ কি লক্ষ্য করে না যে, আমি তাকে একটি শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর সে প্রকাশ্যই শত্রু হয়ে যায়। যদি তোমরা উক্ত আশ্চর্য বিষয়গুলো চিন্তা কর, তাহলে তোমরা ততোধিক আশ্চর্যের বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। জেনে রাখবে, কারুকার্য দেখেই কারিগরকে চিনতে হয়।

        নবীদের অবস্থা সম্পর্কিত বর্ণনাঃ যখন কুরআনে পাক থেকে শোন যে, নবীদেরকে কিভাবে মিথ্যারোপ করা হয়েছিল, কিভাবে অত্যাচার এবং নির্যাতন করা হয়েছিন। তাঁদেরকে এবং তাঁদের কত লোক জনকে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তখন ধারণা করতে পারবে যে, আল্লাহর নবী রাসূলগণ কি বেপরোয়া চরিত্র গুণে বিভূষিত হয়েছিলেন। যদি আল্লাহ তাঁদের সবাকেই ধংস করে দিতেন, তাঁর রাজত্বের কোন কিছুই হানি ঘটত না। যখন তোমরা তাদের কার্যের শেষে তাদের উপর আল্লাহর সাহায্যের বিষয় শোন, তখন তাঁর কুদরতের বিষয় উপলব্ধি করতে পারবে এবং সত্যের সাহায্যের জন্য তাঁর ইচ্ছে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে।

        মিথ্যাবাদীদের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনাঃ যেমন আদ, সামুদ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বিবরণ। তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা যে শাস্তি প্রদান করছেন, তা' থেকে তোমরাও শাস্তি ও তিরস্কারের ভয় করবে এবং মনে মনে তা' থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে। যদি তোমরা এ ব্যাপারে অন্যমনস্ক হও, যদি তোমাদের রীতি-নীতি মন্দ হয়, যা তোমরা করতে পার নি তার জন্য দুঃখিত ও অনুতপ্ত না হও তাহলে তার জন্য তোমরা শাস্তি লাভ করবে। এভাবে যখন বেহেশত দোযখ সম্পর্কে কুরআনের বাণী শোন, আর সে সম্পর্কে যা বুঝ তাকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না। কেননা, তা' কখনই সমানা ও নগণ্য নয়। তার কোন সীমা বা অন্ত নেই। মনে রাখবে, প্রত্যেক বান্দারই পরিমাণ অনুযায়ী রিযিক আছে। এমন কোন নতুন বা পুরাতন জিনিস নেই যা প্রকাশ্য কুরআনে বর্ণিত হয় নি। আল্লাহ বলেন, "ফালা রাহাবুন ওয়ালা ইয়াবিছুন ইল্লা ফী কিতাবিম মুবীন।" আল্লাহ তায়লা আরও বলেছেন, "জ্বল লাও কানাল ব্যহরু মিদাসাল্লি কালিমাতি রাব্বি লানাফিদাল বাহরু বাবলা আন তানফাদা কালিমাতু রাবির" অর্থাৎ বল, যদি আমরা প্রভুর গুণাবলী বর্ণনার জন্য সমুদ্রের পানি কালি হয়ে যেত তবে তা' লিখে শেষ করার পূর্বেই সে সমুদ্র শুকিয়ে যেত; বরং তারই ন্যায় আরো কালি আনা হলে তারও সেই অবস্থ্য হত। হযরত আলীর (রাঃ) বাক্যটি এ আয়াতেরই সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন যে, যদি আমি ইচ্ছে করি তবে সূরা ফাতিহার তাফসীর লিখে সত্তরটি উট দ্বারা তা' বহন করাতে পারি। এ পর্যন্ত বাঁ উল্লেখ করা হল তার সারমর্ম এই যে, কুরআন বুঝার জন্য সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়েছে যেন বোধশক্তির দরজা উন্মুক্ত হয়। তা' না হলে কুরআন বুঝার আগ্রহ জান্মায়না। যে ব্যক্তি কুরআন বুঝার ব্যাপারে সামান্য দরজাও খুলে না রাখে, সে তাদের অন্তর্গত, যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন যে, তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা তোমার কথা শোনে কিন্তু তোমার নিকট থেকে যখন দূরে চলে যায়, তখন তারা ইলম প্রাপ্ত লোকদেরকে এমন কথা বলে যা পূর্বে কখনও বলে নি। এরা ঐ লোক যাদের দিলের ওপর আল্লাহ তায়ালা মহর মেরে দিয়েছেন। মহর মারার অর্থ প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা। আমি এ বিষয়ে শীঘ্রই বর্ণনা করব। কেউ কেউ বলে যে, দ্বীনের পথের পথিক পথ চলতে পারে না যে পর্যন্ত না সে কুরআনের ভিতর যা ইচ্ছে করে তা' পায়। তার ভিতর উপকার ও ক্ষতি চিনতে পারে এবং বান্দার নিকট থেকে ফিরে গিয়ে আল্লাহ তায়ালাকেই যথেষ্ট মনে করে।

Post a Comment

0 Comments