বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর স্ত্রী স্বামীর জন্য এক প্রকার আজ্ঞাবহ দাসীর মত হয়ে যায়। তখন তার কর্তব্য প্রতি কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। তবে শর্ত হল, আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপকর্মে আনুগত্য করা চলবে না।
স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর দায়িত্ব কর্তব্য। এ সম্পর্কিত প্রচুর বর্ণনা হাদীস গ্রন্থসমূহে রয়েছে। এক হাদীসে নবী করীম (ছঃ) বলেন-
أيُّمَا امْرَأَةٍ مَانَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الْجَنَّةَ .
-যে স্ত্রীলোক স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এক ব্যক্তি সফরে যাওয়ার সময় স্ত্রীর নিকট থেকে ওয়াদা নিয়েছিল, সে তার অনুপস্থিতিতে উপর তলা থেকে নীচে নামবে না। নীচে স্ত্রীর পিতা অবস্থান করতেন। একদা পিতা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নীচে নেমে পিতাকে দেখা ও সেবা-শুশ্রূষার অনুমতি প্রার্থনা করে স্ত্রী নবী করীম (ছঃ)-এর নিকট লোক প্রেরণ করেন। তিনি বললেন, তাকে বল, সে যেন স্বামীর আদেশের অনুগত থাকে। পিতার মৃত্যুর পর দাফনকার্য সম্পন্ন হলে নবী করীম (ছঃ) স্ত্রীর নিকট পয়গাম পাঠালেন, 'স্বামীর আনুগত্যের কারণে আল্লাহ্ তা'আলা তোমার পিতাকে মাফ করে দিয়েছেন।'
রাসূলে আকরাম (ছঃ) বলেন-
إِذَا صَلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا وَ صَامَتْ شَهْرَهَا وَحَفِظَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا دَخَلَتْ جَنَّةَ رَبِّهَا .
-'যে স্ত্রীলোক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযানের রোযা রাখে, সতীত্ব রক্ষা করে চলে এবং স্বামীর বাধ্য থাকে, সে তার রবের জান্নাতে প্রবেশ করবে।'
প্রণিধানযোগ্য, এ হাদীসে রাসূলে আকরাম (ছঃ) স্বামীর বাধ্যতার বিষয়টিকে ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়াবলীর সাথে উল্লেখ করে তৎপ্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) স্ত্রীলোকদের প্রসঙ্গে বলেন-
حَامِلاتٌ وَالِدَاتٌ مُرْضِعاتٌ رَجِيْمَاتٌ بِأَوْلَادِهِنَّ لَوْلَا مَا يَأْتِينَ إِلَى أَزْوَاجِهِنَّ دَخَلَ مُصَلِّياتُهُنَّ الْجَنَّةَ .
-'গর্ভধারিণী স্ত্রীলোক, সন্তানের মা, সন্তানকে দুধ পান করানোয় কষ্ট স্বীকারকারিণী, সন্তানের প্রতি দয়া স্নেহ প্রদর্শনকারিণী, এরা স্বামীর অবাধ্যতা না করলে তাদের মধ্যে নিয়মিত নামাযী মহিলারা অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।'
নবী করীম (ছঃ) বলেন-
اطَلَعْتُ فِي النَّارِ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ فَقُلْنَ لِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ يُكْثِرْنَ اللَّعْنَ وَيَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ -
-'আমি জাহান্নামে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছি, সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসী নারী। তারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল। কেন এমন হবে? তিনি বললেন, তারা বেশি বেশি অভিশাপ দেয় এবং স্বামীদের নাশোকরী করে।'
অন্য এক বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেন, 'আমি জান্নাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখি, সেখানে নারীর সংখ্যা খুবই কম। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, স্বর্ণ ও যাফরান এ দু' লালের মোহ আকর্ষণ তাদের বিমুখ করে রেখেছে।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, একজন যুবতী মেয়েলোক নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল। আমার এখন উঠতি বয়স; বিয়ের জন্য আমার পয়গাম আসছে, কিন্তু আমি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন পছন্দ করি না। আপনি বলুন, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কি দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে? তিনি বললেন, স্বামী পীড়িত হয়ে সমগ্র দেহ যদি পুঁজে ভরে যায় আর স্ত্রী তা জিহ্বা দ্বারা লেহন করে পরিষ্কার করে, তবু তার কৃতজ্ঞতা আদায় হবে না। যুবতীটি বলল, তাহলে কি আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না? রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, না, তুমি বিবাহ বস; কেননা, এতেই মঙ্গল নিহিত রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খাসআঁম গোত্রের এক মহিলা রাসূল (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একজন বিধবা স্ত্রীলোক; আমার বিবাহ করার ইচ্ছা আছে, আপনি বলুন, স্বামীর হক কি? তিনি বললেন, স্ত্রীর উপর স্বামীর হক হচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে শয্যায় আহ্বান করলে সে উটের পৃষ্ঠে আরোহিত অবস্থায় থাকলেও যেন তার ডাকে সাড়া দেয়। স্বামীর আরেক হক হচ্ছে, স্ত্রী তার বিনানুমতিতে গৃহের কোন বস্তু কাউকে দিবে না, দিলে স্ত্রীর গুনাহ হবে, কিন্তু সওয়াব স্বামীর হবে। স্বামীর আরেক হক হচ্ছে, তার অনুমতি ছাড়া স্ত্রী নফল রোযা রাখবে না। এরূপ করলে অযথা পানাহার থেকে বিরত থেকে কষ্ট করা হবে; কোন সওয়াব হবে না। স্ত্রী স্বামীর বিনানুমতিতে ঘর থেকে বের হলে পুনরায় ঘরে প্রত্যাবর্তন না করা অথবা তওবা না করা পর্যন্ত ফেরেশতারা তাকে অভিশাপ দিতে থাকে।
রাসূলে আকরাম (ছঃ) বলেন-
لَوْ أَمَرْتُ أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَلِزَوْجِهَا -
-'আমি কাউকে সেজদার আদেশ করলে নারীদের বলতাম তাদের স্বামীদের সেজদা করতে।'
তিনি আরও বলেন, স্ত্রীলোকেরা আল্লাহ্ তা'আলার একান্ত নিকটতর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হয় তখন, যখন তারা স্বগৃহে থাকে। স্বগৃহের আঙ্গিনায় তাদের নামায আদায় করা মসজিদে আদায় করা থেকে উত্তম। গৃহের ভিতর আদায় করা নামায গৃহের আঙ্গিনায় আদায় করা নামায থেকে উত্তম। গৃহাভ্যন্তরের কক্ষে আদায় করা নামায গৃহের ভিতর আদায় করা নামায থেকে উত্তম। পর্দার হেফাযতের জন্যই এ হুকুম করা হয়েছে। এ জন্যই তিনি বলেন, 'স্ত্রীলোক স্বয়ং পর্দা; সে গৃহ থেকে বের হলেই শয়তান উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'স্ত্রীলোকের পর্দা এগারটি। বিয়ের পর স্বামী তার জন্য এক পর্দা; মৃত্যুর পর কবর তার জন্য দশটি পর্দা।'
মোট কথা, স্ত্রীর উপর স্বামীর অনেক অধিকার রয়েছে; তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে দুটি: ১. সতীত্ব রক্ষা ও পর্দা পালন। ২। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু স্বামীর নিকট দাবী না করা।
আদর্শ পূর্বসূরীদের নীতি ছিল, তাদের কেউ জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হলে তাদের স্ত্রী-কন্যারা বলতেন, হারাম রোজগার থেকে বেঁচে চলবেন; আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণা ও অন্যান্য কষ্ট সহ্য করে নেব, তবুও জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না।
তাঁদেরই একজনের ঘটনা, একদা তিনি সফরে যেতে মনস্থ করেন। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ তাঁর এ সফর কামনা করছিল না; তারা সে লোকের স্ত্রীকে বলল, আপনি কেন তাকে সফরে যেতে দিচ্ছেন, অথচ সে আপনার প্রয়োজনীয় খরচাদি দিয়ে যাচ্ছে না? স্ত্রী জবাব দিলেন, আমি তার ঘরে আসার পর থেকে তাকে শুধু একজন ভোজনবিলাসীই পেয়েছি: রিযিকদাতা হিসাবে পাইনি। তিনি যাচ্ছেন; যান, কিন্তু আসল রিযিকদাতা তো রয়েছেন। তাঁর উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।
হযরত রাবেয়া বিনতে ইসমাঈল (রঃ) হযরত আহমদ ইবনে আবিল হওয়ারী (রঃ)-এর নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তিনি ইবাদত-বন্দেগীতে বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কায় অসম্মতি প্রকাশ করেন। হযরত রাবেয়া বললেন, আমিও আপনার ন্যায় ইবাদতে মগ্ন থাকি; তদুপরি আমার বিবাহের ইচ্ছাও নেই, কিন্তু আমার পূর্ববর্তী স্বামী থেকে আমি যে প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেছি, আমার ইচ্ছা আপনি সেসব সম্পদ আপনার বন্ধুজন ও তাপসদের মাঝে খরচ করুন। আর এ সুযোগে আমি তাঁদের পরিচিতিলাভে ধন্য হই। এভাবে আল্লাহকে পাওয়ার পথও আমার জন্য সুগম হয়ে যাবে। এ কথায় তিনি বললেন, তাহলে আমার শায়খের সাথে পরামর্শ করে নেই। তাঁর শায়খ হরত আবু সোলায়মান দারানী (রঃ) ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কায় এতকাল তাঁকে বৈবাহিক জীবন অবলম্বন করতে নিষেধ করতেন। হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রঃ) উক্ত মহিলার উক্তি ও অবস্থা জেনে তাঁকে বিবাহের অনুমতি দিয়ে বললেন, তিনি আল্লাহর ওলী ও সিদ্দীকদের ন্যায় উক্তি করেছেন। আহমদ ইবনে আবিল হাওয়ারী (রঃ) তাঁকে বিবাহ করার পর ঘরে তাঁর বসবাস এমন ছিল যে, গোসল করা তো দূরের কথা, খাওয়া-দাওয়ার পর হাত ধোয়ার ফুরসত পায় না এমন ব্যক্তির ন্যায় শীঘ্র বের হয়ে আসতেন। পরবর্তীতে তিনি আরও বিবাহ করেছেন। তিনি বলেন, প্রথমা স্ত্রী আমাকে উন্নত খাওয়া-দাওয়া করাত, সব সময় উৎফুল্ল রাখত আর বলত, যান, সদা আনন্দে সময় কাটান এবং অন্যান্য স্ত্রীদের জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন। তাঁর মর্তবা ছিল, বসরা নিবাসী হযরত রাবেয়া বসরী (রঃ)-এর ন্যায়।
স্ত্রীলোকের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে, স্বামীর সম্মতি না জেনে তার সম্পদে কিছুমাত্র এদিক সেদিক করবে না। রাসূলে আকরাম (ছঃ)-এর নির্দেশ হচ্ছে, স্ত্রীলোক স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাউকে কিছু খাওয়াবে না। হাঁ, কোন খাদ্যবস্তু বিনষ্ট হয়ে যাবে এ আশঙ্কা দেখা দিলে তা ভিন্ন কথা। স্বামীর অনুমতি নিয়ে কোন অভাবীকে অন্ন দান করলে সে স্বামীর সমপরিমাণ নেকী পাবে। পক্ষান্তরে বিনা অনুমতিতে এরূপ করলে সে গুনাহগার আর স্বামীর আমলনামায় নেকী লিপিবদ্ধ হবে।
কন্যার প্রতি মা-বাবার কর্তব্য হচ্ছে, মা-বাবা তাদের প্রতিটি কন্যা সন্তানকে পূর্বাহ্নেই শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে। উন্নত আচার-ব্যবহার ও সুন্দর আচরণনীতি, স্বামীর সাথে সংসার করার সুন্দর নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষা দেবে।
বর্ণিত আছে, হযরত ওসামা বিনতে খারেজা ফায়ারী (রাঃ) তাঁর কন্যাকে স্বামীর ঘরে যাওয়ার সময় উপদেশ দিয়েছিলেন, এতদিন তুমি পাখির বাসার ন্যায় একটি ক্ষুদ্র পরিসরে থেকেছ, এখন তুমি একটি অপরিচিত প্রশস্ত পরিবেশে যাচ্ছ। যেখানে তোমাকে এমন এক শয্যা গ্রহণ করতে হবে যে সম্পর্কে তোমার কোনই ধারণা নেই। এমন সাথীকে আপন করে নিতে হবে যার সাথে পূর্বে কোন সম্পর্ক ছিল না। সুতরাং তুমি তার জন্য যমীন হয়ে যাও, সে তোমার জন্য আকাশের মত উদার হবে। তুমি তার জন্য বিছানা হয়ে যাও, সে তোমার জন্য সুদৃঢ় স্তম্ভ হবে। তুমি তার বাঁদী হলে সে তোমার গোলাম হবে। কোন কাজে বা কথায় তাকে খোঁচা দিও না বা অতিরঞ্জন করো না, তাহলে সে তোমাকে সরিয়ে দিবে। তুমি তাকে দূরে রেখো না, তাহলে সেও তোমাকে দূর করে দিবে। সে তোমার নিকটবর্তী হলে তুমি তার আরো নিকটবর্তী হও। সে তোমাকে পরিহার করে চললে তুমি তার থেকে সরে পড়। সর্বদা লক্ষ্য রাখবে, সে যেন সব সময় তোমা থেকে ভালো কথা শুনে, ভালো দেখে, ভালো আঁচ করে।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত এক হাদীসে আছে, হযরত মায়মুনা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর অনুমতি না নিয়ে বাঁদী মুক্ত করে দিয়েছিলেন। নির্ধারিত দিনে তার নিকট হাজির হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বিষয়টি জানতে পেরে বললেন, 'তোমার ভাই-বোনদের যদি বাঁদীটি দান করে দিতে তবে তুমি অধিক নেকীর ভাগী হতে।'
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নসীহত করেছেন, যদি ক্ষমার দৃষ্টি রাখ তবে মহব্বত স্থায়ী হবে। আমার অসন্তোষের মুহূর্তে যদি নিশ্চুপ থাক তবে কল্যাণ হবে। ঢোলের ন্যায় আমাকে আঘাত করো না, কারণ, জানা নেই অদৃশ্যের অন্তরালে কি লুকিয়ে আছে। অধিক মাত্রায় অভিযোগ করো না, এতে ভালোবাসা হ্রাস পায়; মন তোমাকে অস্বীকার করতে পারে; মনের উপর আমার হাত নেই। অন্তঃকরণে আমি যেমন ভালোবাসা লক্ষ্য করেছি, তেমনি তাতে শত্রুতাও অবস্থান করে, তবে ভালোবাসা শত্রুতা দূর করতে সক্ষম।
0 Comments