হাদীস ব্যতীত নিজস্ব মতানুসারে কুরআনের অর্থ করার পরিণতি

        এ ব্যপারে তুমি হয়ত বলবে যে, কুরআনে পাক বুঝবার গূঢ় তত্ত্ব সম্বন্ধে পূর্বে যা বলা হয়েছে এবং পবিত্র হৃদয়বানদের জন্য যে অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে তাই এব্যাপারে যথেষ্ট। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এরশাদ করেছেন, "যে ব্যক্তি নিজের মতানুসারে কুরআনের অর্থ করে, সে যেন তার স্থান দোযখে অনুসন্ধান করে"। এই হাদীসের উপর ভিত্তি করেই যে সকল আলিম প্রকাশ্য ব্যাখ্যার সমর্থক, তারা সুফিয়ানে কিরামের ব্যাখ্যাকে দোষারোপ করে। তারা কুরআনের বাণীর বিপরীত ব্যাখ্যা করে, যা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বা অন্যান্য ছাহাবীগণ করেন নি। তারা এতদূর এগিয়ে গিয়েছে যে, সুফী মতানুসারে যে ব্যক্তি নিজ থেকে গুপ্ত ব্যাখ্যা করে সে ব্যাখ্যাকে তারা কুফরী বলে আখ্যায়িত করে। যদি এ সকল ব্যাখ্যাকারদের বাক্য সত্যি হয়, তাহলে তাদের তাফসীর মুখস্থ করা ছাড়া কুরআন বুঝার অন্য উপায় নেই। যদি তা' সত্যি না হয় তাহলে হযরত রাসূলে করীম (দঃ)এর এই বাণীর কি অর্থ আছে, যে তার মতানুসারে কুরআনে পাকের অর্থ করে, সে যেন তার স্থান দোযখে অনুসন্ধান করে। অর্থাৎ নিজের মতানুসারে ব্যাখ্যা না করে তাফসীর অনুসারেই ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। পাঠক-পাঠিকা। এই সমস্যার উত্তর জেনে নাও। যে ব্যক্তি এরূপ ধারণা করে যে, প্রকাশ্য অর্থ ব্যতীত কুরআনে পাকের অন্য কোন অর্থ নেই, সে নিজের সীমিত জ্ঞানের বিষয় জানিয়ে দেয় এবং নিজের অবস্থার বিষয় সত্য বলে। কিন্তু সমস্ত লোককে তার নিজস্ব সীমায় ও স্থানে আনার জন্য যা বলা হয় তাতে সে নিশ্চয়ই ভুল করে; বরং হাদীস এবং জ্ঞানীদের বাণীতে যা দেখা যায় যে, জ্ঞানী লোকদের জন্য কুরআনে পাকের অর্থ ব্যাপক ও বহুমুখী। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে কুরআনে পাকের বুঝ দিয়েছেন। যদি তা' পূর্ববর্তীদের তাফসীর ব্যতীত না হয় তাহলে সে বুঝ বা জ্ঞানের অর্থ কি? হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই কুরআনের জন্য প্রকাশ্য অর্থ, গুপ্ত অর্থ, সীমা এবং বিভিন্ন স্তর রয়েছে। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, আমি যদি ইচ্ছা করি, তবে সূরা ফাতিহার তাফসীর লিখে সত্তরটি উটকে বোঝা বহন করাতে পারি। একথার অর্থ কি? অথচ সূরা ফাতিহার প্রকাশ্য অর্থ কত সংক্ষেপ। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, কুরআনে পাকের প্রত্যেকটি আয়াতের ষাট হাজার অর্থ আছে। এর পরও যা বুঝতে বাকী থাকে তা' আরও অধিক। কোন কোন আলিম বলেছেন, কুরআনে পাকে সাতাত্তর হাজার দু'শত ইলমের সমন্বয় আছে। কেননা, প্রত্যেক বাক্যই ইলম। প্রত্যেক বাক্যের জন্য প্রকাশ্য এবং গুপ্ত অর্থ আছে এবং উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপান রয়েছে। একদা হুযুরে পাক (দঃ) বিশ বার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করেছিলেন। তার গুপ্ত অর্থ ব্যতীত আর কিসের জন্য তা' এরূপ বার বার পাঠ করা হয়েছে? অথচ বিসমিল্লাহর অর্থ প্রকাশ্য। বার বার পাঠ করার কোন দরকার করে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পূর্ববর্তীদের ও পরবর্তীদের জ্ঞান অর্জন করতে চায় সে যেন কুরআনে পাকের বিষয়ের উপর চিন্তা-ভাবনা করে। এটা শুধু বাহ্যিক তাফসীর দ্বারা হয় না। ফলকথা হল, সমস্ত জ্ঞানই আল্লাহর কার্যকলাপ, কারুকার্য ও তাঁর গুণাগুণের মধ্যে নিহিত। কুরআনে পাক আল্লাহর সত্তার কারুকার্যের এবং গুণাগুণের ব্যাখ্যা করে। সুতরাং এ সকল জ্ঞানের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। খোদ কুরআনে পাকই নিজেকে এসকল জ্ঞানের সমন্বয় বলে ইঙ্গিত দান করে; এর বিশদ ব্যাখ্যার দিকে মনযোগ দেয়া কুরআনে পাক বুঝার দিকে পথ বাতলায়; কিন্তু শুধু প্রকাশ্য ব্যাখ্যা সেদিকের পথ প্রদর্শন করে না। যে সকল কথা দর্শকদের উপর কষ্টকর হয় চাই তা' দৃষ্টির বিষয়-বস্তুতে হোক বা বুদ্ধির বিষয়-বস্তুতে হোক, তাতে মতভেদ ঘটে। কুরআনে পাকে এসকল বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত এবং ইশারা রয়েছে; এবং বিশেষ করে জ্ঞানী এবং সূধীজনেরা তা' ধরে নিতে পারে। এই অবস্থায় প্রকাশ্য শব্দের অর্থ এবং এসকল বিষয়ের অর্থ কি প্রকারে যথেষ্ট হতে পারে? একারণেই হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেনঃ কুরআন পাঠ কর এবং অজানা বিষয়ের অনুসন্ধান কর। তিনি আরও বলেছিলেন, যিনি আমাকে সত্যের সহিত নবী করে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম! আমার উম্মতগণ তাদের ধর্মের এবং জামাতের মূল নীতি সম্বন্ধে তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক দলই পথভ্রষ্টকারী, দোযখের দিকে আশ্রয়দানকারী। যখন এই অবস্থা হয় তখন তোমরা আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে। কেননা, তাতে তোমাদের পূর্ববর্তীদের এবং পরবর্তীদেরও কাহিনী রয়েছে এবং তোমাদের মধ্যে যে মতবিরোধ হয় তার সমাধান আছে। অত্যাচারীদের মধ্যে যে কুরআনে পাকের বিরোধিতা করে আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন। যে ব্যক্তি কুরআন ব্যতীত ইলম অন্বেষণ করে, আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেন। কুরআন আল্লাহর দৃঢ় রজ্জু, প্রকাশ্য আলোক এবং অতি উপকারী দাওয়াই, যে ব্যক্তি তাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে তা' তাকে রক্ষা করে। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করে তা' তাকে মুক্তি দান করে। কুরআনে পাক এমন কোন বক্র বস্তু নয় যার সোজাভাবে দণ্ডায়মান হওয়ার প্রয়োজন। একদিকে ঝুঁকানো কোন বস্তু নয় যাকে সোজা করে দেয়া আবশ্যক। কুরআনে পাকের আশ্চর্যজনক বিষয়সমূহ অখণ্ডনীয় ও অকর্তনীয়। বার বার পঠনেও কুরআনে পাক পুরাতন হয় না।

        হযরত রাসূলে করীম (দঃ) যখন ছাহাবী হোযায়ফা (রাঃ)কে মতভেদের যমানা ও তারপর বিভিন্ন দল সম্বন্ধে সংবাদ দান করলেন তখন তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি যদি সেই সময়টি পেয়ে যাই তাহলে আপনি আমাকে কি করতে বলেন? হুযুরে পাক (দঃ) জবাবে বললেন, আল্লাহর কিতাবকে শিক্ষা করবে ও তার মধ্যেই মুক্তি রয়েছে। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআনকে বুঝতে পারে, সে সমস্ত ইলমকে একত্রে বর্ণনা করে। এ কথায় কুরআনে পাক যে, সমস্ত ইলমের সমন্বয় তার ইঙ্গিত বহন করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নিম্নোক্ত আয়াত অর্থাৎ "অমান উতিয়াল হিকমাতা ফাক্বাদ উতিয়া খাইরান কাছীরা" অর্থাৎ যাকে হিকমত প্রদত্ত হয়েছে, তাকে সমস্ত কল্যাণ দান করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) উক্ত আয়াতের হিকমত শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন, কুরআনের জ্ঞান দ্বারা। আল্লাহ বলেন, আমি নবী সোলায়মানকে জ্ঞান, হিকমত এবং ইলম দিয়েছি। তাঁকে যা দান করা হয়েছে, তাকে বলা হয়েছে হিকমত এবং ইলম। তবে স্বাভাবিক যে জ্ঞান দ্বারা সোলায়মানকে বিশেষত্ব দান করা হয়েছে, তা' ইলম এবং হিকমতের পূর্বেই তাঁকে দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কুরআনের অর্থ বুঝবার জন্য যথেষ্ট স্থান আছে এবং এর অর্থ ব্যাপক।

        কুরআনে পাকের প্রকাশ্য অর্থ সম্বন্ধে যে সমস্ত হাদীস রয়েছে তারও সংখ্যা অনেক। হুযুরে পাক (দঃ) এর এ বাণীটি যথাঃ "যে তার নিজের মতানুসারে কুরআনের ব্যাখ্যা করে. এতে তিনি নিজের মতানুসারে কুরআনের ব্যাখ্যা করতে নিষেধ করেছেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেছেন, যদি আমি কুরআনের ব্যাখ্যা করি, তবে কোন জগত আমাকে আশ্রয় দেবে এবং কোন আসমান আমাকে ছায়া দান করবে? নিজের মতানুসারে কুরআনের ব্যাখ্যা করা সঙ্গত নয় বলেই এরূপ বহু হাদীস এবং বিজ্ঞজনের বাণী রয়েছে। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমতঃ এর উদ্দেশ্য হাদীস ও তাফসীরে তা' সীমাবদ্ধতা করা, নূতন অর্থ উদ্ঘাটন না করা কিংবা স্বাধীন চিন্তা বর্জন করা কিংবা এর উদ্দেশ্য অন্য ব্যাপার। যদি এর উদ্দেশ্য এরূপ হয়ে থাকে যে কোন ব্যক্তি যা' তাফসীরে দেখে, তাছাড়া কুরআনে পাকের সে অন্য অর্থ করতে পারবে না। তা হলে এই কথা নিম্নলিখিত কারণে বাতিল। কারণগুলো ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করছি।

        প্রথম কারণঃ একটি শর্ত এরূপ করা হয় যে, তাফসীর শুধু হযরত রাসূলে করীম (দঃ) থেকে শ্রবণ করা ও তাঁর প্রতি আরোপ করা অত্যাবশ্যক এবং এই শর্ত কুরআনে পাকের অন্যান্য অংশ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তবে এ শর্ত গ্রহণযোগ্য হলে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর তাফসীর মেনে নেয়া চলবে না; বরং বলা যাবে যে, তাঁরা নিজেদের মতানুসারে ঐসব বলেছেন। তাঁরা তা' হযরত রাসূলে করীম (দঃ) থেকে শুনেন নি। অন্যান্য ছাহাবীদের সম্পর্কেও এরূপ ধারণা করা যায়। এই তর্ক অনর্থক-অশুদ্ধ।

        দ্বিতীয় কারণঃ কোন কোন আয়াতের তাফসীর সম্বন্ধে ছাহাবী এবং তাফসীরকারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাঁরা সে সম্বন্ধে বিভিন্নি মতবাদের কথা উল্লেখ করছেন। তাঁদের একমত হওয়া সম্ভব হয় নি এবং সকলেই হুযুরে পাক (দঃ) থেকে শুনে তাফসীর করেন নি। যদি কোন কথা হুযুরে পাক (দঃ) থেকে শুনে বলে থাকেন, তাহলে তাঁদের বাকী কথাগুলো অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া সরাসরি ভাবে জানা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক ব্যাখ্যাকার তাঁদের নিজেদের বুদ্ধি জ্ঞান দ্বারা অনেক অর্থ বের করেছেন। এমনকি অনেক সূরার প্রারম্ভে যে সকল সংক্ষিপ্ত কালাম আছে, তাঁরা তার সাতটি বিভিন্ন অর্থ করেছেন।

        কেউ বলেছেন যে, আলিফ, লাম, মীম--এ অক্ষরত্রয় "আররাহমান" শব্দের অক্ষরসমূহের অন্তর্গত। কেউ বলেছেন, আলিফের অর্থ আল্লাহ, লামের অর্থ লাতীফ অর্থাৎ করুণাময় এবং মীমের অর্থ হামীম অর্থাৎ দয়ালু। অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণ এ সকল অক্ষরের অন্যান্য ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন, যে সকল ব্যাখ্যার সমন্বয় করা সম্ভব নয়; সুতরাং এ সবই কিরূপে হুযুরে পাক (দঃ) থেকে শুনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলা যায়?

        তৃতীয় কারণঃ হযরত রাসূলে করীম (দঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ক্ষেত্রে দোয়া করে বললেন, হে মাবুদ! তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান কর এবং অর্থ শিখাও। যদি অর্থ অবতীর্ণ আয়াতের ন্যায় শুধু হাদীস থেকে আসত এবং তদ্রূপ রক্ষিত হত, তাহলে তাঁর বিশেষ দোয়ার কি অর্থ থাকত?

        চতুর্থ কারণঃ আল্লাহ বলেন, "যারা তাদের নিকট হতে তা' জ্ঞানের দ্বারা বের করে, তারা নিশ্চয় জানে"। এ আয়াতে আলিম লোকদের জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা অর্থ আবিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। প্রকাশ্য অর্থ আবিষ্কার করা শ্রুত অর্থ থেকে পৃথক। মোট কথা কুরআনে পাকের অর্থ সম্বন্ধে যে সব হাদীস প্রদর্শন করেছি, তা' এ মতের পরিপন্থী, এতে বুঝা যাচ্ছে যে, সমস্ত অর্থের মধ্যে তাফসীরের শর্ত লাগানো অশুদ্ধ বরং প্রত্যেকের জন্য তার বুঝের সীমা অনুসারে কুরআনের অর্থ উদ্ঘাটন করা সিদ্ধ।

        কুরআনে পাকে নিজের মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করার নিষেধের দুটি কারণ রয়েছে। তার একটি হল, প্রত্যেক ব্যাপারে মানুষের একটি মত থাকে। আর স্বাভাবিক ভাবেই সেই মতকেই সে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ কারণেই কুরআনের ব্যাখ্যাও সে নিজের মত ও ধারণা অনুসারে করে। কেননা তাতে তার নিজের উদ্দেশ্য সফল হয়। তার এই মত এবং খাহেশের অনুপস্থিতিতে কুরআনের এই অর্থ তার জানার সুযোগ হত না। এই ব্যাপার কখনও কখনও মানুষের সজ্ঞানেও ঘটে, যেমন কেউ কেউ নিজের বেদয়াতকে শুদ্ধ এবং সিদ্ধ করার জন্য কুরআনের আয়াতের প্রমাণ পেশ করে। যদিও তার জানা থাকে যে, উক্ত আয়াতের অর্থ তা' নয়। এ ভাবে সে বিপক্ষকে প্রতারণা করে। আবার কখনও কখনও সে ঐ আয়াতের উক্তরূপ অর্থ অজ্ঞানতা বশতঃও করে। আয়াতটি একাধিক অর্থবোধক হলে সে এমন অর্থ করে করে, যা তার স্বার্থ সিদ্ধির পক্ষে অনুকূল হয়। এটাও নিজের ভ্রান্ত মতদ্বারা অর্থ করার নামান্তর। সুতর সুতরাং যে নিজের মতানুসারে ব্যাখ্যা করে, সে তার মতানুযায়ী তার উদ্দেশ্যের দিকে অর্থ ঘুরিয়ে য়ে নেয়। অনেক সময় সে তার উদ্দেশ্য ঠিক রেখে কুরআন থেকে প্রমাণ তালাশ করে এবং কুর কুরআনে নিজের জানার বিষয়ের দ্বারাই তার প্রমাণ দেয়। যদিও তার এবিষয়টি জানা আছে যে, সংশ্লিষ্ট আয়াতের উদ্দেশ্য তা' নয়। যেমন কোন ব্যক্তি রাত্রে লোকদেরকে যিকির করার জন্য থাকে এবং তা' প্রমাণ করার জন্য "তাযহাকু ফাইন্না ফিস সুচুরি বারাকাতুন" এ হাদীসটি বলে পেশ করে। তাযহাকুর অর্থ শেষরাতে খানা খাওয়া এটা তার জানা আছে। অথচ সে তার অর্থ করে যিকির।

        আর একটি উদাহরণ হল, কুরআনে পাকে আয়াত আছেঃ "ইযহাব ইলা ফিরআউনা ইন্নাহু ত্বাগা" অর্থাৎ ফিরাউনের নিকট যাও। কেননা সে খোদাদ্রোহী। অথচ সে ফিরআউনের অর্থ করে দিল। অর্থাৎ সে বলে যে, কঠিন মনকে ফিরআউন বলা হয়েছে। তার মতানুসারেই এরূপ অর্থ করা হয়। এই ধরনের অর্থ কোন কোন বক্তা তার বক্তৃতার মধ্যে সৎ উদ্দেশ্যেই বাক্যালংকার হিসাবেও গ্রহণ করে থাকে। যাতে করে শ্রোতাদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ কাজ নিষিদ্ধ। ব্যর্থ দল অনেক সময় এরূপ অর্থ লোকদেরকে প্রবঞ্চনা করার লক্ষ্যে বা তাদের নিজ দলভুক্ত করার উদ্দেশ্যে নিজেদের মতানুসারে করে থাকে। তাদের মাযহাব তাদের জ্ঞান মতেই ব্যর্থ বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই নিজেদের মতানুসারে ব্যাখ্যা করার নিষেধের এ একটি কারণ। এই প্রকার মতের অর্থ ভ্রান্ত মত যা ইজতেহাদ ব্যতীত নিজেদের খামখেয়ালী অনুসরণ করে। জেনে রাখবে, মত শুদ্ধ বা অশুদ্ধ যাই হোকনা কেন খেয়ালের অনুসরণ করলে তা' কস্মিনকালে গ্রহণীয় নয়।

         দ্বিতীয় কারণঃ হাদীস ও তাফসীর ব্যতীত প্রকাশ্য আরবী ভাষা অনুসারে কুরআনে পাকের ঐ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করা যা অবোধ্য, সংক্ষিপ্ত, উহ্য যা শব্দের ভিতরে নিহিত, যা পূর্বে কিংবা পরে হবে। যে ব্যক্তি প্রকাশ্য অর্থে পারদর্শী নয় এবং শুধু প্রকাশ্য আরবী শব্দের অর্থ বুঝে নিয়ে কুরআনের আয়াতের অর্থ জ্ঞান বুদ্ধির মাধ্যমে উদ্ঘাটন করে তার বহু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে। উপরোক্ত লোকগণ যারা নিজেদের মতানুসারে অর্থ করে তাদেরই দলভুক্ত। প্রথমে প্রকাশ্য অর্থের জন্য হাদীস এবং তাফসীরের আবশ্যক হয়, যেন স্থানে স্থানে ভুল-ভ্রান্তি না ঘটে। তারপর জ্ঞান-বুদ্ধি প্রসারের সাথে সাথে বুদ্ধির দ্বারা অর্থ বের হয়। তাফসীর ব্যতীত অর্থ বুঝা যায় না এরূপ অবোধ্য শব্দের সংখ্যা অনেক রয়েছে। তন্মধ্যে আমি কিছু কিছু শব্দের ইঙ্গিত দিচ্ছি যেন তার দ্বারা অন্যান্য শব্দের অবস্থাও পরিষ্কার হয়ে যায় এবং এ কথাও জানা যায় যে, প্রথমে প্রকাশ্য অর্থে পারদর্শী না হয়ে গুপ্ত অর্থের দিকে লালায়িত হওয়া সঙ্গত নয়। আসলে প্রকাশ্য অর্থে পারদর্শী না হয়ে কুরআনে পাকের গুপ্ততত্ত্ব উপলব্ধি করার দাবী করা ঐ ব্যক্তির দাবীর ন্যায়, যে দরজা অতিক্রম না করে গৃহের মাঝখানে পৌঁছার দাবী করে। অথবা যে তুর্কী ভাষা না জেনে তুর্কীদের কথা শুনেই তাদের মনের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলতে পারে বলে দাবী করে। প্রকাশ্য তাফসীর জানা ভাষা শিক্ষারই অনুরূপ। বুঝবার জন্য তা' অত্যাবশ্যক। তাফসীর থেকে যে সকল আবশ্যকীয় জিনিস জানা যায় তা' অনেক। তাতে উহোর এবং অন্তর্নিহিত অর্থের ব্যাখ্যা থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, "ওয়া আতাইনা ছামুদান নাকাতা মুবছিরাতান। ফাজালাম্ বিহা" অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, আমরা ছামুদ জাতির জন্য উটনীকে প্রকাশ্য প্রমাণ দিয়েছিলাম। তারা তদ্দ্বারা অত্যাচার করল। এখানে আয়াত শব্দ উহ্য রয়েছে। তারা তা' হত্যা করে নিজেদের আত্মাকে অত্যাচার করেছিল। প্রকাশ্য আরবী শব্দের দিকে যার লক্ষ্য সে এরূপ অর্থ করবে যে, উটনীটির দৃষ্টিশক্তি ছিল। ওটা অন্ধ ছিল না। সে জানে না কি বস্তুর দ্বারা তারা অত্যাচার করেছে। বা কার উপর অত্যাচার করছে। নিজের উপর না কি অন্যের উপর? আল্লাহ বলেন, "ওয়া উশরিবু ফী কুলুবিহিমুল ইজলা বিকুফরিহিম" অর্থাৎ তাদের কুফরীর জন্য তাদের দিলকে গরুর মাংস পান করানো হয়েছিল। অর্থাৎ তারা কুফরীর জন্য গোবৎস পূজা প্রিয় মনে করেছে। এখানে সেই প্রিয় মনে করাকে উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, "ইযান লা আযাকনাকা দ্বি'ফাল হাইয়্যাতি অদ্বি'ফাল মামাত" অর্থাৎ তখন আমি তোমাকে জীবনের কঠোরতা ও মৃত্যুর কঠোরতার স্বাদ দিয়েছিলাম। অর্থাৎ জীবিত লোকের শাস্তির কঠোরতা ও মৃত লোকের শাস্তির কঠোরতা প্রদান করেছিলাম। এখানে শাস্তি উহ্য রাখা হয়েছে এবং জীবন ও মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে জীবন ও মৃত্যুর পরিবর্তন করা হয়েছে। মনে রাখবে, এর প্রত্যেকটিই ভাষার সৌন্দর্যের দিক থেকে সংগত। আল্লাহ বলেন, "ওয়া আসআলিল কারইয়াতাল্লাতী কুন্না ফিহা ওয়াল ঈরাল্লাতী আকুবালনা ফীহা"। অর্থাৎ আমরা যে শহরে ছিলাম এবং পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম সেই শহর ও পাহাড়কে জিজ্ঞেস কর অর্থাৎ শহরবাসীকে ও পর্বতবাসীকে জিজ্ঞেস কর। এখানে অধিবাসী শব্দ উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, "ছাকুলাত ফিসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি"। অর্থাৎ দুনিয়া ও আসমানের ভিতর উহা ভারী হয়েছে (অর্থাৎ গুপ্ত করা হয়েছে)। মূল অর্থ হল দুনিয়া ও আসমানবাসীদের জন্য তা' গুপ্ত করা হয়েছে। কোন জিনিস গুপ্ত হলে তা' ভারী হয়ে থাকে; সুতরাং এর দ্বারা শব্দ পরিবর্তিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ওয়াতাজ্বআলুনা রিযকাকুম ইন্নাকুম তুকাষযিবুন' অর্থাৎ তোমাদের জীবিকাকে তোমরা এমন কর যেন তোমরা মিথ্যা কথ্য বল। এর আসল অর্থ হল, তোমাদের রিযিকের জন্য তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আল্লাহ বলেন, "আতিনা মা ওয়াতানা আলা রুসুলিকা" অর্থাৎ তোমরা রাসূলদের মাধ্যমে আমাদেরকে যা ওয়াদা করেছিলে তা' আমাদেরকে দান কর। এর মূল অর্থ হল, তোমার রাসূলদের রসনার মারফতে যা ওয়াদা করেছিলে তা' আমাদেরকে দাও। এখানে রসনা শব্দকে উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, "ইন্না আনযালনাহু ফী লাইলাতিল কাদরি” অর্থাৎ আমি তাকে (অর্থাৎ কুরআনকে) কদরের রাত্রে নাযিল করেছি। এখানে কুরআন শব্দটি উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, 'হাত্তা তাসাওয়ারাত বিল হিজাবি' অর্থাৎ যে পর্যন্ত তা' পর্দার দ্বারা আবৃত না হয়েছে। এখানে তার অর্থ সূর্যকে উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, তাঁকে ব্যতীত অন্যান্যকে যারা বন্ধুরূপে গ্রহণ করে (তারা বলে) আমরা তাদের পূজা করি যেন তারা আল্লাহর নিকট পৌঁছে দেয়ার উসিলা হয়। এখানে "তারা বলে" কথাটি উহ্য রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, "ফামা লি হাউলায়িল কাউমি লা ইয়াকাদুনা ইয়াফকাহুনা হাদীছা মা আছাবাকা মিন হাসানাতিন ফামিনাল্লাহি অমা আছাবাকা মিন সাইয়্যিয়াতিন ফামিন নাফিছিকা" অর্থাৎ এসব লোকের কি হবে? তারা অল্পই বুঝ রাখে। যে সকল মঙ্গল তোমার নিকট আসে তা' আল্লাহর তরফ থেকে আসে। এর অর্থ তারা এই কথা বুঝে না। তারা বলে, যে সকল মঙ্গল তোমার নিকট আসে তা' আল্লাহর তরফ থেকে আসে ইত্যাদি। যদি তিনি এরূপ ইচ্ছা না করেন তা' এ আয়াতের পরিপন্থী হয়। আল্লাহ বলেন, "কুল কুলুম মিন ইন্দিল্লাহি অর্থাৎ বল, সবই আল্লাহর নিকট থেকে আসে। এর জন্য কাদরিয়া নামক একটি দল বের হয়েছে, যারা এর বিপরীত অর্থ করে। আল্লাহ বলেন, ওয়া ভূরি সীনীনা অর্থাৎ ত্বরে সীনীন পর্বতের কসম। আল্লাহ বলেন, সালামুন আলা ইল-ইয়াসীন অর্থাৎ ইলইয়াসীনের উপর সালাম। যার মূল অর্থ ইলইয়াসের উপর সালাম। কেউ কেউ বলে যে, ইদ্রীসের উপর সালাম। কেননা, হযরত ইবনে মাসউদের শব্দে ইদ ইয়াসিনের উপর সালাম বলা হয়েছে। আবার কখনও কখনও বাহ্যতঃ বাক্যকে কর্তন করে ফেলে এরূপ শব্দও বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, "ওয়ামা ইয়াত্তাবিউল্লাযীন। ইয়াদ উন্য মিন দূনিল্লাহি শুরাকায়া ইয়্যান্ডাবিউন। ইল্লাজ্জান্না" অর্থাৎ যারা আল্লাহ ব্যতীত অংশীদারদের নিকট প্রার্থনা করে, তারা ধারণা ব্যতীত আর কিছুরই অনুসরণ করে না। আল্লাহ বলেন, "জ্বালাল মালায়ুল্লাযীনাস্তাকবারু মিন কাউমিহিল্লাযীনাসতুম্বইফু লিমান আমানা মিনহুম”। অর্থাৎ তার কাওমের ভিতর যে সকল অহঙ্কারী তারা দুর্বল ঈনদারদেরকে বলল, এর মূল অর্থ হল, দুর্বলদের ভিতর যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে অহঙ্কারীগণ বলল, এর ভিতরে অগ্র-পশ্চাত শব্দ রয়েছে একারণেই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আল্লাহ বলেন, "অ লাওলা কালিমাতুন সাবাক্বাত মিররাব্বিকা লাকানা লিযামাও অ আজালুম মুসাম্মা। অর্থাৎ যদি তোমার প্রভু হতে বাণী এবং নির্দেশের সময় পূর্বেই না আসত, তা হলে তা' নিশ্চয়ই চিরস্থায়ী হত। নির্দিষ্ট সময় পরে এসেছে। কিন্তু তার অর্থ হবে বাণীর সহিত। এরশাদ হয়েছে, "অ ইয়াসয়ালুনাকা কাআন্নাকা হাফিয়্যান আনহা" অর্থাৎ তারা সেই সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, যেন তুমি তা' থেকে মুক্ত। "সেই সম্বন্ধে" কথা পরে রয়েছে। এরশাদ হয়েছেঃ "লাহুম মাগফিরাতুও অ রিযকুন কারীম" অর্থাৎ তাদের জন্য ক্ষমা এবং উত্তম রিযিক আছে। যেরূপ তোমার প্রভু তোমাকে সত্যের সহিত তোমার গৃহ হতে বহির্গত করেছেন। এই শেষের বাক্যের সহিত প্রথম বাক্যের সম্পর্ক নেই। তা' পূর্ববর্তী বাক্যের সংশ্রবে পড়তে হবে। তা হল, বল "যুদ্ধসম্ভার আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (দঃ) এর জন্য। কেননা তোমার প্রভু তোমাকে সত্যের সহিত তোমার গৃহ হতে বের করেছেন"। অর্থাৎ গনিমতের সম্ভার তোমার জন্য হালাল করা হয়েছে। কেননা তোমার বহির্গমনে তুমি সম্মত ছিলে। যদিও তা' তাদের ইচ্ছার বিপরীত ছিল। এরশাদ হয়েছেঃ "দ্বারাবাল্লাহু মাছালান আবদাম মামলুকান লা ইয়াকুদিরু আলা শাইয়িন।" অর্থাৎ আল্লাহ একজনের কতত্বাধীনে গোলামের তুলনা করেছেন। তার কোন জিনিসের উপর ক্ষমতা নেই। এর দ্বারা তিনি ধন-সম্পদের ব্যয় সম্বন্ধে বলতে ইচ্ছে করেছেন। এরশাদ হয়েছে। "দ্বারাবাল্লাহু মাছালার রাজুলাইনি আহাদুহুমা আবকামু লা ইয়াকুদিরু আলা শাইয়িন" অর্থাৎ আল্লাহ দুজন লোকের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একজন মূক কোন জিনিসের উপর ক্ষমতা রাখে না। অর্থাৎ সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশ দানে অপারগ। এরশাদ হয়েছে। "ফাইনিত্তাবাআনী ফালা তাসআলনী আন শাইয়িন" অর্থাৎ যদি তুমি আমার অনুসরণ কর, আমাকে কোন কিছুর বিষয় জিজ্ঞেস করো না। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার গুণাগুণের বিষয় জিজ্ঞেস করতে বিরত থাক। তা' এমন ইলম যার সম্বন্ধে প্রশ্ন করা যায় না। যে পর্যন্ত না আরেফ অর্থাৎ খোদাতত্ত্ব প্রাপ্ত লোক তার প্রকৃত তত্ত্বের বিষয় প্রথমে না বলে। এরশাদ হয়েছে, "আম খুলিকু মিন দ্বাইরি শাইয়িন আম হুমুল খালিকুন" অর্থাৎ তারা কি কোন জিনিস (সৃষ্টিকর্তা) ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? অথবা তারাই কি সৃষ্টিকারী?

        'ক্বারীন' শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে ফিরেশতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা এরশাদ হয়েছে। "অক্কালা ক্বারীনুহু হাযা মা পাদাইয়্যা আতিদ"। অর্থাৎ তার সঙ্গী ন্যস্ত করা ফিরেশতা) বলল, আমার নিকট সে বিদ্রোহী। নিম্নোক্ত আয়াতে শব্দটি শয়তানের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা এরশাদ হয়েছে। ওয়াক্বালা ক্বারীনুহু রাব্বানা আত্বম্বাইতুহু। অর্থাৎ তার সঙ্গী (শয়তান) বলল, হে আমাদের প্রভু! আমি তাকে পথভ্রষ্ট করিনি। এভাবে উন্মত শব্দটি আট প্রকার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন 
        (১) একদল লোকের অর্থে এরশাদ হয়েছে, যথাঃ অজাদা আলাইহি উন্মাতাম মিনান্নাসি ইয়াসকুন। অর্থাৎ তিনি একদল লোককে পানি পান করাতে দেখলেন।
        
         (২) নবীদের অনুসরণকারী দলের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা এরশাদ হয়েছে; "নাহনু মিন উম্মাতি মুহাম্মাদিন" অর্থাৎ আমরা হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। 

        (৩) সকল গুণের অধিকারীর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাঃ এরশাদ হয়েছে, "ইন্না ইব্রাহীমা কানা উন্মাতান কানিত্বাল লিল্লাহি”। অর্থাৎ নিশ্চয়ই হযরত ইব্রাহীম সকল গুণের অধিকারী আল্লাহর বাধ্যগত ছিলেন।

         (৪) দ্বীনের একদলের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাঃ এরশাদ হয়েছেঃ "ইন্না ওয়াজাদনা আবাআনা আলা উম্মাতিন" অর্থাৎ নিশ্চয় আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক উম্মতরূপে দেখেছি।

         (৫) কোন নির্দিষ্ট যুগের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাঃ এরশাদ হয়েছেঃ ইলা উম্মাতিন মা'দূদাতিন। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট যুগ পর্যন্ত। 

        (৬) আকৃতির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়ঃ ফলানুন হাসানুলউম্মাতি অর্থাৎ অমুকের সুন্দর গঠন। 

        (৭) দীনের ভিতর এক ব্যক্তি যে তার মধ্যে শিরক করে নি এমন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হুযুরে পাক এরশাদ করেছেন, "যায়েদ বিন আমর বিন তোফায়েল নিজেই এক উম্মত রূপে উত্থিত হবে"। 

        (৮) মাতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, "হাযা উম্মাতু যায়িদিন"। অর্থাৎ এ যায়েদের মাতা।

        এভাবে রূহ শব্দটিও বিভিন্ন অর্থে কুরআনে এসেছে। তার বিবরণ সুদীর্ঘ হবে। এভাবে শব্দ ও অক্ষরের ভিতর অনির্দিষ্ট অর্থ থাকে। যথাঃ এরশাদ হয়েছেঃ "ফা আছারনা বিহী নাকুআন"। অর্থাৎ তদ্বারা তারা ধূলি উড়িয়ে যায়। এখানে "হে" অক্ষর বা শব্দটি গর্তের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তারা (অশ্বগুলো) গর্তপূর্ণ মাঠের উপর দৌড়ে যাওয়ার ফলে ধূলা বালি উত্থিত হয়। আবার এরশাদ হয়েছেঃ "ফাওয়াসাত্বনা বিহী জাম'আন" অর্থাৎ তারা এভাবে দলমধ্যে প্রবিষ্ট হয়। এখানে হে' শব্দটি আক্রমণের বদলে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ অশ্বগুলো কাফিরদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য তাদের গৃহে প্রবেশ করে।

         কুরআনে পাকে কখনও কখনও একই বিষয় ক্রমান্বয়ে বলা হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছেঃ রমজান মাসের ভিতরে কুরআন নাযিল হয়েছিল। এতে এ বিষয়ে প্রকাশ পায় না যে, কখন তা' নাযিল হয়েছিল। রাত্রে কি দিনে। তারপর এরশাদ হয়েছেঃ আমি কুরআনকে এক মুবারক রাত্রে নাযিল করেছি। এই আয়াত দ্বারা রাত্রে নাযিল হওয়া পরিষ্কার হয়ে গেছে। যা উপরোক্ত আয়াতে হয় নি। তারপর এরশাদ হয়েছেঃ আমি একে কদরের রাত্রে নাযিল করেছি। বাহ্যতঃ এ সকল আয়াত পরস্পর বিরোধী বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে তা' নয়। মোটকথা হাদীস ও তাফসীর ব্যতীত অন্য কোন কথা এর জন্য যথেষ্ট নয়। কুরআন শরীফ প্রথম থেকেই কথায় ভরপুর। এজন্যই কুরআনে পাক আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। শেষপর্যন্ত এ সকল কথ সংক্ষেপ, দীর্ঘ বা বিস্তারিত, 5. গুপ্ত, উহা, বদ বদল বা পরির্বতন, অগ্র ও পশ্চাত আরবী ভাষায় আছে। সুতরাং তা' কুরআনে পাকের মধ্যেও রয়েছে। যেন তা' মানুষের জন্য সহ সহজবোধ্য হয় এবং এঁকেই যথেষ্ট মনেণক নিকট একে মু'জেজা বলে মনে হয়। যে ব্যক্তি আরবী ভাষার প্রকাশ্য অর্থকো মনে করে, কুরআনের তাফসীরে তাড়াহুড়ো করতে যায় এবং এসকল বিষয় তাফসীরের সাহায্য গ্রহণ করে না সে ঐ দলের শামিল যারা নিজেদের ব্যাখ্যা করে। যেমন উম্মত শব্দের সুবিদিত ও সুস্পষ্ট অর্থই সে বুঝে হাদীস ও সারে কুরআনের এবং তার মতি-গতি তার প্রতিই অনুরক্ত হয়। যখন সে ব্যক্তি তার অন্য অর্থ শুনে সে তা' গ্রহণ না করে তি ও যা শ্রবণ করেছে তার দিকেই ধাবিত হয় এবং হাদীসের অনুসরণ অনেক ক্ষেত্রেই ত্যাগ করে; এবং পরিশ্রম সহকারে তার অর্থের অনুসন্ধান করে না। যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তা' হওয়ার অবস্থা প্রাপ্ত হয়। কুরআনের উক্ত অর্থ বুঝার অবস্থা সৃষ্টি হয় না প্রকার ব্যাপার তাফসীর থেকে জানা যাবে তখন প্রকাশ নিষিদ্ধ না। ফলকথা যখন এই কাশ্য শব্দের অর্থ জানা যাবে। তবে অর্থের প্রকৃত এবং গূঢ় তত্ত্ব বুঝার জন্য শুধু তাফসীর পড়া বা জানাই যথেষ্ট তত্ত্ব এবং প্রকাশ্য অর্থের পার্থকা কখনও কখনও দৃষ্টান্ত দ্বারা উপ নয়। অর্থের প্রকৃত গূঢ় উপলব্ধি করা যায়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন। ওয়ামা রামাইতা ইয রামাইতা ওয়ালাবি লাকিন্নাল্লাহা রামা। অর্থাৎ যখন তুমি তীর নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি তীর নিক্ষেপ করোনি কিন্তু আল্লাহ তায়ালাই তীর নিক্ষেপ অপ্রকাশ্য। । কেননা করেছিলেন। আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ স্পষ্ট কিন্তু এর প্রকৃত তত্ত্ব বা তাৎপর্য অগ্র এতে তীর নিক্ষেপ করা ও না করা উভয়ই রয়েছে। বাহ্যতঃ এর অর্থ পরস্পর বিরোধী। যে পর্যন্ত না এটা বুঝা যাবে যে, কোন কারণের জন্য তীর নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং কোন কারণের জন্য নিক্ষেপ করা হয় নি, তখন পর্যন্ত প্রকাশ্য অর্থ পরস্পর বিরোধী থাকবে। যে কারণে বলা হয় তুমি তীর নিক্ষেপ করোনি, নিক্ষেপ করেছেন আল্লাহ। এরশাদ হয়েছেঃ ক্বাতিলুহুম ইয়ুআযযিবুহুমুল্লাহু বিআইদিকুম। অর্থাৎ তাদের সাথে যুদ্ধ কর, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের হস্ত দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দিবেন। যখন মুসলানগণই যুদ্ধ করে তখন কিরূপে বলা যায়, আল্লাহ শাস্তি দান করেন? যদি আল্লাহ তায়ালাই তাঁর হস্ত নাড়াচাড়া করে শাস্তি দান করেন তাহলে মুসলমানদেরকে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? এর প্রকৃত তত্ত্ব ইলমে মুকাশাফাহ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র থেকে জানতে পারা যায়। বাহ্যিক অর্থ-এরূপ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তবে তা' জানার পন্থা এইঃ প্রথমে জেনে নাও মানুষের আমল তার শক্তির সাথে আবদ্ধ এবং সেই শক্তি আল্লাহর শক্তির সাথে বাঁধা। এভাবে সূক্ষ ব্যাপার সমূহে পরিষ্কার হওয়ার পর তা' প্রকাশ পাবে। আল্লাহ পাকের একথা সত্য, যখন তুমি তীর নিক্ষেপ করেছ (মূলতঃ) তুমি তীর নিক্ষেপ করোনি আল্লাহই নিক্ষেপ করেছেন। হে পাঠক! যদি সমস্ত জীবন উপরোক্ত বাক্যের গূঢ় তত্ত্ব জানার জন্য এবং এর প্রাথমিক সাজ সরঞ্জামের বন্ধনাদি জানার জন্য ব্যয় কর, তবু তার সকল বিষয় জানার পূর্বেই তোমার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। কুরআনে পাকের কোন বাক্য এরূপ নেই যার প্রকৃত তত্ত্ব অত্র আয়াতের গূঢ় তত্ত্বের সাথে জড়িত নয়। যারা এর গুপ্ত তত্ত্বের ইলমে যত বেশী পারদর্শী, যাদের স্বাভাবিক জ্ঞান যত দৃঢ় প্রতিষ্ঠ, যাদের দিল যত পরিষ্কার যারা চিন্তার আসক্তিতে যত বেশী মগ্ন, অনুসন্ধানে যাদের যত বেশী খালেছ নিয়ত, তত বেশী তা' তাদের নিকট প্রকাশ পায়। প্রত্যেক উম্মতের সীমার সোপানের উপর পরবর্তী উচ্চতর সোপান রয়েছে। সবগুলো সোপান একত্রে অতিক্রম করা সম্ভবপর ন নয়। যদি সমস্ত সমুদ্র কালি হয়ে যেত এবং সমস্ত বৃক্ষ কলম বনে যেত, তবু আল্লাহর কালামের গূঢ় তত্ত্ব লিখে শেষ করা যেত না; বরং আল্লাহর গুণাগুণ লিখার পূর্বেই কালি শেষ হয়ে যেত। এজন্যই গূঢ় তত্ত্ব বুঝার ক্ষেত্রে লোক মতভেদ করে ফেলে। যদিও তারা কুরআন পার্কের প্রকাশ্য অর্থ জানে। গুপ্ত তত্ত্ব জানা ও বুঝার জন্য তাফসীর যথেষ্ট নয়। দিলওয়ালাদের গুপ্ত তত্ত্ব বুঝার দৃষ্টান্ত হুযুরে পাক (দঃ) এর সিজদাহর দোয়া থেকে অনুধাবন করা যায়। তা' এই যে, হে মাবুদ। তোমার অসন্তুষ্টি হতে তোমার সন্তুষ্টির দিকে আশ্রয় চাচ্ছি। তোমা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। তোমার প্রশংসা করার সাধ্য আমার নেই। তুমি যেরূপ তোমার প্রশংসা করেছ তুমি ঠিক তদ্রূপ। আল্লাহ বলেন, "ওয়াসজুদ ওয়াকৃতারিব" অর্থাৎ সিজদাহ দাও এবং নৈকট্য অর্জন কর। হুযুরে পাক (দঃ) নিজে সিজদাহ দিয়ে নৈকট্য লাভ করেছেন। তিনি আল্লাহর বিভিন্ন গুণের দিকে লক্ষ্য করে তাঁর এক গুণ দ্বারা তাঁর অন্য গুণ থেকে তাঁরই নিকট আশ্রয় চেয়েছেন। অর্থাৎ সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টি আল্লাহর দুটি গুণ। তারপর তিনি তাঁর নৈকট্যের বৃদ্ধি প্রার্থনা করেছেন। তারপর তিনি বলেছেন,। তোমা হতে যে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। অর্থাৎ তোমা হতে তোমার জাতের আশ্রয় চাচ্ছি। তারপর তাঁর নৈকট্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়ার ফলে নৈকট্যের কারণে তিনি লজ্জিত হয়েছেন। অতঃপর তিনি প্রশংসার আশ্রয় নিয়েছেন এবং এই কালাম দ্বারা তাঁর প্রশংসা করেছেন। আমি তোমার প্রশংসার গণনায় অসমর্থ। তারপর যখন তিনি জানতে পারলেন যে, তাঁর প্রশংসার স্তুতি ত্রুটিপূর্ণ তখন তিনি বললেন, তুমি নিজে যেরূপ নিজের প্রশংসা করেছ তুমি তদ্রূপ। মোটকথা দিলওয়ালা লোকদের জন্য এইরূপ বিভিন্ন স্তরের ভাবন্য উন্মুক্ত হয় এবং তার পশ্চাতে আরও গভীর চিন্তা থাকে। যা নৈকট্যের অর্থ উপলব্ধি করার সিজদাহর দ্বারা তার বিশেষত্ব প্রদানের এবং একগুণের দ্বারা অন্য গুনের দিকে আশ্রয় প্রার্থনা করার অর্থে প্রকাশ পেয়েছে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক। প্রকাশ্য অর্থ তা' প্রদর্শনে অক্ষম। এই নিগূঢ় তাৎপর্য বা গুপ্ত তত্ত্ব প্রকাশ্য তাফসীরের বিরোধী নয়; বরং তা' তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে এবং বাহ্যিক আবরণী থেকে আভ্যন্তরীণ মূল বস্তুর দিকে পৌছে দেয়। ফলকথা গুপ্ত অর্থ দ্বারা আমরা এটাই বুঝি যা তার প্রকাশ্য অর্থের মোটেই বিরোধী নয়। ওয়াল্লাহু আ'লামু বিচ্ছাওয়াব। অর্থাৎ আল্লাহই এ বিষয় ভাল জানেন।

Post a Comment

0 Comments