প্রকাশ থাকে যে, কলেমায়ে তাইয়্যেবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ বলা আমাদের জন্যে একটি এবাদত। কিন্তু এ কলেমার যেসব মূলনীতি রয়েছে, সেগুলো না জানা পর্যন্ত কেবল মুখে এর সাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে কোন ফায়দা নেই। এসব মূলনীতির উপরই এ কলেমার বাক্য দু'টি ভিত্তিশীল।
জানা দরকার, এ বাক্য দুটি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও চারটি বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। (১) আল্লাহ্ তাআলার সত্তা সপ্রমাণ করা এবং (২) তাঁর গুণাবলী সপ্রমাণ করা, (৩) তাঁর ক্রিয়াকর্ম সপ্রমাণ করা এবং (৪) তাঁর রসূলগণের সত্যতা সপ্রমাণ করা। এ থেকেই জানা গেল, ঈমান চারটি স্তম্ভের উপর এবং প্রত্যেকটি স্তম্ভ দশটি মূলনীতির উপর ভিত্তিশীল।
প্রথম স্তম্ভের প্রথম মূলনীতি হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের প্রমাণ। এ সম্পর্কে কোরআন প্রদর্শিত পন্থাই সর্বোত্তম। কেননা, আল্লাহ তাআলার বর্ণনা অপেক্ষা উত্তম বর্ণনা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন- الَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا وَخَلَقْنَكُمْ ازوَاجًا وَجَعَلْنَا نَومَكُمْ سُبَانًا وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا وجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا - وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا وجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَاجًا وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاء تجاجا لتخرج بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا وَجَنْتِ الْفَافًا .
অর্থাৎ, আমি কি ভূমিকে বিছানা এবং পর্বতকে গজাল সদৃশ করিনি? আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি, তোমাদেরকে নিদ্রা দিয়েছি বিশ্রামের জন্যে, রাত্রিকে করেছি আবরণস্বরূপ এবং দিবসকে করেছি জীবিকা উপার্জনের সময়। আমি তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে মজবুত সাত আকাশ নির্মাণ করেছি এবং সমুজ্জ্বল প্রদীপ তৈরী করেছি। আমি পানিবাহী মেঘমালা থেকে প্রচুর বারিপাত করি; তদ্দ্বারা আমি উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও ঘন সন্নিবিষ্ট বাগান।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
إنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ والنهارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ الناس وَمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الريح وَالسَّحَابِ الْمُسَحْرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَايَتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ .
অর্থাৎ, “নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিনের পরিবর্তনে, মানুষের জন্যে লাভজনক বস্তু নিয়ে সমুদ্রে চলমান নৌকায়, আকাশ থেকে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ পানিতে, যদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সঞ্জীবিত করেন ও তাতে ছড়িয়ে দেন সবরকম জীব-জন্তু, আবহাওয়ার পরিবর্তনে এবং আল্লাহর আদেশাধীন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে বিচরণকারী মেঘমালার মধ্যে তাঁদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে, যারা বুঝে।"
অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-
الَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللَّهُ سَبْعَ سَمَوَاتٍ طِبَاقًا وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا وَاللَّهُ أَنْتَكُمْ مِّنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا .
অর্থাৎ, "তোমরা কি লক্ষ্য করনি, আল্লাহ কিভাবে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং তাতে চন্দ্রকে রেখেছেন প্রদীপরূপে। আল্লাহ তোমাদেরকে উৎপন্ন করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর তাতে তিনি তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করবেন এবং পুনরুত্থিত করবেন।"
আর এক জায়গায় এরশাদ হয়েছে-
أَفَرَأَيْتُمْ مَّا تُمُونَ أَنْتُمْ تَخْلُقُونَهُ أَمْ نَحْنُ الْخَالِقُونَ .
অর্থাৎ, "তোমরা কি তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে ভেবে দেখেছ? তা কি তোমারা সৃষ্টি কর, না আমি সৃষ্টি করি?"
অবশেষে বলা হয়েছে-
نَحْنُ جَعَلْنَهَا تَذْكِرَةً وَمَتَاعًا لِلْمُقْوِينَ .
অর্থাৎ, "আমি একে করেছি নিদর্শন এবং মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্তু।"
বলাবাহুল্য, যদি সামান্য সচেতন ব্যক্তিও এসব আয়াত সম্পর্কে • সামান্য চিন্তাভাবনা করে, আকাশ ও পৃথিবীতে অবস্থিত বিস্ময়কর বস্তুসমূহের প্রতি এবং জীবজন্তু ও উদ্ভিদের অদ্ভুত প্রজনন প্রক্রিয়ার প্রতি লক্ষ্য করে, তবে সে অবশ্যই জানতে পারবে, এই অভূতপূর্ব কারখানা ও অটল ব্যবস্থাপনার একজন রচয়িতা অবশ্যই রয়েছেন। তিনি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। বরং মানুষের মূল সৃষ্টিই এ বিষয়ের সাক্ষ্যদাতা। কারণ, মানুষ আল্লাহর কুদরতের অধীন। তাঁর কৌশল অনুযায়ী ক্রমবিকাশ লাভ করতে থাকে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
افِي اللَّهِ شَكٍّ فَاطِرِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ .
অর্থাৎ, "আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহ সম্পর্কেই সন্দেহ?" এ জন্যেই মানুষকে তওহীদের প্রতি আহ্বান করার উদ্দেশে তিনি পয়গম্বরগণকে প্রেরণ করেছেন, যাতে মানুষ বলে উঠে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। মানুষকে একথা বলার নির্দেশ করা হয়নি যে, তাঁদের এক মাবুদ এবং বিশ্বের অন্য মাবুদ। কেননা, জন্মলগ্ন থেকেই এটা মানুষের মজ্জাগত বিষয় ছিল। তাই আল্লাহ বলেন-
وَلَئِن سَأَلْتُهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ الله.
অর্থাৎ, "তাদেরকে যদি প্রশ্ন কর- আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে, তাঁরা অবশ্যই বলবে- আল্লাহ। আরও বলা হয়েছে-
فَاقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ .
অর্থাৎ, "অতএব আপনি একাগ্রতার সাথে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনের উপর অনড় থাকুন। এটা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত স্বভাবধর্ম, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিরীতির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সঠিক দ্বীন।"
মোট কথা, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের বর্ণনায় মানুষের জন্মের এবং কোরআন পাকের প্রমাণ এত উঁচুর পরিমাণে বিদ্যমান যে, অন্য কোন প্রমাণ উল্লেখ্য করার প্রয়োজন নেই। তবুও আমরা বক্তব্য জোরদার করার উদ্দেশে কালাম শাস্ত্রের অনুসরণে এর একটি যুক্তিও লেখে দিচ্ছি। যে বস্তু পূর্বে ছিল না, এখন আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে না, তাকে পরিভাষায় 'হাদেস' তথা অনিত্য বলা হয়। এমন অনিত্য বস্তুর অস্তিত্ব লাভের জন্যে কোন কারণ অবশ্যই দরকার। এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এ বিশ্বও অনিত্য। কেননা, এক সময়ে এটা ছিল না এবং ভবিষ্যতেও এমন সময় আসবে, যখন থাকবে না। সুতরাং এ বিশ্বের অস্তিত্ব লাভের পেছনেও কোন কারণ অবশ্যই রয়েছে। বলাবাহুল্য, এ কারণ হলেন আল্লাহ তাআলা। তিনি সৃষ্টি করেছেন বলেই এ বিশ্বচরাচর অস্তিত্ব লাভ করেছে।
দ্বিতীয় মূলনীতি হল. আল্লাহ তাআলা নিত্য, অনাদি ও চিরন্তন। তাঁর অস্তিত্বের কোন আদি নেই; বরং প্রত্যেক বস্তুর তথা জীবিত ও মৃতের পূর্বে তিনিই আছেন। এর দলীল, আল্লাহ তাআলা 'কাদীম' তথা নিত্য না হয়ে 'হাদেস' তথা অনিত্য হলে তিনিও অস্তিত্ব লাভের জন্যে কোন নিত্য কারণের মুখাপেক্ষী হবেন। সেই কারণটিও অন্য একটি কারণের মুখাপেক্ষী হবে এবং সেটাও অন্য এক কারণের মুখাপেক্ষী হবে। এভাবে এ মুখাপেক্ষিতার কোন অন্ত থাকবে না। ফলে মূল কারণ অর্জিত হবে না। সুতরাং কোন না কোন পর্যায়ে গিয়ে একটি স্বয়ম্ভূ কারণ মানতে হবে, যেটি হবে নিত্য, চিরন্তন ও সর্বপ্রথম। এটাই আমাদের লক্ষ্য এবং এরই নাম বিশ্বস্রষ্টা, অস্তিত্বদাতা, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবক ইত্যাদি।
তৃতীয় মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা অনাদি হওয়ার সাথে সাথে অনন্তও বটে। তাঁর অস্তিত্বের কোন অন্ত নেই; বরং তিনি প্রথম এবং তিনিই শেষ, তিনিই জাহের, তিনিই বাতেন। কারণ, যাঁর চিরন্তনতা সপ্রমাণিত, তাঁর বিলুপ্তি অসম্ভব। কেননা, তিনি বিলুপ্ত হলে হয় আপনা আপনি বিলুপ্ত হবেন, না হয় কোন বিলুপ্তকারীর বিলুপ্ত করার কারণে বিলুপ্ত হবেন। প্রথমটি বাতিল। কেননা, যাকে চিরন্তন কল্পনা করা হয়েছে, তার আপনা আপনি বিলুপ্তি সম্ভব হলে কোন বস্তুর আপনা আপনি অস্তিত্ব লাভও সম্ভব হবে। বিলুপ্তকারী দ্বারা বিলুপ্ত হওয়াও বাতিল। কেননা, এই বিলুপ্তকারী নিত্য ও চিরন্তন হলে তার উপস্থিতিতে এ সত্তার অস্তিত্ব কিরূপে হল? প্রথমোক্ত দুটি মূলনীতির দ্বারা তাঁর অস্তিত্ব ও চিরন্তনতা প্রমাণিত হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে বিলুপ্তকারী হাদেস তথা অনিত্য হলে সে নিজেই চিরন্তনের কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে। এমতাবস্থায় সে চিরন্তনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে পারে না।
চতুর্থ মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা কোন আয়তনে পরিবেষ্টিত নন; বরং তিনি আয়তনের বেষ্টনী থেকে মুক্ত পবিত্র। এর প্রমাণ, প্রত্যেক বস্তু যে আয়তনে পরিবেষ্টিত রয়েছে, এর মূলে হয় সে বস্তু সে আয়তক্ষেত্রে অবস্থান করছে, না হয় সে ক্ষেত্র থেকে গতিশীল হচ্ছে। অবস্থান ও গতিশীলতা উভয়টি হাদেস তথা অনিত্য। এটা আল্লাহ তাআলার জন্যে নয়।
পঞ্চম-মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা পদার্থ গঠিত শরীরী নন। কেননা, যা পদার্থ গঠিত, তাকেই শরীরী বলা হয়। আল্লাহ তাআলা পদার্থ হওয়া এবং বিশেষ স্থানে অবস্থানকারী হওয়া যখন বাতিল, তখন তাঁর শরীরী হওয়াও বাতিল। জগত স্রষ্টার শরীরী হওয়া সঠিক হলে সূর্য, চন্দ্র অথবা অন্য কোন শরীরীকে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করাও সম্ভবপর হবে।
ষষ্ঠ মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা কোন শরীরীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বস্তুর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট কোন গুণ নন। কেননা, সকল শরীরীই নিশ্চিতরূপে হাদেস বা অনিত্য। যে এসব শরীরীকে অস্তিত্ব দান করবে, সে এগুলোর পূর্বে বিদ্যমান থাকবে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা কোন শরীরীর মধ্যে কিরূপে অনুপ্রবেশ করতে পারেন? তিনি তো অনাদিকালে সকলের পূর্বে একাই বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। নিজের পরে
এ ছয়টি মূলনীতি থেকে জানা গেল, আল্লাহ তাআলা বিদ্যমান, নিজে নিজেই প্রতিষ্ঠিত, তিনি পদার্থ নন, শরীরী নন এবং গুণও নন। সমগ্র বিশ্ব পদার্থ, গুণ ও শরীরী। এতে প্রমাণিত হল, তিনি কারও মত নন এবং কেউ তাঁর মত নয়।
সপ্তম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলার সত্তা দিকের বিশেষত্ব থেকেও পবিত্র। কেননা, দিক ছয়টি ঊর্ধ্ব, অধঃ, ডান, বাম, অগ্র ও পশ্চাৎ। আল্লাহ তাআলাই এগুলো সব মানর সৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। কেননা, তিনি মানুষের দুটি দিক সৃষ্টি করেছেন। একটি ভূমি সংলগ্ন, যাকে পা বলা হয় এবং অপরটি তার বিপরীত, যাকে মাথা বলা হয়। সুতরাং, ঊর্ধ্ব শব্দটি মাথার দিকের জন্য এবং অধঃ শব্দটি পায়ের দিকের জন্যে গঠিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্যে দুটি হাত সৃষ্টি করেছেন। প্রায়শঃ এর একটি অপরটি অপেক্ষা শক্তিশালী হয়। যে হাতটি অধিক শক্তিশালী, তার নাম রাখা হয়েছে ডান এবং এর বিপরীত হাতের নাম বাম। এর পর যে দিকটি ডান তরফে তার নাম ডান দিক এবং যে দিকটি বাম তরফে তার নাম বাম দিক রাখা হয়েছে। এছাড়া আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্যে দুটি তরফ সৃষ্টি করেছেন। এক তরফে দেখে এবং চলে, সেই তরফের নাম হয়েছে অগ্র দিক এবং এর বিপরীত তরফের নাম সাব্যস্ত হয়েছে পশ্চাদ্দিক।
সুতরাং উপরোক্ত ছয়টি দিক মানব সৃষ্টির ফলস্বরূপ সৃজিত হয়েছে। যদি মানুষকে এই আকারে সৃষ্টি করা না হত, বরং বলের মত গোলাকার সৃষ্টি করা হত, তবে এসব দিকেরও অস্তিত্ব থাকত না। সুতরাং এসব দিক হাদেস বা অনিত্য। যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন এসব দিক থাকবে। মানুষের বিলুপ্তির সাথে সাথে এসব দিকেরও বিলুপ্তি ঘটবে। অতএব আল্লাহ তাআলা এগুলোর দ্বারা অনাদিকালেও বিশেষত্ব লাভ করতে পারেন না এবং এখনও পারেন না। কেননা, মানব সৃষ্টির সময় তিনি কোন বিশেষ দিকে ছিলেন না।'
আল্লাহ তাআলার জন্যে ঊর্ধ্ব হবে, এ বিষয় থেকে তিনি মুক্ত। কেননা, মাথা থেকে তিনি মুক্ত। মাথার দিককেই বলা হয় ঊর্ধ্ব। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলার জন্যে অধঃ হতে পারে না, কেননা, তাঁর পা নেই। এখন প্রশ্ন হয়, দোয়ার সময় হাত আকাশের দিকে উঠানো হয় কেন? জওয়াব, আকাশের দিকেই দোয়ার কেবলা। এতে আরও ইশারা আছে, যার কাছে দোয়া চাওয়া হয়, তিনি প্রতাপশালী ও মহান। উচ্চতার দিক শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব জ্ঞাপন করে। আল্লাহ তাআলা শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রবলতার দিক দিয়ে প্রত্যেক বিদ্যমান বস্তুর ঊর্ধ্বে রয়েছেন।
অষ্টম মূলনীতি, আল্লাহ্ তাআলা সেই অর্থে আরশের উপর সমাসীন, যে অর্থ তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, সমাসীন হওয়ার যে অর্থ তাঁর বিশালতার পরিপন্থী নয় এবং যাতে অনিত্যতা, ফানা বা বিনাশের কোন দখল নেই। নিম্নোক্ত আয়াতে সমাসীন হওয়ার অর্থই বুঝানো হয়েছে-
ثم استوى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانُ .
অর্থাৎ, "অতঃপর আল্লাহ্ আকাশে আরোহণ করলেন। তখন আকাশ ছিল ধোঁয়া।"
এ অর্থ কেবল প্রচণ্ডতা ও প্রবলতার দিক দিয়েই সম্ভব। অর্থাৎ, তিনি আকাশের উপর প্রবল হলেন। জনৈক কবি বলেন: "এখন বাশার এরাফের উপর সমাসীন হল। সে তরবারি ও রক্তপাতের মুখাপেক্ষী হয়নি।” সত্যপন্থীদেরকে বাধ্য হয়ে এ ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। তোমরা যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন" আয়াতের ব্যাখ্যা করেছে, সঙ্গে থাকার উদ্দেশ্য বেষ্টন করা ও জানা। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
قلب المؤمن بين أصبعين من اصابع الرحمن -
অর্থাৎ, “মুমিনের অন্তর আল্লাহ্ তাআলার দু'অঙ্গুলির মাঝখানে অবস্থিত।"
এখানে অঙ্গুলির ব্যাখ্যা কুদরত ও প্রবলতা করা হয়েছে। এমনিভাবে الاسود يمين الله في ارضه
"কৃষ্ণ প্রস্তর পৃথিবীতে আল্লাহ্ তাআলার দক্ষিণ হস্ত।” এর অর্থ নেয়া হয়েছে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব। কারণ এগুলোকে বাহ্যিক অর্থে রাখা হলে তা সম্ভব থাকে না। অনুরূপভাবে এক্ষেত্রে استوی শব্দের বাহ্যিক অর্থ অবস্থান করা ও স্থান নেয়া করা হলে আল্লাহ তাআলার শরীরী হওয়া এবং আরশের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ আরশের সমান হবেন অথবা ছোট হবেন অথবা বৃহৎ হবেন। এসবই অসম্ভব। কাজেই বাহ্যিক অর্থ নেয়াও অম্ভব।
নবম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা আকার, পরিমাণ, দিক ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আখেরাতে চর্মচোখে দৃষ্টিগোচর হবেন। কেননা, তিনি বলেন:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ .
অর্থাৎ, "অনেক মুখমণ্ডল সেদিন প্রফুল্ল হবে- তাদের পালনকর্তাকে অবলোকন করবে।"
তিনি পৃথিবীতে দৃষ্টিগোচর হন না। কারণ, আল্লাহ বলেন-
لَا تُدْرِكْهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ .
অর্থাৎ, “দৃষ্টি তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি দৃষ্টিসমূহকে উপলব্ধি করেন।"
তদুপরি এ কারণে যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর জওয়াবে তিনি নিজে বলেন:
لن تراني .
অর্থাৎ, "তুমি কিছুতেই আমাকে দেখতে পারবে না।" এখন কেউ বলুক, আল্লাহ তাআলার যে সিফাত হযরত মূসা (আঃ)-এর পক্ষে জানা সম্ভব হল না, তা মুতাযেলা সম্প্রদায় কেমন করে জেনে নিল এবং দীদার অসম্ভব হওয়া সত্ত্বেও মূসা (আঃ) দীদারের প্রার্থনা কিরূপে করলেন? পরকালে দীদারের আয়াতকে বাহ্যিক অর্থে নেয়ার কারণ, এতে কোন কিছু অসম্ভব হওয়া জরুরী হয় না। কেননা, দর্শনও এক প্রকার জ্ঞান ও কাল্ফ। তবে তা জ্ঞান অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ ও সুস্পষ্ট। সুতরাং আল্লাহ তাআলা কোন দিকে না থাকা সত্ত্বেও যখন তাঁর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে, তখন এমনি অবস্থায় দেখাও তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। আল্লাহকে জানা যেমন আকার ছাড়াই সম্ভব, তেমনি তাঁকে দেখাও আকার আকৃতি ব্যতিরেকেই সম্ভবপর।
দশম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলার কোন শরীক নেই। তিনি একক, অদ্বিতীয়। তিনি একাই আবিষ্কার করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কোন সমতুল্য, সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যে তাঁর সাথে কলহ ও বিরোধ করতে পারে। এর প্রমাণ এই আয়াত-
لَو كَانَ فِيهِمَا أَلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَنَا .
অর্থাৎ, যদি আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ্ ব্যতীত আরও উপাস্য থাকত, তবে আকাশ ও পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত।
এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, যদি আল্লাহ দু'জন থাকে এবং তাঁদের মধ্যে কোন একজন কোন কাজ করতে চায়, তবে অন্যজন তার সাথে সায় দিতে বাধ্য হলে সে অক্ষম অপারগ বলে বিবেচিত হবে। সর্বশক্তিমান হবে না। আর যদি দ্বিতীয় জন প্রথম জনকে প্রতিহত করতে ও বিরোধিতা করতে সক্ষম হয়, তবে দ্বিতীয় জন শক্তিশালী ও প্রবল হবে আর প্রথম জন দুর্বল ও অক্ষম প্রতিপন্ন হবে; সর্বশক্তিমান হবে না।
0 Comments