প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, ফিকির বা চিন্তার অর্থ হৃদয়ের মধ্যে দু'টো জ্ঞানের উদয় এবং দুটোর সংমিশ্রণের ফলে তৃতীয় জ্ঞানের উদয়। তার দৃষ্টান্ত এই যে, যে ব্যক্তি ইহকালের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ইহলৌকিক জীবনকে ভালবাসে এবং ইহকাল থেকে পরকাল যে উত্তম তা' জানার ইচ্ছা করে তার দু'টো উপায় আছে। একটি উপায় এই যে, পরকাল যে ইহকালের তুলনায় উত্তম তা' সে অন্যের নিকট থেকে শ্রবণ করবে এবং বিশ্বাস করবে। তাহলে প্রত্যেক বস্তুর প্রকৃত পরিচয় জ্ঞানের অন্তর্দৃষ্টি ব্যতীতই সে তা' সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারে এবং বিশ্বাস ও কার্যের মাধ্যমেই সে পরকালকে অধিক পছন্দ করে। এর কারণ এই যে, সে অন্যের কথায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখে, এর নামই তাকলীফ বা দেখাদেখি অন্ধ বিশ্বাস। এটা মারেফাত বা পরিচয় অর্জনপূর্বক বিশ্বাস নয়। দ্বিতীয় উপায় এই যে, যা' চিরস্থায়ী তা' উত্তম বলে জানা। তারপর পরকালকে চিরস্থায়ী বলে বিশ্বাস করা। এই দু' পরিচয় জ্ঞান থেকে তৃতীয় এক পরিচয় জ্ঞানের জন্ম হয়। তা'হল, ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম। পূর্ববণিত দুটো পরিচয় ব্যতীত পরকালকে উত্তম বলে জানা সম্ভব হয় না। সুতরাং পূর্ববর্ণিত দুটো জ্ঞান জন্মালেই তৃতীয় জ্ঞানে উপনীত হওয়া যায়। এর নামই তাফাকুর (সৎ চিন্তা), এতেবার (অনধাবনপূর্বক উপদেশ গ্রহণ), তাযাজুর (স্মরণ), নজর (অন্তর্দৃষ্টি) তাআম্মুল। (আশা করা) এবং তাদাব্বুর (গুণ উপলব্ধির চেষ্টা)।
তাদাব্বুর, তাআম্মুল এবং তাফাকুর এই শব্দত্রয়ের অর্থ একই। এদের বিভিন্ন অর্থ নেই, কিন্তু তাফাক্কুর, এ'তেবার এবং নজর শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে। যদিও তাদের মূল অর্থ একই। যেরূপ ছোয়ারিম, মুহান্নাদ এবং ছাইফ শব্দত্রয় একই বস্তু অসির জন্য ব্যবহৃত হলেও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে তা' ব্যবহৃত হয়। ছোয়ারিমের অর্থ অতি ধারাল অসি। মুহান্নাদের অর্থ হিন্দুস্থানের অসি। আর ছাইফের অর্থ কোন কিছুতে বিশেষিত না হয়ে সাধারণ অসি। তদ্রূপ এ'তেবার দুটো বস্তুর পরিচয় অর্জনের পর ঘটে। কেননা এ দুটো বস্তুর পরিচয় জ্ঞান থেকে তৃতীয় পরিচয় জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। যদি তৃতীয় জ্ঞানোদয় পরিচয় জ্ঞানেই তা' স্থগিত থাকে, তখন তাযাঙ্কুরের কথা আসে। তাকে এ'তেবার বা অনুধাবনপূর্বক উপদেশ গ্রহণ বলা হয় না। নজর এবং তাফাকুর সম্বন্ধে তার মধ্যে তৃতীয় পরিচয় জ্ঞানের অনুসন্ধান ঘটে। যে ব্যক্তি এই তৃতীয় পরিচয় জ্ঞানের অনুসন্ধান করে না তাকে পর্যক্ষেণকারী বা নজর বলা যায় না। প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই মুতাযাক্কির কিন্তু প্রত্যেক মুতাযাক্কির ব্যক্তি চিন্তাশীল নয়।
তাযাক্করের উপকার মনের উপর পুনঃ পুনঃ পরিচয় করিয়ে দেয়া যেন তা' তার উপর বদ্ধমূল হয় এবং মন থেকে তা' নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। তাফাকুর বা চিন্তার উপকার জ্ঞান বৃদ্ধি এবং এমন জ্ঞানের জন্য হওয়া যা' পূর্বে অর্জিত হয়নি। এটাই তাযাক্কুর ও তাফাকুরের মধ্যে পার্থক্য। যখন বিভিন্ন প্রকারের পরিচয় মনের উপর পুঞ্জীভূত হয় এবং বিশেষ নিয়মানুসারে তা' ঘটে তখন তার ফলে অন্য জ্ঞানের উদয় হয়; সুতরাং এক জ্ঞান থেকে অন্য জ্ঞানের জন্ম হয়ে থাকে। যখন অন্য জ্ঞান অর্জিত হয় এবং তা' আবার অন্য কোন জ্ঞানের সাথে সংযুক্ত হয় এ দু' জ্ঞানের সংযোগে তৃতীয় জ্ঞানের উদয় হয়। এরূপ জ্ঞানের পর জ্ঞান প্রকাশ পেতে থাকে এবং জ্ঞানের পর জ্ঞান উদয় হতে থাকে। তখন চিন্তারও শেষ হয় না। জ্ঞানের দুয়ার মৃত্যুর সাথে বা শেষ নিশ্বাসের সাথে বন্ধ হয়ে যায় না।
যে ব্যক্তি জ্ঞান থেকে ফল আহরণ করতে সমর্থ হয়, সে এই পন্থা অর্জন করতে সমর্থ হয় এবং তা' থেকে চিন্তার পথে নিয়ে যায়। অধিকাংশ লোকই অতিরিক্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, কেননা তাদের নিকট মূলধন নেই। অর্থাৎ তাদের সেই পরিচয় জ্ঞান নেই, যা' থেকে নানাবিধ জ্ঞানের উদয় হয়। সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যার ব্যবসায়ে কোন মূলধন নেই; সুতরাং সে কোন লাভ অর্জন করতে সমর্থ হয় না। আবার কেউ হয়ত মূলধনের অধিকারী। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের কৌশল ও উত্তম নিয়ম- প্রণালীতে অনভিজ্ঞ, তারও ব্যবসায়ে কোন মুনাফা অর্জিত হয় না। তদ্রূপ যার মারেফাত জ্ঞানরূপ মূলধন থাকে। কিন্তু সে তার সদ্ব্যবহার জানে না এবং তা' কার্যে পরিণত করতে পারে না, তাতে তার কোন ফলোদয় হয় না এবং তা' ব্যবহার করার পন্থাও জানে না। এতে কখনও ঐশী আলোকে হৃদয় মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানের উদয় হয়। যেরূপ নবী-রাসূলদের বেলায় হয়েছিল। জ্ঞান অর্জন করা অতীব কষ্টকর। তা' শিক্ষা ও অভ্যাস দ্বারা অর্জন করতে হয়। অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি চিন্তা করে তার নিকট এই পরিচয় জ্ঞান উপস্থিত হয় এবং সে তার ফল অর্জন করে। যে তা' অর্জনের বিশেষ নিয়ম-কানুন জানে না, ব্যাখ্যা কার্যে ইচ্ছা সত্ত্বেও স্বল্প অভ্যাসের দরুন সে তা' ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয় না। অনেক লোক অছে যে, ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম এ বিষয়টি অবগত থাকে। কিন্তু যখন তাকে তার পরিচয় জ্ঞান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয় সে তা' ব্যাখ্যা করতে অপারগ হয়ে পড়ে। এই প্রকার লোক যে তার জ্ঞান ভাণ্ডার বৃদ্ধি করতে পারে না তার কারণ দুটো। উক্ত জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাকে দুটো জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। তার একটি এই যে, যে বস্তু স্থায়ী তা' অস্থায়ী বন্ধু অপেক্ষা উত্তম। পরকাল স্থায়ী আর ইহকাল অস্থায়ী এদুটো জ্ঞান থেকে যে তৃতীয় জ্ঞানটি জন্মে তা' এই যে, ইহকাল থেকে পরকাল উত্তম। যদি এই দুটো জ্ঞান পূর্ব থেকে মনে সঞ্চিত থাকে এবং এ দুটো জ্ঞানকে একত্র করা যায় তখনই ইহকাল অপেক্ষা পরকাল-উত্তম এ জ্ঞান মনে সহজেই জন্মে। কিন্তু উক্ত দুটো জ্ঞান যদি মনে না থাকে তবে কখনও শোষোক্ত জ্ঞান জন্মলাভ করে না।
0 Comments