(১) কুরআন পাকের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মহত্ত মনে-প্রাণে উপলব্ধি করা
মহান আল্লাহ তায়ালা স্বীয় অপার করুণায় মানুষের উপর কুরআন নাযিল করে যে রহমত বর্ষণ করেছেন তা' পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করা। পাঠক লক্ষ্য করুন আল্লাহ মানুষের জন্য কি অপার করুণা প্রদর্শন করেছেন যাতে তারা আল্লাহর কালামের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহর কালাম একটি আদি গুণ এবং তা' তাঁর সত্তার সহিত ওতপ্রোতঃ জড়িত। আর সেই গুণ তিনি মানবীয় গুণ অক্ষরের রূপে এবং স্বরে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। মানুষ যখন আল্লাহর গুণ উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন তা' তার নিজের গুণের মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়। যদি অক্ষরের পরিচ্ছদে আল্লাহর কালামের মাহাত্ম্য ও গৌরব বুঝিয়ে না দেয়া হত, তবে আসমান, জমিন আল্লাহর কালাম শুনে স্থির ও অবিচল থাকতে পারত না; বরং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবই চূর্ণ-বিচূর্ণ, হয়ে যেত। যদি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই নবী হযরত মুসাকে (আঃ) দৃঢ় বা স্থির না রাখতেন, তবে তিনি তাঁর কালাম শুনে অজ্ঞান ও অচেতন নাহয়ে পারতেন না। যেমন পর্বত কালামুল্লাহর তাজাল্লীর সুতীব্র ধাক্কায় সুস্থির থাকতে সক্ষম হল না। হযরত মুসার (আঃ)ও ঠিক তেমন অবস্থা হত। সার কথা, আল্লাহর কালামের মাহাত্ম্য বুঝার জন্য উপমা ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। এজন্যই জনৈক আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি বলেছেন যে, লওহে মাহফুজে রক্ষিত আল্লাহর কালামের প্রতিটি অক্ষরই পর্বত থেকেও বিশাল ও উচ্চতর। যদি সমস্ত ফিরেশতা একত্র হয়ে তার একটি অক্ষরকে ছোট করতে যায় তা' করতে সক্ষম হবে না, যে পর্যন্ত না লওহে মাহফুজের রক্ষক তা' করে দেন। এটা অবশ্য অক্ষরের শক্তি বা সামর্থের জন্য নয়। মহান গৌরবান্বিত আল্লাহ তায়ালা সেই অকল্পনীয় কালামকে শব্দের আবরণে আবৃত করে মানুষের ব্যবহারযোগ্য করে দিয়েছেন। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি আল্লাহর কালাম বুঝার জন্য কিছু উপমার দ্বারা তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উক্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি কোন বাদশাহকে নবীদের শরীয়ত গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিলে বাদশাহ তাকে কতকগুলো বিষয় জিজ্ঞেস করল। বিজ্ঞ তাকে এমন উত্তর দিল যে, বাদশাহ তা' বুঝতে পারল না। এমন কি তার জ্ঞানের আওতায়ও তা' এল না। তখন বাদশাহ বলল, নবীগণ যে হেদায়েত নিয়ে এসেছেন তুমি নিজে কি তা' বুঝেছ? তাঁরা যখন দাওয়াত দিয়েছেন মানুষের কালাম দিয়ে দেন নি। তাঁরা আল্লাহর কালাম দিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন তা' মানুষ কিরূপে বুঝতে পাবে? বাদশাহর কথা শুনে বিজ্ঞ ব্যক্তি বলল, আমরা মানুষের বেলায় দেখেছি যে, যখন তারা তাদের কোন পোষ্য প্রাণী বা পাখিকে কিছু বোঝাতে চায় যেমন প্রাণীটি সামনে এগুবে বা পিছনে পেছোবে, দ্রুত চলবে বা ধীরে চলবে। তারা প্রাণীদের অব্যক্ত শব্দের সাথে নিজেদের কতগুলো শব্দ মিশ্রিত করে তাদেরকে চালাবার জন্য একপ্রকার ভাষা তৈরী করে নেয়। প্রাণীরা তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির দ্বারা তা' বুঝতে পারে এবং তদনুযায়ী কাজ করে। এভাবে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর স্বর অন্যান্য ইঙ্গিত দ্বারা তাদেরকে নিজেদের কথা বুঝাতে থাকে এবং তারাও তা' বুঝে নিয়ে তদনুযায়ী কাজ করে যায়। মানুষের অবস্থাও অবিকল তদ্রূপ। আল্লাহর কালামের পূর্ণত্ব, মহত্ত্ব, গুরুত্ব ও সৌন্দর্য মানুষ অনুভব উপলব্ধি ও বহন করতে অক্ষম হলেও নবীগণ তাদেরকে তা' এরূপ ভাবে বুঝিয়েছেন, যেভাবে মানুষ চতুস্পদ স্নায়ুকে একটি বিশিষ্ট ভাষার দ্বারা পরিচালনা করে। পবিত্র কুরআনের ভাষাকে এরূপ শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে, যেন মানুষ কুরআনে পাকের হেকমত উপলব্ধি করতে পারে। যেমন চুতস্পদ জন্তু মানুষের স্বর ও ইঙ্গিত দ্বারা মানুষের মনের ভার বুঝতে পারে। হেকমতের মূল বা আসল অর্থ এই শব্দ ও স্বরগুলোর মধ্যে গুপ্ত থাকে তবু এর অর্থের সম্মানের জন্য একে সম্মান করা হয়। বস্তুতঃ অক্ষরই হেকমতের দেহ এবং ভাবার্থ হেকমতের আত্মা, আর স্বর তার প্রাণ। যেরূপ মানুষের দেহকে তার আভ্যন্তরীণ রূহের জন্য সম্মান করা হয়, তদ্রূপ হেকমতের স্বরকে তার ভাবার্থের জন্য সম্মান করা।
মহান আল্লাহ থেকে অবতীর্ণ বাণীর উচ্চ পদমর্যাদা রয়েছে। তা' শক্তিতে অপরাজেয়। সত্য ও খাঁটি বিষয়ে নির্দেশকারী ও অসত্য এবং অখাঁটি বিষয়ে নিষেধকারী, সুবিচারক কাজী এবং প্রিয় সাক্ষী। কোন পন্ড বিষয়ের এরূপ শক্তি নেই। যেমন ছায়া সূর্যের তীব্র রশিশ্মর সামনে দাঁড়াতে অক্ষম, তেমনি কোন মানুষ কুরআনে পাকের হেকমতের বাণীর সামনে থাকতে সক্ষম নয়। যেমন চক্ষুর দৃষ্টি প্রখর সূর্যের দিকে তিষ্ঠিতে অক্ষম, তেমনি হেকমতের গভীর তলদেশে প্রবেশ করার শক্তিও মানুষের নেই। মানুষ সূর্যের জ্যোতি শুধু এতটুকু গ্রহণ করে, যম্বরা সে দেখতে সক্ষম হয় ও যদ্দরা সে আবশ্যকীয় বিষয়বস্তু জেনে দেখে লয়। সারকথা হল, আল্লাহর কালাম পুরু পর্দার ভিতর অদৃশ্য সম্রাটের ন্যায়। যার মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হয় না, তবু তার আদেশ-নিষেধ জারী থাকে। অথবা আল্লাহর কালাম সূর্যের ন্যায়, যার জ্যোতি বাহ্যতঃ প্রকাশ্য কিন্তু তার অবয়ব গুপ্ত। অথবা তারার ন্যায়, যার সাহায্যে পথ চলা যায়। আল্লাহর কালাম বা কুরআনে পাক অমূল্য ধন ভান্ডারের কুঞ্জি স্বরূপ। অথবা জীবনের আবেহায়াত, যা পান করলে কখনও মৃত্যু ঘটে না। অথবা তা' ব্যাধির কোন ওষুধ যা সেবনে কোন রোগ-ব্যাধি থাকে না। উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি উপরোক্তরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর অতিরিক্ত কিছু বর্ণনা করা ব্যবহারিক জ্ঞানের বহির্ভূত। তাই আমি এখানেই শেষ করলাম।
(২) কালামকারী অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালার সম্মান করাঃ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত শুরু করার সময় মনে কালামকারীর গৌরব উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে হবে এবং মনে এ বিশ্বাস ও ধারণা রাখবে যে, যা পাঠ করতে যেতেছ তা' কোন মানুষের বাণী নয়। আর আল্লাহর বাণী তিলাওয়াত করাতে বহু ভুলত্রুটি হতে পারে। কেননা, আল্লাহ বলেছেন, লা ইয়ামাসসুহু ইল্লাল মুতাহহিরুন। অর্থাৎ পবিত্র লোকগণ ছাড়া কেউ তা' স্পর্শ করবে না। যেমন কুরআনে পাকের বাহ্যিক কাগজ ও পাতা মানুষের বাহ্যিক অপবিত্র হস্ত থেকে সুরক্ষিত থাকে। তেমনি এর গুপ্ত অর্থ ও হেকমত আভ্যন্তরীণ কালব তথা অন্তরে অবরুদ্ধ থাকে। যদি সমস্ত অপবিত্রতা থেকে তা' পবিত্র না থাকে এবং তা' সম্মান ও গাম্ভীর্যের নূর দ্বারা আলোকিত না হয়, যেমন কুরআনের পাতাকে প্রত্যেক হস্ত স্পর্শ করতে পারে না তেমন কুরআনের অক্ষর প্রত্যেক জিহ্বা তিলাওয়াত করতে পারে না এবং প্রত্যেক হৃদয় তার অর্থ ধারণ করতে পারে না। বর্ণিত রয়েছে, আবু জেহেলের পুত্র আকরামা যখন কুরআন মজীদ খুলে বসত, সে তখন বেহুঁশ হয়ে যেত এবং বলত, এ আমার মহান প্রভুর কালাম। কালামকে সম্মান করার অর্থ, প্রভুকে সম্মান করা এবং প্রভুকে সম্মান করা হয় না যে পর্যন্ত না তাঁর গুণাবলীর মাহাত্ম্য ও সৃষ্টির বৈচিত্র্য সম্বন্ধে চিন্তা করা হয়, যে পর্যন্ত না আরশ, কুরসী, আসমান-যমিন এবং এতদুভয়ের ভিতর যে জ্বীন, মানুষ, পশু-পক্ষি ও বৃক্ষ-লত্য রয়েছে তার অন্তরে না আসে এবং না জানে যে, এ সমস্তেরই সৃষ্টিকর্তা তিনি। তিনি তাদের সবার উপর শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান। তিনি তাদের রিযিকদাতা তিনি এক এবং সব কিছুই তাঁর কুদরতের আওতাধীন, তাঁর অপরিসীম করুণা ও রহমতের অন্তর্গত। সব কিছুই তাঁর শাসন ও শৃঙখলার অধীন। যদি নিয়ামত লাভ করা যায়, তবে তাঁরই করুণায়। যদি শাস্তি পেতে হয় তবে তা' তাঁরই সুবিচারে প্রদত্ত হয়। তিনি বলেন, এ সকল লোক বেহেশতের জন্য, আমার কোন পরওয়া নেই। এসকল লোক দোযখের জন্য এবং আমার কোন পরওয়া নেই। এই-ই সম্মানের চরম সীমা। এভাবে চিন্তা করাতেই কালামকারীকে সম্মান করা হয় এবং তারপর তাঁর বাণীকে সম্মান করা হয়।
0 Comments