ওযু ও গোসলের রহস্য কী

        স্মরণ রেখ, মানুষ কখনও কখনও প্রকৃতিগত অন্ধকার থেকে পবিত্র মজলিসের দিকে মনোনিবেশ করে। তখন সেখানকার স্বর্গীয় দ্যুতি তার ওপরে ছেয়ে যায়। ফলে ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে প্রকৃতিগত বিধি-বিধান থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এমন কি পবিত্র মজলিসের ফেরেশতাদের সাথে একাকার হয়ে যায়। এমন কি আত্মিক পবিত্রতার দিক দিয়ে সে তাদেরই একজন হয়ে যায়। তারপর তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। তখন সে প্রথম অবস্থার ব্যাপার-স্যাপারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কারণ, প্রথম অবস্থার অবর্তমানে সে সেটাকে গনীমত ভেবেছিল এবং সেটাকে হারানো অবস্থা লাভের একটা উপকরণ মনে করে।

        বস্তুতঃ সে উক্ত গুণের মাধ্যমে হারানো অবস্থা থেকে একটি অবস্থা লাভ করে। সেটা হচ্ছে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত এবং পবিত্রতা অর্জনের বস্তুসমূহ ব্যবহার করার ফলে অর্জিত তৃপ্তি ও প্রসন্নতা। সে সেই অবস্থাটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে তখন সে ব্যক্তি শুনতে পায় যে, সত্য সংবাদদাতা ঘোষণা করলেন, এ অবস্থায় মানবিক পূর্ণত্ব অর্জনের মর্যাদা লাভ ঘটে। সে এও শুনতে পায় যে, তার স্রষ্টা প্রভু এ অবস্থাটি পসন্দ করেন। এ ছাড়াও এতে অসংখ্য কল্যাণ রয়েছে।

        বস্তুতঃ সে আন্তরিক সাক্ষ্য দ্বারা এটাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছে। তার প্রভু তাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সে তা পালন করেছে। তিনি তাকে যে আশ্বাস দিয়েছেন তা সত্য হয়েছে। তার ওপর রহমতের দুয়ার খুলে গেছে। সে ফেরেশতার রঙে রঞ্জিত হয়েছে।

        এর পরের স্তর হল তাদের, যারা উক্ত স্তরের কিছুই জানে না, কিন্তু নবীগণ তাদের জোর করে সে পথে নিয়েছে। তাদের এমন অবস্থায় পৌঁছতে বাধ্য করেছে যাতে অন্ততঃ পরকালে ফেরেশতাদের সাথে একাকার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এরা হল সে দল যাদের জিঞ্জিরে বেঁধে জান্নাতের দিকে টেনে হেঁচেড়ে নেয়া হবে।

        যে অপবিত্রতা সাধারণ লোকের ধারণায় রয়েছে, যার প্রভাব প্রত্যেকের আত্মাই অনুভব করে, যার উৎস ও প্রতিকার সর্বসাধারণকে স্মরণ করিয়ে ও বুঝিয়ে দিতে হয় আর যা অহরহ ঘটে থাকে এবং যা লোকদের শিক্ষা না দিলে মারাত্মক ক্ষতি হয় এরূপ অপবিত্রতা দু ধরনের হয়ে থাকে:-

        (১) মানুষের তিনটি পরিত্যাজ্য বস্তু যথা হাওয়া ছাড়া কিংবা পেশাব- পায়খানায় লিপ্ত হওয়া। এগুলো তার পাকস্থলির প্রক্রিয়াজাত বাড়তি জিনিস। এগুলো না জানে এমন কোন লোক নেই। যখন কারো পেটে হাওয়া জমে যায় কিংবা পেশাব-পায়খানা জমা হয়, তখন তার মন খারাপ হয়ে যাবে। তখন সে কোন ভূখণ্ডের দিকে যায় এবং অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থার ভেতর কাটায়। তখন সে অস্থিরতা অনুভব করে। স্বস্তি ও তার মাঝখানে পর্দা পড়ে যায়। যখন তার পেট থেকে হাওয়া এবং পায়খানা-পেশাব বেরিয়ে যায়, তখন ওযু-গোসল করে নেয়। ফলে নিজকে পবিত্র মনে হয়। তখন সে স্বস্তি ও তৃপ্তি ফিরে পায়। তখন তার মনে হয়, হারানো বস্তু ফিরে পেয়েছে।

        (২ যৌনাচারে মত্ত হওয়া। এ কাজটা মানুষকে পশু প্রকৃতির স্তরে নামিয়ে দেয়।

        একটু ভেবে দেখুন, যখন চতুষ্পদ জন্তুকে পোষ মানানো হয়, সেটাকে বিশেষ রীতি-নীতি শেখানো হয়, শিকারী জন্তুকে ক্ষুধা ও অনিদ্রা দ্বারা অনুগত করা হয়, সেটাকে শিকার ধরে ঠিকঠাকমত নিয়ে আসার শিক্ষা দেয়া হয়, পাখীকে যখন মানুষের বুলি সেখানো হয়, এক কথায় যে জীবই হোক সেটাকে তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ভুলিয়ে বিপরীতধর্মী যে কাজই শেখানো হোক, যখনই সে সুযোগ পাবে পাশবিক যৌনাচারে লিপ্ত হবেই। তখন সব ভুলে ক্রমাগত সে কাজেই লিপ্ত থাকতে চাইবে। কেউ যদি একটু ভেবে দেখে, তা হলেই বুঝতে পারে, এ কাজটি তার মন মানসিকতাকে কতখানি অস্বস্তিকর করে দেয়। এমনকি অধিক খাওয়া ও নেশা করায়ও এত বেশী অস্বস্তি বোধ হয় না। তাই এটা প্রমাণিত সত্য যে, যৌনাচার মানুষকে অধিকতর পশু স্বভাবের অধিকারী করে। যে কেউ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেও এটা বুঝতে পারে। এ জন্যেই ডাক্তাররা দুনিয়া ত্যাগী সন্ন্যাসীদের প্রতিষেধক হিসেবে যৌন সম্পর্কের ব্যবস্থার কথা বলেন।

         সর্ব সাধারণের বোধগম্য ও সকলের জন্যে অপরিহার্য। এ দু'ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ হল পানি। তাই আবাদ এলাকায় তা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। যেহেতু ঐগুলো অহরহ ঘটে থাকে তাই তা দূর করার ব্যবস্থাকে সহজ লভ্য করা হয়েছে। যেহেতু এ দুটো ব্যাপার প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে বিবেচ্য তাই তা আবার দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।

    এক- ছোট পবিত্রতা।

    দুই- বড় পবিত্রতা।

        বড় পবিত্রতার জন্যে সারা শরীর পানি দিয়ে ডলে-মলে ধুয়ে সাফ করতে হবে। পানি যে পবিত্রকর ও অপবিত্রতা বিদূরক এটা সর্বজন স্বীকৃত সত্য। পানি শরীরের অবসাদ দূর করে সজীবতা ও প্রসন্নতা ফিরিয়ে আনে।

         কিছুলোক শরাব পান করে নেশায় মত্ত হয়। তার প্রকৃতিতে নেশার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে কিংবা কোন মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করে। তারপর হঠাৎ সে সচেতন হয়, সুস্থ হয়, নেশার ঘোর।

        কেটে বুদ্ধি ফিরে আসে। অনেক দুর্বল লোকও নেশায় মত্ত অবস্থায় সবল হয়ে যায় আর নেশা কেটে গেলে তার নড়াচড়ারও শক্তি থাকে না। এভাবে হঠাৎ কোন ব্যাপারে উত্তেজিত হয়ে বা জিদের বশবর্তী হয়ে দুর্বলরা সবল হয় এবং উত্তেজনা ও জিদ চলে গেলে আবার দুর্বল হয়ে যায়।

        মোটকথা মানুষের মানস জগতে কখনো হঠাৎ পরিবর্তন আসে এবং তা এক স্বভাব থেকে অন্য স্বভাবে পরিবর্তিত হয় এ জন্য মন চাংগা হয়ে উঠে। মানস জগতের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মনের এ চাংগা অবস্থা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা একটা উত্তম পন্থা। এ ধরনের সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পূর্ণাংগ পবিত্রতা অর্জন একটা কার্যকর ব্যবস্থা। এ পবিত্রতা একমাত্র পানি দ্বারাই অর্জিত হতে পারে।

        পক্ষান্তরে ছোট অপবিত্রতা দূর করে পবিত্রতা অর্জনের জন্যে মুখ, হাত ও পা ধোয়াই যথেষ্ট। কারণ সকল সভ্য সমাজেই এ তিনটি খোলা অংগ ধূলা-বালি থেকে পরিষ্কার রাখার জন্যে ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, তা জামা-কাপড়ের বাইরেই রাখা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও এ তিনটি অংগ কাপড় ঢাকা করতে নিষেধ করেছেন। খোলা অংগ-প্রত্যংগে স্বভাবতঃই ময়লা লাগে বলে অহরহ তা সবাই ধুয়ে থাকে। রাজা-বাদশাহর দরবারে যেতেও মানুষ এগুলো ধুয়ে সাফ করে নেয়। মানুষের নজরেও এ তিনটি ধরা দেয়। তাছাড়া অভিজ্ঞতাও বলে দেয় এ তিনটি অংগ ধুয়ে মাথা মুছে ফেললে দেহে স্বস্তি ও প্রশান্তি আসে। অচেতন কিংবা নিদ্রামগ্নকে সচেতন ও সজাগ ২ রতে হলে মুখে পানি ছিটাতে হয়। ডাক্তারগণও তাই বলে।

        পবিত্রতা অর্জন মানুষের অভ্যেসগত ব্যাপারে পারিণত হয়েছে। মানবতার পরিপূর্ণতার এটা ভিত্তিমূল। পবিত্রতা মানুষকে ফেরেশতার সংস্পর্শে পৌঁছায় ও শয়তান থেকে দূরে রাখে। এর বদৌলতে কবর আযাব থেকেও রেহাই মেলে। রাসূল (সঃ) বলেছেন, পেশাব থেকে সাবধান। কারণ, সাধারণতঃ পেশাবের অপবিত্রতা কবর আযাবের কারণ হয়ে থাকে। পবিত্রতার বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। আল্লাহ বলেন: "পবিত্র ব্যক্তিকে আল্লাহ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন।" যখন পবিত্রতার প্রভাব অন্তরে মজবুত ভাবে বসে যায়, তখন ফেরেশতার নূরের দ্যুতি সেখানে অবস্থান করে। ফলে পশুত্বের তথা জৈবিকতার অন্ধকার তার থেকে দূর হয়ে যায়। পুণ্য লিপিবদ্ধ হওয়া ও পাপ বিলুপ্ত হওয়ার তাৎপর্য এটাই। বুসম-রেওয়াজ বা সামাজিক রীতিনীতির বিচারেও পবিত্রতা অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ। রাজা-বাদশাহর দরবারে যাবার জন্যে যেভাবে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা অনুসরণ করে, যদি কেউ ঠিক তেমনি নিয়ত করে পবিত্র থাকে ও যিকর-আযবার চালু রাখে তা হলে আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়।

        মানুষ যখন বুঝতে পায় যে, পবিত্রতাই তার পূর্ণতা অর্জনের ভিত্তি। তখন তার জ্ঞানই তাকে নির্দেশ দেবে আর সে জ্ঞান অনুসারেই সে তা করতে থাকবে। ফলে তার স্বভাব-প্রকৃতি জ্ঞানের অনুগামী হতে বাধ্য হবে। এটাও বড় একটা লাভ। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।

Post a Comment

0 Comments