আল্লাহর আশ্চর্য কার্যাবলীর পঞ্চম নিদর্শন মহা সমুদ্র

         সুগভীর মহা সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে দুনিয়া একটি স্থলভাগ মাত্র, তবে দুনিয়া তার পাহাড়-পর্বত, প্রান্তর ও সমগ্র স্থল ভাগসহ মহাসমুদ্র স্থিত বিশাল জলরাশির তুলনায় তার একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ মাত্র। সমগ্র স্থলভাগ জলরাশির দ্বারা পরিবেষ্টিত। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "আল আরছু ফিল বাহরি কাল আছতাবালি ফিল আবদ্ধ।" অর্থাৎ প্রান্তরের মধ্যে আস্তাবল যেরূপ, সমুদ্রের মধ্যে দুনিয়াও তদ্রূপ। সুতরাং আস্তাবলকে সমগ্র দুনিয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়ার তুলনায় আস্তাবল যেরূপ অতীব নগণ্য, দুনিয়াও সমুদ্রের তুলনায় ঠিক তদ্রূপ নগণ্য। দুনিয়া এবং দুনিয়ার পৃষ্ঠে যা কিছু আছে, তা' তুমি দেখছ, এখন মহাসমুদ্রের বিষয় চিন্তা কর। তার মধ্যে যে সব সামুদ্রিক প্রাণী ও অমূল্য রত্ন আছে, ভূপৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে যা আছে তার চেয়েও তা' অধিক আশ্চর্যজনক। তোমরা ভূপৃষ্ঠের দিকে অবলোকন কর। মনে হয় যেন সমুদ্রের আয়তন দুনিয়ার আয়তনের চেয়ে কয়েকগুণ বড়। সমুদ্রের একটি আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, তার মধ্যে বহু বৃহৎ বৃহৎ জলজজীব আছে। তা' এতবড় যে একেকটি দ্বীপের মত দেখা যায়। তজ্জন্য হয়ত তুমি তার উপর অবতরণ করে বিচরণ করবে কিন্তু তার উপর অগ্নি জ্বেলে রন্ধন করতে লাগলে সে জলজ প্রাণী অগ্নি তেজস্পর্শে নড়ে চড়ে উঠবে। তখন তুমি বুঝতে পারবে যে, তা' একটি জলজ প্রাণী। ভূপৃষ্ঠে অশ্ব, পাখি, গরু, মানুষ ইত্যাদি যে সব প্রাণী আছে, তারা বিভিন্ন প্রকার। কিন্তু জলের মধ্যে কতগুলি বিশেষ ধরনের পদার্থ আছে, যা স্থলভাগে নেই। যার বিবরণ লিখতে গিয়ে বহুগ্রন্থ রচিত হয়েছে। সমুদ্রে ভ্রমণ করে কতক লোক তা' সংগ্রহ করেছে।


        তারপর আল্লাহতায়ালা সমুদ্র গর্ভে কিরূপে হীরক ও মণিমুক্তা সৃষ্টি করেছেন, সেদিকে লক্ষ্য কর। তিনি কিরূপে সমুদ্রের তলদেশে উপত্যকার পৃষ্ঠ হতে মারজান এবং প্রবাল উৎপাদন করেন তা' লক্ষ্য কর। এগুলি একেকটি বৃক্ষবৎ প্রস্তর থেকে জন্মলাভ করে। তারপর চিন্তা কর যে, ঐগুলি থেকে কিরূপে অম্বর এবং অন্যান্য বহু মূলবান রত্নসমূহ বের হয় এবং তা' সমুদ্র তরঙ্গাঘাতে তীরে নিক্ষিপ্ত হয়। তারপর লক্ষ্য কর সামুদ্রিক জলযানসমূহের দিকে, কিরূপে আল্লাহ সমুদ্রের জলরাশির বুকে জাহাজসমূহ চালনা করেন এবং তারই মাধ্যমে ব্যবসায়ীগণ দেশ দেশান্তরে গমন করে মুনাফা অর্জন করে এবং ধন রত্ন সংগ্রহ করে আনে। আল্লাহতায়ালা জলযানসমূহকেও মানুষের বশীভূত করে দিয়েছেন, যেন তাতে আরোহণ করে। লোকগণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিভিন্ন মাল মাত্তা, ব্যবসায়ী পণ্য এর খাদ্য শস্য ইত্যাদি আমদানী রপ্তানী করতে পারে। তারপর আল্লাহ ইঞ্জীনবিহীন নৌজাহাজগুলিকে চলার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য বায়ু প্রবাহিত করেন। নাবিকগণকে তিনি বায়ুর উৎপত্তিস্থল, বায়ুর সময় এবং ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির বিষয়সমূহ জানিয়ে দেন। এ বিষয়গুলো বিস্তারিত বর্ণনা করতে গেলে বর্ণনা অতিশয় দীর্ঘ হবে।

        জলবিন্দুঃ সমুদ্র থেকেও অধিক আশ্চর্যজনক যা প্রত্যেক প্রকাশ্য জিনিস থেকে অধিক প্রকাশ্য, তা' হল জল বিন্দুর উপাদান। তার দেহ লঘু, সূক্ষ্ম, প্রবাহমান, প্রত্যেক বস্তু সংযুক্ত, যেন তা' একই বস্তু, তার উপাদান সূক্ষ্ম, তা' আশু বিভাজ্য, যেন তা' পরিবর্তনের জন্য বশীভূত, পৃথক করার উপযুক্ত। দুনিয়ায় প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রাণের মূল বস্তু সলিল। যদি কোন ব্যক্তির জলপানের আবশ্যক হয় এবং তাকে যদি তা' না দেয়া হয় সে দুনিয়ার সমস্ত ধন রত্নের বিনিময়ে হলেও, সে তা' চাইতে থাকে। আবার সেই পানি পান করবার পর যদি তা' তোমার মুত্রাধারে আটকে যায় প্রস্রাবের পথে বের না হয়, তখন তুমি সেই মূত্র বের করে দিয়ে মূত্র যন্ত্রণা হতে বাঁচবার বাসনায় চিকিৎসকের সব ধন দিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে। মানুষের জন্য বড়ই বিস্ময় প্রকাশ করতে হয় যে, সে কিরূপে টাকা পয়সা ও অমূল্য রত্নকে বড় মনে করে এবং যখন পিপাসা হয় তখন পানি পান করার আল্লাহর নিয়ামতকে অবহেলা করে, অথচ দুনিয়ার সমস্ত ধন সম্পদের বিনিময়ে তা' থেকে সে মুক্তি পেতে চায়; সুতরাং সলিল রাশি, নদী, সমুদ্র ও মহাসমুদ্রের আশ্চর্যজনক ব্যাপারের বিষয় চিন্তা কর। তাতে বহু চিন্তার খোরাক এবং বিস্তীর্ণ ময়দান আছে। এসব ব্যাপার প্রকাশ্য সাক্ষ্যদান করে এবং অবস্থার রসনার দ্বারা আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শনসমূহের কথা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে এবং তার সৃষ্টিকর্তার গৌরব ও পূর্ণ কৌশল দেখিয়ে দেয়।

        কলবের লোকদেরকে তা' করুণ স্বরে ঘোষণা করে দেয়, তুমি কি আমাকে দেখ না, আমার আকৃতি, আমার গঠন, আমার প্রকৃতি, আমার উপকার, আমার অবস্থার পরিবর্তন ও আমার অসীম উপকারের দিকে লক্ষ্য কর না? তুমি কি ভাবছ যে, আমি নিজে নিজেই অস্তিত্বে এসেছি বা আমার নিজ শ্রেণীর কেউ আমাকে সৃষ্টি করেছে অথবা তোমার কি লজ্জা হয় না যে, তুমি তিন অক্ষরের বাক্যের দিকে লক্ষ্য করে নিশ্চিত বিশ্বাস কর যে, তা' মানব শ্রেণীর মধ্যে একজন বিজ্ঞ শক্তিশালী তার্কিক এবং আশান্বিত আলিমের কারুকার্য। তারপর আল্লাহর কলম দ্বারা আমার মুখের উপর কিভাবে তিনি লিখেছেন, তাঁর সত্তা এবং চলাচল দৃষ্টি ধরতে পারে না এবং তাঁর লেখার স্থান তাকে সংযুক্ত করতে পারে না। তারপর তা' আমার হৃদয়কে শিল্পীর গৌরব থেকে মুক্ত করে এবং শ্রবণ ও মনের অধিকারীদেরকে বলে, ঐ লোকরেকে বলে না যারা শ্রবণ থেকে দূরে থাকে। মনে কর যে, শিল্পী ঘোর অন্ধকারে হায়েজের রক্তে নিমজ্জিত করে আমাকে রেখেছে। আমার ললাট দেশে আকৃতি ও অংকন প্রকাশ করছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা ইত্যাদির আকৃতি তৈয়ার করেছে। সেই চিত্রকর আমার চক্ষুর পালক, চক্ষুর পাতা, ললাট দেশ, গণ্ডদেশ, অধর ইত্যাদির নকসা আঁকছে। ক্রমান্বয় একটির পর আর একটি বস্তুর আকৃতি বানাচ্ছে।

            তুমি কিন্তু শুক্রের অভ্যন্তর বা বাইরে কোন চিত্রকর দেখবে না। জরায়ুর মধ্যে বা বাইরে তাকে দেখবে না। তার সম্বন্ধে তার পিতামাতারও কোন জ্ঞান নেই। শুক্রের ও জরায়ুরও কোন জ্ঞান নেই। তুমি যে চিত্রকরকে কলমদ্বারা আশ্চর্য মূর্তি অংকন করতে দেখ, তার চেয়ে কি এই চিত্রকরের প্রতি অধিক বিস্ময় প্রকাশ করতে হয় না? যদি তুমি তার দিকে একবার কি দুবার লক্ষ্য কর, তুমি তা' শিখে লও। শুক্রের মধ্যে ও বাইরে এবং তার সমস্ত অংশে শুক্রকে স্পর্শ না করে এবং তার সাথে সংযুক্ত না হয়ে মধ্যে ও বাইরে না গিয়ে তার যে নকশা প্রস্তুত হচ্ছে, তার সম্বন্ধে জানা কি তোমার উচিত নয়? যদি তুমি এই আশ্চর্য বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ না কর এবং তদ্বারা এটা না বুঝতে পার যে, যিনি এই চিত্র ও নকশা অংকন করেছেন, তার নজীর নেই, তার তুলনা নেই। কোন চিত্রকর তার সমকক্ষ নয়। তোমার জন্য দুঃখ। যেরূপ তাঁর নকশা এবং চিত্র অন্যের নকশা এবং চিত্রের সমান নয়, তদ্রূপ তিনি ও অন্য চিত্রকরের সমান নন। যেরূপ কার্যের পার্থক্য আছে তদ্রূপ শিল্পীর দক্ষতারও পার্থক্য আছে। এতে যদি তুমি বিস্মিত না হও, তোমার আশ্চর্য না হবার জন্য তুমিই আশ্চর্যান্বিত হও। কেননা তা-ই সব আশ্চর্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আশ্চর্য। যে বস্তু প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও তোমার দৃষ্টিকে লোপ করে দিয়েছে এবং তোমাকে তা' প্রকাশ করতে বারণ করেছে, তজ্জন্য তোমার অধিক বিস্ময় প্রকাশ করতে হয়; সুতরাং ঐ আল্লাহকে ধৈন্য। যিনি পথ প্রদর্শন করেন, পথ-ভ্রষ্ট করেন, সরল পথ দেখান, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য প্রদান করেন, যিনি তার বন্ধুগণের অন্তর্দৃষ্টি খুলেছেন। তার ফলে তারা দুনিয়ার সর্বস্থলে ও কোণে তাকে দেখতে পান। তিনি তাঁর শত্রুগণের মনকে অন্ধ করে দিয়েছেন এবং তাদের নিকট থেকে তার গৌরব ও সম্মানের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছেন। তারই জন্য খালক ও আমর, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ব্যাপার, সম্মান, করুণা এবং ক্রোধ। তাঁর আদেশের কোন লংঘনকারী নেই'। তাঁর বিধানের কোন পরিবর্তন নেই।

Post a Comment

0 Comments