প্রকাশ থাকে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্- এ কলেমার সাক্ষ্য দেয়া ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে একটি স্তম্ভ। এর প্রথম বাক্যে তওহীদ এবং দ্বিতীয় বাক্যে রেসালত বিধৃত হয়েছে। প্রথম বাক্য কয়েকটি বিষয় জানা উচিত।
প্রথম: একত্ববাদ; অর্থাৎ একথা জানা যে, আল্লাহ্ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি একক, তাঁর মত কেউ নেই। তিনি অমুখাপেক্ষী, তাঁর প্রতিদ্বন্দী এবং সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি চিরন্তন, যাঁর কোন শুরু নেই। তিনি সদা প্রতিষ্ঠিত, যাঁর কোন শেষ নেই। তিনি সদা বিদ্যমান, যাঁর কোন অবসান নেই। তিনি অক্ষয়, যাঁর কোন ক্ষয় নেই। তিনি মাহাত্ম্যের গুণাবলী দ্বারা সদা গুণান্বিত রয়েছেন এবং সদা থাকবেন। তিনিই সবার প্রথম এবং সবার শেষ। তিনিই জাহের এবং তিনিই বাতেন।
দ্বিতীয়: পবিত্রতা; অর্থাৎ, এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা সাকার নন, সীমিত পদার্থ নন, পরিণামবিশিষ্ট নন এবং বিভাজ্য নন। তিনি দেহের অনুরূপ নন, নিজে পদার্থ নন এবং কোন পদার্থ তাঁর মধ্যে অনুপ্রবিষ্টও নয়। তি িআর্য নন; অর্থাৎ অন্যের উপর ভর দিয়ে কায়েম নন এবং অন্যের উপর ভর দিয়ে যা কায়েম থাকে, তা তাঁর মধ্যে অনুপ্রবিষ্টও নয়। কোন বিদ্যমান বস্তুর অনুরূপ তিনি নন এবং কোন বিদ্যমান বস্তুও তাঁর মত নয়। না তাঁর সমতুল্য কেউ আছে এবং না তিনি কারও অনুরূপ । কোন পরিমাণ তাঁকে সীমিত করতে পারে না এবং কোন দিকও তাঁকে বেষ্টন করে রাখতে পারে না। আকাশ ও পৃথিবী তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না। তিনি আরশের উপর এমনভাবে অবস্থিত যেমন তিনি নিজে বলেছেন এবং যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেছেন। অর্থাৎ, তিনি আরশ স্পর্শ করা, তার উপর প্রতিষ্ঠত হওয়া, অবস্থান নেয়া, তাতে অনুপ্রবেশ করা এবং স্থানান্তরিত হওয়া থেকে পবিত্র। আরশ তাঁকে বহন করে না, বরং আরশ ও আরশ বহনকারীদেরকে তাঁর কুদরত বহন করে রেখেছে। সবকিছুই তাঁর কুদরতের আওতাভুক্ত। তিনি আরশ, আকাশ এবং পৃথিবীর সীমানা পর্যন্ত সবকিছুর উপরে। তিনি এভাবে উপরে যে, আরশেরও নিকটে নন এবং পৃথিবী থেকেও দূরে নন। বরং তাঁর মর্যাদা এসব নৈকট্য ও দূরত্বের অনেক ঊর্ধ্বে। এতদসত্ত্বেও তিনি প্রত্যেক বিদ্যমান বস্তুর সন্নিকটে এবং বান্দার ধমনীর চেয়েও নিকটবর্তী। কেননা, তাঁর নৈকট্য দেহের নৈকট্যের অনুরূপ নয়, যেমন তাঁর সত্তা দেহের সত্তার অনুরূপ নয়। তিনি কোন বস্তুর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেন না এবং কোন বস্তু তাঁর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে না। কোন স্থান তাঁকে বেষ্টন করবে তিনি এ বিষয়ের ঊর্ধ্বে, যেমন তিনি সময়ের বেষ্টনী থেকে মুক্ত। তিনি স্থান ও কালের জন্মের পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন। তিনি এখনও তেমনি আছেন যেমন পূর্বে ছিলেন। তিনি নিজ গুণাবলীতে সৃষ্টি থেকে আলাদা। তাঁর সত্তায় তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নেই এবং অন্য কোন কিছুতেই তাঁর সত্তা নেই। তিনি পরিবর্তন ও স্থানান্তর থেকে পবিত্র। তিনি আপন মাহাত্ম্যের গুণাবলীতে ক্ষয় ও পতন থেকে সর্বদা মুক্ত। তিনি গুণাবলীর পূর্ণতায় কোন সংযোজনের প্রয়োজন রাখেন না। বিবেক দ্বারাই তাঁর অস্তিত্ব আপনা আপনি জানা হয়ে যায়। জান্নাতে সৎকর্মপরায়ণদের প্রতি তাঁর নেয়ামত ও অনুগ্রহ এই হবে যে, দীদার বা দর্শনের আনন্দ পূর্ণ করার জন্যে তিনি আপন সত্তা চর্মচক্ষে দেখিয়ে দেবেন।
তৃতীয়: জীবন ও কুদরত। অর্থাৎ, এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা জীবিত, ক্ষমতাবান ও প্রতাপশালী। ক্লান্তি, অবসাদ, অসাবধানতা, নিদ্রা ও ক্ষয় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর মুত্যু নেই। আকাশ ও পৃথিবীর সাম্রাজ্য তাঁরই। আধিপত্য, ইযযত, সর্বশক্তিমত্তা, সৃষ্টি ও আদেশ তাঁরই। আকাশমণ্ডলী তাঁর ডান হাতে আবদ্ধ এবং সকল সৃষ্টি তাঁর মুঠোর মধ্যে পতিত। সৃষ্টি ও আবিষ্কারে তিনি স্বতন্ত্র ও একক। মানুষ ও তাদের ক্রিয়াকর্ম তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের রিযিক ও মৃত্যু নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কোন কিছু তাঁর কুদরতের বহির্ভূত নয়। তাঁর কদুরতের বস্তুসমূহ অগণিত এবং তাঁর জানা বিষয়সমূহের কোন শেষ নেই।
চতুর্থ: এলেম অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা সবকিছু জানেন এটা জানা।... পাতাল থেকে নিয়ে আকাশের উপর পর্যন্ত যা কিছু হয়, সবই তাঁর নখদর্পণে। আকাশ ও পৃথিবীর কোন অণু পরমাণু তাঁর কাছে গোপন নয়, বরং গভীর কালো রাতে কালো পাথরের উপর একটি কালো বর্ণের পিপীলিকার ধীর পদক্ষেপ এবং বায়ুর অভ্যন্তরে ধূলিকণার গতিবিধ সম্পর্কেও তিনি সুপরিজ্ঞাত। তিনি গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জেনে নেন এবং অন্তরের কুমন্ত্রণা, খটকা ও গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। তাঁর এলেম নিত্য ও অনন্ত। তিনি অনন্তকাল থেকে এই এলেম গুণে গুণান্বিত আছেন। তাঁর এলেম তাঁর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি এবং স্থানান্তর দ্বারা নতুন সৃষ্ট হয়নি।
পঞ্চম: ইচ্ছা অর্থাৎ, এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা এ জগতকে ইচ্ছাপূর্বক সৃষ্টি করেছেন এবং নব নব সৃষ্টির ব্যবস্থাপনা তিনিই করেন। তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তা হয়েছে এবং যা ইচ্ছা করেননি তা হয়নি। চোখের নিমেষ অথবা কোন আকস্মিক বিপদ আসা তাঁর ইচ্ছার বাইরে নয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাঁর আদেশ খণ্ডনকারী কেউ নেই এবং --তাঁর সিদ্ধান্ত মুলতবীকারীও কেউ নেই। তাঁর তওফীক ও রহমত ছাড়া বান্দার জন্যে নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই এবং তাঁর ইচ্ছা ব্যতিরেকে এবাদত ও আনুগত্যের কারও শক্তি নেই। যদি সমস্ত মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা ও শয়তান একত্রিত হয়ে বিশ্বের কোন একটি পরমাণুকেও আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুজ্ঞা ছাড়া গতিশীল অথবা স্থিতিশীল করতে চায়, তবে কখনও তারা তা পারবে না। তাঁর ইচ্ছা গুণও অন্য সকল গুণের ন্যায় তাঁর সত্তার সাথেই প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি অনন্তকাল থেকে এসব গুণে গুণান্বিত। তিনি যখন যে বস্তু হওয়ার ইচ্ছা অনন্তকালের মধ্যে করেছেন, ঠিক তখনই অগ্র-পশ্চাত ব্যতিরেকে তা হয়েছে। তাঁর কোন অবস্থা অন্য অবস্থা থেকে অমনোযোগী করে না।
ষষ্ঠ: শ্রবণ ও দর্শন। অর্থাৎ, এরূপ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। কোন শ্রাব্য বস্তু যতই গোপন, কোন দ্রষ্টব্য বস্তু যতই সূক্ষ্ম হোক, তাঁর শ্রবণ ও দর্শন থেকে অব্যাহতি পায় না। কোন দূরত্ব কিংবা অন্ধকার তাঁর শ্রবণের পথে প্রতিবন্ধক হয় না। তিনি দেখেন, কিন্তু চক্ষু কোটর ও পলক থেকে তিনি মুক্ত, তিনি শুনেন; কিন্তু কর্ণকুহর থেকে পবিত্র। কেনা, তাঁর পবিত্র সত্তা যেমন সৃষ্টির সত্তার মত নয়, তেমনি তাঁর গুণাবলী সৃষ্টির গুণাবলীর অনুরূপ নয়।
সপ্তম: কালাম অর্থাৎ, এটা জানা যে, আল্লাহ তাআলা কালাম করেন। সত্তার সাথে কায়েম তাঁর নিত্য ও অনন্ত কালাম দ্বারা তিনি আদেশ, নিষেধ, অঙ্গীকার ও শাস্তির কথা প্রকাশ করেছেন। তাঁর কালাম সৃষ্টির কালামের মত নয় যে, বায়ু থেকে অথবা বস্তুর আঘাত থেকে আওয়াজ হবে অথবা জিহ্বার নড়াচড়া ও ঠোঁটের মিল থেকে উচ্চারণ সৃষ্টি হবে; বরং তাঁর কালাম উপসর্গ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কোরআন, তওরাত, ইনজীল ও যবুর তাঁর গ্রন্থ, যা তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন পাকের তেলাওয়াত মুখে হয়, পত্রে লিখিত হয় এবং অন্তরে হেফয করা হয়; এতদসত্ত্বেও কোরআন নিত্য এবং আল্লাহ তাআলার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে পত্রে স্থানান্তরিত হতে পারে না। মূসা (আঃ) আল্লাহ তাআলার কালাম কণ্ঠস্বর ও অক্ষর ব্যতিরেকে শ্রবণ করেছেন।
অষ্টম: ক্রিয়াকর্ম অর্থাৎ, এরূপ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ ব্যতীত যা কিছু বিদ্যমান, তা সবই তাঁর কর্ম দ্বারা সৃষ্ট এবং তাঁরই ন্যায়বিচার থেকে কল্যাণপ্রাপ্ত। আল্লাহ তা'আলা আপন ক্রিয়াকর্মে প্রজ্ঞাময় এবং আপন বিধি-বিধানে ন্যায়বিচারক। তাঁর ন্যায়বিচার বান্দার ন্যায়বিচার দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। কেননা, বান্দা জুলুম করতে পারে, অন্যের মালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারে; কিন্তু আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে জুলুম কল্পনাও করা যায় না। কেননা, তিনি অন্যের মালিকানা লাভ করেন না। মোট কথা, তিনি ব্যতীত যত মানুষ জ্বিন, ফেরেশতা, শয়তান, আকাশ, পৃথিবী, জীবজন্তু, লতাপাতা, জড় পদার্থ, অজড় পদার্থ, উপলব্ধ ও অনুপলব্ধ বস্তু রয়েছে, সবই তিনি আপন কুদরতের দ্বারা নাস্তি থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। অনন্তকালে তিনি একাই বিদ্যমান ছিলেন। এরপর স্বীয় কুদরত প্রকাশ এবং পূর্ব ইচ্ছা বাস্তবায়িত করার উদ্দেশে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল না। একান্ত কৃপাবশেই তিনি সৃষ্টি করেন। এগুলো তাঁর উপর অপরিহার্য নয়। সুতরাং কৃপা, অনুগ্রহ ও নেয়ামত তাঁরই জন্যে শোভনীয়। কারণ, তিনি বান্দাদেরকে নানারকম আযাব ও বিপদাপদে ফেলে দিতে সক্ষম ছিলেন। এটাও তাঁর জন্যে ন্যায়বিচার হত, জুলুম হত না। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে আনুগত্যের বিনিময়ে সওয়াব দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটা তাঁর জন্যে অপরিহার্য ছিল কারণে এ প্রতিশ্রুতি দেননি। কেননা, কারও জন্যে কোন কিছু করা তাঁর উপর ওয়াজেব নয়। তাঁর কাছে কারও কোন ওয়াজেব প্রাপ্য নেই। কিন্তু মানুষের উপর তাঁর আনুগত্য অবশ্য প্রাপ্য রয়েছে, যা তিনি তাঁর পয়গম্বরগণের বাচনিক ওয়াজেব করেছেন। কেবল বিবেকের দৃষ্টিতে ওয়াজেব করেননি; বরং তিনি রসূল প্রেরণ করেছেন এবং প্রকাশ্য মোজেযার মাধ্যমে তাঁদের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর আদেশ নিষেধ, প্রতিশ্রুতি ও শান্তিবাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন। তাই রসূলগণকে সত্য জ্ঞান করা এবং তাঁদের আনীত বিধি-বিধান মেনে চলা মানুষের অপরিহার্য কর্তব্য।
এখন দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ অর্থাৎ, রেসালতের সাক্ষ্য দেয়ার কথা শুন। এটা বিশ্বাস করা উচিত, আল্লাহ তা'আলা নবীয়ে উম্মী কোরায়শী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আরব, আজম, জ্বিন ও মানবের প্রতি রসূলরূপে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর শরীয়ত দ্বারা পূর্ববর্তী সকল শরীয়ত রহিত করেছেন। তবে যেগুলো তিনি বহাল রেখেছেন সেগুলো ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সকল পয়গম্বরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং সকল মানুষের নেতা করেছেন। আল্লাহ তাআলা কেবল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু তথা তওহীদের সাক্ষ্য দেয়াকেই পূর্ণ ঈমান সাব্যস্ত করেননি, বরং এর সাথে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ তথা রসূলের রেসালতের সাক্ষ্যও জুড়ে দিয়েছেন। তিনি ইহকাল ও পরকালের যেসব বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন, সেগুলো মানুষের জন্যে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। এ সমুদয় বিষয়েই তাঁকে সত্যবাদী মনে করতে হবে। আল্লাহ তাআলা কোন বান্দার ঈমান কবুল করেন না, যতক্ষণ না সে মৃত্যু পরবর্তী অবস্থাসমূহের প্রতি বিশ্বাস করে, যার সংবাদ মুহাম্মদ (সাঃ) দিয়েছেন।
এসব অবস্থার মধ্যে প্রথম মুনকার ও নকীরের প্রশ্ন। মুনকার ও নকীর দু'জন ভয়ংকর আকৃতির ফেরেশতা। তাঁরা কবরে বান্দাকে আত্মা ও দেহ সহকারে সোজা বসিয়ে দেয় এবং তাকে তওহীদ ও রেসালত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা বলেন: তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কি? তোমার নবী কে? তাঁরা উভয়েই কবরের পরীক্ষক। মৃত্যুর পর প্রথম পরীক্ষা হয় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ।
দ্বিতীয়, কবরের আযাব নিশ্চিত বিশ্বাস করতে হবে। এ আযাব প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার সহকারে আত্মা এবং দেহ উভয়ের উপর যেভাবে আল্লাহ চাইবেন হবে।
তৃতীয়, মীযান তথা মানদণ্ড সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এর দু'টি পাল্লা হবে এবং প্রত্যেক পাল্লা আকাশ ও পৃথিবীর স্তরসমূহের সমান বৃহদাকার হবে। তাতে আল্লাহ তাআলার কুদরতে আমলসমূহ ওজন করা হবে। সেদিন বাটখারা কণা ও সরিষা পরিমাণে হবে, যাতে ন্যায়বিচার যথার্থই পূর্ণ হয়। সৎ আমলনামা সুন্দর আকারে নূরের পাল্লায় রাখা হবে এবং এসব নেক আমলের মর্তবা আল্লাহর কাছে যত বেশী হবে, ততই আল্লাহর কৃপায় পাল্লা ভারী হবে। মন্দ আমলনামা বিশ্রী আকারে অন্ধকার পাল্লায় রাখা হবে এবং আল্লাহ তাআলার ন্যায়বিচারের দরুন পাল্লা হালকা হবে।
চতুর্থ, পুলসেরাতে বিশ্বাস রাখতে হবে। দোযখের পৃষ্ঠে তরবারির চেয়ে ধারালো এবং চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম একটি পুল নির্মিত রয়েছে, সবাইকে এ পুল অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাফেরদের পা এ পুল থেকে ফসকে যাবে এবং তারা দোযখে পতিত হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর কৃপায় মুমিনদের পা তাতে অটল থাকবে এবং তারা জান্নাতে পৌঁছে যাবে।
পঞ্চম, হাউজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। ঈমানদারগণ এ হাউজের কাছ দিয়ে যাবে। এটা রসূলে করীম (সাঃ)-এর হাউজ। জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে এবং পুলসেরাত থেকে নীচে অবতরণের পর মুমিনরা এর পানি পান করবে। যে এর এক চুমুক পানি পান করবে, সে পরে কখনও পিপাসার্ত হবে না। এর প্রস্থ এক মাসের পথ। এর পানি দুধের চেয়ে সাদা এবং মধুর চেয়ে মিষ্ট। আকাশের তারার সমপরিমাণ পাত্র এর চারপাশে রক্ষিত থাকবে। জান্নাতের হাউজে কাওসার থেকে এসে দুটি নালা এ হাউজে পতিত হয়।
যষ্ঠ, হিসাব-নিকাশে ঈমান আনতে হবে। হিসাব-নিকাশ বিভিন্ন রূপ হবে। কারও কাছ থেকে চুলচেরা হিসাব নেয়া হবে, কাউকে ক্ষমা করা হবে এবং কেউ বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁরা হবেন আল্লাহ তাআলার নৈকট্যশীল বান্দা। পয়গম্বরগণের মধ্যে আল্লাহ যাঁকে ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করবেন রেসালতের বিষয়বস্তু পৌঁছানো হয়েছে কি না। রসূলগণকে মিথ্যা বলার ব্যাপারে কাফেরদের মধ্যেও যাকে ইচ্ছা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। বেদআতীদেরকে সুন্নতের ব্যাপারে এবং মুসলমানদেরকে আমলের ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন।
সপ্তম, এরূপ বিশ্বাস করতে হবে যে, তওহীদে বিশ্বাসী গোনাহগাররা শাস্তিভোগের পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। শেষ পর্যন্ত কোন তওহীদ বিশ্বাসী ব্যক্তিই জাহান্নামে থাকবে না। এ থেকে তওহীদ বিশ্বাসীর চিরকাল জাহান্নামে না থাকার কথা জানা গেল।
অষ্টম, শাফায়াতে বিশ্বাস করতে হবে। প্রথমে পয়গম্বরগণ শাফায়াত করবেন, এরপর আলেমগণ, এরপর শহীদগণ, এর পর সকল মুসলমান শাফায়াত করবেন। তাঁদের মধ্যে যাঁর যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ তাআলার কাছে হবে, তাঁর শাফায়াত ততটুকু গৃহীত হবে। যে মুমিন এমন থেকে যাবে, তাঁর জন্যে কেউ শাফায়াত করেনি, তাকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় কৃপায় দোযখ থেকে বের করবেন। সুতরাং কোন মুমিন অনন্তকাল দোযখে থাকবে না। যার অন্তরে কণা পরিমাণও ঈমান থাকবে, সেও দোযখ থেকে মুক্তি পাবে।
নবম, এরূপ বিশ্বাস করতে হবে যে, সাহাবায়ে কেরাম শ্রেষ্ঠ এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম এরূপ: নবী করীম (সাঃ)-এর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হলেন হযরত আবু বকর (রাঃ), এরপর হযরত ওমর (রাঃ), এরপর হযরত ওসমান (রাঃ), এরপর হযরত আলী (রাঃ)।
দশম: সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করতে হবে এবং তাঁদের প্রশংসা করতে হবে, যেমন আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূল (সাঃ) তাঁদের প্রশংসা করেছেন।
উপরোক্ত বিশ্বাস্য বিষয়সমূহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং মনীষীগণের উক্তি এগুলোর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। সুতরাং যেব্যক্তি এসব বিষয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হবে, সে আহলে সুন্নত দলের মধ্যে গণ্য হবে এবং পথভ্রষ্ট ও বেদআতীদের দল থেকে আলাদা থাকবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এবং সকল মুসলমানকে পূর্ণ বিশ্বাস দান করুন এবং দ্বীনের উপর কায়েম রাখুন।
0 Comments