ইসলামের জন্য হযরত আবু জান্দাল (রাঃ) নির্যাতনের শিকার

        একদিকে এই বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই অবমাননাকর সন্ধি, মুসলমানদের মনে ক্ষোভ ধূমায়িত ছিল। যখন সন্ধি লেখার কাজ চলছিল ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলমানদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবার মতই একটি ঘটনা ঘটলো। কুরাইশদের প্রতিনিধি সুহায়েল ইবনে আমর সন্ধি করতে এসেছে। আর তার সন্তান আবু জান্দাল তখন শৃংখলিত অবস্থায় মক্কা থেকে পালিয়ে সন্ধি স্থলে দেহে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ইতোপূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে বেঁধে নির্যাতন করা হত। তখন পর্যন্ত তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। তাঁর এই অবস্থা দেখে মুসলমানদের মানের আগুন এবার প্রকাশ্যে জ্বলে উঠলো। হযরত আবু জান্দাল এসে মুসলমানদেরকে এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন। তিনি মুসলমানদের সামনে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর কাফির পিতা সুহায়েল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, 'হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সন্ধি পালনের সময় উপস্থিত। আমার সন্তানকে আমার কাছে ফেরৎ দেয়া হোক।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'এখনো তো চুক্তিপত্র লেখার কাজই শেষ হয়নি।' সুহায়েল বললো, 'তাহলে আমরা এই চুক্তি অনুসরণ করবো না।' 

        আল্লাহর নবী তাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে কোন কথাই শুনলো না। তার সন্তান আবু জান্দালের মুখে সে প্রচন্ড আঘাত করলো। হযরত আবু জান্দাল তখন করুণ কন্ঠে আর্তনাদ করে মুসলমানদেরকে বলছিল, 'হে আমার মুসলমান ভাইয়েরা! ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যারা আমার ওপর দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন চালাচ্ছে, আমাকে পুনরায় তাদের কাছেই ফেরৎ পাঠাচ্ছো?'

        তাঁর অবস্থা দেখে মুসলমানদের চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বুকের ভেতর যেন তোলপাড় করে উঠলো। তিনি তাঁর হযরত আবু জান্দালকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 'আবু জান্দাল! ধৈর্য ধারণ করো। তোমাদের মত যাদের অবস্থা তাদের মুক্তির ব্যবস্থা মহান আল্লাহ করে দেবেন। আমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে চুক্তি করেছি। এই চুক্তি লংঘন করা যায় না।'

        হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছুটে গেলেন হযরত আবু জান্দালের কাছে। তিনি তাঁর দিকে কথা বলতে বলতে তরবারী এগিয়ে দিলেন। হযরত ওমর আশা করেছিলেন, আবু জান্দাল তাঁর তরবারী গ্রহণ করে পিতা সুহাইলকে হত্যা করে নিজেকে মুক্ত করবে। কিন্তু হযরত আবু জান্দাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আল্লাহর নবীর কথায় ধৈর্যের পথ অবলম্বন করলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এলেন। তাঁর মুসলিম ভাইয়ের যন্ত্রণা নিজ চোখে দেখে তিনি যেন কিছুটা ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহর নবীকে তিনি আবেগভরে বললেন, 'আপনি কি সত্যই আল্লাহর রাসূল নন?' আল্লাহর হাবীব শান্ত কন্ঠে বললেন, 'হে ওমর। আমি সত্যই আল্লাহর রাসূল।' হযরত ওমর পুনরায় বললেন, 'আমরা কি সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত নই?' তিনি বললেন, 'অবশ্যই আমরা সত্যর ওপর প্রতিষ্ঠিত।'

         হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'আমরা ইসলামের এই অবমাননা কেমন করে বরদাস্ত করবো?'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'হে ওমর! আমি আল্লাহর রাসূল,তাঁর নির্দেশ ব্যতীত কিছুই করতে পারি না। তিনি অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবেন।' হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু অভিমান সুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা কা'বাঘর তাওয়াফ করবো!'

        রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, 'তবে আমি এ কথা বলিনি যে, এ বছরই আমরা তাওয়াফ করবো।'

        হযরত ওমর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছে গেলেন। তাঁর কাছেও তিনি একই কথা বললেন। হযরত আবু বকর বললেন, 'হে ওমর। তিনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল। তিনি যা কিছু করেন তা আল্লাহর নির্দেশেই করেন।'

        এ সময়টি ছিল সাহাবায়ে কেরামের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার সময়। এই ধরণের চুক্তি রাসূল কেন করলেন, তা তাদের বোধগম্য হলো না। তারপর আবু জান্দালের করুণ অবস্থা দেখে তাদের মন-মানসিকতা একেবারে যেন ভেঙ্গে পড়েছিল। রাসূল নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই চৌদ্দশত তরবারী প্রস্তুত হয়ে যেত হযরত আবু জান্দালকে মুক্ত করার জন্য। অথচ আল্লাহর নবী তাঁদেরকে সে নির্দেশ না দিয়ে তাঁকে কাফিরদের হাতেই উঠিয়ে দিলেন। কেমন যেন এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম পড়ে গেলেন। তাঁরা আল্লাহর নবীর আদেশ পালন করতেও দেরী করলেন।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আদেশ দিলেন, 'তোমরা যে যেখানে আছো সেখানেই কোরবানী করো।' পরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার আদেশ দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম অবিচল বসে রইলেন। তারপর তিনি উঠে তাঁর তাঁবুর ভেতরে গেলেন। উম্মুল মোমেনিন হযরত উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার কাছে উপস্থিত সমস্যার কথা জানালেন। তিনি আল্লাহর নবীকে পরামর্শ দিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাউকে কিছু না বলে বাইরে গিয়ে নিজেই কোরবানী করুন এবং ইহরাম খোলার জন্য নিজের মাথা মুড়িয়ে ফেলুন। তারপর দেখবেন তাঁরা আপনার অনুসরণ করবে।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করলেন। সাহাবায়ে কেরাম এবার বুঝলেন, তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তা অপরিবর্তনীয়। তাঁর সিদ্ধান্তে আর পরিবর্তন আনা হবে না। তখন তাঁরাও আল্লাহর নবীর অনুসরণে কোরবানী করলেন এবং মাথা মুড়িয়ে ফেললেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনদিন হোদায়বিয়াতে অবস্থান করে মদীনার দিকে অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম মদীনা থেকে যে আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস নিয়ে মক্কার দিকে এসেছিলেন, এখন আর তাঁদের ভেতরে সে আনন্দের, লেশ মাত্র নেই। তার পরিবর্তে তাদের ভেতরে জমা হয়েছে হতাশা আর অভিমান। মনে বড় আশা ছিল, মাতৃভূমি মক্কাতে থাকতে না পারলেও অন্তত দীর্ঘ দিন পরে প্রাণ ভরে মক্কাকে দেখবেন। সে ভাগ্য তো হলোই না, এমন এক ধরণের সন্ধির কাছে নতি স্বীকার করে যেতে হচ্ছে, যে সন্ধি পরাজয়মূলক। ভগ্ন হৃদয়ে তাঁরা মদীনার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। আবার সাহাবায়ে কেরামের মনে বিবেকের যন্ত্রণাও ছিল, তাঁরা কি এবার রাসূলের সাথে কোন অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেন না তো! বিশেষ করে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বিবেকের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছিলেন।

        এমন সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহর ঘোষনা শুনিয়ে দিলেন। যে কারণে মুসলমানদের মন খারাপ ছিল, আল্লাহ তা'য়ালা সেদিকেই ইঙ্গিত করে জানিয়ে দিলেন- হে রাসূল। আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি। (সূরা ফাতাহ-১-৪)

        সমস্ত মুসলমান যে চুক্তিকে স্পষ্ট পরাজয় হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, মহান আল্লাহ সেই চুক্তিকে সুস্পষ্ট বিজয় হিসাবে চিহ্নিত করলেন। তাঁরা অনুভব করলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজস্ব মন-মস্তিষ্ক দিয়ে এই চুক্তি করেননি। তাঁকে এ ধরণের চুক্তি করার জন্য মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ঘোষনাও দেয়া হলো, সাহাবায়ে কেরাম যে ভুল ত্রুটি করেছেন, মহান আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের মনে যে বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল, সে বেদনা তাঁদের ব্যক্তি স্বার্থে হয়নি। ইসলামের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই তাঁদের ভেতরে ক্ষোভের বা বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল।

        মুসলিম শরীফের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষনা আসার পরে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু অন্তরে শান্তি লাভ করেছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, আমি নিশ্চয়ই রাসূলের সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে কাফফারা আদায় করেন। রোজা রাখেন, নফল নামায আদায় করেন, দান সদকা করতে থাকেন, দাস মুক্ত করেন। এভাবে তিনি তাঁর ব্যবহারের জন্য কাফফারা আদায় করেন। কিছুদিন পরেই সকল সাহাবায়ে কেরাম বুঝলেন, হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিল মক্কা বিজয়ের উদ্বোধন।

Post a Comment

0 Comments