হযরত আরকামের বাড়িটা ছিল এই ইসলামী কার্যক্রমের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এই বাড়িতেই হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইসলামের ইতিহাসে সেদিনই সর্বপ্রথম স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উচ্চকণ্ঠে তাকবির দিয়েছিলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর পিতার নাম ছিল খাত্তাব এবং মাতার নাম ছিল হান্ডামা। তাঁরা ছিলেন আ'দী গোত্রের লোক। হযরত ওমরের অষ্টম উর্ধ্ব পুরুষ কা'বা নামক ব্যক্তির মাধ্যমে বিশ্বনবীর নছবের সাথে মিলিত হয়েছে। মক্কার জাবালে আকির নামক পাহাড়ের পাদদেশে ছিল হযরত ওমরের উর্ধ্বতন গোষ্ঠীর বাসস্থান। ইসলামের স্বর্ণালী যুগে সে পাহাড়ের নাম দেয়া হয়েছিল জাবালে ওমর বা ওমরের পাহাড়।
যে সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেন সে সময়ে গোটা কুরাইশদের মধ্যে মাত্র সতেরজন লোক লেখা পড়া জানতেন। তাঁর মধ্যে হযরত ওমর ছিলেন একজন। সে সময়ের ইতিহাস থেকে জানা যায় হযরত ওমর ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ বীর এবং বিখ্যাত কুস্তিগীর, পাহলোয়ান। ঊকাষের মেলায় তিনি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। সমকালিন বিখ্যাত কবিদের সমস্ত কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ, এ থেকে ধারণা করা যায় তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভা কি ধরণের ছিল। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। বংশ ভালিকা বিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। ঐতিহাসিকগণ বলেন তাঁর জ্ঞান বিবেক বুদ্ধির সুনাম চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কোন গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তাকেই দূত হিসাবে প্রেরণ করা হত। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী এবং সে কারণে তাকে বিদেশ ভ্রমণ করতে হত। ফলে বিদেশের নেতৃবৃন্দ এবং শাসক ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশার কারণে তাঁর জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি বিশেষ এক স্তরে উন্নিত হয়েছিল।
নেতৃত্বের যাবতীয় গুণাবলী ছিল তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। সেই মূর্খতার যুগেও তিনি ছিলেন নেতা আবার ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তিনিই ছিলেন নেতা। ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাঁর মত ব্যক্তিত্বের একান্ত প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর মত ব্যক্তিত্বের জন্য দোয়া করেছিলেন, 'হে আল্লাহা ওমর ইবনে খাত্তাব অথবা আমর ইবনে হিশামকে ইসলামে দাখিল করে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী করো।'
তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা ছিল বড় অপূর্ব। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর বংশের আরেকজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল হযরত নুয়াইম ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি তখন পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে তেমন কোন সংবাদ রাখতেন না। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যে সময় ইসলামের কথা শুনলেন তখন তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়লেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন যারা ইসলাম কবুল করেছিল, তিনি তাদের প্রাণের শত্রু হয়ে পড়লেন। তিনি যখন শুনলেন তাঁর এক দাসীও ইসলাম কবুল করেছে, তখন তিনি সেই দাসীর ওপরে চরম নির্যাতন করলেন। দাসীকে যখন তিনি ইসলাম ত্যাগ করাতে সম্মত হলেন না, তখন তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, ইসলাম যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তাকেই তিনি এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিবেন। তারপর শানিত তরবারী কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি বিশ্বনবীর সন্ধানে বের হলেন। পথে তাঁর সাথে কথা হয়েছিল হযরত নুয়াইম ইবনে আব্দুল্লাহর সাথে। সে হযরত ওমরকে জিজ্ঞাসা 'করলো, 'হে ওমর! তুমি এমন ক্রোধের সাথে কাঁধে তরবারী ঝুলিয়ে কোথায় যাচ্ছো?'
লোকটির প্রশ্নের জবাবে হযরত ওমর ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সাথে একটা শেষ বুঝাপড়া করতে।' লোকটি তাঁকে সাবধান করে দেয়ার জন্য বললো, 'তাঁর কোন ক্ষতি করলে তাঁর গোত্রের লোকজনের হাত থেকে তুমি নিস্তার পাৰে কি করে?' লোকটির একথায় হযরত ওমর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 'তুমি বোধহয় তাঁর আদর্শ গ্রহণ করেছো?' লোকটি হযরত ওমরের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য দ্রুত কন্ঠে বললো, 'একটি সংবাদ শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে, তোমার বোন এবং তাঁর স্বামী ইসলাম কবুল করেছে।'
এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত ওমর ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি ছুটলেন তাঁর বোনের বাড়ির দিকে। তাঁর বোন ভগ্নিপতি ঘরের দরোজা বন্ধ করে সে সময় হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছে কোরআনের সূরা ত্ব-হা শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। হযরত ওমর বোনের বদ্ধ দরজার কাছে যেতেই তাঁর কানে কোরআনের মধুর বানী প্রবেশ করে তাঁর অন্তরের পূঞ্জিভূত বরফ গলানো শুরু করে দিয়েছিল। তিনি গর্জন করে বোনের দরজায় আঘাত করলেন। ওমরের আভাস পেয়ে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু-আত্মগোপন করলেন। দরজা খুলে দেয়ার পরে হযরত ওমর ঘরে প্রবেশ করে তাদের কাছে ধমকের সুরে জানতে চাইলেন, 'তোমরা কি পড়ছিলে? আমি তাঁর শব্দ পেয়েছি।'
তাঁরা জবাব দিলেন, 'আমরা পরস্পরের মধ্যে কথা বলছিলাম। হযরত ওমর বললেন, 'তোমরা বাপ-দাদার আদর্শ ত্যাগ করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করেছো। তাঁর ভগ্নিপতি বললেন, 'আমাদের আদর্শ থেকেও অন্য আদর্শ যদি উত্তম হয় তাহলে তুমি কি করবে ওমর?'
তাঁর মুখের কথা শেষ হতেই হযরত ওমর ভগ্নিপতির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে অমানবিকভাবে প্রহার করতে শুরু করলেন। স্বামীকে বাঁচাতে এসে তাঁর বোনও ভাইয়ের হাতে রক্তাক্ত হলেন। বোনের শরীরে রক্ত দেখে হযরত ওমর যেন চমকে উঠলেন। ইতোপূর্বেই তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, নির্যাতনের মুখেও তাঁর দাসী এই আদর্শ ত্যাগ করেনি। তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতির অবস্থাও তেমনি। তাহলে কি আছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আদর্শের ভেতরে? প্রশ্নটি তাঁর ভেতরের পৃথিবীটা সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিল। তিনি কেমন যেন বিহবল হয়ে পড়লেন। অনুশোচনার কণ্ঠে তিনি তাঁর বোন ভগ্নিপতিকে বললেন, 'তোমরা কি পড়ছিলে আমাকে দেখাও!'
হযরত ওমরর কন্ঠের পরিবর্তন শুনেই তাঁরা অনুভব করেছিল, ওমরের ভেতরে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। তাঁরা জানালো, 'আমরা যা পড়ছিলাম তা মহান আল্লাহর বাণী, অপবিত্র অবস্থায় তা স্পর্শ করা যায় না।'
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু পবিত্র হয়ে এসে আল্লাহর কোরআন পড়তে লাগলেন। কিছুটা পড়েই তিনি করুণ কন্ঠে আবেদন জানালেন, 'কোথায় আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো।' হযরত ওমরের এই কথা শুনে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু গোপন স্থান থেকে বের হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আনন্দিত কন্ঠে বললেন, 'হে ওমর। আনন্দের সংবাদ গ্রহণ করো, তোমার জন্য আল্লাহর রাসূল দোয়া করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের দোয়া কবুল করেছেন। তিনি এখন সাফা পাহাড়ের ওপরে আরকামের বাড়িতে অবস্থান করছেন।'
হযরত ওমর দারে আরকামের দিকে চলেছেন। হযরত হামজা ও হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম সে সময় দারে আরকামের দরজায় কিছু সংখ্যক মুসলমানসহ প্রহরা দিচ্ছিলেন। হযরত ওমরকে কাঁধে তরবারী ঝুলিয়ে আসতে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। হযরত হামজা সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, 'তাকে আসতে দাও, আল্লাহ যদি ওমরের কল্যাণ করেন তাহলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করবে, আর যদি সে অন্য উদ্দেশ্যে আসে তাহলে তাঁর তরবারী দিয়েই তাকে হত্যা করা হবে।'
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে সময় আরকামের বাড়ির ভেতরে অবস্থান *করছিলেন। হযরত ওমরের আগমনের কথা জানালে তিনি প্রশান্ত চিত্তে বলেছিলেন, 'তাকে আসতে দাও।'
এরপর হযরত ওমর এসে পৌঁছলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে এসে তাঁর তরবারীর গোড়ার দিক এবং পরনের কাপড় নিজের হাতে ধরে মমতাভরা কন্ঠে বললেন, 'হে ওমর! তুমি কি বিরত হবে না। হে আল্লাহ! ওমর আমার সামনে, হে আল্লাহ ওমরের মাধ্যমে তুমি তোমার ইসলামকে শক্তিশালী করো।'
হযরত ওমর আল্লাহর নবীর হাতে হাত রেখে ঘোষনা দিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনার জন্য আপনার কাছে এসেছি।' হযরত ওমরের কন্ঠে এমন ব্যাকুল আবেদন শুনে আল্লাহর নবীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বলেন, 'বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে মুহূর্তে উচ্চকণ্ঠে আল্লাহ আকবার বলে তাকবির দিয়েছিলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামও নবীর কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সেদিন তাওহীদের বিজয় ঘোষনা করেছিলেন। নবী এবং সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত শ্লোগানে সেদিন পৃথিবীর সমস্ত বাতিল শক্তির ভিত্তি ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল, যা শুধু ধ্বসে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। ইসলামের বিপ্লবী কাফেলায় শামিল হয়েই আল্লাহর সৈনিক ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ষোঘনা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আর লুকোচুরি নয়, আল্লাহ বিরোধী মিথ্যে শক্তি প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাবে, আল্লাহর ঘরে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবে আর আমরা যারা মহান আল্লাহর দাসত্ব করি তাঁরা কা'বায় নামায আদায় করতে পারবো না, গোপনে নামায আদায় করবো তা হতে পারে না। চলুন আমারা প্রকাশ্যে কা'বায় মহান আল্লাহকে সেজদা করবো।'
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইসলামী কার্যক্রম শুরু করার ছয় বছরের সময়। সে সময় হযরত ওমরের বয়স ছিল ত্রিশ-এর ওপরে এবং তেত্রিশ-এর মধ্যে।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছেন এ কারণে গোটা মক্কায় একটা শোরগোল সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল সেই আলোচনা। ব্যাপারটি আল্লাহর সৈনিকদের কাছে পরম খুশীর হলেও আল্লাহদ্রোহীদের কাছে তা ছিল একেবারে অবিশ্বাস্য। তাঁরা হতবাক হয়ে পড়েছিল। এই শোরগোল শুনে বীর কেশরী আস ইবনে ওয়াঈল এসে সমবেত কুরাইশদের কাছে জানতে চাইলো, 'কি হয়েছে তোমাদের, এত হৈ চৈ করছো কেন?'
কুরাইশরা তাকে জানালো, 'সর্বনাশের সংবাদ হলো ওমর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দলে ভিড়েছে।' এ সংবাদ শুনে আস ইবনে ওয়াঈল বললো, 'ওমর ঠিকই করেছে। আমি তাকে আশ্রয় দিলাম।' স্বয়ং হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করে সে রাতেই চিন্তা করলাম মক্কায় ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু কে আছে, তাকেই আমি আমার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ জানাবো। আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়লো ইসলামের বড় শত্রু হলো আবু জেহেল। পরদিন সকালে আমি আবু জেহেলের বাড়িতে চলে গেলাম। তাঁর ঘরের দরোজায় করাঘাত করে তাকে ডাকলাম। সে দরোজা খুলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ওমর! তুমি আমার কাছে এত সকালে কি মনে করে এসেছো? আমি তাকে বললাম, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছি। আমার কথা শুনে আবু জেহেল বললো, আল্লাহ তোকে কলঙ্কিত করুক এবং যে সংবাদ নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলঙ্কিত করুক। এই কথাগুলো বলতে বলতে সে আমার মুখের ওপরে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
0 Comments