মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং হাদীসে মহান নবী-রাসূল সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে, এ সম্পর্কে ধারণা অর্জনের পূর্বে মানুষকে সর্বপ্রথমে মহান আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হলে সর্বপ্রথমে আমাদের সামনে যে প্রশ্ন দেখা দেয় তাহলো, আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানার মাধ্যম কি? মানুষ হিসেবে আমাদের যে জ্ঞান আছে, এই জ্ঞান কি আমাদের নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত করে?
এই প্রশ্নের সঠিক এবং একমাত্র জবাব হলো, না। মানুষের জ্ঞান অসীম নয় বরং সসীম এবং এ সসীম জ্ঞান মানুষকে সকল বিষয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞান মানুষকে অনিবার্যভাবে ভুল পথে পরিচালিত করে। মানুষের দৃষ্টি শক্তির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। শ্রবণশক্তি, অনুভবশক্তি, উপলব্ধিবোধ, চিন্তাশক্তি, বাকশক্তি, দৈহিকশক্তি তথা সকল শক্তিই সীমাবদ্ধ। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, একজন মানুষ রেল লাইনের ওপরে দাঁড়িয়ে সম্মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়, এক পর্যায়ে মানুষ দেখে দু'পাশের রেল লাইন যেন এক হয়ে গিয়েছে। রেল লাইন আর দু'টো নেই একত্রে মিশে গেছে। আকাশের প্রান্তের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় আকাশ অনেক দূরে গিয়ে পৃথিবীর মাটির সাথে মিশে গেছে। বিশাল জলধী সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় শুধু পানি আর পানি। ওপার দেখা যায় না। ওপারে যে বৃক্ষ-তরুলতার অস্তিত্ব রয়েছে, জনপদ রয়েছে, দৃষ্টিশক্তি তা দর্শন করতে ব্যর্থ হয়। সুতরাং মানুষের দৃষ্টিশক্তি মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়।
মানুষের শ্রবণশক্তির অবস্থা আরো শোচনীয়। একত্রে পাঁচজন মানুষ যদি কোনো শব্দ শোনে, পাঁচজন পাঁচ ধরনের মন্তব্য করে। প্রকৃত যে কিসের শব্দ তা আড়াল থেকে অনুভব করা বড় কঠিন। মানুষের শ্রবণ শক্তিও মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। মানুষের ত্বক যা দিয়ে মানুষ স্পর্শ অনুভব করে, ত্বকও মানুষকে প্রকৃত সত্য অবগত করতে ব্যর্থ হয়। আড়াল থেকে একজন মানুষকে আরেকজন মানুষ স্পর্শ করলে সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় চোখে না দেখে বলতে পারে না।
নবী করীম (সা:) এর যুগের একটি ঘটনা, হযরত যাহের (রা:) নামক একজন বেদুঈন সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সা:) কে তিনি প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। তিনি মাঝে মধ্যেই রাসূল (সা:) এর জন্য উপহার সামগ্রী প্রেরণ করতেন। একদিন তিনি তাঁর এলাকা থেকে পণ্যসামগ্রী বিক্রির উদ্দেশ্যে মদীনা শহরের বাজারে এলেন। তিনি দাঁড়িয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন, এমন সময় নবী করীম (সা:) তাঁর পেছন দিক থেকে এসে তাঁকে নিজের বুকের মাঝে জাপটে ধরলেন। হযরত যাহের (রা:) দেখতে পাননি কে তাঁকে জাপটে ধরেছে। তিনি একটু কঠিন স্বরেই বললেন, 'এই কে? ছেড়ে দাও বলছি'। তারপর দেখলেন যাঁর স্পর্শ পেলে সমগ্র জগৎ ধন্য হয়, সেই তাঁরই পবিত্র দু'টো বাহু তাঁর মতো মানুষকে নিজ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেছেন। তখন তিনি নিজের শরীরটা আরো ঘনিষ্ঠভাবে নবী করীম (সা:) এর পবিত্র দেহ মুবারকের সাথে মিশিয়ে দিলেন। আল্লাহর রাসূল (সা:) কৌতুক করে লোকজনকে বললেন, 'তোমরা কি কেউ এই গোলামটি কিনবে?'
হযরত যাহের (রা:) কুণ্ঠিত হাসি হেসে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার মতো মূল্যহীন গোলামকে যে কিনবে সেই ঠগবে'।
নবী করীম (সা:) তাঁকে বললেন, 'আল্লাহ তা'য়ালার কাছে তোমার মূল্য কিন্তু অনেক বেশি'। (সীরাত উন নবী)
হযরত যাহের (রা:) যদি অনুভব করতে পারতেন যে, তাঁকে যিনি অনুগ্রহ করে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালার হাবীব। তাহলে তিনি অমন করে, 'এই কে, ছেড়ে দাও বলছি' বলতেন না। অর্থাৎ দেখা গেল, মানুষের অনুভব শক্তি তথা ত্বক মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
সুতরাং আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হলে আল্লাহ তা'য়ালা কর্তৃক প্রেরিত মহান নবী-রাসূল ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো পথ মানব জাতির সম্মুখে উন্মুক্ত নেই। ঠিক এ কারণেই মহান মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে সর্বপ্রথমে যাঁকে প্রেরণ করলেন তাঁকে নবুয়্যাত দান করেই প্রেরণ করলেন এবং যেখানে পাঠালেন সেখানে যে সকল বস্তু রয়েছে তার নাম ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কিত জ্ঞানও তাঁকে দান করলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন বলছে-
وَعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاءَ كُلِّهَا -
আল্লাহ তা'য়ালা অত:পর (তাঁর খলীফা) আদমকে (প্রয়োজনীয়) সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন। (সূরা আল বাকারা-৩১)
পৃথিবীতে আগমন করে তিনি কিভাবে কোন্ বিধান অনুসরণে জীবন পরিচালিত করে শান্তি, কল্যাণ, সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন করবেন সে দিকনির্দেশনাও মহান আল্লাহ তা'য়ালা এভাবে দিয়ে দিলেন-
قُلْنَا اهْبِطُواْ مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِّنَى هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ
আমি (তাদের) বললাম, তোমরা সবাই (এবার) এখান থেকে নেমে যাও, তবে (যেখানে যাবে অবশ্যই সেখানে) আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (জীবন বিধান সম্পর্কিত) হিদায়াত আসবে, অত:পর যে আমার (সেই) বিধান মেনে চলবে তার কোনো ভয় নেই, তাদের কোনো প্রকার উৎকণ্ঠিতও হতে হবে না। (সূরা আল বাকারা-৩৮)
সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা আল্লাহ তা'য়ালা প্রথম মানুষটিকে জানিয়ে দিলেন তাঁর পক্ষ থেকে তিনি জীবন বিধান সম্পর্কিত হিদায়াত প্রেরণ করবেন। প্রত্যেক মানুষের কাছে তিনি পৃথকভাবে হিদায়াত প্রেরণ করবেন এটি তাঁর নিয়ম নয় এবং বিষয়টি যৌক্তিকও নয়। এ জন্যে মানব জাতির মধ্য থেকেই নবী-রাসূল নির্বাচিত করেন তথা নবুয়্যাত- রিসালাত দান করে তাঁর মাধ্যমে মানুষের জন্যে হিদায়াত প্রেরণ করেছেন। এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে নবুয়্যাত ও রিসালাত কি জিনিস এবং এ দু'টো জিনিসের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা। এ দুটো জিনিসের দায়িত্ব কর্তব্যই বা কি এবং সম্মান-মর্যাদাই বা কি। এ বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার এই আয়াতের বক্তব্য জানতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন-
(এক সময়) সকল মানুষ একই উম্মতের অন্তর্ভূক্ত ছিলো (পরে এরা নানা দল উপদলে বিভক্ত হয়ে তাদের স্রষ্টাকেই ভুলে গেলো)। তখন আল্লাহ তা'য়ালা (সঠিক পথের অনুসারীদের) সুসংবাদবাহী আর অপরাধিদের জন্যে শাস্তির সতর্ককারী হিসাবে নবীদের পাঠালেন, তিনি সত্যসহ গ্রন্থও অবতীর্ণ করলেন, যেনো তা মানুষদের এমন পারস্পরিক বিরোধসমূহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করতে পারে, যে ব্যাপারে তারা মতবিরোধ করে; তাদের কাছে সুস্পষ্ট হিদায়াত পাঠানো সত্ত্বেও তারা পারস্পরিক (বিদ্রোহ ও) বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্যে মতবিরোধ করেছে, অতপর আল্লাহ তা'য়ালা তাদের সবাইকে স্বীয় ইচ্ছায় সেই সঠিক পথ দেখালেন, যার ব্যাপারে ইতোপূর্বে তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিলো; আল্লাহ যাকে চান তাকে সঠিক পথ দেখান। (সূরা বাকারাহ-২১৩)
তাফসীরকারগণ পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াত সম্পর্কে এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন; মানুষ সৃষ্টির শুরুতে সত্য পথ অনুসরণ করে চলছিল। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং তারা দলাদলি সৃষ্টি করে বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই মানব সভ্যতায় এক বিশৃংখল অবস্থার উদ্ভব হয়। এই মতভেদের কারণেই মানুষ প্রকৃত সত্য থেকে ছিটকে পড়ে, ক্রমশঃ সত্য তিরোহিত হয়ে যায়। মানুষ ভ্রান্ত পথের পথিক হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত পৃথিবীতে জীবন পরিচালনা করতে থাকে।
সত্য তিরোহিত হবার কারণে মানুষের মধ্যে চরম হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, মানুষ আত্মস্বার্থে অন্ধ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা সত্য অস্বীকারকারী হয়ে পড়ে। বিশৃংখলতা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন মহান আল্লাহ তাদের মধ্যে নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। তাঁরা মানুষকে মিথ্যা বা ভ্রান্ত পথ পরিহার করে সত্য গ্রহণের আহ্বান জানান, মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন, যারা সত্য গ্রহণ না করে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে তাদেরকে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেন।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নবী রাসূলের কাছে এমন এক কিতাব অবতীর্ণ করেন, যে কিতাবে প্রত্যেক মানুষের জন্য তাদের জীবনের প্রতিটি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান নিহিত রয়েছে। মানুষ যে সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, পরস্পরে দলাদলি করছে, যে বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য করছে, এ সকল কিছুর সমাধান এই কিতাবে রয়েছে। এই কিতাব সকল সমস্যার সমাধানকারী এবং মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনকারী। এই কিতাব ব্যতীত অন্য কোথাও সত্যের সামান্য চিহ্ন মাত্র নেই। সব সমস্যার সমাধান করার জন্যই এই কিতাব মহান আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে তাঁর নবী-রাসূলদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে মানুষের কাছে সত্য প্রেরণ করার পরে এবং তাদের সামনে মহাসত্য উদ্ভাসিত হবার পরেও এই মানুষ মতভেদে নিমজ্জিত এবং সত্যের বাহকদের প্রতি অবাঞ্ছিত আচরণে লিপ্ত ছিল। আর এ কারণেই সত্যের প্রতি যারা অনুরাগী, তারাই কেবল আল্লাহ তা'য়ালার অনুগ্রহে সত্য গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। কারণ, কোনো মানুষের যদি সত্য গ্রহণ করার মন-মানসিকতা আদৌ না থাকে, সত্য গ্রহণ করতে সে যদি প্রস্তুত না থাকে, তাহলে তার পক্ষে সত্য পথের পথিক হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। মহান আল্লাহ ঐ সকল ব্যক্তিকেই সত্য গ্রহণে সহযোগিতা করেন, যারা সত্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, যারা মিথ্যা বা বিশৃংখলা পরিহার করে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে আগ্রহী, তাদেরকেই আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে থাকেন।
সূরা আল বাকারার উক্ত আয়াত থেকে আমরা নবী-রাসূল প্রেরণের পটভূমি জানতে পারি, সেই সাথে আমরা জানতে পারলাম মানুষ শুরুতে সত্য পথের পথিক ছিল। পরবর্তীতে তারা কেনো বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল সেটাও জানা গেল এবং কোন শ্রেণীর মানুষের হিদায়াত নছীব হয়, কারা সত্য পথের পথিক হতে সক্ষম তা আমরা পবিত্র কুরআন থেকে জানতে পারলাম।
এ পর্যায়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, 'হযরত আদম (আ:) ও হযরত নূহ (আ:) এর মধ্যে সময়ের দশটি অধ্যায়ের ব্যবধান রয়েছে। প্রথমে মানুষ সত্য পথের পথিক ছিল। পরবর্তীতে তাদের ভেতরে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। আর তারপরই মহান আল্লাহ হযরত নূহ (আ:) ও অন্যান্য নবী প্রেরণ করেন'।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অজুহাত প্রদর্শন করা। মহান আল্লাহ মানুষকে যখন তাঁর কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তখন তো মানুষ এই অজুহাত দাঁড় করবে, 'হে আল্লাহ! আমরা প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাইনি। এ কারণে আমরা ভুল পথের পথিক ছিলাম'। এ ধরণের নানা যুক্তি আল্লাহর সামনে তারা পেশ করবে। সুতরাং মানুষের কাছে আল্লাহ তা'য়ালা নবী প্রেরণ করে তাদের কাছে সত্য প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন-
رُّسُلاً مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لَئَلَّا يَكُوْنَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ ط وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا
রাসূলরা (ছিলো জান্নাতের) সুসংবাদবাহী ও (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শনকারী, (তাদের এ জন্যেই পাঠানো হয়েছিলো) যাতে করে রাসূলদের আগমনের পর আল্লাহ তা'য়ালার ওপর মানব জাতির কেনো অজুহাত দাঁড় করার সুযোগ না থাকে; (সত্যিই) আল্লাহ তা'য়ালা মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিছা-১৬৫)
এই পৃথিবীতে নবী-রাসূলগণ আগমন করেন সকল মানুষের মুক্তিদাতা (The Salvationist) হিসেবে। তাঁরা সাথে করে জ্ঞানভান্ডার নিয়ে আসেন। মানুষকে তাঁরা মূর্খতার অন্ধকার হতে মহাসত্যের দিকে নিয়ে আসেন এবং আলোর পথের পথিক করেন। বস্তুত মহাসত্যের ধর্মই হলো, তাঁর অনুসারীকে অন্ধকার হতে আলোর জগতে আনয়ন করা। মহাসত্যের বাহক হযরত মূসা (আ:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِ لا وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ طَ إِنَّ فِي ذَالِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ -
আমি মূসাকে অবশ্যই নিদর্শনসমূহ দিয়ে (তার জাতির কাছে) পাঠিয়েছি, আমি আদেশ দিয়েছিলাম, তুমি বের করে নিয়ে এসো তোমার জাতিকে (মূর্খতার) অন্ধকার থেকে (মহাসত্যের) আলোতে এবং তুমি তাদের আল্লাহর (অনুগ্রহের বিশেষ) দিনগুলোর কথা স্মরণ করাও; যারা একান্ত ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞতাপরায়ণ, তাদের জন্যে এ (ঘটনার) মাঝে (অনেক) নিদর্শন রয়েছে। (সূরা ইবরাহীম-৫)
নবুয়্যাত এবং রিসালাত চেষ্টা-সাধনা করে লাভ করার কোনো জিনিস নয়। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে এটা একটি শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁকে এই নিয়ামত দানে ধন্য করেছেন। তাঁর সৃষ্টি মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ তা'য়ালা যাকে যোগ্য বিবেচনা করেছেন তাঁকেই তিনি নবুয়্যাত দান করেছেন। পৃথিবীতে মানুষ দায়িত্ব বলতে যা বুঝে, অর্থাৎ যত কঠিন দায়িত্ব এই পৃথিবীতে থাকতে পারে, এর মধ্যে নবুয়্যাতের দায়িত্ব হলো সবচেয়ে কঠিন। সাধারণ কোনো মানুষ এই দায়িত্ব এবং এর পরিধি সম্পর্কে কল্পনাও করতে পারে না।
যে কোনো মানুষের পক্ষে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে মহান আল্লাহ এই দায়িত্ব যার ওপরে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তাঁকে তাঁর মাতৃগর্ভ থেকেই উপযুক্ত করে গড়েছিলেন। এই দায়িত্ব যে কত কঠিন নবী করীম (সা:) কে মহান আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন-
إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلاً ثَقِيلاً
অচিরেই আমি আপনার ওপর একটি ভারী (গুরুত্বপূর্ণ বাণী সদৃশ) কিছু রাখতে যাচ্ছি। (সূরা মুয্যাম্মিল-৫)
দায়িত্ব যিনি অর্পণ করেন সেই আল্লাহই বলেছেন, এই দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিন। উল্লেখিত আয়াতে এই দুর্বহ দায়িত্বের কথা তিনি তাঁর নবীকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। নবুয়্যাত এবং রেসালাত চেষ্টা-সাধনা করে লাভ করার কোনো জিনিস নয়। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে এটা একটি শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁকে এই নিয়ামত দানে ধন্য করেছেন। তাঁর সৃষ্টি মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ যাকে যোগ্য বিবেচনা করেছেন তাঁকেই তিনি নবুয়্যাত দান করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন-
وَاللَّهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ طَ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
আল্লাহ তা'য়ালা যাকে চান তাকেই তাঁর অনুগ্রহে বিশেষভাবে বেছে নেন; আল্লাহ তা'য়ালা অত্যন্ত অনুগ্রহশীল। (সূরা বাকারা-১০৫)
ذَالِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَشَاءُ طَ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
(রাসূল পাঠানো) এটা আল্লাহর এক বিরাট অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি এটা দান করেন; আল্লাহ তা'য়ালা মহা অনুগ্রহশীল। (সূরা আল জুমুয়া-৪)
নবুয়্যাত এবং রিসালাত বংশগতভাবে বা উত্তরাধিকার সূত্রেও লাভ করা যায় না। আল্লাহ তা'য়ালা যাকে পছন্দ করেছেন, তাঁকেই তিনি নবী বা রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন-
اللهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلاً وَمِنَ النَّاسِ طَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعُم بَصِيْرٌ -
আল্লাহ তা'য়ালা (তাঁর ওহী বহন করার জন্যে) ফিরিশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক মনোনীত করেন, মানুষদের ভেতর (তিনি এটা করেন) অবশ্যই আল্লাহ তা'য়ালা সবকিছু শোনেন ও সবকিছু দেখেন। (সূরা হজ্জ্ব-৭৫)
মহান আল্লাহর বাছাই নীতি সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানে ঘোষণা করেছেন-
إِنَّ اللهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'য়ালা আদম, নূহ ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরদের সৃষ্টিকুলের ওপর (নেতৃত্ব করার জন্যে) বাছাই করে নিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান-৩৩)
মহান আল্লাহর দেয়া এই নবুয়্যাতের দায়িত্ব যেমন কঠিন তেমনি এই দায়িত্ব যিনি লাভ করেছিলেন তাঁর সম্মান-মর্যাদা পৃথিবীতে সকলের তুলনায় সর্বোচ্চে। নবী করীম (সা:)-এর বিরোধিরা যতগুলো কারণে তাঁর বিরোধিতা করতো তাঁর মধ্যে এটাও একটি কারণ ছিল যে, এই দায়িত্ব লাভ করা অত্যন্ত সম্মান-মর্যাদার ব্যাপার। এই দায়িত্ব লাভ করবে সমকালীন দেশ-সমাজের প্রতিষ্ঠিত নেতৃবৃন্দ। আব্দুল্লাহর ইয়াতিম সন্তান মুহাম্মাদ (সা:) এই দায়িত্ব কিছুতেই লাভ করতে পারে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়েও তারা বিরোধিতা করতো।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের চিন্তা চেতনা এবং পছন্দ অনুসারে তাঁর নবুয়্যাত- রিসালাত বন্টন করেন না। এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা। তিনি বলেন-
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ ط
0 Comments