কুরাইশদের মধ্যে সম্মানিত গোষ্ঠীর সন্তান ছিলেন হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। তাঁর গোটা বংশই ছিল আরবের সেনা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। অর্থাৎ তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যারা সবাই সামরিক বাহিনীর লোক ছিল। তাঁর রক্তের মধ্যে মিশ্রিত ছিল সামরিক বাহিনীর সমর কৌশল। হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে মক্কা বিজয়ের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আমর ইবনুল আ'স রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সম্পর্কে কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি হাবশাতেই বাদশাহর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবার কোন বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি হাবশা থেকে মদীনায় রাসূলের কাছে যাচ্ছিলেন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। পথে তিনি মদীনা যাত্রী একদল লোককে দেখতে পেলেন। তাদের মধ্যে হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'হে খালিদ! কোন দিকে যাচ্ছো?'
তিনি কোন ধরণের জড়তা ব্যতীতই বললেন, 'আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আর কতদিন এভাবে থাকবো। চলো যাই তাঁর কাছে, ইসলাম গ্রহণ করি।'
তারপর তাঁরা মদীনায় আল্লাহর নবীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে প্রথমে হযরত খালিদ ও পরে হযরত আমর ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খালিদ বলেন, ইসলাম গ্রহণ করার পরে আল্লাহর নবী আমাকে বলেছিলেন, 'আমি তোমার ভেতরে যে যোগ্যতা দেখতাম, তাতে আমি আশাবাদী ছিলাম তুমি একদিন কল্যাণ লাভ করবে।'
হযরত খালিদ ইসলাম গ্রহণ করার পরে তাঁর মধ্যে অতীত ভুলের জন্য অনুশোচনা জাগলো। তিনি আল্লাহর নবীর কাছে আবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে আমি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে গোনাহ করেছি, এ কারণে আমার জন্য দোয়া করুন।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'ইসলাম অতীতের সমস্ত পাপ মুছে দেয়।'
হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'আপনার এই কথার ওপরে আমি বাইয়াত করলাম।' রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, 'আমার আল্লাহ! খালিদ তোমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে পাপ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও!'
ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশদের জেনারেল, ইসলাম গ্রহণের পরে মুসলিম হিসাবে তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধেই ঘটনা চক্রে তাঁকেই জেনারেলের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। মুসলিম হিসাবে তাঁর প্রথম যুদ্ধ ছিল মুতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার আর রোমান বাহিনীর সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধে পরপর তিনজনের নাম সেনাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। হযরত যায়িদ, হযরত জাফর ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম আজমাঈন- এই তিনজনের কথা রাসূল এভাবে বলেছিলেন যে, প্রথমজন শাহাদতবরণ করলে দ্বিতীয়জন সেনাপতি হবে। তিনিও শাহাদাতবরণ করলে তৃতীয়জন সেনাপতি হবে। তিনিও শাহাদাতবরণ করলে মুসলমানরা যাকে ইচ্ছা সেনাপতি নিয়োগ করবে।
মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতির অধীনে হযরত খালিদ জেনারেলের সমস্ত অহংকার বিসর্জন দিয়ে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। পরপর তিনজনই যখন শাহাদাতবরণ করলেন, তখন হযরত সাবিত ইবনে আকরাম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যুদ্ধের পতাকা উঠিয়ে নিলেন- যেন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে কোন ধরণের বিশৃংখলা সৃষ্টি না হয়।
পতাকা হাতে তিনি হযরত খালিদের কাছে এসে বললেন, 'হে খালিদ! এই পতাকা তুমি ধরো।'
দুই লক্ষের বিরুদ্ধে মাত্র দুই হাজার সৈন্য এবং এই দুই হাজারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা বেশী। বদর, ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরাম এই বাহিনীতে শামিল রয়েছেন। তাদের ওপরে নও মুসলিম খালিদের নেতৃত্ব দেবার যে কোন অধিকার নেই এ কথা হযরত খালিদের থেকে আর কে ভালো বুঝতো! তিনি আপত্তি জানিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে বললেন, 'অসম্ভব! আমি এ পতাকা গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আপনি বদর-ওহুদে অংশগ্রহণ করেছেন। আপনিই এই পতাকার যোগ্যতম ব্যক্তি।
হযরত সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'আমি এই পতাকা তোমার জন্যই উঠিয়ে এনেছি। আমার তুলনায় তোমার মধ্যে সামরিক যোগ্যতা অনেক বেশী। তুমি এ পতাকা ধরো।' এবার হযরত সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মুসলিম বাহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমরা কি খালিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে রাজি আছো?' সমবেত বাহিনী সম্মতি জানিয়ে বলেছিল, 'অবশ্যই আমরা রাজি আছি।'
হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে দুই হাজার মুসলিম বাহিনী দুই লক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। তিনি বলেন, 'সেদিনের যুদ্ধে আমার হাতে সাতটি তরবারী ভেঙ্গেছিল। সর্বশেষে একটি ইয়েমেনী তরবারী টিকে ছিল।'
আল্লাহর নবী হযরত খালিদের উপাধি দান করেছিলেন, সাইফুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারী। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যেমন ছিলেন ইসলামের কট্টর শত্রু, তেমনি ইসলাম গ্রহণ করার পরে হয়েছিলেন ইসলামের পরম বন্ধু।
মক্কায় বিভিন্ন গোত্রের ওপরে বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পিত ছিল এ কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর গোত্র ছিল মক্কার সেই বিখ্যাত গোত্র, যে গোত্র মক্কার ঝগড়া বিবাদের মিমাংসা করতো। তাঁর গোত্রের নাম ছিল বনী সাহম। মক্কার যে তিনজন লোক ছিল ইসলামের প্রধান শত্রু, হযরত আমর ছিলেন তাদের একজন। তিনিই ইসলাম গ্রহণ করে হলেন ইসলামের মহাসেনা নায়ক, আরবের শ্রেষ্ঠ কৌশলী কূটনীতিক ও মিশরবাসীর মুক্তিদাতা।
মুসলমানদের প্রথম যে দলটি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য হযরত আমর গিয়েছিলেন। তিনিই অমুসলিম অবস্থায় আবিসিনিয়ার বাদশাহকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। খন্দকের যুদ্ধে এসেই হযরত আমরের ভেতরে ইসলাম সম্পর্কে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি স্বয়ং বলেন, 'ইসলামের আহ্বান সম্পর্কে আমি ভাবতে থাকি। তারপর এক পর্যায়ে আমার কাছে ইসলামের মূল সত্য স্পষ্ট হতে থাকে। তারপর আমি মুসলমানদের বিরোধিতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। কুরাইশ নেতারা আমার মনের অবস্থা অনুভব করতে পেরে আমার কাছে একজন লোক পাঠিয়েছিল। সে আমার সাথে তর্ক বিতর্ক শুরু করলো। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বলতে পারো, আমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত না রোমান পারসিকরা?'
লোকটি জবাব দিল, 'আমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।' আমি তাকে পুনরায় প্রশ্ন করলাম, 'সুখ সম্পদ এবং ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী আমরা না তারা?' লোকটি জরাব দিয়েছিল, 'তারাই সুখ-সম্পদ এবং ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী।'
আমি তাকে বললাম, 'বর্তমান জীবনের শেষে ইন্তেকালের পরে যদি কোন জীবন থেকে থাকে, তাহলে আমাদের এই সত্য কোন কাজে লাগলো? এই পৃথিবীতে আমাদের সত্য আমাদের দুর্দশা দূর করতে সক্ষম হলো না, তাহলে পরকালে আমাদের কোন কল্যাণ লাভের কোন আশাই নেই। সুতরাং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেন, মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন আছে এবং সে জীবনে মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করবে, এ কথা অত্যন্ত যুক্তি সংগত বলেই আমার কাছে মনে হয়।'
তিনি আরো বলেন, 'খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরেই আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের বলেছিলাম, একটি কথা তোমরা জেনে রেখো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রচারিত আদর্শ বিজয়ী হবার জন্যই এসেছে। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এ সম্পর্কে আমার পরামর্শ হলো, চলো আমরা আবিসিনিয়ায় 'বাদশাহর দরবারে চলে যাই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি বিজয়ী হয় তাহলে আমরা আর ফিরবো না। আমরা আবিসিনিয়ায় বাদশাহর দরবারে চলে গেলাম।'
সেখানে ঘটনার এক পর্যায়ে বাদশাহ তাঁকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বুঝালেন। তাঁর চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটে গেল। তিনি বাদশাহর হাতে হাত রেখেই ইসলামের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেন। তারপরই তিনি মদীনার পথে দরবারে নববীতে যাত্রা করলেন। পথে হযরত খালিদের সাথে দেখা এবং কথা হলো। তারপর তাঁরা আল্লাহর নবীর সামনে উপস্থিত হলেন। হযরত আমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, 'আমাদেরকে দেখেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারকে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। তিনি উপস্থিত মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, লাকাদ রামাত কুম মাককাহ বিফালাজাতি আকবাদিহা-মক্কা তার কলিজার মূল্যবান অংশসমূহ তোমাদের প্রতি ছুড়ে দিয়েছে।' হযরত খালিদ ইসলাম কবুল করে যে কথা বলেছিলেন, হযরত আমরও অনুশোচনা করে একই কথা বললেন। আল্লাহর নবী বললেন, 'ইসলাম অতীতের সমস্ত গোনাহ মুছে দেয় এবং হিজরতও সমস্ত গোনাহ মুছে দেয়।'
আরব উপদ্বীপে অধিকাংশ গোত্র মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কোন কোন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাদের শতাব্দী সঞ্চিত কুসংস্কার ত্যাগ করতে পারেনি। তাঁরা মূর্তির আখড়া উৎখাত করতে ভয় পাচ্ছিল। এ কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন এলাকার নও মুসলিমদের কাছে সাহাবায়ে কেরামকে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা মূর্তির আখড়া উৎখাত করতে সহযোগিতা করতেন। বনী হুজাইল গোত্রের লোকদের কাছে হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে প্রেরণ করা হলো।
সেখানে বিশাল একটি মূর্তির আখড়া ছিল। নও মুসলিমরা তাঁকে জানালো, এখানের মুর্তি ভাঙ্গা সহজ হবে না। এই মুর্তি নিজেকেই নিজে রক্ষা করতে পারে। হযরত আমর তাদের ঈমানী দুর্বলতা দেখে মৃদু হেসে তাদেরকে বললেন, 'তোমাদের অন্তর থেকে দেখছি এখন পর্যন্ত কুসংস্কার দূর হয়নি। যাদের দেখার ক্ষমতা নেই, শোনার ক্ষমতা নেই, তারা কিভাবে আত্মরক্ষা করবে? এবার দেখো তারা কিভাবে আত্মরক্ষা করে!'
এ কথা বলেই তিনি মূর্তির আখড়া ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য দেখে ঐ গোত্রের লোকজনের ঈমান দৃঢ় এবং শতাব্দী সঞ্চিত কুসংস্কার ক্রমশঃ তাদের মধ্যে থেকে দূরিভূত হলো।
0 Comments