অগ্নি পরীক্ষায় হযরত খাব্বাব (রাঃ)

        যাঁরা দ্বীন ইসলামের জন্য নিজেদেরকে কোরবানী এবং আল্লাহর রাস্তায় কঠিনতম শাস্তি ভোগ করেছিলেন, হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রাথমিক স্তরের পাঁচ ছয় জনের ইসলাম গ্রহনের পর তিনি মুসলমান হন। সুতরাং তাঁকে যে কি ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল তা সহজই অনুমেয়। তাঁর জীবনের পরিবর্তন অত্যন্ত হৃদয়-বিদারক। তাঁর প্রতি কাফেরদের অত্যাচারের অবধি ছিল না। লৌহ জেরা পরিয়ে তাঁকে আরবের মরুভূমির প্রচন্ড রোদে শায়িত করে রাখা হতো। রোদের তাপে তাঁর শরীর থেকে বিগলিত ধারায় ঘর্ম নির্গত হতো। অধিকাংশ সময়ই তাঁকে উত্তপ্ত বালুকাতে শয়ন করে রাখা হতো। উত্তাপে তাঁর কোমরের গোশত পর্যন্ন গলে যেত।

        তিনি জনৈকা স্ত্রী লোকের গোলাম ছিলেন। সেই স্ত্রী লোকটির নিকট যখন সংবাদ পৌছল যে, খাব্বাব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়েছেন। তখন থেকে স্ত্রী লোকটি লোহার শলাকা গরম করে তাঁর মাথায় দাগ দিতে লাগল। এরপরেও হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কোনক্রমেই বিচলিত হচ্ছেন না দেখে একদিন কোরাইশ দলপতিগণ মাটিতে প্রজ্বলিত অংগার বিছিয়ে তার ওপর তাঁকে চিৎ করে শায়িত করতো এবং কতিপয় পাষণ্ড তার বুকে পা দিয়ে চেপে ধরতো। অংগারগুলো তার পিঠের গোস্তা-চর্বি পুড়াতে পুড়াতে এক সময় নিভে যেত, তবুও নরাধমরা তাঁকে ছাড়ত না। হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর পৃষ্ঠের চামড়া এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে, শেষ বয়স পর্যন্ত তার সমস্ত পৃষ্ঠে ধবল কুন্ঠের ন্যায় ঐ দাগের চিহ্ন বিদ্যামান ছিল। তিনি কর্মকার ছিলেন। তিনি জেরা,তরবারী ইত্যাদি প্রস্তুত করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর লোকের নিকট তার যে সকল প্রাপ্য ছিল, কোরাইশদের নির্দেশমতে তা কেউই আর দেয়নি। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর খেলাফতের সময় তিনি হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে তাঁর প্রতি ইসলাম বিরোধিদের নির্যাতন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাঁর পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর কোমর দেখে বললেন, এমন কোমর তো আর আমি কারো দেখিনি। হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, আমাকে আগুনের অঙ্গারে চেপে রাখা হতো। তাতে আমার রক্ত এবং চর্বি গলে আগুন নিভে যেত।'

        মহান আল্লাহর রহমতে সাহাবায়ে কেরাম ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীম ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে ইসলাম বিজয়ী হবার পরে ইসলামী সাম্রাজ্যে প্রাচুর্যতা দেখা দিয়েছিলো। প্রায় সাহাবায়ে কেরামই স্বচ্ছলতা লাভ করেন। হযরত খাব্বাব যখন রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন কেউ কেউ তাঁকে বলেছিলেন, আপনি খুশী হন যে, ইন্তেকালের পরে আপনি আপনার সাথীদের সাথে হাউজে কাওসারের পাশে সাক্ষাৎ করবেন।

        এ কথা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন আর বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। তোমরা সেসব সাথীর কথা বলছো, যারা পৃথিবীতে কোনো প্রতিদান পায়নি। আখিরাতে তাঁরা অবশ্যই নিজেদের কর্মের প্রতিদান পাবে। কিন্তু আমরা পরে রয়েছি এবং দুনিয়ার নিয়ামতের অংশ এত পেয়েছি যে, ভয় হয় তা আমাদের আমলের সওয়াব হিসেবেই হিসেব না হয়ে যায়।

     ইন্তেকালের কিছুক্ষণ পূর্বে তাঁর সামনে কাফন আনা হলো, তিনি কাফন দেখে অতীতে  মুসলমানদের দুরাবস্থার কথা স্মরণ করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন- এতা সম্পূর্ণ কাফন! আফসোস! হামযাকে (রাঃ) একটি ছোট ধরনের কাপড়ে কাফন দেয়া হয়েছিলো। যেটি তাঁর সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করার মতো ছিলো না। তাঁর পা আবৃত করলে মাথা বের হয়ে যেতো আর মাথা আবৃত করলে পা বের হয়ে যেতো। পরিশেষে আমরা তাঁর পা ইববির নামক ঘাস দিয়ে ঢেকে কাফনের কাজ সম্পন্ন করেছি।

        ৩৭ হিজরীতে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ইন্তেকাল করেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তাঁকেই সর্বপ্রথম কুফায় দাফন করা হয়। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর চোখে কুফা শহরের বাইরে সাতটি কবর পড়লো। ভিনি সাথীদের কাছে জানতে চাইলেন, এসব কোন লোকজনের কবর! এখানে তো কোনো কবর ছিলো না! তাঁকে বলা হলো, এই প্রথম কবরটি খাব্বাব বিন আরাতের। তাঁর ওসিয়ত অনুযায়ী সর্বপ্রথম তাঁকে এখানে দাফন করা হয়। অবশিষ্ট- কবরগুলো অন্যদের। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা তাঁদেরকে এখানে দাফন করেছে।

        এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর চোখ দুটো অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। তিনি তাঁর কবরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগলেন, খাব্বাবের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তিনি স্বেচ্ছায় ও আনন্দ চিত্তে আল্লাহর দ্বীন কবুল করেছিলেন এবং নিজের ইচ্ছাতেই হিজরত করেছিলেন। সারাটি জীবন তিনি জিহাদে কাটিয়েছেন এবং ইসলামের জন্য অকল্পনীয় বিপদ সহ্য করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা সৎলোকদের আমল নষ্ট করেন না।

        হযরত খাব্বাব ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের দৃঢ় সঙ্কল্প ও অধিচল-অটলতার এমন তুলনাহীন চিহ্ন এঁকেছেন যে, প্রত্যেক যুগের ঈমানদারদের জন্য তা চেতনার মশাল হয়ে রয়েছে। তিনি নিজের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে জেনে বুঝে মুসলমান হন এবং হিজরত করেন। সারাটি জীবন জিহাদে অতিবাহিত করেন এবং যে-কোনো ধরনের দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করেন। যে ব্যক্তি কিয়ামতের কথা স্মরণে রাখে আখিরাতের জীবনে হিসাব দিতে হবে- এ কথা বিশ্বাস করে, তাঁর পক্ষে এই পৃথিবীতে ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য হালাল পথে ছোট কাজ করা কোনোক্রমেই লজ্জার নয়। হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কর্মকারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

Post a Comment

0 Comments