সিরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় রোম সম্রাটের অধিনে বেশ কয়েকজন নেতা শাসন কাজ পরিচালনা করতো। বালক্কা এলাকায় যে নেতা শাসন করতো তার নাম ছিল শোরহাবিল। আল্লাহর নবীর দূত হারিস ইবনে ওমায়ের নবীর পত্র নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলেন। বর্তমানেই শুধু নয়, সে সময়েও দূত হত্যা করা সমস্ত দেশেই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু শোরহাবিল আন্তর্জাতিক সকল রীতি নীতি ভঙ্গ করে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের দূতকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল।
এই ঘটনার কিসাস হিসাবে আল্লাহর নবী তিনহাজারের এক মুসলিম বাহিনী সেখানে প্রেরণ করেছিলেন। রোম সম্রাট নবীর পত্র পেয়ে সাময়িকের জন্য ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিল বটে, কিন্তু বৈষয়িক স্বার্থের কারণে ইসলামের কঠিন শত্রুর ভূমিকায় সে অবতীর্ণ হয়েছিল। তার অধিনস্থ নেতা শোরহাবিলকে মদীনা আক্রমনের উৎসাহ সেই দিয়েছিল। উদিয়মান ইসলামী শক্তিকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। কারণ তার বেশ কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্র ইসলামের প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। অনেকে ইসলাম কবুল করেছিল। তার সাম্রাজ্য কখন ইসলামের শক্তির কাছে নত হয়ে যায়, এই ভয়েই সে ছিল কম্পমান।
তার শাসনাধীন সিরিয়ার মায়ান প্রদেশের গভর্ণর ফারোয়া ইতোমধ্যেই ইসলাম কবুল করেছিল। ফারোয়াকে সে তার দরবারে ডেকে নিয়ে প্রথমে নানা ধরণের ভয়ভীতি দেখালো ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় খৃষ্টান হবার জন্য। তিনি ইসলাম ত্যাগ করলেন না। তারপর তাকে প্রলোভন দেখানো হলো। তবুও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। তারপর তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। ভয় পেয়ে গিয়েছিল রোম সম্রাট হোরাক্লিয়াস। তার শাসনাধীন এলাকার নেতারা যদি ইসলাম কবুল করতে থাকে, তাহলে তো তার সাম্রাজ্যই টিকবে না। সুতরাং শোরহাবিলকে সে লাগিয়ে দিল, সৈন্য বাহিনী যা প্রয়োজন আমার কাছে থেকে গ্রহণ করো, তবুও মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রকে উৎখাত করতেই হবে।
বিশ্বনবী এবার ভিন্ন ধরণের ব্যাবস্থাধীনে ইসলামের সেনাবহিনী প্রেরণ করেছিলেন। মাত্র তিন হাজার সেনা সদস্য। সবাই তাওহীদের অনুসারী। এক সময়ের ক্রীতদাস, যাকে আল্লাহর নবী নিজের সন্তানের সতই দেখতেন। সেই শিশুকাল থেকেই তিনি নবীর সাহচর্যে রয়েছেন। তিনি হলেন হযরত যায়িদ ইবনে হারিসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। তাঁকেই এই বাহিনীর প্রথম সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। প্রতিটি যুদ্ধেই একজন করে সেনাবাহিনী নিযুক্ত করা হত। এই যুদ্ধে পরপর তিনজন সেনাবাহিনী নিযুক্ত করলেন। বিষয়টা ছিল অন্য যুদ্ধের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম ধর্মী। দ্বিতীয় প্রধান করা হলো হযরত জাফর ইবনে আবি তালেব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে। তৃতীয় প্রধান করা হলো হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষনা করলেন, 'যায়িদ শাহাদাতবরণ করলে দায়িত্ব গ্রহণ করবে জাফর, জাফর শাহাদাতবরণ করলে দায়িত্ব গ্রহণ করবে আব্দুল্লাহ। সেও যদি শাহাদাতবরণ করে তাহলে মুসলিম বাহিনী যাকে ইচ্ছা তাকে সেনবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করবে।'
সেনাবাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে, আল্লাহর নবী সাথে সাথেই যাচ্ছেন। তিনি সেনা প্রধানকে বললেন, 'প্রথমে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাবে, যদি তারা ইসলাম কবুল করে তাহলে যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই। তোমরা অগ্রসর হবে ঐ পর্যন্ত যেখানে হারিস তাঁর মহান কর্তব্য পালন করার সময় শাহাদাতবরণ করেছে।' মুসলিম বাহিনী মদীনা হতে বের হয়েছে-এ সংবাদ গুপ্তচর মাধ্যমে শোরহাবিল জানতে পেরে এক লক্ষ সৈন্যর এক বাহিনী প্রস্তুত করলো। রোম সম্রাট এবং আরব গোত্রগুলোর ভেতর থেকে আরো প্রায় এক লক্ষ সৈন্য প্রস্তুত রাখলো। প্রথম এক লক্ষ ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় এক লক্ষের দলকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়া হবে।
মুসলিম বাহিনী সিরিয়া প্রদেশে উপনিত হয়ে জানতে পারলো, তাদেরকে মোকাবেলা করার জন্য শোরহাবিল এক লক্ষ সৈন্যবাহিনী নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে এবং আরো এক লক্ষ সৈন্য তাদেরকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। মুসলিম বাহিনী সেখানেই যাত্রা বিরতি করে নিজেদের ভেতরে আলোচনায় বসলেন। সেনাপতি হযরত যায়িদ বললেন, 'এ অবস্থায় সামনের দিকে আর অগ্রসর না হয়ে এখানেই অবস্থান করা উচিত। মদীনায় সংবাদ প্রেরণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি।'
শাহাদাতের আকাংখায় উদ্দিপ্ত মুসলিম বাহিনী তাদের সেনাপতির কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বললেন, 'আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতবরণ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। শাহাদাতের মধ্যেই রয়েছে জীবনে পরম সাফল্য। শাহাদাত আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত হিসাবেই এসে থাকে। এই নিয়ামত সবার ভাগ্যে নছিব হয় না। আর সংখ্যা বিচারে মুসলমানগণ বিজয়ের আশা করে না। বিজয় দানের মালিক মহান আল্লাহ।' হযরত আব্দুল্লাহর তোজোদৃপ্ত কথা শুনে মুসলিম বাহিনীর ভেতরে শাহাদাতের অদম্য কামনা তীব্র হয়ে উঠলো। তাঁরা বীর দর্পে সামনের দিকেই এগিয়ে গেলেন। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি হযরত যায়িদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দক্ষতার সাথে সৈন্য বিন্যাস করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে এক সময় তিনি শাহাদাতের সুধা পান করলেন। এরপর হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু পতাকা হাতে উঠিয়ে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একলক্ষ এক বাহিনীর সাথে মাত্র তিন হাজার সৈন্যর এক অসম যুদ্ধ হচ্ছে। ময়দানের অবস্থা তখন ভয়ংকর। হযরত জাফরের ঘোড়া আহত হলো।
তিনি পদাতিক অবস্থায় যুদ্ধ করতে লাগলেন। শত্রু পক্ষ তাঁর বাম হাত কেটে ফেলে দিলে তিনি ডান হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। ডান হাত কেটে ফেললে তিনি কাটা বাহু দিয়ে পতাকা উড্ডিন রাখলেন। শত্রু পক্ষ তাঁকে শহীদ করে ফেললো। এবার এগিয়ে এলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। প্রচন্ড বেগে সে সময়ে যুদ্ধ চলছে। তরবারী চালনা করতে করতে তিনি বেশ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। একজন সাহাবী তাঁকে একটুকরা গোস্ত দিয়ে বললেন, 'আপনি বড় ক্ষুধার্ত, এই টুকু খেয়ে তরবারী চালনা করুন।
গোস্তের টুকরা তিনি মুখে দিয়েছেন। এমন সময় তিনি দেখলেন, একজন মুসলিম সৈন্য বড় বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি গোস্তের টুকরা ফেলে দিয়ে বললেন, 'এ পৃথিবীর খাবারের কোন প্রয়োজন আর নেই।'
ছুটে গেলেন তিনি রণাঙ্গনে। এক সময় তিনিও শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতির অধীনে হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জেনারেলের সমস্ত অহংকার বিসর্জন দিয়ে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। পরপর তিনজনই যখন শাহাদাতবরণ করলেন, তখন হযরত সাবিত ইবনে আকরাম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যুদ্ধের পতাকা উঠিয়ে নিলেন, যেন মুসলিম বাহিনীর ভেতরে কোন ধরণের বিশৃংখলা সৃষ্টি না হয়।
পতাকা হাতে তিনি ছুটে এলেন হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এর কাছে। তিনি বললেন, 'হে খালিদ! এই পতাকা তুমি ধরো।' দুই লক্ষের বিরুদ্ধে মাত্র দুই হাজার সৈন্য। যাদের ভেতরে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা বেশী। বদর, ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবাগণ এই বাহিনীতে শামিল রয়েছেন। তাদের ওপরে নও মুসলিম খালিদের যে নেতৃত্ব দেবার কোন অধিকার নেই এ কথা হযরত খালিদের থেকে আর কে ভালো বুঝতো। তিনি আপত্তি জানিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে বললেন, 'অসম্ভব! আমি এ পতাকা গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আপনি বদর ওহুদে অংশগ্রহণ করেছেন। আপনিই এই পতাকার যোগ্যতম ব্যক্তি।
হযরত সাবিত বললেন, 'আমি এই পতাকা তোমার জন্যই উঠিয়ে এনেছি। আমার থেকে তোমার সামরিক দিক দিয়ে যোগ্যতা অধিক। তুমি এ পতাকা ধরো।' এবার হযরত সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মুসলিম বাহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমরা কি খালিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে রাজি আছো?' সমবেত বাহিনী সম্মতি জানিয়ে বলেছিল, 'অবশ্যই আমরা রাজি আছি।' হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে দুই হাজার মুসলিম বাহিনী দুই লক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, 'সেদিনের যুদ্ধে আমার হাতে সাতখানা তরবারী ভেঙ্গেছিল। সর্বশেষে একটি ইয়েমেনী তরবারী টিকে ছিল।
0 Comments