খায়বরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১৬০০ শত। মাত্র ২০০ সৈন্য ছিল অশ্বারোহী আর সবাই পদাতিক। এই যুদ্ধে আল্লাহর নবী তিনটি বিশাল পতাকা নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম বাহিনী এই যুদ্ধে প্রথমে এমন এক স্থানে শিবির স্থাপন করেছিল, যে স্থান ছিল খায়বর এবং গাতফান গোত্রের মাঝে। কারণ গাতফান গোত্র ইয়াহুদীদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। মুসলিম বাহিনীর একটি দল এই স্থানেই রয়ে গেল এবং আরেকটি দল খায়বরের দিকে এগিয়ে গেল। অর্থাৎ মুসলমানদের সামনেও শত্রু পেছনেও শত্রু। গাতফান গোত্র যখন জানতে পারলো, মুসলিম বাহিনী খায়বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তারা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চুক্তি মোতাবেক ইয়াহুদীদেরকে সাহায্য করার জন্য বের হলো। তারপরই তারা যখন দেখলো, তাদের গোত্রের পাশে মুসলিম বাহিনীর শিবির, ভয়ে তাদের কলিজা যেন কন্ঠনালির কাছে চলে এলো। ইয়াহুদীদের সাহায্য করা দূরে থাক, নিজেদের গোত্রকে বাঁচানোর চেষ্টাতেই তারা হতবিহবল হয়ে পড়েছিল। খায়বরে বিশাল আকৃতির ছয়টি দূর্গ ছিল এবং এসব দুর্গে প্রায় বিশহাজার সৈন্য ছিল। সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ ছিল কামুস দুর্গ। মদীনা থেকে বহিষ্কৃত ইয়াহুদীরা এই দুর্গেই বাস করতো। এই দুর্গের অধিপতি ছিল মারহাব নামক এক বিখ্যাত বীর। তদানীন্তন আরবে যাকে এক হাজার যোদ্ধার সাথে তুলনা করা হত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পথে আসরের নামাযের সময় হলে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি নামায আদায় করে আহার পর্ব সারলেন। খাদ্য বলতে এ সময় মুসলমানদের কাছে ছিল যবের ছাতু। আল্লাহর নবী এই ছাতু পানিতে মিশিয়ে আহার করেছিলেন।
রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বরে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দোয়া'স্করলেন, 'আমার আল্লাহ! আপনার কাছে এই এলাকার, এলাকাবাসীর এবং এলাকার সমস্ত বিষয়ের কল্যাণ কামনা করছি ও এসবের অনিষ্টকারীতা হতে আপনার কাছে পানাহ চাইছি।'
তিনি যে কোন নতুন এলাকায় পৌছলেই এই দোয়া করতেন। তিনি রাতে কাউকে আক্রমন করতে দিতেন না। এ কারণে রাতে সেখানে অবস্থান করে তিনি সকালে খায়বর দুর্গের কাছে উপনিত হলেন। এখানে পৌঁছেও আল্লাহর নবী আপোসের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কুচক্রি ইয়াহুদীদের দল যুদ্ধ ব্যতীত কোন কিছুই গ্রহণ করেনি। ইয়াহুদীদের উস্কানীর মুখে মুসলিম বাহিনী প্রথমে একটি দুর্গের ওপরে আক্রমন করলো। কিছুক্ষণের ভেতরেই সে দুর্গ মুসলমানরা দখল করে নিল।
এভাবে প্রায় দুর্গই মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিল। কিন্তু কামুস দুর্গ দখল করা গেল না। এই দুর্গেই অবস্থান করছিল তাদের বিখ্যাত বীর মারহাব। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে সেনাপতি করে এই কামুস দুর্গ জয় করার জন্য প্রেরণ করলেন। তিনি জয় করতে পারলেন না। আল্লাহর নবী এবার প্রেরণ করলেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে। তিনিও পারলেন না। আল্লাহর নবী ঘোষণা করলেন, 'আমি আগামী কাল এমন একজনের হাতে পতাকা অর্পণ করবো, মহান আল্লাহ তাঁকে বিজয় দান করবেন। সেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও সেই ব্যক্তিকে ভালোবাসে।'
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষনা সাহাবায়ে কেরামের ভেতরে এক অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। কে সেই সৌভগ্যবান ব্যক্তি, যাকে স্বয়ং আল্লাহ ভালোবাসেন এবং তাঁর রাসূলও ভালোবাসেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর সারা জীবনে কোনদিন পদের জন্য সামান্যতম আশা পোষণ করেননি। কিন্তু খায়বরের দিন তিনি নিজেকে সুস্থির রাখতে পারেননি। কারণ আল্লাহর নবী আগামী কাল যাকে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করবেন, তাঁকে আল্লাহ ভালেবাসেন। এই পদের লোভ কি ত্যাগ করা যায়। এ কারণে তিনি ঐ পদের লোভ করেছিলেন। পরের দিন সকালে আল্লাহর নবী সকল জল্পনা কল্পনার অবসান করে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর নাম ঘোষনা করলেন। সাহাবায়ে কেরামের কাছে হযরত আলীর, নামটা অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ, তাঁরা জানতেন হযরত আলী চোখের পীড়ায় অসুস্থ। এ অবস্থায় তাঁকে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করা এক অসম্ভব ব্যাপার। অসুস্থ হযরত আলীকে ডেকে আনা হলো। আল্লাহর নবী তাঁর চোখে পবিত্র মুখের লালা দিলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলীর হাতে পতাকা উঠিয়ে দিলেন। হযরত আলী বললেন, 'দুর্গের ইয়াহুদীদেরকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বো।' আল্লাহর রাসূল তাঁকে বললেন, 'তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করবে। তাদের একজনও যদি তোমার প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে সেটা মূল্যবান হিসাবে বিবেচিত হবে।'
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যুদ্ধে গেলেন। আরবের বিখ্যাত বীর মারহাব যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দুর্গ থেকে বের হলো। তার মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ এবং তার ওপরে পাথরের খোল। তার সাথে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। এক পর্যায়ে হযরত আলী আল্লাহু আকবর বলে গর্জন করে মারহাবের মাথার ওপরে আল্লাহর নবীর দেয়া তরবারীর আঘাত করলেন। হাদীস এবং ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, সে আঘাতে মারহাবের মাথার শিরস্ত্রাণের ওপরের পাথর দু'ভাগ হয়ে শিরস্ত্রাণ দু'ভাগ হলো, তারপর তার মাথা দু'ভাগ হয়ে মুখের দাঁত পর্যন্ত তরবারী পৌঁছে গেল।
খায়বরে প্রায় ২০ দিন ইয়াহুদীদের অবরোধ করে রাখার পরে মুসলমানগণ বিজয়ী হয়েছিল। প্রতিপক্ষের ৯৩ জন নিহত হয়েছিল আর মুসলমানদের শাহাদাতবরণ করেছিল ১৫ জন। করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন খায়বর বিজয় করে মদীনায় এলেন, সেদিনই হযরত আলীর বড় ভাই হযরত আবু জাফর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আবিসিনিয়া থেকে মদীনায় ফিরে এলেন। আল্লাহর নবী তাঁকে দেখে এত খুশী হয়েছিলেন যে, তিনি এগিয়ে গিয়ে হযরত আবু জাফরের কপালে চুমু দিলেন। মুসলমানগণ একত্রে দুটো কারণে খুশী হলেন। একদিকে খায়বর বিজয় আরেকদিকে হযরত জাফরের প্রত্যাবর্তন।
0 Comments