হযরত আনাস বিন নযর একজন আল্লাহর রাসূলের একজন সম্মানীত সাহাবী ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। এ কারণে তিনি এই বলে আক্ষেপ করতেন, ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল প্রথম যুদ্ধে সকলেই অংশগ্রহণ করলো। কেউ শহীদ কেউ গাজী হয়ে ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলো আর আমি হতভাগ্য এতে যোগ দেয়ার কোন সুযোগই পেলাম না।
দুঃখ ও আক্ষেপে অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হয়ে তিনি সংকল্প করলেন যে, যদি ভবিষ্যতে কোনও জিহাদের সুযোগ মিলে তবে তাঁর এই অসম্পূর্ণ আকাঙ্খা বুকের রক্ত দিয়ে পূর্ণ করবেন।
তাঁকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হলো না, শীঘ্রই ওহুদ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হলো। তিনি তাঁর প্রাণের দাবী ও মনের আশা আকাঙ্খা নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিলেন। ওহুদের যুদ্ধে প্রথমতঃ মুসলামদের বিজয় লাভ হয়, কিন্তু শেষ দিকে একটি মাত্র ভুলের জন্য তাঁদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। তাঁদের এই ভুলটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ অমান্য করার কারণেই সংঘটিত হয়েছিল। আল্লাহর নবী পঞ্চাশজন তীরন্দাযকে ওহুদ পর্বতের পেছনের দিকে একটি গিরি পথ প্রহরা দেয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁদের নির্দেশ ছিলো, কোন অবস্থাতেই যেন তারা ঐ স্থান পরিত্যাগ না করেন। কারণ ঐ পথ দিয়ে শত্রুদের আক্রমণ করার আশঙ্কা ছিল।
যুদ্ধের শুরুতেই মুসলমানদের যখন বিজয় ঘটলো এবং কাফিররা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-ওদিক ছুটে পালাতে লাগলো, তখন সেই তীরন্দাযগণ মনে করলেন যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে এখন ঐ স্থান পরিত্যাগ করে শত্রুগণের পশ্চাদ্ধাবন করা এবং তাদের পরিত্যাক্ত সম্পদ কুড়িয়ে নেয়া যেতে পারে। তাঁদের নেতা তাঁদেরকে স্থান ত্যাগ করতে নিষেধও করেছিলেন এবং আল্লাহর নবী আদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মনে করলেন যে, আল্লাহর নবীর আদেশ শুধু যুদ্ধের সময়ের জন্যই দেয়া হয়েছিল, অন্য সময়ের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। এ কথা মনে করে তাঁরা ঐ স্থান পরিত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন এবং শত্রুর পরিত্যক্ত সম্পদ কুড়াতে আরম্ভ করলেন।
পলায়নরত শত্রুরা গিরিপথটি অরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে প্রতি আক্রমণের মহাসুযোগ পেয়ে গেলো। তারা ঐ পথ দিয়ে প্রবেশ করে অপ্রস্তুত মুসলমানদের ওপর প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করলো। এ অতর্কিত আক্রমণে মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। সামনে ও পেছনে দু'দিকের আক্রমণে তারা শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লেন এবং নিতান্ত অসহায়ের মতো প্রতিপক্ষের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করতে লাগলেন।
হযরত আনাস মুসলমানদের এ দূরবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তার সম্মুখে হযরত সায়াদকে দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছো সায়াদ? আল্লাহর কসম আমি ওহুদের পর্বত থেকে জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি। এই কথা বলেই তিনি শত্রুদের মধ্যে ঢুকে পড়লেন এবং যে পর্যন্ত না শহীদ হলেন, অবিরত তলোয়ার চালিয়ে গেলেন।
যুদ্ধ শেষে শহীদানদের লাশ দাফন-কাফনের জন্য একত্রিত করা হলো। হযরত আনাসের লাশ এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছিলো যে, কারো পক্ষে তা সনাক্ত করা সম্ভব ছিলো না। নানা ধরনের অস্ত্রের আঘাতে তাঁর লাশ ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর বোন তাঁর হাতের একটি আঙ্গুল দেখে লাশ সনাক্ত করেছিলেন। যাঁরা অকৃত্রিম মন-মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন, তাঁরা বাস্তবিকই পৃথিবীতে জান্নাতের সুগন্ধ পেয়ে থাকেন; হযরত আনাস জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সুগন্ধ পেয়েছিলেন।
0 Comments