হক আর বাতিলের প্রথম রক্তক্ষয়ী সংঘাত বদর যুদ্ধের দিনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় চাচা হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর মাথার পাগড়ীর সাথে উট পাখির পালক লাগিয়ে ছিলেন। সেদিনও তিনি দু'হাতে তরবারী চালনা করে বাতিল শক্তির ভেতরে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। মাথায় পাখির পালক থাকার কারণে তিনি যেদিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাঁকে সহজেই চেনা যাচ্ছিলো।
নিহত হবার পূর্বে হযয়ত বিলালকে নির্যাতনকারী মক্কার কাফির নেতা উমাইয়া হযরত আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'মাথায় উট পাখির পালক লাগানো লোকটি কে?'
হযরত আব্দুর রহমান বলেছিলেন, 'তিনি বিশ্বনবীর চাচা হযরত হামজা।' উমাহায়া আক্ষেপ করে বলেছিল, 'ঐ ব্যক্তি আজ আমিদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে।' বদরের ময়দানে মক্কার জুবায়ের ইবনে মুতয়িমের চাচা হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর হাতে নিহত হয়েছিল। ওহুদের দিনে সে তার গোলাম ওয়াহশীকে শর্ত দিয়েছিল, 'তুমি যদি হামজাকে হত্যা করে আমার চাচা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারো তাহলো আমি তোমাকে দাসত্বের এই ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি দিবো।' ওয়াহশী ওহুদের প্রান্তরে একটি বিশাল পাথর খন্ডের আড়ালে এমন একটি বর্শা হাতে ওৎপেতে বসেছিল, যে ধর্ণা দূর থেকে ছুড়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা যায়। হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দু'হাতে তরবারী পরিচালনা করছেন আর কাফিরদের বুহ্য ভেঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। শত্রুপক্ষ তাঁর সুতীক্ষ্ণধার তরধারীর সামনে কাটা কলা গাছের মতই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। হযরত হামজা যে মুহূর্তে পাথর খন্ড অতিক্রম করছিলেন, পাথরের আড়ালে ওৎপেতে বসে থাকা ওয়াহশী তার হাতের বর্ণা হযরত হামজার নাভি লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলো।
তীক্ষ্ণ বর্শা নবীর প্রিয় ঢাচার নাভিমূলে বিদ্ধ হয়ে পৃষ্ঠদেশ পার হয়ে গেল। জীবনের 'এই শেষ মুহূর্তেও ইসলামের এই বীর সেনানী শত্রুকে আঘাত করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তাঁর জীবনী শক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না। তিনি রক্তাক্ত দেহে ওহুদের রণপ্রান্তরে লুটিয়ে পড়লেন। মক্কায় আবু জাহিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সামান্য আঘাত করেছিল, চাচা হামজা তা সহ্য করতে না পেরে আবু জেহেলকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওহুদের প্রান্তরে যখন আব্দুল্লাহ ইবনে কামিয়াহ আল্লাহর নবীকে আঘাত করে রক্তাক্ত করেদিল, তখন হযরত হামজা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে পারলেন না। ওয়াহশীর নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাত তাঁকে চিরদিনের মতই নিথর নিস্তব্দ স্পন্দনহীন করে দিয়েছে। তিনি আর কোনদিন আল্লাহর নবীর সামনে এসে দাঁড়াবেন না।
হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে হত্যা করে ওয়াহশী যুদ্ধ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। সেদিন আর তার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। দাসের জীবন থেকে সে মুক্তি লাভ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ওয়াহশী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আল্লাহর রাসূলের সামনে এসে দাঁড়াতেই রাসূলের মানসপটে প্রিয় চাচা হামজার শত সহস্র স্মৃতি ভেসে উঠেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেদনা বিধুর হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে হযরত ওয়াহশীকে বলেছিলে, 'ওয়াহশী! তুমি আমার সামনে এসো না। তোমাকে দেখলেই আমার চাচার কথা মনে পড়ে।'
হযরত ওয়াহশী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে হত্যা করে যে পাপ তিনি করেছেন, জীবন দান করে হলেও তিনি সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর খেলাফতকালে হযরত ওয়াহশী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ভন্ডনবী মুসাইলামাকে হত্যা করে তাঁর সে কৃতকর্মের কাফ্ফারা আদায় করেছিলেন।
কুরাইশদের নারী বাহিনী মুসলিম বাহিনীর শাহাদাত বরণকারীদের নিথর লাশের ওপরে শকুনের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শহীদদের লাশের নাক-কান ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে মালা বানিয়ে তাদের গলায় পরেছিল। আল্লাহর নবীর প্রিয় চাচা হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর স্পন্দনহীন লাশ নিয়ে মক্কার হিংস্র হায়েনার দল পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল। তাঁর পবিত্র নাক-কান ও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে মালা বানিয়ে তা গলায় পরে নগ্ন উল্লাস প্রকাশ করেছিল।
এতেও তাদের হিংস্র আক্রোশ চরিতার্থ হলো না, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, আমীরে মুয়াবিয়ার মাতা হিন্দা হযরত হামজার পেট-বুক চিরে ফেললো। রাসূলের চাচার বুকের ভেতর থেকে হিন্দা কলিজা বের করে আনলো। সে কলিজা হিন্দা চিবিয়ে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করলো। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন ধরণের। হিন্দা সে কলিজা গিলতে না পেরে বমি করে ফেলে দিল। ইতিহাস মক্কার এই নারীকে 'কলিজা ভক্ষণকারিণী' হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
যুদ্ধ অবসানে শহীদদের লাশ দাফন করা হচ্ছে। শাহাদাতের রক্তাক্ত ময়দানে আল্লাহর নবীর প্রিয় চাচার প্রাণহীন দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর লাশের এ অবস্থা দেখে সাহাবায়ে কেরাম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আল্লাহর নবী অশ্রু সংরণ করতে পারলেন না। তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, 'চাচা! তোমার ওপরে আল্লাহ রহম করুন। কিয়ামতের ময়দানে তুমি হবে শহীদদের নেতা। আমার মন চায় তোমাকে এভাবেই এখানে ফেলে রাখি। পশু পাখি তোমার লাশ ভক্ষণ করতো। কিয়ামতের দিন তোমাকে পশু পাখির পেট থেকে জীবন্ত বের করা হত। কিন্তু তোমার লাশ এভাবে ফেলে গেলে তোমার বোন শোকে অধির হয়ে পড়বে। চাচা! তুমি সৎকাজে অগ্রগামী ছিলে। আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি তোমার কতই না মর্মতা ছিল।'
আপন ভাই হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর শাহাদাতের সংবাদ পেয়ে তাঁর বোন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু হযরত সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা শোকে অধির হয়ে ওহুদের প্রান্তরে ছুটে এলেন। আল্লাহর নবী হযরত সাফিয়ার সন্তান হযরত যুবায়েরকে বললেন, 'তোমার মা'কে তাঁর ভাইয়ের এই করুণ অবস্থা দেখতে দিওনা। সে সহ্য করতে পারবে না।''
হযরত যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর মাতাকে লাশ দেখতে নিষেধ করলেন। হযরত সাফিয়া বললেন, 'আমার ভাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নাক-কান ও বুকের কলিজা দান করেছে, এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কি আছে। আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করবো।'
হযরত সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল তাঁকে হযরত হামজার লাশ দেখার অনুমতি দিলেন। হযরত সাফিয়া ময়দানে আসার পথেই ভাইয়ের, কাফনের জন্য দুটো কাপড় এনেছিলেন। মুসলিম বাহিনী আল্লাহর পথে সমস্ত কিছুই উৎসর্গ করেছিলেন। বাকি ছিল শুধু প্রাণ, সে প্রাণও উৎসর্গ করলেন। কাফন দেয়ার মত কাপড়ও ছিল না। হযরত হামজার পাশেই হযরত ছুহায়েন আনসারীর প্রাণহীন দেহ পড়েছিল। তাঁর লাশকেও কাফিররা বিকৃত করেছিল। শহীদদের লাশ একত্র করা হলো। কাফনের যে কাপড় দেয়া হলো, সে কাপড়ে মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায় আর পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে থাকে। অবশেষে মাথার দিক ঢেকে পায়ের দিকে ইজখির নামক এক ধরণের সুগন্ধ বিশিষ্ট ঘাস দিয়ে দোজাহানের বাদশাহর চাচার লাশ ওহুদের প্রান্তরেই দাফন করা হয়েছিল।
0 Comments