মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নবী করীম (স:) এর মর্যাদা প্রসঙ্গ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সূর্য বা চন্দ্রের সাথে উপমা দেননি, দিয়েছেন প্রদীপের সাথে। আল্লাহ তা'য়ালা এ কথা বলেননি যে, 'আমি আপনাকে মানুষের জন্য সূর্যের বা চন্দ্রের মতো আলো দানকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি'। বরং তিনি বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَّنَذِيرًا لَا وَّدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا -
হে নবী! আমি আপনাকে (হিদায়াতের) সাক্ষী (করে) পাঠিয়েছি, (আপনাকে) বানিয়েছি (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারী, আল্লাহর অনুমতিক্রমে আপনি হচ্ছেন আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও (হিদায়াতের) সুস্পষ্ট প্রদীপ। (সূরা আল আহযাব-৪৫-৪৬)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তা'য়ালা ঐ বিশাল আলোকোজ্জ্বল সূর্য এবং প্রশান্তিদায়ক মায়াবী কিরণ দানকারী চন্দ্রের সাথে নবী করীম (সা:) এর উপমা না দিয়ে স্বল্প পরিসরে আলো বিতরণকারী ক্ষুদ্র প্রদীপের সাথে কেনো উপমা দিলেন?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে সূর্য এবং চন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করি। সূর্য একটি বিশালাকারের উত্তপ্ত গ্যাসীয় অগ্নিগোলক, সৃষ্টির সূচনা থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আলো এবং তাপ বিকিরণ করলেও এই সূর্যের পক্ষে আরেকটি সূর্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সূর্যের অভ্যন্তরে মহান আল্লাহ যে শক্তি দান করেছেন, এই শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষুদ্র আরেকটি সূর্য কখনো সৃষ্টি করতে পারবে না। আর চন্দ্রের তো নিজস্ব কোনো আলো নেই, সূর্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত। এর পক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো তৈরী করাও সম্ভব নয়, কেননা আল্লাহ তা'য়ালা সে শক্তি চন্দ্রকে দান করেননি।
এবার প্রদীপের দিকে দৃষ্টিপাত করি, ক্ষুদ্র প্রদীপের সামান্য আলো অগণিত প্রদীপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। হাজার কোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেও স্বয়ং সে ক্ষুদ্র প্রদীপ অমর অক্ষয়, এর আলো দান বা অন্য প্রদীপ জ্বালানোর ক্ষমতা কখনো বিলীন বা নিঃশেষ হয় না। নবী করীম (সা:) স্বয়ং এবং তাঁর আদর্শ এমনি এক প্রদীপ, বিগত চৌদ্দশত বছরব্যাপী সমগ্র পৃথিবীতে আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে এবং অনন্তকালব্যাপী আলো বিকিরণ করবে। কিন্তু এ আলো কখনো নিঃশেষ হবে না। এমনকি কেউ এ আলো নির্বাপিত করার ষড়যন্ত্র করলে এর গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে ইনশাআল্লাহ।
কবি বলেছেন, 'ইসলাম কি ফিতরাত মে কুদরাত নে লাচাক দিয়া, যিতনি দাবাউগি উতনি উভরে গা'। অর্থাৎ ইসলামের প্রকৃতিগত শক্তির লাবণ্যতা এতই প্রখর যে, কেউ এর শক্তি হ্রাস করতে চাইলে তা আরো অধিক বৃদ্ধিই পেতে থাকে।
নবী করীম (সা:) এর আন্দোলনের কার্যক্রমের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ আন্দোলনকে অঙ্কুরেই নিঃশেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে, চলছে এবং চলবে। জড়বাদী শক্তি এ আন্দোলনের দিকে দন্ত-নখর বিস্তার করেছে এ আন্দোলনকে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মুছে দেয়ার জন্য। মুখের ফুৎকারে তারা নবী করীম (সা:) এর জ্বালানো প্রদীপ নির্বাপিত করতে চেয়েছে। অপরদিকে সূচনালগ্নেই আল্লাহ তা'য়ালা ঘোষণা করেছেন-
يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُوْرَه وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ -
এ (মূর্খ) লোকেরা তাদের মুখের (এক) ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর (দ্বীনের) মশাল নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ তাঁর এ আলোর পূর্ণ বিকাশ ছাড়া অন্য কিছুই চান না, যদিও কাফিরদের কাছে এটা খুবই অপ্রীতিকর! (সূরা আত্ তাওবা-৩২)
লক্ষ্য করুন, নাইন ইলেভেন এ নিজেরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ঘোষণা দিয়ে আমেরিকা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। 'লাদেন' ট্যাক্স আবিষ্কার করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ওপর এ অন্যায় ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার মুসলমানদের কাছ থেকে চুষে নিলো। নানাভাবে ইসলামী দল, ব্যক্তিত্ব, সংঘ ও সংগঠন ধ্বংস করার ব্যবস্থা করলো। প্রচার মাধ্যমে দিবারাতি অহর্নিশি ইসলামকে সন্ত্রাসী আদর্শ ও কুরআনকে সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণদাতা হিসাবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করলো। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমেরিকাসহ সমগ্র দুনিয়ায় ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
কুরআন অবতীর্ণের সময়কালে বিরোধিতার যে ঝড় সৃষ্টি করা হয়েছিলো তখনই মহান আল্লাহ তা'য়ালা ঘোষণা করেছেন-
سنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ طَ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দিবো), যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ (কুরআনই মূলত) সত্য; (হে নবী, আপনার জন্যে) এ কথা কি যথেষ্ট নয়, আপনার মালিক (আপনার) সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (সূরা হামীম আস সাজদা-৫৩)
নবী করীম (সা:) যখন ইসলামী আন্দোলনের প্রদীপ জ্বালালেন, তখন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ প্রদীপকে নির্বাপিত করার লক্ষ্যে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র ও দমন-নিপীড়ন চলছে। কিন্তু সকল বাধার প্রাচীর অতিক্রম করে প্রদীপের কান্তিময় কিরণচ্ছটা দিগন্তবলয় স্পর্শ করেছে। আরবের ইসলাম বিরোধী শক্তি নিজেদের জীবনকালেই দেখেছিলো প্রদীপের এ আলো সমগ্র আরবকে আলোকিত করে আশেপাশের সকল দেশ অতিক্রম করে আফ্রিকা পর্যন্ত কিরণ দান করেছিলো। নিজেরা তখন একান্তই অসহায়ের মতো নবী করীম (সা:) এর এ প্রদীপের সম্মুখে শির নত করে অধো: মুখে দণ্ডায়মান হয়েছিলো। প্রদীপের এ অপ্রতিরোধ্য কিরণ এক বিরাট বিশাল ধর্মীয়, সভ্যতা-সাংস্কৃতিক, নৈতিক, চিন্তাগত ও মানসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবসাধন করেছিলো।
যেখানেই প্রদীপের কিরণচ্ছটা পতিত হয়েছে সেখানেই মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম যোগ্যতা ও গুণ-বৈশিষ্ট সৃষ্টি হয়েছে এবং কুপ্রবৃত্তি ও অসৎ স্বভাবসমূহ অবদমিত হয়ে মানুষের সুকুমার বৃত্তিসমূহ বিকশিত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ কেবলমাত্র দুনিয়াত্যাগী ফকির দরবেশ এবং নিভৃতে বসে 'আল্লাহু আল্লাহু' নাম জপকারীদের মধ্যে যেসব গুণ-বৈশিষ্ট দেখার আশা পোষণ করতো এবং সমাজ ও দেশ পরিচালকদের মধ্যে যেসব গুণ-বৈশিষ্ট দেখার কল্পনাও করতে পারতো না, নবী করীম (সা:) এর প্রদীপ সেই সকল গুণ-বৈশিষ্ট ও উন্নতমানের নৈতিকতা সমাজপতিদের, শাসকদের রাজনীতিতে, বিচারকদের আদালতে, রাষ্ট্রের সকল স্ত রের কর্মকর্তাদের, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দানকারী সেনাপতিদের পরিচালিত যুদ্ধে বিজয় অভিযানসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে, রাজস্ব আদায়কারীদের আচরণে এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গন আলোকিত করেছিলো। প্রদীপের এই আলোয় নির্মিত সমাজে সাধারণ মানুষকে নৈতিক চরিত্র ও আচরণ এবং পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে এতই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে যে, অন্যান্য সমাজের অভিজাত হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও তার তুলনায় অত্যন্ত নীচু মানের বলে অভিহিত হয়েছে।
নবী করীম (সা:) এর প্রদীপের এ কিরণ মানুষকে কুসংস্কার ও অমূলক ধ্যান-ধারণার আবর্ত থেকে বের করে জ্ঞান-গবেষণা এবং যুক্তিসঙ্গত চিন্তা ও কর্মনীতির সুস্পষ্ট রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষের সমাজে এমন কতক সমস্যা রয়েছে যে সমস্যার সমাধানের সুত্র সম্পর্কে ন্যূনতম কল্পনাও পৃথিবীর চিন্তাবিদদের মনে আসেনি, অথচ নবী করীম (সা:) এর এ প্রদীপ সামাজিক জীবনের সেই সকল রোগ-ব্যাধির এমন চিকিৎসা করেছে যে, সেসব রোগের মূলোৎপাটিত হয়েছে।
সামাজিক জীবনের অপরাপর সমস্যা যেমন বর্ণ, গোত্র, দেশ ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য, একই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ এবং তাদের মধ্যে উচ্চ নীচের বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, আইনগত অধিকার ও বাস্তব আচরণের আধিক্য, মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন, জবাবদিহি ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে সরকারের অবস্থান, মৌলিক অধিকার থেকেও জনগণের বঞ্চনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুক্তিসমূহের অমর্যাদা, সমরাঙ্গনে বর্বরতা ও পশুসুলভ আচরণ এবং এমন ধরনের অগণিত সমস্যার অন্ধকার নবী করীম (সা:) এর প্রদীপের আলোয় দূরীভূত হয়েছিলো।
প্রদীপের এ স্নিগ্ধ আলো আরব ভূমিতে রাজনৈতিক অরাজকতার স্থানে শৃংখলা, খুন খারাবী ও নিরাপত্তাহীনতার স্থানে নিরাপত্তা, পাপাচারের স্থানে আল্লাহভীতি ও পবিত্রতা, জুলুম ও ইনসাফহীনতার স্থানে ন্যায় বিচার, নোংড়ামী ও শত্রুতার স্থানে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে এবং যে জাতির লোকজন নিজ গোত্রের নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো মর্যাদাসম্পন্ন পদের বিষয় কল্পনাও করতে সক্ষম ছিলো না, প্রদীপের এ আলো তাদেরকে পৃথিবীর নেতা বানিয়ে দিয়েছিলো। কবি বলেছেন-
মুক্তা বরষণে তোমার বিন্দু হলো বিশাল বারিধি সমান,
হৃদয়ে জ্বালালে নূরের মশাল, নয়নে করিলে দৃষ্টিদান।
পথহারা ছিলো যাঁরা, তাঁদের করিলে দিশারী জগতের;
পরশ দৃষ্টি তব মৃতদেরকে বানালো জীবনদাতা।
অর্থাৎ হে রাসূল (সাঃ)! আপনার পরশে সঙ্কীর্ণতা উদার হলো, আঁধার মনে আলো উদ্ভাসিত হলো, কল্যাণ দৃষ্টি উন্মোচিত হলো, ভ্রান্তরা পথ-প্রদর্শক হলো আর মৃতরা হয়ে গেলো অন্যদের ত্রাণকর্তা।
নবী করীম (সা:) ছিলেন উজ্জ্বল প্রদীপ এবং প্রদীপের এ আলো নির্বাপিত করার জন্যে সমসাময়িক কালে যারা চেষ্টা করেছিলো, সেই প্রজন্মের লোকজন নিজ চোখে দেখেছিলো, কিভাবে এ আলো জগৎময় ছড়িয়ে পড়েছিলো। তখন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবী দেখছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রদীপের আলো কিভাবে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রদীপের এ আলো মুসলিম মনমানসিকতা এমনভাবে আলোকিত করেছিলো যে, মুসলিম মিল্লাতের পতন যুগেও তারা নৈতিক চরিত্রের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, বর্তমানে যারা সভ্যতা ও শিষ্টাচারের একক নেতৃত্বের দাবীদার হয়েছে তারা পতন যুগের মুসলমানদের নৈতিকতার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি।
0 Comments