ওহুদ যুদ্ধের পূর্ব অবস্থা


        সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে জানা যায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহুদ যুদ্ধের পূর্বে হযরত যায়িদ ইবনে হারিসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে আরেকটি অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন, যে অভিযানের নাম হলো 'কারাদ' অভিযান। কারণ, তিনি জানতে পেরেছিলেন, মক্কার কুরাইশরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করছে, তারা অচিরেই মদীনার ওপর আক্রমন করবে। সুতরাং শত্রুকে সামনে অগ্রসর হতে দেয়া বা তাদেরকে শক্তি সঞ্চয় করতে দেয়া ঠিক নয় বিবেচনা করেই তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। বনী কুরাইজা মদীনায় না থাকেলও মদীনায় ইসলামের শত্রুর অভাব ছিল না।

        একদিকে ছিল মুনাফিকের দল, আরেকদিকে ছিল ইয়াহুদী ও পৌত্তলিক সম্প্রদায়। কুরাইশরা তাদের ওপর নির্ভর করেই ইসলামকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করছিল। মদীনার কাছের কিছু গোত্র হজ্জে যেতো, আর এই সুযোগে কুরাইশরা তাদেরকে ইসলামের সাথে বিরোধিতা করার জন্য একপ্রকার বাধ্যই করতো। ইতোপূর্বে কুরাইশরা সিরিয়া থেকে তাদের ব্যবসার মালামাল মদীনার যে পথ দিয়ে নিয়ে আসতো, তখন তারা সে পথ পরিহার করে ভিন্ন আরেক পথ ব্যবহার করা শুরু করেছিল।

        ইরাক যাওয়ার পথ দিয়ে কুরাইশরা তখন তাদের ব্যবসার পণ্য নিয়ে আসতো। কারাদ ছিল নজদের একটি জলাশয়। সেখান দিয়েই কুরাইশরা আসা যাওয়া করতো। মক্কা থেকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি দল প্রচুর পরিমাণে রৌপ্য নিয়ে সিরিয়ার দিকে যাচ্ছিল। মজুরীর বিনিময়ে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করছিল বনী বকর গোত্রের ফুরাত ইবনে হাইয়ান। হযরত যায়িদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর বাহিনী দেখে তারা তাদের মালামাল ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। হযরত যায়িদ সমস্ত মালামাল এনে আল্লাহর নবীর কাছে জমা দিয়েছিলেন।

        উল্লেখিত ঘটনার পরেই ওহুদের প্রান্তরে মক্কার ইসলাম বিরোধিদের সাথে মুসলমানদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছিল। মদীনা শহরের উত্তর দিকে প্রায় দুই মাইল দুরে একটি পর্বত শ্রেণীর নাম হলো ওহুদ। অনেক গবেষকগণই মন্তব্য করেছেন, বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের উদারতা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অধিক। তাদের এই উদারতার মাশুল তাদেরকে দিতে হয়েছিল ওহুদের প্রান্তরে।

        বদরের প্রান্তরে মক্কা থেকে যারা যুদ্ধ করতে এসেছিল, ইসলামের এই শত্রুদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া তেমন কোন কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক রক্তপাত পছন্দ করেননি বলেই তাদের অধিকাংশই প্রাণ নিয়ে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। বদরের যুদ্ধের পূর্বে আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে যে বাণিজ্য বহর মক্কায় এনেছিল এবং যে অর্থ লাভ হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের কাছেই তা রক্ষিত ছিল।

        বদরের প্রান্তরে যাদের স্বামী, সন্তান, ভাই, পিতা তথা আত্মীয়-স্বজন নিহত হয়েছিল, তাদের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। তাদের একজন নিহত হলেই তাদের ভেতরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত, সেখানে তাদের বিখ্যাত নেতৃবৃন্দসহ ৭০ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা হিংস্র হায়েনার মতই হয়েছিল।

         আবু জাহিলের সন্তান ইকরামা এবং আরো বেশ কয়েকজন কুরাইশ নেতা আবু সফিয়ানের কাছে গিয়ে বললো, 'মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বহুলোকজন হত্যা করেছে। আমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। ব্যবসার লাভের যে অর্থ জমা আছে, আমরা চাই সে অর্থ প্রতিশোধ গ্রহণের কাজে ব্যয় করা হোক।' ইকরামার কথায় প্রতি কুরাইশদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সমর্থন জানালো। বদরের প্রান্তরে তারা মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে অনুমান করেছিল। এ কারণে তারা এবার বদরের তুলনায় অনেক বেশী শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। সে সময় মানুষের মধ্যে যুদ্ধের উদ্দীপনা সৃষ্টি করার জন্য প্রধান হাতিয়ার ছিল উৎসাহ ব্যঞ্জক কবিতা। বদর যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছিল, তাদের ওপরে মক্কার কবিগণ শোকগাঁথা রচনা করে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শোকগাঁথা গেয়ে সাধারণ মানুষের মনে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিল।

        প্রতিপক্ষের আক্রমনের মুখে বদরের ময়দানের মত কোন ব্যক্তি যেন পালিয়ে না আসে, এ কারণে এবার তারা মক্কার কিছু সংখ্যক নারীকে সাথে নিয়েছিল। নারী কোন পুরুষকে লজ্জা দিবে, আরবের লোকদের কাছে এটা ছিল মৃত্যুর শামিল। যুদ্ধের ময়দানে নারী থাকবে আর কোন পুরুষ যোদ্ধা পিছনে সরে আসবে, এ কথা তারা কল্পনাও করতে পারতো না। তাছাড়া নারীরা নানা ধরণের উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে সৈন্যদেরকে উৎসাহ দিতো।

        যুদ্ধের ময়দানে নারী সাথে থাকলে আরবের লোকজন নিজের সর্বশেষ শক্তি ব্যয় করে যুদ্ধ করতো। তারা জানতো, যুদ্ধে তারা পরাজিত হলে তাদের নারীদের ওপরে প্রতিপক্ষ নির্যাতন করবে। এ কারণে ওহুদের দিকে অগ্রসর হবার সময় তারা ঐ সমস্ত নারীদেরকে সাথে নিয়েছিল, বদরের প্রান্তরে যাদের কেউ না কেউ নিহত হয়েছিল।

        বদর যুদ্ধের সেনাপতি ওৎবা নিহত হয়েছিল। তার মেয়ে হিন্দা প্রতীজ্ঞা করেছিল, তার পিতার হত্যাকারীর কলিজা সে চিবিয়ে টুকরো টুকরো করবে। এই হিন্দা ছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, কারবালায় নবী বংশ নিধনের নায়ক ইয়াজিদের দাদী এবং হযরত মাবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এর মাতা। যদিও আবু সুফিয়ান এবং হিন্দা এক সময় ইসলাম কবুল করে ইসলামের যথেষ্ট খেদমত করেছিলেন। আবু জাহিলের সন্তান ইকরামাও এক সময় ইসলাম কবুল করে ইসলামের জন্য শাহাদাতবরণ করেছিলেন।

        এ ধরণের বেশ কয়েকজন নারী, ওহুদের ময়দানে কুরাইশদের সাথে ছিল। তাদের নাম হলো, হিন্দা, আবু জাহিলের সন্তান ইকরামার স্ত্রী উম্মে হাকিম, হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের বোন ফাতিমা, তায়েফের নেতা মাসুদ সাকাফির মেয়ে বারজাহ, আমর ইবনুল আসের স্ত্রী রীতা বা বারিতা, হযরত মুসআব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর মাতা গান্নাস। এই ওহুদের ময়দানেই কাফির মাতার চোখের সামনেই হযরত মুসআব শাহাদাত বরণ করেছিলেন। মক্কা থেকে কুরাইশরা যাত্রা করে মদীনার সামনের উপত্যকার মুখে ঝর্ণার কাছে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। আল্লাহর নবী কুরাইশদের প্রস্তুতির কথা জেনে সাহাবায়ে কেরামের কাছে বললেন, 'আমি একটি ভালো স্বপ্ন দেখেছি। আমি স্বপ্নে দেখলাম আমার একটি গরু জবেহ করা হয়েছে। আমার তরবারী একদিকে ফেটে গেছে। আমি একটি সুরক্ষিত বর্মের ভেতরে হাত প্রবেশ করিয়েছি।

        তাঁর এই স্বপ্নের তাৎপর্য ছিল, এবার তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবা শাহাদাতবরণ করবে। রাসূলের পরিবার ভুক্ত একজন অর্থাৎ হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনুহু শাহাদাতবরণ করবেন। তাঁর দেখা স্বপ্নের একটি অংশের উল্লেখ করে সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, 'আমি বর্ম দ্বারা মদীনাকে বুঝেছি। তোমরা যদি ভালো মনে করো তাহলে মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করেই কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করবে তাহলে তা করতে পারো। এরপরও যদি কুরাইশরা ওখানেই অবস্থান করে তাহলে তাদের পরিণতি খারাপ হবে। আর তারা যদি মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে আমরা মদীনায় বসেই তাদের মোকাবেলা করবো।'

        বিশ্বনবীর চাচা হযরত আব্বাস ইসলাম কবুল করলেও তিনি মক্কাতেই বসবাস করতেন। তিনি কুরাইশদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য লিখে একজন সংবাদদাতা প্রেরণ করেছিলেন মদীনায়। হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সংবাদদাতাকে সতর্ক করে দিলেন, সে যেন তিনদিনের মধ্যে মদীনায় আল্লাহর রাসূলের কাছে গিয়ে মক্কার সংবাদ জানায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচার পক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে তিনিও দু'জন সংবাদ সংগ্রহকারীকে কুরাইশদের গতিবিধি জানার জন্য প্রেরণ করলেন।

        তাঁরা ফিরে এসে জানালো, কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকন্ঠে এসে পৌঁছেছে। তাদের অশ্ব মদীনার চারণ ক্ষেতগুলো খেয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আল্লাহর নবী একজনকে প্রেরণ করলেন, কুরাইশদের সৈন্য সংখ্যা জানার জন্য। তিনি সংবাদ সংগ্রহ করে তাঁকে জানালেন। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার চারদিকে এমনভাবে প্রহরার ব্যবস্থা করলেন যে, বাইরের কোন শক্তি যেন মদীনা আক্রমন করতে না পারে। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রহরা দেয়ার জন্য নিযুক্ত হলেন হযরত সায়াদ ইবনে মুয়াজ ও হযরত সায়াদ ইবনে ওবাদাহ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম। তাঁরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মসজিদে নববীর দরজায় প্রহরা দিতে থাকলেন।

         আল্লাহর নবী সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে গুরত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন। তিনি তাদের মতামত জানতে চাইলেন, মদীনার ভেতরে অবস্থান করেই যুদ্ধ করা হবে, না মদীনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা হবে। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডাকা হয়নি, তবুও সে বৈঠকে উপস্থিত থেকে উপযাচক হয়ে মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্রুর সাথে মোকাবেলার পরামর্শ দিল। মুনাফিক নেতা বলেছিল, 'মদীনাতেই অবস্থান গ্রহণ করুন, বাইরে যাবেন না। আমরা মদীনার বাইরে গিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে গেলে শত্রু আমাদের অধিক ক্ষতি করতে পারবে। আর আমরা মদীনার ভেতরে বসে তাদের সাথে মোকাবেলা করলে আমরা তাদের অধিক ক্ষতি করতে পারবো। সুতরাং আপনি বাইরে যাবেন না। শত্রুরা যেখানে আছে তাদের সেখানেই থাকতে দিন। তাদের অবস্থান স্থল ভাঁদের জন্য অবরোধ স্থল হিসাবেই গণ্য হবে। তারা যদি মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে আমালের "যোদ্ধাগণ তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেবে আর আমাদের নারী আর শিশুরা বাড়ির ছাদের ওপর থেকে শত্রুদের ওপরে পাথর দিয়ে আঘাত করতে পারবে।

        মুনাফিক নেতার অভিলাষ ছিল, তার পরামর্শ মত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি মদীনার অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করেন, তাহলে সে তার ইয়াহুদী মিত্রের সাথে যোগ দিয়ে ভেতর থেকে মুসলমানদেরকে আঘাত করে মদীনা থেকে ইসলামকে বিদায় করে দেবে। আল্লাহর নবী মুনাফিক নেতার এই গোপন অভিলাষের কথা জানতে পেরে এবং সামরিক কৌশলের কারণে মদীনার বাইরে গিয়েই যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। 24

        সাহাবায়ে কেরামের একটি অংশও মদীনার ভেতরে অবস্থান করে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। বদরের যুদ্ধে যেসব সাহাবা অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাঁরা পরামর্শ দিলেন মদীনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য। তাঁরা বলেছিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! শত্রুর মোকাবেলার জন্য আমাদেরকে মদীনার বাইরে নিয়ে চলুন, কেননা ওরা যেন ধারণা করতে না পারে যে, আমরা কাপুরুষ হয়ে গেছি বা দুর্বল হয়ে পড়েছি।'

        সেদিন ছিল জুমুআবার। একজন আনসার সাহাবীও সেদিন ইন্তেকাল করেছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর নামায় আদায় করে তারপর জানাযা আদায় করলেন। এরপর তিনি নিজের ঘরে প্রবেশ করে যুদ্ধের পোষাকে সজ্জিত হয়ে যখন বের হয়ে এলেন, তখন যেসব সাহাবায়ে কেরাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁরা ধারণা করেছিল, আল্লাহর নবীর ইচ্ছা ছিল মদীনার ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা, এখন তাদের পরামর্শেই তিনি বাইরে যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন।

        সাহাবায়ে কেরাম বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করছি। আপনি বাইরে না গিয়ে মদীনাতেই অবস্থান করুন।'

            রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'এটা কখনো হয় না। যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পরে তা খুলে ফেলা কোন নবীর পক্ষে শোভনীয় নয়।'

        মক্কা থেকে ইসলামের শত্রু বাহিনী যাত্রা করে মদীনার উপকণ্ঠে পৌছেছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর নামায আদায় করে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। মুসলিম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক হাজার। এর ভেতরে মুনাফিক নেতা আম্বুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অনুগত সৈন্য ছিল তিনশত।

        আল্লাহর নবী শাওত নামক স্থানে পৌঁছার পরে বিশ্বাসঘাতক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তার অনুগত তিনশত সৈন্য নিয়ে পৃথক হয়ে গেল। সে সৈন্য বাহিনীকে লক্ষ্য করে ঘোষনা দিল, 'ওহে লোক সকল! আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কেন এতগুলো মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথায় প্রাণ দিবে।'

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মুনাফিক নেতাকে অনুরোধ করে বললো, 'আমি তোমাদেরকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে বলছি, তোমার মুসলিম ভাইদেরকে এবং স্বয়ং আল্লাহর নবীকে 'শত্রুর অস্ত্রের সামনে ফেলে এভাবে চলে যেও না।' বিশ্বাসঘাতক জবাষ দিল, 'আমাদের ধারণা যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ হবে মনে করলে আমরা ফিরে যেতাম না।'

        তাদেরকে অনেক অনুরোধ করেও ফিরিয়ে আনা' গেল না। তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু রেগে উঠে বললেন, 'হে আল্লাহর শত্রুরা! আল্লাই তোদেরকে বিতাড়িত করে দিক। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোদের মুখাপেক্ষী নয়, আমাদের জন্য মহান আল্লাহই যথেষ্ট।'

        মাত্র সাত শত সৈন্য নিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহুদের রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। মুসলিম বাহিনীর ভেতরে একশতজন ছিল লৌহ বর্ম আবৃত। এই বাহিনীতে বেশ কয়েকজন কিশোর সাহাবী ছিলেন। আল্লাহর নবী তাঁদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা এতই প্রবল ছিল যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে তাঁদেরকে অনুমতি দিলেন।

        হযরত ছামুরা এবং হযরত রাফে রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম ছিলেন বয়সে একেবারেই কিশোর। সেনা বাহিনী যখন বাছাই করা হচ্ছিল, তখন তাঁরা পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলেন, যেন তাদেরকে বড় দেখা যায়। তাদেরকে বাদ দেয়া হলে তাঁরা আল্লাহর পথে প্রাণ দান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো, এ কথা মনে করে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তাদের কাঁন্না দেখে স্থির করা হলো, এই দুইজনের মধ্যে কুন্তি লড়ে যে জিতবে তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়া হবে। দু'জন বোধহয় এই সুযোগ লাভ করে একে অপরের কানে কানে বলে দিয়েছিল, 'কুস্তি লড়াইতে একবার তুমি হারবে আরেক বার আমি হারবো। তাহলে আমরা দু'জনই যুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগ লাভ করবো।'

        পরিশেষে তারা কুস্তি লড়াই করে বিজয়ী জ্বয়ে রাসূলের অনুমতি লাভ করেছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুসারীদেরকে এমন শিক্ষাই দিয়েছিলেন যে, তাঁরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণ দান করার জন্য প্রতিযোগিতা করতো। আর তাদের এই ত্যাগের কারণেই ইসলাম একটি অপরাজিত শক্তি হিসাবে বিশ্বব্যাপী আত্মপ্রকাশ করেছিল।

Post a Comment

0 Comments