রাজা-বাদশাহর প্রতি বিশ্বনবীর আহ্বান

        হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানদের জন্য শান্তি এবং স্বস্তির একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র আরব ভুখন্ডের জন্য প্রেরণ করেননি। তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল সারা বিশ্বের জন্য। তাঁর দায়িত্ব ছিল সমস্ত মানুষের কাছে মহাসত্যের আহ্বান পৌঁছে দেয়া। সন্ধির বদলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজে লাগালেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের একটি সমাবেশ আহ্বান করে বললেন, 'মহান আল্লাহ আমাকে সারা জগতের জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তোমরা আমার পক্ষ থেকে মানুষের কাছে সত্যের আহ্বান পৌঁছে দাও। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষন করবেন। ঈসার অনুসারীদের মত তোমরা আমার বিরুদ্ধাচরণ করো না।'

        সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! তারা কিভাবে হযরত ঈসার বিরুদ্ধাচরণ করতো?' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, 'আমি তোমাদের ওপরে যেভাবে দায়িত্ব প্রদান করি তিনিও সেভাবে তাঁর অনুসারীদের ওপর দায়িত্ব দিতেন। যাকে কাছে কোথাও প্রেরণ করা হত, সে খুবই খুশী হত। আর যাকে দূরে প্রেরণ করা হত, সে খুবই অসন্তুষ্ট হত। এ অবস্থা দেখে ঈসা আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তারপর তাদেরকে যে দেশে প্রেরণ করা হত, সে সেই দেশের ভাষাভাষী হয়ে যেত।'

        অর্থাৎ নিজের আসল দায়িত্ব ভুলে গিয়ে সেই দেশের সভ্যতার সাথে মিশে যেত। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের শাসকদের কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য দূত মারফত বার্তা প্রেরণ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আরবের বাইরের শাসকদের কাছে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন, সে সময় মক্কার কুরাইশদের ব্যবসায়ী দল আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়া অবস্থান করছিল। বছর কয়েক পূর্বে পারস্য সৈন্যগণ রোমকদের নিয়ন্ত্রণাধীন সিরিয়া আক্রমন করে তাদেরকে পরাজিত করেছিল। তারপর রোম সম্রাট তাদেরকে পরাজিত করে সিরিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এই উপলক্ষে সে জেরুজালেম ভ্রমণ করছিল। আরব গোত্রগুলোর মধ্যে যে গোত্র রোমানদের শাসনাধীনে ছিল, সে গোত্রের নাম ছিল গাচ্ছানী গোত্র। তাদের রাজধানীর নাম ছিল বসরা।

        বসরার অধিপতির নাম ছিল হারিস গাচ্ছানী। হযরত দাহিয়া কলবী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এই হারিস গাচ্ছানীর কাছেই আল্লাহর নবীর পত্র হস্তান্তর করেছিলেন। এই ঘটনার কিছু দিন পূর্বে রোম সম্রাট একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর দরবারের লোকদের কাছে সে স্বপ্ন বলার পরে কেউ তার অর্থ বলতে পারেনি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর সাম্রাজ্য এমন এক জাতি দখল করেছে, যারা তাঁর ধর্ম অনুসরণ করে না। এ সময়েই তাঁর কাছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র হারিস গাচ্ছানী প্রেরণ করেছিল। রোম সম্রাট পত্র পাবার পরে নির্দেশ দিলেন, 'আরবের কোন অধিবাসীকে খোঁজ করে নিয়ে এসো।'

        আবু সুফিয়ান সঙ্গী-সাথীসহ সে সময় ব্যবসা উপলক্ষে সেখানেই ছিল। তাদেরকে রোম সম্রাটের দরবারে নিয়ে আসা হলো। এ সময় দরবারে দোভাষীও ছিল। তাঁর দরবারে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং তাঁর ধর্মের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিল। রোম সম্রাট জানতে চাইলো, 'আরবে যে ব্যক্তি নবী হিসাবে নিজেকে দাবী করছে তাঁর নিকটতম প্রতিবেশী কে আছে?'

        আবু সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, 'আমি ঐ ব্যক্তির নিকটতম প্রতিবেশী, যে ব্যক্তি নিজেকে নবী হিসাবে দাবী করে।' রোম সম্রাট জানতে চাইলো, 'যে ব্যক্তি নবী হিসাবে দাবী করছে, তাঁর বংশ কেমন?' আবু সুফিয়ান বললো, 'তিনি আমাদের মধ্যে উত্তম বংশের লোক।' রোম সম্রাট প্রশ্ন করলো, 'এই বংশে কি আর কোন ব্যক্তি নবী হিসাবে দাবী করেছিল?' আবু সুফিয়ান জানালো, 'না, এমন দাবী ইতোপূর্বে কোন ব্যক্তি করেনি।'

        রোম সম্রাট জানতে চাইলো, 'তাঁর বংশে কি কোন ব্যক্তি রাজা বাদশাহ ছিল?' আবু সুফিয়ান বললো, 'না, কেউ রাজা-বাদশাহ ছিল না।' রোম সম্রাট জিজ্ঞাসা করলো, 'তাঁর আদর্শ যারা গ্রহণ করছে, তাঁরা কি সমাজের উচ্চস্তরের লোক না নিম্ন স্তরের?' আবু সুফিয়ান জবাব দিল, 'সমাজের নিম্ন স্তরের লোকের সংখ্যাই বেশী।' রোম সম্রাট প্রশ্ন করলো, 'তাঁর আদর্শের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না হ্রাস পাচ্ছে?' আবু সুফিয়ান কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিল, 'ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।' রোম সম্রাট জানতে চাইলো, 'তিনি কি কোনদিন মিথ্যা কথা বলেছেন?' আবু সুফিয়ান জানালো, 'না কোনদিন মিথ্যা কথা বলেননি।'

        রোম সম্রাট জিজ্ঞাসা করলো, 'তিনি কি কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন?' আবু সুফিয়ান উত্তর দিল, 'না, তিনি কোনদিন কারো সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। তবে তাঁর সাথে আমরা বর্তমানে একটি চুক্তি করেছি। এই চুক্তির ব্যাপারে সে কি করে ভবিষ্যৎই বলে দেবে।' রোম সম্রাট প্রশ্ন করলো, 'তোমরা কি কখনো তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছো?' আবু সুফিয়ান জানালো, 'হ্যাঁ করেছি।' রোম সম্রাট আগ্রহ প্রকাশ করলো, 'যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?' আবু সুফিয়ান সত্য স্বীকার করলো, 'কখনো আমরা বিজয়ী হয়েছি কখনো তিনি বিজয়ী হয়েছেন।' রোম সম্রাট সর্বশেষ প্রশ্ন করলো, 'তিনি মানুষকে কোন শিক্ষার দিকে আহ্বান করেন?'

        আবু সুফিয়ান জানালো, 'তিনি মানুষকে আহ্বান করেন, তোমরা এক আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করো। তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না। নামায আদায় করো। সত্য কথা বলো। অঙ্গীকার পালন করো। পবিত্রতা অবলম্বন করো। লুটতরাজ করো না। অন্যের উপকার করো ইত্যাদী।'

        আবু সফিয়ান মিথ্যা কথা বলতে পারেনি। কারণ পৌত্তলিক হলেও তাঁর ভেতরে কিছুটা শালিনতা বোধ ছিল। এ ছাড়া তার সাথে মক্কার বেশ কয়েকজন লোক ছিল। সে তাদেরই নেতা। নেতা হয়ে তাদের সামনে সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতে পারেনি। আবু সুফিয়ানের কথা শুনে রোম সম্রাট মন্তব্য করেছিল, 'তুমি সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যা বললে, সবকিছু শুনে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হলো যে, সে ব্যক্তি অবশ্যই আল্লাহর নবী। তিনি অবশ্যই আমার দেশ জয় করবেন। এখন তিনি আমার কাছে থাকলে আমি তাঁর কদম মোবারক ধুয়ে দিতাম এবং নিজেকে ধন্য করতাম।'

রোম সম্রাটের কাছে বিশ্বনবীর পত্র মোবারক

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি রোম সম্রাটের দুর্বলতা দেখে তাঁর রাজ্যের উচ্চ পদস্থ লোকজন তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিল, রোম সম্রাট তা স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছিল। সম্রাটের কথাবার্তা এবং ব্যবহার থেকে প্রকাশ পেয়েছিল তিনি অচিরেই ইসলাম গ্রহণ করবেন। কিন্তু রাজ্য লোভ, পদের লোভ তাকে সত্য গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করেছিল। তাঁর মনের জগতে মহাসত্যের যে জ্যোতি উদিত হয়েছিল, লোভের ঘৃণ্য স্পর্শে সে জ্যোতি মুহূর্তেই নির্বাপিত হয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণ করলেই তাঁর রাজ্যের কর্মকর্তাবৃন্দ তাকে আর বর্তমান পদে বহাল রাখবে না বা তাঁর গদি টিকবে না, এই ধারণা তাঁর ভেতরে ছিল বদ্ধমূল। ফলে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য হতে সে বঞ্চিত হলো। তবে আল্লাহর নবীর পত্রের প্রতি সে কোন অমর্যাদা প্রদর্শন করেনি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছে যে পত্র লিখেছিলেন, আমরা তাঁর বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করছি।

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যিনি আল্লাহর বান্দাহ এবং প্রেরিত রাসূল। রোমের সম্রাটের প্রতি যিনি রোমের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। যিনি সত্য গ্রহণের প্রত্যাশী তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং নিরাপত্তা লাভ করুক। আমি তোমাকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, ইসলাম গ্রহণ করো তাহলে নিরাপত্তা পাবে। মহান আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ বিনিময় দিবেন। যদি তুমি সত্য গ্রহণ না করো তাহলে তোমার প্রজাদের যাবতীয় অপরাধের কারণে তুমিই দায়ী হবে। হে গ্রন্থধারীগণ! এসো, আমরা এমন একটি কথার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি, যা তোমাদের ও আমাদের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। সে কথাটি হলো, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করবো না। আমরা অন্য কোন শক্তিকে তাঁর সাথে অংশীদার বানাবো না এবং আমরা একে অন্যকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করবো না। তুমি যদি এসব কথা গ্রহণ না করো, তাহলো সাক্ষী থেকো আমরা এসব কথা গ্রহণ করেছি।' পত্রের শেষে আল্লাহর নবীর পবিত্র নাম মোবারক সীল মোহর করা ছিল। অর্থাৎ 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দ সীল মোহর করা ছিল।

        কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, সম্রাট এই পত্র তাঁর দেশের প্রধান পুরোহিতের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। পুরোহিত সে পত্র পাঠ করে প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়েছিল, সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাঁর ঘোষনা শোনার সাথে সাথেই তাকে তাঁর অনুসারীরা হত্যা করেছিল। সে সময় মহান আল্লাহর নাজিল করা পূর্ববর্তী কিতাবের শিক্ষা কিছুটা ছিল। এর মাধ্যমেই অনেকেই জানতো যে, বর্তমান সময় একজন নবী অবশ্যই আসবেন। তবে এই কিতাবধারিদের ধারণা ছিল, সেই নবী তাদের ভেতর থেকেই প্রকাশিত হবেন। কিন্তু আরবদের মধ্য থেকে নবী হতে দেখে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো হিংসা। এই হিংসাই শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পথভ্রান্ত করেছিল।

পারস্যের দরবারে বিশ্বনবীর দূত

        পারস্যের দরবারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হোজায়ফা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। পারস্যের দরবারের নিয়ম ছিল সম্রাট যতক্ষণ আদেশ না দিতেন, ততক্ষণ কোন ব্যক্তি মাথা উঠাতো না। হযরত আব্দুল্লাহ দরবারে প্রবেশের সময় এই নিয়ম তাঁকে একজন শিখিয়ে দিল। তিনি বললেন, 'আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমরা এক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো সম্মুখে মাথানত করি না।'

        প্রহরী তাকে জানালো, এই নিয়ম পালন না করলে সম্রাট কারো পত্র গ্রহণ করেন না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হোজায়ফা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দরবারে প্রবেশ করলেন। সম্রাট দরবারে প্রবেশ করে সামনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। সবাই মাথা নিচু করে আছে আর একজন লোক মাথা উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গীতে বসে আছে। তিনি লোকটির পরিচয় জানতে চাইলেন। তাকে বলা হলো, লোকটি এসেছে সেই আরব থেকে। আপনার জন্য সে একটি বার্তা এনেছে।

        সম্রাট তাঁকে কাছে আসতে বললেন। নবীর সাহাবী কাছে এসে তাকে সালাম জানিয়ে পত্র তার কাছে হস্তান্তর করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্রাটের কাছে লিখেছিলেন-

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম

        মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট খসরুর কাছে। যারা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করে তাদের প্রতি সালাম। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ দাসত্ব পাবার উপযোগী নয় এবং আমি তাঁর প্রেরিত রাসূল। জীবিত মানুষকে সতর্ক করার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। তোমার প্রতি আমার আহ্বান, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। তোমার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি বর্ষিত হবে। যদি না করো তাহলো তোমার শাসিত প্রজাদের যাবতীয় অন্যায় কাজের জন্য তুমি দায়ী হবে।

        পত্রের শেষে আল্লাহর নবীর পবিত্র নাম মোবারক সীল মোহর করা ছিল। পারস্যের সম্রাট খসরু ছিল চরম পাপাচারী ব্যক্তি। পৃথিবীর কোন মানুষ তার সমপর্যায়ের হতে পারে, এটা সে মানতো না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র পাঠ করার সাথে সাথে সে অহংকারে গর্জে উঠে বললো, 'এতবড় সাহস কার। আরবের সামান্য একজন মানুষ আমাকে বলে আমার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য? তারপরে সে আমার নামের পূর্বে নিজের নাম লিখেছে!'

        চরম অহংকারের বশবর্তী হয়ে সে আল্লাহর নবীর পত্র ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেললো। তার ধৃষ্টতার এখানেই শেষ হলো না। ইয়েমেনের গভর্ণর বাজানকে আদেশ দিল, আরবের নবী সেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রেফতার করে তার দরবারে প্রেরণ করা হোক। পারস্য সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী বাজান দুইজন রাজ কর্মচারীকে মদীনায় প্রেরণ করলো, আল্লাহর নবীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার জন্য। তারা মদীনায় গিয়ে আল্লাহর নবীএক জানালো, 'আমরা পারস্য সম্রাটের আদেশ অনুসারে আপনাকে গ্রেফতার করতে এসেছি। আপনি স্বেচ্ছায় যদি আমাদের সাথে না যান তাহলে সৈন্য বাহিনী এখানে আসবে।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সমাদর করে মেহমানদারী করলেন। আল্লাহর নবী ও সাহাবায়ে কেরামের ব্যবহার দেখে পারস্য রাজের কর্মচারীবৃন্দ অবাক হয়ে গেল। তারা পুনরায় জানালো, 'আপনি যদি আদেশ অনুসারে উপস্থিত হন, তাহলে ইয়েমেনের গভর্ণর আপনার জন্য সুপারিশ করতে পারেন। আর তা যদি না করেন তাহলে আপনার শহর তিনি মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন।'

        'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জানালেন, 'আপনাদের প্রশ্নের জবাব আমি আগামী কাল দেব।'

        তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মেহমান খানায় রাখা হলো। তারা অবাক হলো, পারস্য সম্রাটের আদেশে মানুষ থরথর করে কাঁপে। অথচ এই মানুষটির ভেতরে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া নেই। পরের দিন তারা আল্লাহর নবীর কাছে এলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জানালেন, 'তোমাদের সম্রাট আর এই পৃথিবীতে জীবিত নেই। তার সন্তান তাকে গতরাতে নিহত করেছে। তোমাদের গভর্ণর বাজানকে বলবে, পারস্য সম্রাট যেমন আমার পত্রকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেছে, মহান আল্লাহ পারস্য সাম্রাজ্যকে তেমনি টুকরা টুকরা করে দেবেন। বাজানকে বলবে, সে যদি ইসলাম কবুল করে তাহলে তাকে আমি তার পদেই বহাল রাখবো। কারণ, অচিরেই ইসলাম পারস্যের সিংহাসনে বসবে।'

        পারস্যের দূতগণ অবাক হয়ে ইয়েমেনে ফিরে গেল। সেখানেই তারা জানতে পারলো, সম্রাট খসরুর সন্তান সিরওয়াহ পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছে। সে বাজানের কাছে সংবাদ প্রেরণ করেছে, দ্বিতীয় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত আরবের সেই নবীর ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। ইয়েমেনের গভর্ণর তার দূতের মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সংবাদ শুনলেন। তারপরই সে এবং দরবারের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

        কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তাঁর মনে এই দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠেছিল। তাঁর ইচ্ছা ছিল, জীবনের বাকী কয়টি দিন সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে অবস্থান করে কাটিয়ে দেবে। এ কারণে সে গভর্ণরের পদ হতে পদত্যাগ করে মদীনার পথে যাত্রা করেছিল। পথে তিনি এক গুপ্তঘাতকের হাতে শাহাদাতবরণ করেন।

        আবিসিনিয়ার দরবারেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূত প্রেরণ করেছিলেন। ইতোপূর্বেই সেখানের বাদশাহ ইসলামের অনুকূলে সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর নবীর জন্য প্রচুর উপঢৌকনসহ তাঁর সন্তানকে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু পানি পথে জাহাজ ডুবিতে তাঁরা সবাই শাহাদাতবরণ করেছিলেন। আবিসিনিয়ার বাদশাহর প্রচেষ্টায় ইসলাম অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই বাদশাহর ইন্তেকালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেছিলেন বলে কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে।

Post a Comment

0 Comments