আলোচনা পাঠে মনে এইরূপ প্রশ্ন আসিতে পারে যে, এই নীরবতা ও চুপ থাকা উত্তম হওয়ার কারণ কি? উহার জবাব হইল, কথা বলিতে গেলেই পদে পদে যত বিপদাশংকা। ঝুট, মিথ্যা, পরনিন্দা, গীবত-শেকায়েত, রিয়া চোগলখোরী, কথা বাড়াইয়া বলা বা হ্রাস করা, মিথ্যা প্রশংসা, আত্মপ্রশংসা, অপরকে কষ্ট দেওয়া, গোপন বিষয় ফাঁস করিয়া দেওয়া ইত্যাদি সর্বনাশা অপরাধসমূহ এই জিহ্বার মাধ্যমেই হইয়া থাকে। জিহ্বা অতি সহজেই সঞ্চালন করা যায় এবং উহাতে কিছুমাত্র কষ্ট হয় না। বরং কথা বলায় অভ্যস্ত ব্যক্তিগণ অনর্গল কথা বলিতে এক প্রকার আত্মসুখই অনুভব করিয়া থাকে।
বস্তুতঃ যাহারা অতিশয় কথা বলায় অভ্যস্ত তাহাদের পক্ষে কোন্ কথা বলা উচিত আর কোন্ কথা বলা উচিৎ নহে এই সকল বিষয় জানিয়া তদনুযায়ী নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। বরং এই শ্রেণীর লোকেরা পরিণাম চিন্তা না করিয়া অনর্গল সব ধরনের কথাই বলিতে থাকে। তা ছাড়া কোন্ কথাটি মন্দ আর কোন্ কথাটি ভাল, তাহা কেবল আলেমগণের পক্ষেই অবগত হওয়া সম্ভব।
মোটকথা, কথা বলার মধ্যেই যত বিপদের আশংকা এবং চুপ থাকার মধ্যেই নিরাপত্তা। এই কারণেই কথা বলা অপেক্ষা চুপ থাকার ফজিলত অধিক বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। নীরব থাকার আরো অনেক ফায়দা রহিয়াছে। যেমন কম কথা বলা ও নীরবতার ফলে হিম্মত, সাহস ও ভাব-গাম্ভীর্য সুসংহত থাকে এবং জিকির-ফিকির ও এবাদতের সুযোগ পাওয়া যায়। তাছাড়া চুপ থাকার ফলে দুনিয়াতে কথা বলার বিপদ এবং পরকালে উহার হিসাব হইতে মুক্তি পাওয়া যায়। কালামে পাকে এরশাদ হইয়াছে-
ما يلفظ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
অর্থঃ "সে যেই কথাই উচ্চারণ করে, তাহাই গ্রহণ করার জন্য তাহার নিকট সদাপ্রস্তুত প্রহরী রহিয়াছে।"
(সূরা ক্বাফ ১৮ আয়াত)
এক্ষণে আমরা যুক্তি-প্রমাণাদিসহ চুপ থাকার ফজিলত এবং উহার উপকারিতা উল্লেখ করিব। চুপ থাকার উপকারিতা, কথা বলার অনিষ্টের বিবেচনায় 'কথা' মোট চারি প্রকার-
(এক) এমন কথা যাহার মধ্যে কেবল অকল্যাণ ও ক্ষতিই নিহিত।
(দুই) যেই কথা সর্ব বিবেচনায় মানুষের জন্য কল্যাণকর ও উপকারী।
(তিন) যেই কথার মধ্যে অপকার ও উপকার উভয়ই নিহিত।
(চার) যেই কথার মধ্যে কোন ক্ষতিও নাই এবং উপকারও নাই।
প্রথম প্রকারে বর্ণিত কথার ক্ষেত্রে নীরব থাকা আবশ্যক। তৃতীয় প্রকারের কথার ক্ষেত্রে যদি উপকারের তুলনায় ক্ষতি বেশী হয় তবে সেই ক্ষেত্রেও নীরব থাকিতে হইবে। চতুর্থ প্রকার কথা কেবল অকারণে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নহে। এখন অবশিষ্ট রহিল কেবল দ্বিতীয় প্রকারের কথা এবং ইহাই কেবল বলার যোগ্য কথা। সুতরাং দেখা যাইতেছে- কথার সমষ্টির কেবল এক চতুর্থাংশই বলার যোগ্য এবং উহার তিন চতুর্থাংশ বর্জনীয়। দ্বিতীয় প্রকারে বর্ণিত যাহা বলার যোগ্য সেই ক্ষেত্রেও পদে পদেই বিপদের আশংকা রহিয়াছে। কেননা, এই কথা বলার ক্ষেত্রেও মানুষের অবচেতন মনে এমন কিছু গর্হিত উপসর্গ আসিয়া উহার সহিত যুক্ত হয় যে, অনেক সময় মানুষ উহার উপস্থিতি টেরও পায় না। যেমন- রিয়া, গীবত-শেকায়েত, পরনিন্দা, আত্মপ্রীতি ইত্যাদি বিষয় সমূহ অতি সূক্ষভাবেই মানুষের ভাল কথার সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া উহাকেও মন্দ ও গর্হিত কথায় পরিণত করিয়া ফেলে। সুতরাং কথা বলার অর্থই যেন বিপদ লইয়া খেলা করা।
তো যেই ব্যক্তি উপস্থাপিত বিবরণের আলোকে কথা বলার সূক্ষ্ম বিপদ, উহার অনিষ্ট ও পরিণতি সম্পর্কে বিশদভাবে পরিজ্ঞাত হইবে, সেই ব্যক্তি ইহাও নিশ্চিতভাবেই উপলব্ধি করিবে যে, এই প্রসঙ্গে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তিই চূড়ান্ত ও যথার্থ। তিনি এরশাদ করিয়াছেন-
مَنْ سَكَتَ نَجا
"যে চুপ থাকে, সে মুক্তি পায়।"
বস্তুতঃ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এলেম, হেকমত ও প্রজ্ঞা-সমুদ্রের সিঞ্চিত মণিমুক্তার আধার। তাঁহার পবিত্র জবান-নিসৃত প্রতিটি কথাই ছিল পরিপূর্ণ হেকমত, প্রজ্ঞা ও তাৎপর্যের নূরানী আবরনে আচ্ছাদিত। এই আবরণ উন্মুক্ত করিয়া তাঁহার পবিত্র বাণীর তাৎপর্য অনুধাবন করা- ইহা সকলের কাজ নহে। কেবল মোহাক্কেক আলেমগণের পক্ষেই ইহা সম্ভব। বক্ষমান আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা পর্যায়ক্রমে মানুষের মুখ-নিসৃত কথার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনিষ্ট ও বিপদ সমূহের ধারাবাহিক বিবরণ উল্লেখ করিব।
অর্থহীন কথাঃ
মানুষের কর্তব্য হইল নিজের মুখ হইতে কেবল এমন কথাই উচ্চারণ করা যাহা উপকারী ও কল্যাণকর এবং এমন সব কথা হইতে বিরত থাকা যাহা ক্ষতিকর। মিথ্যা, পরনিন্দা, গীবত-শেকায়েত, চোগলখোরী ইত্যাদি অনিষ্টকর কথা হইতে অবশ্যই নিজেকে রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে।
যেই কথা না বলিলে কোন গোনাহ হয় না এবং যাহা না বলা নিজের জান-মালের জন্যও ক্ষতিকর নহে উহাই অর্থহীন কথা। মানুষের জন্য সব চাইতে নিরাপদ অবস্থা হইল কোন কথা বলার সময় ভালভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবে যেন কোন অধস্থাতেই তাহা উপরে বর্ণিত গীবত-শেকায়েত ইত্যাদি অনিষ্টের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া না পড়ে। কেবল এমন কথাই বলিবে যাহা শরীয়ত সম্মত এবং যাহা নিজের জন্য বা অন্য কোন মুসলমানের জন্য ক্ষতিকর নহে।
অবশ্য অনেক সময় মানুষের মুখ হইতে অর্থহীন ও অনাবশ্যক কথাও বাহির হইয়া যায় বটে। উহার ফলে এক দিকে যেমন সময় অপচয় হয়, অপর দিকে পরকালের হিসাব বৃদ্ধি পায় এবং নিকৃষ্ট বস্তুর বিনিময়ে উৎকৃষ্ট বস্তু হাত ছাড়া হয়। কেননা, বক্তা যদি তাহার কথার পরিবর্তে নীরবে আল্লাহ পাকের জাত-সিফাত ও গুণ-বৈশিষ্টের ফিকিরে নিমগ্ন থাকিত, তবে অবশ্যই উহা তাহার জন্য অধিক লাভজনক হইত এবং উহার কারণে তাহার প্রতি আল্লাহর রহমতের দরজা খুলিয়া যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। আর আল্লাহ পাকের জাত-সিফাত ও কুদরতের উপর চিন্তা ও গবেষণার ফলে অদৃশ্য জগতের রহস্যাবলী উন্মোচিত হইয়া যাওয়াও খুবই সম্ভব।
মানুষ অর্থহীন কথা না বলিয়া যদি আল্লাহ পাকের তাসবীহ তাহলীল ও জিকির-আজকারে লিপ্ত থাকে, তবে অবশ্যই উহা তাহার জন্য অধিক উপকারী ও লাভজনক হইবে। যেই ব্যক্তি মণি-মুক্তা লাভ করিতে সক্ষম, সেই ব্যক্তি যদি ইট-পাথর ও কংকর সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তবে ইহা তাহার দুর্ভাগ্য ও বোকামীই বলিতে হইবে। অর্থাৎ বৈধ ও মোবাহ কথা বলা যদিও গোনাহ নহে কিন্তু যেই সময়টুকু কথা বলা হইল সেই সময়টুকু যদি আল্লাহ পাকের জিকির করা হইত তবে বিপুল পরিমাণ ছাওয়াবের অধিকারী হওয়া যাইত; এই ছাওয়াব হইতে বঞ্চিত হওয়া- ইহাও কম ক্ষতি নহে।
রাসূলে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাইয়াছেন-
فان المؤمن لا يكون صمته الا فكرا و نظره الا عبرة و نطقه ال ذكرا .
অর্থাৎ, "মোমেনের নীরবতা হইল ফিকির, তাহার দৃষ্টি এবাদত এবং তাহার কথা আল্লাহর জিকির।"
মানুষের সবচাইতে বড় সম্পদ হইল সময়। সুতরাং মানুষ যদি এই মূল্যবান সময়কে অর্থহীন ক্রিয়া-কর্ম হইতে বাঁচাইয়া পরকালের কাজে ব্যয় না করে, তবে ইহা তাহার জন্য নিতান্ত দুর্ভাগ্যেরই কারণ হইবে। এই কারণেই নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন-
من حسن إسلام المرء تركه مالا يعنيه
অর্থাৎ, "মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হইল, অর্থহীন বিষয় বর্জন করা।"
(তিরমিজী, ইবনে মাজা)
এক হাদীসে তো উপরোক্ত বিষয়টি আরো কঠোর ভাষায় বিবৃত হইয়াছে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ওহোদের যুদ্ধে এক যুবক শহীদ হওয়ার পর আমরা দেখিতে পাইলাম, তাহার পেটে পাথর বাঁধা আছে। ক্ষুধার কারণেই সে পেটে পাথর বাঁধিয়াছিল। এই সময় যুবকের মাতা তাহার চেহারা হইতে ধুলাবালি মুছিয়া দিতে দিতে বলিল, "বেটা! জান্নাত মোবারক হউক।" এই কথা শুনিয়া রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কিরূপে জানা গেল যে, সে জান্নাতী হইবে? এমনও তো হইতে পারে যে, সে অনর্থক কথা বলিত।
একবার নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমাগত কয়েকদিন হযরত কায়াব (রাঃ)-কে না দেখিয়া ছাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কায়াব কোথায়? তাহারা আরজ করিলেন, কায়াব অসুস্থ। অতঃপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হযরত কায়াবকে দেখিতে গেলেন এবং তাহার নিকটে গিয়া বলিলেনঃ ابشر یا کعب "হে কায়াব! তোমার জন্য সুসংবাদ।"
হযরত কায়াবের মাতা আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবান হইতে এই সুসংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত খুশী হইলেন এবং ছেলেকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, হে কায়াব! তোমার বিনা হিসাব জান্নাত মোবারক হউক। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, এই মহিলা কে, যে আল্লাহর উপর হুকুম জারী করে? হযরত কায়াব (রাঃ) আরজ করিলেন, ইনি আমার মাতা। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, হে কায়াবের মাতা! তুমি কেমন করিয়া জানিলে? তোমার ছেলে হয়ত কখনো অনর্থক কথা বলিয়া থাকিবে।
উপরোক্ত হাদীসের তাৎপর্য হইল, যেই ব্যক্তির জিম্মায় কোন হিসাব নাই, সেই ব্যক্তির পক্ষেই বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেই ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন অনাবশ্যক কথা বলিয়াছে, পরকালে তাহাকে উহার হিসাব দিতে হইবে- যদিও সেই কথা মোবাহ হয়। সুতরাং এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার উক্তি করা ঠিক নহে। আখেরাতের কঠিন দিবসে কোন বিষয়ের হিসাব দেওয়া ইহাও এক প্রকার আজাব বটে। এই প্রাথমিক আজাব হইতে নিষ্কৃতি পাওয়ার পরই জান্নাতে যাওয়া যাইবে।
হযরত মোহাম্মদ বিন কায়াব (রাঃ) বলেন, একদা নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেনঃ আজ যেই ব্যক্তি সর্ব প্রথম এই দরজা দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিবে, সে জান্নাতে যাইবে। পরে দেখা গেল, সেই দরজা দিয়া সর্ব প্রথম হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম ভিতরে প্রবেশ করিলেন। উপস্থিত ছাহাবায়ে কেরাম হযরত আব্দুল্লাহ সম্পর্কে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি তাহাকে অবহিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার সেই মজবুত আমল কোনটি যেই আমলের কারণে আপনি বেহেশতে যাওয়ার আশা করিতেছেন? জবাবে হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম বলিলেন, আমি একজন দুর্বল মানুষ, আমার দ্বারা মজবুত আমল হইবে, কিরূপে? তবে এই কারণে আমি. আশাবাদী যে, আমি আমার সীনাকে হেফাজত করি এবং কোন অপ্রয়োজনীয় কথা বলা হইতে বিরত থাকি। (ইবনে আবিদ্দুনয়া)
হযরত আবু জর (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা আল্লাহর হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেনঃ আমি কি তোমাকে এমন আমলের কথা বলিব না, যাহা শরীরের জন্য খুবই হালকা এবং মিজানে খুব ভারী হইবে? আমি আরজ করিলাম, ইহা রাসূলাল্লাহ! আপনি অবশ্যই তাহা বলুন। তিনি এরশাদ করিলেনঃ সেই আমল হইল নীরবতা, উত্তম চরিত্র এবং অপ্রয়োজনীয় (কথা ও কাজ) বর্জন করা। (ইবনে আবিদ্দুনয়া)
হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হইতে শুনিয়াছি, তিনি বলিতেন- পাঁচটি বিষয় আমার নিকট ওয়াকফকৃত দেরহাম অপেক্ষাও উত্তম মনে হয়। সেই পাঁচটি বিষয় হইল-
(এক) অর্থহীন কথা না বলা। কেননা, এই অনাবশ্যক ও অতিরিক্ত কথা দ্বারা গোনাহ হওয়ার আশংকা বিদ্যমান থাকে।
(দুই) উপকারী কথাও মওকা ও সুযোগ বুঝিয়া বলা। কারণ, অনেক সময় ভাল কথাও যদি বে-মওকা বলা হয়, তবে উহা অনিষ্ট ও কষ্টের কারণ হইয়া থাকে।
(তিন) সহনশীল ও আহাম্মক এই দুই শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কোন বিষয়ে বিতর্ক না করা। কেননা, সহনশীল মানুষের সঙ্গে তর্ক করার অর্থ হইল তাহাকে উত্তেজিত করা। আর আহাম্মকের সঙ্গে তর্ক করার অর্থ নিজে কষ্ট পাওয়া।
(চার) নিজের কোন অনুপস্থিত ভাই প্রসঙ্গে কেবল এমন আলোচনাই করা, যেই ভাবে সে নিজের আলোচনা নিজে করিতে পছন্দ করে। তাহার সেই সকল দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করিয়া দেওয়া যাহা সে নিজে ক্ষমা করাইতে পছন্দ করে। তাহার সঙ্গে এমন আচরণ করা যাহা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।
(পাঁচ) যাবতীয় আমল এমন এক্বীনের সঙ্গে করা যে, আমার এই আমল যদি ভাল হয়, তবে উহার বিনিময় পাওয়া যাইবে। আর আমার এই আমল খারাপ হইলে উহার জন্য শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
হযরত আজালী (রহঃ) বলেন, আমি দীর্ঘ বিশ বৎসর যাবৎ একটি বিষয় সন্ধান করিয়া ফিরিতেছি কিন্তু এখনো সেই বিষয়টি হাসিল করিতে পারি নাই। এতদ্ সত্ত্বেও উহার সন্ধান পরিত্যাগ করি নাই। লোকেরা জিজ্ঞাসা করিল, সেই বিষয়টি কি? তিনি বলিলেন, যাহা উপকারী নহে এমন কথা হইতে নীরবতা অবলম্বন।
হযরত ওমর (রাঃ) বলিতেন, তোমরা অর্থহীন কথায় প্রবৃত্ত হইও না। নিজের শত্রু হইতে দূরে থাক এবং বন্ধুকে এড়াইয়া চলিও। অবশ্য বন্ধু যদি আমীন হয় তবে ভিন্ন কথা। আমীন সেই ব্যক্তিই হইতে পারে যাহার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে। কখনো কোন পাপী লোকের সংস্রবে বসিও না। কেননা, উহার ফলে তোমরাও তাহার দ্বারা প্রভাবিত হইয়া পড়িবে। তাহার নিকট কখনো নিজের একান্ত গোপন কথা প্রকাশ করিও না। নিজের কোন কাজের বিষয়ে এমন লোকদের নিকট হইতে পরামর্শ গ্রহণ করিও যাহারা আল্লাহকে ভয় করে।
অর্থহীন কথার সংজ্ঞাঃ
এক্ষণে আমরা অর্থহীন কথার সংজ্ঞা এবং উহার পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা করিব। এমন কথাকেই অর্থহীন কথা বলা হয় যে, তুমি যদি সেই কথা না বলিয়া নীরব থাক, তবে তোমার কোন গোনাহ হইবে না এবং উহার ফলে উপস্থিত ক্ষেত্রে কিংবা পরবর্তীতেও কোনরূপ ক্ষতির শিকার হইতে হইবে না। উহার উদাহরণ এইরূপ মনে কর, তুমি কোন মজলিসে বসিয়া সকলকে তোমার সফরের ঘটনা শোনাইতেছ যে, তুমি কত বিরাট বিরাট পাহাড়-পর্বত এবং প্রবাহমান নহর ইত্যাদি দেখিয়াছ। সফরে কেমন কেমন বিস্ময়কর ও মনোরম দৃশ্যাবলী দেখিয়াছ এবং কত রকমারী খাবার খাইয়াছ। কত মহান ও বুজুর্গ ব্যক্তিগণের সঙ্গে তোমার সাক্ষাত হইয়াছে ইত্যাদি।
এইসব আলোচনা এমন যে, উহা বর্ণনা না করিলেও তোমার কোন গোনাহ হইত না এবং উহার কারণে তোমার কোন ক্ষতিও হইত না। আর এই ক্ষতি না হওয়ার অবস্থাটিও কেবল সেই ক্ষেত্রে যে, ঘটনা যেইভাবে ঘটিয়াছে এবং তুমি যাহা যাহা দেখিয়াছ হুবহু সেইভাবেই যদি তাহা বর্ণনা করিয়া থাক, এবং উহাতে কিছুমাত্র হ্রাস-বৃদ্ধি করিয়া না থাক। তোমার বিবরণে কাহারো সমালোচনা, গীবত-শেকায়েত, নিজের অহংকার-বড়াই ইত্যাদি কিছুই যদি প্রকাশ করা না হয়।
তো এতসব এহতিয়াত ও সতর্কতা অবলম্বনের পরও এই প্রসঙ্গে তোমাকে ইহাই বলা হইবে যে, সফরের ঘটনা বর্ণনা করিয়া তুমি সময়ের অপচয় করিয়াছ। তদুপরি এই আশংকা তো সততই বিদ্যমান যে, ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে তুমি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করিতে পারিয়াছ, না এই ক্ষেত্রে তোমার জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বা অবচেতন মনে কোন গর্হিত অবস্থার শিকার হইয়াছ।
কাহাকেও কোন গর্হিত প্রশ্ন করার ক্ষেত্রেও এই একই কথা। অনাবশ্যক ও. অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রশ্নকারী ও শ্রোতা উভয়েরই সময় নষ্ট হয়। বরং তুলনামূলকভাবে প্রশ্নকারীরই ক্ষতির আশংকা বেশী। কেননা, প্রশ্ন করিয়া তুমি উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে উহার জবাব দানে বাধ্য করিলে এবং তাহার সময়ও নষ্ট করিলে। ইহাও কেবল সেই ক্ষেত্রে, যখন প্রশ্ন করার মধ্যে কোনরূপ অনিষ্টের সংমিশ্রণ না থাকে। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশ্ন করার মধ্যে কোন না কোন অনিষ্ট ও বিপদ লুকাইয়া থাকে। উহার উদাহরণ এইরূপঃ মনে কর, তুমি রোজাদারকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে রোজা রাখিয়াছে কি না। এখন এই প্রশ্নের। জবাবে সে যদি হাঁ বলে, তবে বলা হইবে যে, এই জবাবের মাধ্যমে সে নিজের এবাদতের কথা প্রকাশ করিয়াছে। অর্থাৎ নিজের এবাদতের কথা অপরের নিকট জাহির করার ফলে সর্বনাশা রিয়ার শিকার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রহিয়াছে। যদি রিয়ার শিকার নাও হয়, তবুও এই জবাবের ফলে তাহার "গোপন এবাদত" প্রকাশ্য এবাদতের মধ্যে পরিবর্তিত হইয়া এবাদত গোপন রাখার ছাওয়াব হইতে বঞ্চিত হইবে।
পক্ষান্তরে রোজাদার যদি সেই প্রশ্নের জবাবে 'না' বলে, তবে ইহা মিথ্যা হইবে। আর জবাব না দিয়া যদি নীরব থাকে, তবে প্রশ্নকর্তাকে অপমান করা হইবে এবং উহার ফলে সে মনে কষ্ট পাইবে। অনুরূপভাবে কোন প্রকার হিলা-বাহানা ও কৌশল অবলম্বন করিয়া যদি সেই প্রশ্নের জবাব এড়াইয়া যাওয়া হয়, তবে এই ক্ষেত্রে অকারণেই প্রশ্নকর্তা মানসিক পীড়ন ও বিব্রতকর অবস্থার শিকার হইবে। অর্থাৎ এইভাবে একটি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের মাধ্যমে রিয়া, মিথ্যা, মুসলমানকে হেয় করন এবং মানসিক পীড়ন ইত্যাদি চারি প্রকার অনিষ্টের যে কোন একটির শিকার হইতে হইবে।
অনুরূপভাবে কোন গোনাহের বিষয়ে এবং এমন কোন গোপন বিষয়েও প্রশ্ন করা ঠিক নহে, যার উত্তর দিতে মানুষ লজ্জাবোধ করে। কাহাকেও এইরূপ প্রশ্ন করাও ঠিক নহে যে, অমুক ব্যক্তি তোমাকে কি বলিয়াছে কিংবা অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? কোন মুসাফিরকে এইরূপ জিজ্ঞাসা করা ঠিক নহে যে, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ। কেননা, অনেক সময় নিজের মহল্লা ও গ্রামের নাম সঙ্গত কারণেই গোপন রাখিতে হয়। সুতরাং এই প্রশ্নের জবাবে যদি সত্য বলা হয় তবে গোপনীয়তা ভঙ্গ হইয়া যায় কিংবা গোপনীয়তা রক্ষা করিয়া মিথ্যা বলিতে হয়।
অনুরূপভাবে কোন আলেমকে অকারণে কোন মাসআলা জিজ্ঞাসা করিবে না। কেননা, অনেক সময় যাহাকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হয়, সে উহার জবাব দিতে না পারিলে প্রশ্নকারীর সম্মুখে অপমানবোধ করে এবং এই অপমান এড়াইবার উদ্দেশ্যে হয়ত মাসআলা জানা না থাকা সত্ত্বেও মনগড়া কোন জবাব দিয়া নিজেও গোমরাহ হয় এবং প্রশ্নকর্তাকেও বিপথগামী করে।
এখানে যেইসব প্রশ্নের কথা বলা হইল এই ধরনের প্রশ্নকে অর্থহীন কথার মধ্যে গণ্য করা হইবে না। কেননা, ইতিপূর্বেই আমরা বলিয়াছি যে, "অর্থহীন কথা" হইল যাহা না বলিলে কোন গোনাহ হয় না এবং কোনরূপ ক্ষতিরও শিকার হইতে হয় না। কিন্তু এখানে যেইসব প্রশ্নের অবতারণা করা হইল, উহাতে গোনাহ ও ক্ষতি বিদ্যমান। "অর্থহীন কথা" কাহাকে বলা হয় নিম্নের উদাহরণ দ্বারা এই বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাইবে-
একবার হযরত লোকমান হেকিম (রহঃ) হযরত দাউদ (আঃ)-এর নিকট গিয়া দেখিতে পাইলেন, তিনি একটি লৌহবর্ম বানাইতেছেন। হযরত লোকমান হেকিম ইতিপূর্বে আর কখনো লৌহবর্ম দেখেন নাই। এই কারণে উহা দেখিয়া তিনি যারপরনাই বিস্মিত হইলেন এবং হযরত দাউদ (আঃ)-কে উহা সম্পর্কে প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাহার হেকমত ও প্রজ্ঞা তাহাকে বাধা দিল এবং তিনি নীরব রহিলেন। কিছু সময় পর হযরত দাউদ (আঃ) বর্ম নির্মাণ শেষে উহা পরিধান করিয়া বলিলেন, যুদ্ধের জন্য লৌহবর্ম বড় উপকারী পোশাক। এইবার হযরত লোকমান হেকিম লৌহবর্মের পরিচয় পাইয়া মনে মনে বলিলেন, "নীরবতাই বড় হেকমত"।
তো এইসব বিষয় উপলব্ধি করা এবং উপলব্ধি করিবার পর উহার উপর আমল করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। হযরত লোকমান হেকিম যদি বর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করিতেন তবে এই প্রশ্নের কারণে তাহার কোন গোনাহ হইত না এবং তিনি কোনরূপ ক্ষতিরও শিকার হইতেন না। কিন্তু তাহার হেকমত ও প্রজ্ঞার কারণেই তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন যে, এই প্রশ্নটি অর্থহীন কথার মধ্যে গণ্য হইবে এবং এই কারণেই তিনি নীরব ছিলেন। এই উদাহরণে আমরা দেখিতে পাইলাম যে, হযরত লোকমান হেকিম সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন না করিয়াই উহা সম্পর্কে এলেম হাসিল করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
মোটকথা, যেই সকল প্রশ্নের মধ্যে কোনরূপ অনিষ্ট, অতিরঞ্জন, রিয়া, মিথ্যা, অপরকে হেয় করা ইত্যাদি বিদ্যমান নহে উহা অর্থহীন কথার মধ্যে গণ্য এবং হাদীসের বর্ণনামতে উহা বর্জন করা ইসলামের সৌন্দর্য।
অর্থহীন কথার উপকরণঃ
অর্থহীন কথা মোটামুটি কয়েক প্রকার ভিত্তির উপর বলা হয়। অনেক সময় উহার কারণ হয় বক্তার অপ্রয়োজনীয় কথা বলার লোভ, আবার অনেক সময় 'কথা প্রচার করিয়া বেড়ানোর অভ্যাসের কারণেও তাহা বলা হয় কিংবা বক্তা হয়ত দীর্ঘ সময় কথা বলিয়া শ্রোতাকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করিতে চাহে। আবার অনেক সময় হয়ত শ্রোতার প্রতি মোহাব্বত ও ভালবাসার কারণেও দীর্ঘ সময় কথা বলিয়া তাহাকে আটকাইয়া রাখিতে মন চাহে। আবার কোন কোন সময় হয়ত আত্মতৃপ্তি ও বিনোদনের জন্যও কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করা হয়।
এইসব ব্যাধির এলাজ ও চিকিৎসা হইল সর্বদা মৃত্যুকে উপস্থিত জ্ঞান করিয়া এইরূপ করিবে যে, দুনিয়াতে আমি যাহা যাহা বলিতেছি, মৃত্যুর পর উহার প্রতিটি শব্দের হিসাব দিতে হইবে। আমার শ্বাস হইল শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং আমার জিহ্বা এমন জাল যাহা দ্বারা বেহেশতের হুর ধরা যাইবে। সুতরাং নিজের আসল সম্পদ নষ্ট করা' আর এমন মূল্যবান জালটি বেকার পড়িয়া থাকিতে দেওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নহে।
এই হইল, অর্থহীন কথা বলার দুষ্ট ব্যাধি হইতে আত্মরক্ষার এলমী চিকিৎসা। উহার আমলী চিকিৎসা হইল- নির্জনতা অবলম্বন কিংবা মুখে কংকর, পুরিয়া রাখা, যেন কথা বর্জনে বাধ্য হইতে হয়। অথবা মাঝে মধ্যে উত্তম কথাও বর্জন করিবে যেন অপ্রয়োজনীয় কথা পরিত্যাগের অভ্যাস গড়িয়া ওঠে। অবশ্য যেই ব্যক্তি নির্জনতার পরিবর্তে সকলের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া থাকা পছন্দ করে, তাহার পক্ষে জিহ্বাকে সংযত রাখা কঠিন বটে।
0 Comments