নবী করীম (সাঃ) ও গুপ্তঘাতক

        বদর যুদ্ধের পরে মক্কার কুরাইশদের মধ্যে একদিকে শোক অপরদিকে প্রতিহিংসায় আগুন দাও দাও করে জ্বলে উঠলো। মক্কার ঘরে ঘরে ছিল শোকের মাতম। মক্কার অনু পরমানু পর্যন্ত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করেই তারা ক্ষান্ত হবে। পরবর্তী কালের যুদ্ধসমূহ তাদের ঐ প্রতীজ্ঞার কারণেই সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধ আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দেয়। মক্কার কুরাইশরা প্রথম থেকেই যুদ্ধ অবস্থার জন্ম দিয়েছিল। ফলে সংঘটিত হলো রক্তক্ষয়ী বদরের যুদ্ধ। এই বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে গিয়ে তারা বারবার যুদ্ধের জন্ম দিল আর পরাজয়ের তালিকা বৃদ্ধিই করে চললো।

        তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, কোন উপলক্ষে মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতে হবে। ইসলামের কঠোর শত্রু ওমাইর ইবনে ওহাব এবং সুফিয়ান ইবনে উমাইয়া এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সুফিয়ান বলছিল, 'এখন আর আমার বেঁচে থেকে কি লাভ হবে।' ওমায়ের তাকে জানালো, 'যদি আমি ঋণগ্রস্থ না হতাম এবং সন্তান-সন্ততির কোন দায়িত্ব আমার ওপর না থাকতো, তাহলে আমি মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতাম। কারণ সেখানে আমার এক সন্তান বন্দী আছে।'

        আবু সুফিয়ান তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো, 'তুমি তোমার ঋণ এবং সন্তানদের জন্য কিছুই চিন্তা করো না। তাদের দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম। তুমি মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করে এসো।'

        তারপর ওমায়ের তার বাড়িতে গিয়ে একটি তীক্ষ্ণধার তরবারী নিয়ে তরবারীতে বিষ মাখালো। তারপর সে মদীনার পথে যাত্রা করলো। মহান আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে তার নবীকে পূর্বেই সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দিলেন। ওমায়ের মদীনায় আসার পরেই হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাকে দেখে সন্দেহ করলেন, লোকটি কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মদীনায় আগমন করেছে। তিনি তাকে ধরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির করলেন। আল্লাহর নবী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'হে ওমায়ের! তুমি কি উদ্দেশ্যে মদীনায় আগমন করেছো?

         ওমায়ের জবাব দিল, 'আমি আমার সন্তানকে মুক্ত করার জন্য এসেছি।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, 'তাহলে সাথে তরবারী এনেছো কেন?' ওমায়ের জবাব দিল, 'তরবারী বদরের প্রান্তরেও তো কোন কাজে আসেনি।'

        আল্লাহর নবী তাকে বললেন, 'কেন আসেনি, তুমি আর আবু সুফিয়ান হাজর নামক স্থানে বসে আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করোনি?' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথায় ওমায়েরের বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। সেখানে তারা মাত্র দু'জন এই পরিকল্পনা করেছিল। মদীনায় অবস্থানরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তো সে কথা জানার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে তিনি এ কথা জানলেন কেমন করে। মুহূর্তে ওমায়েরের ভেতরের জগৎ আলোকিত হয়ে সমস্ত অন্ধকার দূরিভূত হলো। নবীর সামনে সে আত্মসমর্পণ করে বললো, 'এই পরিকল্পনার কথা আমি আর আবু সুফিয়ান ব্যতীত আর কেউ জানে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি সত্যই আল্লাহর রাসূল।' 

        মক্কার কুরাইশদের দুর্ভাগ্য, তারা অপেক্ষায় ছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিহত হয়েছে ওমায়েরের হাতে, এই সংবাদ তারা শুনবে। এখন তাদের শুনতে হলো, যে ওমায়ের গিয়েছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতে, সে ওমায়ের স্বয়ং নিহত হয়ে নতুন রূপে জন্মগ্রহণ করেছে। সে আর অমুসলিম নেই, এখন তার পরিচয় সে আল্লাহর নবীর গর্বিত উম্মত-মুসলমান। বীরদর্পে হযরত ওমায়ের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষনা করলেন। মক্কার অলি গলিতে তিনি তাওহীদের বাণী ঘোষনা করতে লাগলেন। তাঁর আহ্বানে প্রতিদিন মক্কায় মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকলো। মক্কার কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে যতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে তাদের সমস্ত পদক্ষেপ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু মক্কাতেই নয়, গোটা পৃথিবীতেই যেখানে ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে অগ্রসর হয়েছে, সেখানেই তারা লাঞ্ছনামূলক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments