কে এই তরবারীর হক আদায় করবে?
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের তরবারী হাতে নিয়ে ঘোষনা করলেন, 'আমার এই তরবারীর হক আদায় করার জন্য কে প্রস্তুত আছো?'
মুসলিম বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবারী গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তরবারীর দিকে অসংখ্য হাত এগিয়ে এলো। আল্লাহর নবী সে তরবারী কাউকে দিলেন না। হযরত আবু দুঙ্গানা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জানতে চাইলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! তরবারীর হক আদায় করা বলতে কি বুঝায়?' তিনি বললেন, 'তরবারীর হক আদায় বলতে এই তরবারী দিয়ে শত্রুকে এত বেশী আঘাত করতে হবে, যেন এই তরবারীই বাঁকা হয়ে যায়।'
হযরত আবু দুজানা বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমি ঐ তরবারী গ্রহণ করবো এবং তরবারীর হক আদায় করবো।'
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তরবারী হযরত আবু দুজানার হাতে দিলেন। তিনি তরবারী গ্রহণ করে গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে সৈন্যদের বুহ্যে চলে গেলেন। আল্লাহর নবী তাঁর সাহাবীর হাঁটার ভঙ্গী দেখে মন্তব্য করলেন, 'যুদ্ধের ময়দান ব্যতীত হাঁটায় এই ভঙ্গী আল্লাহর কাছে চরম অপছন্দনীয়।'
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে পরস্পরের পরিচিতির জন্য একটি সংকেত শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বাহিনীর কোন সদস্য যদি 'আমিত' শব্দ বলে তাহলে বুঝতে হবে সে নিজেদের লোক। 'আমিত' শব্দের অর্থ হলো, মরণ আঘাত হানো।
যুদ্ধের প্রথমেই কুরাইশদের পক্ষ থেকে এমন একজন লোক ময়দানে এলো, যে • লোকটি ছিল এক সময় মদীনার অধিবাসী। মদীনার আনসারদেরকে লোকটি প্রচুর দান করতো। লোকটির নাম ছিল আবু আমের। সে ধারণা করেছিল, কুরাইশদের সাথে তাকে দেখলেই মদীনার আনসাররা আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করে তার সম্মানে ও তার অতীত দানশীলতার কথা স্মরণ করে কুরাইশদের সাথে যোগ দেবে। মূর্খ এই লোকটি ময়দানে এসেই হুংকার ছাড়লো, 'আমাকে তোমরা চিনতে পারছো? আমি. আবু আমের।'
আনসাররা জবাব দিল, 'আমরা তোমাকে চিনি। তুমি যা আশা করছো তা আল্লাহ পূরণ করবেন না।'
কুরাইশদের পতাকাধারী দল থেকে তালহা বের হয়ে এসে চিৎকার করে বললো, 'ওহে মুসলমানের দল। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে জাহান্নামে প্রেরণ করতে চায় অথবা নিজেই সে জান্নাতে যেতে চায়?'
লোকটির বিদ্রূপাত্মক কথা হয়রত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সহ্য করতে পারলেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, 'তোকে জাহান্নামে প্রেরণের জন্য আমি আছি।'
এ কথা বলে তিনি এমন শক্তিতে তালহাকে (মুসলিম বাহিনীর তালহা ভিন্ন ব্যক্তি) আঘাত করলেন, এক আঘাতেই সে কাফির ধূলি শয্যা গ্রহণ করলো এবং হাতের পতাকা লুটিয়ে পড়লো। তালহার ভাই ওসমান ময়দানে আপন ভাইয়ের শোচনীয় অবস্থা দেখে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলো।
হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এমনভাবে তার কাঁধে আঘাত করলেন যে, ওসমানের কোমর পর্যন্ত হযরত হামজার তরবারী পৌঁছে গেল। এরপরেই ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু রাসূলের তরখারী নিয়ে কুরাইশদের বুহ্য ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত আলী ও হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম একইভাবে কুরাইশদের সৈন্য বাহিনীর বুহ্য ভেঙ্গে তছনছ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত হামজা দুই হাতে তরবারী চালনা করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, রাসূলের তরবারীর অধিকারী আবু দুজানা এমনভাবে যুদ্ধ করছিলেন যে, তাঁর তরবারীর সামনে যে পড়ছিল সেই নিহত হচ্ছিল। আমি দেখলাম শত্রুদের একটি লোক আমাদের লোকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছিল। আবু দুজানা ঐ লোকটির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি দোয়া করছিলাম লোকটি যেন আৰু দুজানার সামনে পড়ে। এক সময় সে আবু দুজানার সামনে পড়লো।
দু'জনে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। লোকটি আবু দুজানাকে প্রচন্ড বেগে তরবারীর আঘাত হানলো। আবু দুজানা সে আঘাত তাঁর চামড়ার ঢাল দিয়ে প্রতিহত করলেন এবং লোকটির তরবারী আবু দুজানার চামড়ার ঢালে আটকে গেল। এই সুযোগে তিনি রাসূলের দেয়া তরবারী দিয়ে আঘাত করে লোকটিকে হত্যা করলেন।
রাসূলের তরবারীর সম্মান
এরপর তাঁর সামনে পড়লো আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। আবু দুজানা তাঁর মাথার ওপর তরবারী উঠিয়েও নামিয়ে নিলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, 'আমি দেখলাম কে একজন মক্কার কাফিরদেরকে উস্কানী দিচ্ছে। আমি তার এই অপকর্ম বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলাম। আমি তরবারী উঠাতেই সে ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। তখন আমি বুঝলাম সে একজন নারী। আমি রাসূলের তরবারী দিয়ে একজন নারীকে আঘাত করে তরবারীর অপমান করতে চাইনি। এ কারণে আমি আঘাত করিনি।'
মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের মুখে মক্কার কুরাইশরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। যখনই তারা পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে, তখনই তাদের নারীরা কবিতা আবৃত্তি করে তাদের উৎসাহ সৃষ্টি করছিল। হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহ তা'য়ালা আনহুর আক্রমনের মুখে কুরাইশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়ছিল। তিনি দু'হাতে তরবারী চালনা করে শত্রু নিধন করছিলেন।
হাবশী গোলাম ওয়াহশী তাঁর মনিবের সাথে চুক্তি করেছিল, সে যদি হযরত হামজাকে হত্যা করতে পারে তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। সে লক্ষ্য স্থির করে আড়ালে বসেছিল। হারবা নামক ছোট এক ধরণের বর্শা দূর থেকে ছুচ্ছে সে হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে হত্যা করেছিল। হযরত হানজালার পিতা আবু আমের কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধ করছিল। হযরত হানজালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলেন, তিনি তাঁর পিতার সাথে যুদ্ধ করবেন।
আল্লাহর নবী এটা পছন্দ করলেন না যে, পিতার সাথে সন্তান যুদ্ধ করবে। তিনি অনুমতি দিলেন না। মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের মুখে যুদ্ধের এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশ রাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের ফেলে যাওয়া সম্পদ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে দেখে তীরান্দাজ বাহিনীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। একদল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য ময়দানে চলে যাবার পক্ষে মতামত দিল।
তীরান্দাজ বাহিনীর সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাদেরকে বারবার নিষেধ করার পরেও তাঁরা নেতার আদেশ অমান্য করে গণিমতের মালামাল সংগ্রহ করার জন্য ময়দানে ছুটে গেল। মক্কার কুরাইশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আল্লাহর নবী মুসলমানদের তীরান্দাজ বাহিনীকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অবস্থান করতে আদেশ দিয়েছিলেন, সে স্থান অরক্ষিত দেখে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে সেদিক থেকেই ঝড়ের বেগে আক্রমন করেছিলেন।
নেতার আদেশ অমান্য করার ফল হাতে হাতেই মুসলিম বাহিনী লাভ করলো। চারদিক থেকে কুরাইশ বাহিনী একত্রিত হয়ে অপ্রস্তুত মুসলিম বাহিনীকে এমনভাবে আক্রমন করলো যে, তাঁরা যুদ্ধ করা দূরে থাক- আত্মরক্ষা করার মত সুযোগ পেল না। অসহায়ের মত বড়বড় বীর যোদ্ধা শাহাদাতবরণ করতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়ের মতই অনেকে কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তীরান্দাজ বাহিনীর যে কয়জন গিরিপথে প্রহরা দিচ্ছিলেন, তাঁরা একে একে শাহাদাতবরণ করলেন। কুরাইশ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল একটিই, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা। ইসলাম বিরোধিদের আক্রমন এতই তীব্র ছিল যে, অধিকাংশ সাহাবা সে সময় জানতেন না, আল্লাহর রাসূলের কোথায় কি অবস্থায় আছেন।
কুরাইশ বাহিনী আর মুসলিম বাহিনী এমনভাবে একাকার হয়ে গিয়েছিল যে, কে শত্রু আর কে মিত্র তা জানার উপায় ছিল না। হযরত মুসআব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর চেহারা এবং দেহের আকৃতি কিছুটা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতই ছিল। তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহন করছিলেন। কাফির ইবনে কামিয়া তাকে হত্যা করে ভেবেছিল সে আল্লাহর নবীকে হত্যা করেছে। ময়দানে সে চিৎকার করে বলেছিল, মুসলমানদের নবীকে আমি হত্যা করেছি।
তার এই চিৎকার শুনে মুসলিম বাহিনীর শেষ শক্তিটুকুও যেনো ঝরে পড়েছিল। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর মত ব্যক্তি নিশ্চল হয়ে বসেছিলেন। হযরত আনাসের চাচা হযরত আনাস ইবনে নদর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম হযরত ওমরকে তরবারী ফেলে বসে থাকতে দেখে বললেন, 'আপনি যুদ্ধ না করে এখানে এমন করে বসে আছেন কেন?' তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, 'এখন যুদ্ধ করে আর কি হবে, আল্লাহর নবীই তো পৃথিবীতে আর নেই।'
হযরত আনাস ইবনে নদর আর্তচিৎকার করে বললেন, 'আল্লাহর রাসূল আর নেই। তাহলে আমার আর বেঁচে থেকে কি হবে।'
এ কথা বলেই তিনি ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। এক পর্যায়ে তিনিও শাহাদাতবরণ করলেন। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে চেনার কোন উপায় ছিল না। কারণ কাফিরদের অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে তাঁর দেহ অক্ষত ছিল না। তাঁর হাতের আঙ্গুল দেখে তাঁর বোন তাকে সনাক্ত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করেছিল রাসূল আর নেই আবার কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, আল্লাহর রাসূলকে কাফিররা হত্যা করতে পারে।
যারা বিশ্বাস করেছিল, তাঁরা জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাতের পথ বেছে নিয়েছিল। আর যারা বিশ্বাস করেনি, তাঁরা যুদ্ধ করছিল এবং আকুল দৃষ্টিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র চেহারা খুঁজে ফিরছিল। হযরত কা'ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সেই পবিত্র চেহারা দেখতে পেলেন। অদম্য আবেগে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, 'হে নবীর অনুসারীরা! আল্লাহর নবী আমাদের মাঝে আছেন!' তাঁর কণ্ঠ শুনে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে গেলেন আল্লাহর নবীর কাছে। কাফির বাহিনীর মূল লক্ষ্যই ছিল আল্লাহর নবীকে হত্যা করা। তারা যখন জানতে পারলো, নবী এখনো জীবিত আছে, তখন নবীর অবস্থানের দিকেই তারা আক্রমন করলো তাঁকে হত্যা করার জন্য কুরাইশ বাহিনী সর্বশক্তি নিয়োগ করলো।
0 Comments