আমরা পবিত্র কুরআন থেকে জানতে পারি, নবুয়্যাত লাভ করার পূর্বে নবীগণ যে জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, সেই জ্ঞানের দ্বারাই তাঁরা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করতেন। ওহীর আগমন তাদের অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানকে বিশাল শক্তিতে পরিণত করতো। ওহী অবতীর্ণের পূর্বে তাদের মন-মস্তিষ্ক যেসব সত্যের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতো, আল্লাহ তা'য়ালার ওহী সেগুলো সত্য হবার বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করতো। পরম সত্যের সাথে নবীদেরকে চাক্ষুষ পরিচয় করে দেয়া হত, নবীগণ সেসব বিষয়ে মানুষের কাছে সাক্ষ্য প্রদান করতেন।
পবিত্র কুরআন বারবার মানব জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছে, তোমরা চিন্তা-গবেষণা করো, দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখো, আমার নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করো। নবী-রাসূল নবুয়্যাত লাভ করার পূর্বে তাই করতেন। সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করলে স্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা এভাবে চিন্তা-গবেষণা করেই পরম সত্তার সন্ধান লাভ করার চেষ্টা করতেন। আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ হতে ওহী অবতীর্ণ হবার কারণে তারা প্রকৃত সত্যের জগতে প্রবেশ করেছেন এবং মানুষকেও সেদিকেই আহ্বান করেছেন।
ওহী অবতীর্ণ হবার পরে তাদেরকে এমন জ্ঞান দান করা হয়েছিল যে, যে জ্ঞান শুধু তাদের জন্যই মহান আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ মহান আল্লাহ নবী- রাসূলকে অদৃশ্য জগতের জ্ঞান দান করেছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, অদৃশ্য জগতের যতটুকু জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন ছিল আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর অদৃশ্য জগতের জ্ঞান নবীকে ততটুকুই দান করেছিলেন। কিন্তু কুরআনের বর্ণনার মুকাবেলায় তাদের মতামত সঠিক নয়।
কুরআন দাবী করছে, নবীদেরকে অদৃশ্য জগতের এমন জ্ঞান ভাণ্ডার দান করা হয়েছিল যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে সে জ্ঞান লাভ করার কোনো উপায়ই নেই। পবিত্র কুরআনে হযরত ইয়াকুব (আ:) সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ইউসুফের ৮৬ নং আয়াত থেকে জানা যায়, তিনি তাঁর সন্তানদেরকে বলেছিলেন-
قَالَ إِنَّمَا أَشْكُوْ بَنِى وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ
সে (আরো) বললো, আমি আমার (অসহনীয়) যন্ত্রণা, আমার দুশ্চিন্তা (-জনিত অভিযোগ) আল্লাহ তা'য়ালার কাছেই নিবেদন করি এবং আমি নিজে আল্লাহ তা'য়ালার কাছ থেকে (তাঁর কথাবার্তা) যতোটুকু জানি, তোমরা তা জানো না। (সূরা ইউসুফ-৮৬)
অদৃশ্য জগতের অবস্থা সম্পর্কে নবীগণ যা জানেন এবং দেখেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সে স্তর অতিক্রম করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এ কারণেই নবী করীম (সা:) সাহাবায়ে কেরামকে বলেছিলেন, 'তোমরা শোনো, আল্লাহর শপথ! আমি যা জেনেছি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে তোমরা খুব কমই হাসতে এবং কাঁদতে সবচেয়ে বেশি'। (বুখারী)
তিনি তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে বলেছিলেন, 'আমি তোমাদেরকে পেছনে ঠিক তেমনভাবেই দেখি যেমনভাবে সামনে দেখি'। (বুখারী)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী করীম (সা:) কে দু'টো পবিত্র চোখ দান করেছিলেন। তিনি সে চোখ দিয়ে সামনের দিকে দেখতে পেতেন। কিন্তু তাঁর পেছনে চোখ না থাকলেও তিনি আল্লাহ তা'য়ালার দেয়া শক্তির কারণে পেছনেও দেখতে পেতেন। অর্থাৎ সামনে পেছনে তিনি একইভাবে দেখতেন। নবী-রাসূলগণ অদৃশ্য জগতের যতটুকু সংবাদ মানুষকে জানিয়ে গেছেন, এ কথা ধারণা করার কোনো কারণ নেই যে, তাঁরা অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে ঐ পরিমাণ জ্ঞানই রাখতেন। বরং এর চেয়ে শত সহস্রগুণ বেশি জ্ঞান তাদেরকে দান করা হয়েছিল অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে।
অকারণে তাদেরকে এই জ্ঞান দান করা হয়নি। এসব জ্ঞান তাদেরকে দান করা হয়েছিল তাদের দায়িত্বের কারণে। তাঁরা যে দায়িত্ব পালন করতেন সে দায়িত্ব পালন করতে গেলে অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে তাদের সীমাহীন জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ছিল। এই জ্ঞান তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সহায়ক হত। তাঁরা যা দেখতেন এবং বুঝতেন তা সাধারণ মানুষের জানার বা বুঝার প্রয়োজন নেই। যতটুকু প্রয়োজন ছিল ততটুকু তাঁরা মানুষকে জানিয়ে গেছেন। সাধারণ মানুষ ঐ অদৃশ্য জ্ঞান সহ্য করতে পারবে না। এ কারণেই মানুষকে আল্লাহ তা'য়ালা ঐ জ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানাননি।
হযরত মূসা (আঃ)ই প্রথম দিকে সহ্য করতে পারেননি, নবী করীম (সা:) ও প্রথম দিকে ঐ জ্ঞানের জগৎ দেখে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের সামনে ঐ জ্ঞানের সামান্যতম বিন্দু প্রকাশিত হলে এই মানুষের পক্ষে নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হতো না।
এই পৃথিবীতে নবী-রাসূল সবচেয়ে অধিক মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী এবং তাঁরা মানব জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। একজন সাধারণ মানুষের জীবনে যে ঘটনা ঘটে তা হয়তঃ কোনো গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু ঐ একই ঘটনা যদি নবীর জীবনে ঘটে তাহলে তা গুরুত্ব বহন করে। সে ঘটনা তাঁর অনুসারীদের জন্য অবশ্যকরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। নবী জীবনের ক্ষুদ্র ঘটনাও মানুষের জন্য আইনে পরিণত হয়। এ কারণে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের প্রত্যেক পদক্ষেপের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছিলো। কারণ নবী জীবনের সকল কিছুই মানুষের জন্য অনুসরণীয়। নবী করীম (সা:) তাঁর পবিত্রা স্ত্রীদেরকে বলতেন, 'আমি তোমাদের সাথে যে আচরণ করি, তা মানুষকে জানিয়ে দাও। আমি দিনে যা করি এবং রাতে যা করি, সকল কিছুই মানুষকে জানিয়ে দাও'।
কারণ তাঁর জীবনের সকল কিছুই মানুষ অনুসরণ করবে। তাদের জীবনের কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজও মহান আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে পারে না। কোনো নবী যদি কখনো কোনো কাজ নিজ প্রবৃত্তি অনুসারে করেও থাকেন, তাহলে সাথে সাথে তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংশোধন করে দেয়া হয়েছে। কেননা, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি সমূহ শুধুমাত্র আল্লাহ তা'য়ালার কিতাবেই নয়, মহান নবীর জীবন আদর্শ হিসেবেও মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে, আর এই বিধানে আল্লাহ তা'য়ালার অপছন্দনীয় সামান্য কোনো অংশ থাকতে পারবে না।
পৃথিবীতে প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসূল আল্লাহ তা'য়ালার কাছে একই মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন না। তাঁদের দায়িত্ব অনুযায়ী মহান আল্লাহ তাঁদেরকে মর্যাদা দান করেছেন। তাঁদের মর্যাদা অনুসারে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁদেরকে অদৃশ্য জগতের জ্ঞান দান করেছিলেন। পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী কিভাবে তিনি পরিচালনা করছেন, এটা তাঁদেরকে পর্যবেক্ষণ করানো হয়েছে। তিনি কিভাবে সৃষ্টি করেন এবং মৃত্যু ঘটান আবার মৃত থেকে জীবিত করেন তা প্রদর্শন করা হয়েছে। এই পৃথিবী ও অদৃশ্য জগতের মাঝে যে পর্দা অন্তরায় হিসেবে রয়েছে, মহান আল্লাহ সে পর্দা তাঁদের দৃষ্টির সামনে থেকে সরিয়ে এমন সব দৃশ্য দেখিয়েছেন, যে দৃশ্য অবলোকন করলে সাধারণ মানুষ চেতনা হারিয়ে ফেলবে।
এসব জিনিসের প্রতি মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে, নবীগণ মানুষকে এসব জিনিসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য আহ্বান জানাবেন। এ কারণেই নবীদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা ঐসব জিনিসের সাথে চাক্ষুষ পরিচয় করে দিয়েছেন। অনেকে আবার নবীদের সাথে পৃথিবীর মানুষ দার্শনিকদের তুলনা করে থাকেন। দার্শনিকগণও তো এমন অনেক কথা বলেন, যা দেখা যায় না। অর্থাৎ নবী আর দার্শনিকদেরকে তারা এক কাতারে দাঁড় করাতে চান।
পৃথিবীর দার্শনিকগণ যা বলেন তা অনুমানের ভিত্তিতে বলেন। যেসব দার্শনিক মানুষ হিসেবে নিজের মর্যাদা ও অবস্থান, জ্ঞানের পরিধি অবগত আছেন, তারা কখনো নিজের মতামতই চরম সত্য বলে রায় দেন না। কিন্তু নবী-রাসূল যা বলেন, তা নিজের চোখে দেখে এবং ওহী জ্ঞানের ভিত্তিতে বলেন। নবীগণ অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলেন না। কিন্তু দার্শনিকগণ অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলে। নবীদের চোখের সামনে গোপন জগতের পর্দা উঠিয়ে যা দেখানো হয়েছে সে সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত হয়েই কথা বলেন।
পবিত্র কুরআনে সূরা ইউসুফে মহান আল্লাহ তা'য়ালা হযরত ইয়াকুব (আ:) ও তাঁর সন্ত ান হযরত ইউসুফ (আ:) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। হযরত ইউসুফ (আ:) ঘটনাক্রমে পিতার সান্নিধ্য থেকে কয়েক বছর যাবৎ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। পিতা তাঁর সন্তানের সন্ধান জানতেন না। তাঁর অন্যান্য সন্তানগণ ব্যবসা উপলক্ষ্যে যখন মিশর গিয়েছিল তখন হযরত ইউসুফ (আ:) মিশরের রাষ্ট্রপতি। তিনি জীবিত আছেন এর চিহ্ন স্বরূপ ভাইদের কাছে তাঁর শরীরের একটি জামা দিয়েছিলেন, যেন তাঁর পিতা সান্ত্বনা লাভ করেন।
সেই জামা নিয়ে যখন তাঁর ভাইগণ আসছিল তখন কয়েক শত মাইল দূরে অবস্থান করে হযরত ইয়াকুব (আঃ) হযরত ইউসুফ (আ:) এর শরীরের গন্ধ অনুভব করছিলেন। এ ধরনের ক্ষমতা মহান আল্লাহ তাঁর এ নবীকে দান করেছিলেন। কিন্তু এরপরেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সকল নবীই মানুষ ছিলেন। তাদের ভেতরে মানবিক সত্তা ছিল। তাঁরা আল্লাহ তা'য়ালার কোনো অভিনব সৃষ্টি ছিলেন না। একজন মানুষকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না।
সাধারণ মানুষের এই পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য যা প্রয়োজন হয়, নবী-রাসূলেরও তাই হত। তাঁরা ক্ষুধা অনুভব করতেন, তাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন হত। রক্ত মাংশে গঠিত ছিল তাদের শরীর। তাঁরাও বেদনা অনুভব করতেন। রোগাক্রান্ত হতেন। জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁরাও শ্রম দিতেন। বিবাহিত জীবনে তাঁদেরও সন্তান জন্ম হতো। আল্লাহ তা'য়ালার বিধান পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনে তাদেরকেও যুদ্ধ বিগ্রহ করতে হয়েছে। কিন্তু তাদের মানবীয় এই সত্তা পরিচালিত হত মহান আল্লাহ তা'য়ালার ইশারায়। কেননা, তাদের জীবনের সবটুকুই তাঁর অনুসারীদের জন্য ছিল অনুসরণীয়।
মুমিনদের জন্য নির্ধারিত যে গুণাবলী এবং পূর্ণমান, সে মানে প্রতিটি মুহূর্ত অবস্থান করা এই পৃথিবীতে একজন মুমিনের পক্ষেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ মুমিনের মান ওঠা নামা করে। যখন সে মহান আল্লাহর পছন্দনীয় কাজে লিপ্ত থাকে তখন মুমিন হিসেবে সে পূর্ণমানে অবস্থান করে। আর তাঁর দ্বারা যখন সামান্য ভুল হয়ে যায় তখন সে ঐ পূর্ণমান থেকে সামান্য নীচে অবস্থান করেন। অর্থাৎ আকাংখিত মানে প্রতিটি মুহূর্ত অবস্থান করা মানুষ হিসেবে মুমিনদের জন্য সম্ভব হয় না।
প্রশ্ন হলো, নবী-রাসূলেরও অবস্থা এমন হতো কি না। এ প্রশ্নের উত্তর আমরা পবিত্র কুরআন-হাদীসে অনুসন্ধান করবো। আমরা পবিত্র কুরআনে দেখতে পাই, হযরত নূহ (আ:) এর যুবক সন্তান যখন তাঁরই চোখের সামনে পানিতে ডুবে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করছিল, তখন হযরত নূহ (আ:) এর ভেতরে মানবীয় দুর্বলতা ক্ষণিকের জন্য স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাঁর সে সন্তান ছিলো আল্লাহ তা'য়ালার বিধানের শত্রু। মুহূর্ত কয়েকের ভেতরে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। আল্লাহর বিধানের মুকাবেলায় তিনি যুবক সন্তানের মমতা হৃদয়ে স্থান দেননি।
এ ধরনের নানা ঘটনা বিভিন্ন নবীর জীবনে সাময়িকের জন্য ঘটেছে। কিন্তু মহান আল্লাহ মুহূর্তের ভেতরে নবীকে সংশোধন করেছেন। একজন নবীর নিষ্পাপ হবার অর্থ এই নয় যে, নবীর দ্বারা পাপ সংঘটিত হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। অথবা সব ধরনের পাপ ও ভুল করার ক্ষমতা নবীর সত্তা থেকে মহান আল্লাহ ছিনিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত বিষয় হলো, নবী ভুল করার প্রবণতা রাখেন কিন্তু তাঁর মানবিক আবেগ অনুভুতি, মানবিক গুণাবলী, ইচ্ছা আশা নিরাশার অধিকারী হবার পরেও তিনি এমন আল্লাহভীরু ও সৎ হন যে, তিনি কখনো সচেতনভাবে কোনো ভুল করেননি।
প্রতিটি মানুষের ভেতরে যে খারাপ প্রবৃত্তি অবস্থান করছে, মানুষ যত খারাপ কাজ করে ততই সেই খারাপ প্রবৃত্তির শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ খারাপ কাজ বা পাপের কাজই হলো কুপ্রবৃত্তির খোরাক বা আহার। নবীর ভেতরে সেই শক্তি আহার না পেয়ে মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং নবীর মধ্যে পাপ করার কোনো আকাংখা সৃষ্টি হতে পারে না। তারপরেও তাঁর দ্বারা যদি সামান্যতম ভুল হতে থাকে, তাহলে মহান আল্লাহ সাথে সাথেই তা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেন। কারণ নবীর পদস্খলন শুধু তাঁর পদস্খলন নয়, সমগ্র উম্মতের পদস্খলন। নবী যদি মহাসত্যের বাইরে ভুলের দিকে বিন্দু পরিমাণ এগিয়ে যান, তাহলে সমগ্র পৃথিবী ভুলের দিকে কয়েক শত মাইল এগিয়ে যাবে।
নবী-রাসূল যে নিষ্পাপ ছিলেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। গুনাহ তথা নাফরমানীর কাজে জড়িয়ে পড়া, নিষিদ্ধ ও ঘৃণ্য হারাম কাজ করা থেকে নবী-রাসূলকে মহান আল্লাহ রক্ষা করেছেন। এই সংরক্ষণ শুধুমাত্র নবী-রাসূলদের জন্যই নির্দিষ্ট ও সংরক্ষিত। এই গুণ ও বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র নবীদেরকেই দান করে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন। সৃষ্টির সকল মানুষের তুলনায় তাদেরকে বিশিষ্ট বানিয়ে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মর্যাদা তাদেরকে দান করা হয়েছে।
পাপ ও অবাধ্যতা থেকে আল্লাহ তা'য়ালার বিশেষ সংরক্ষণ লাভের এই মর্যাদা শুধুমাত্র নবীদেরই রয়েছে। নবী-রাসূল ব্যতীত এই গুণ-বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব সৃষ্টি জগতে আর কোনো মানুষের নেই এবং কোনো মানুষের তা প্রাপ্যও নয়। নবী- রাসূলগণ এই সংরক্ষণ লাভ করেন শুধুমাত্র বড় বড় পাপ থেকেই নয়, ছোট ছোট পাপ থেকেও তাঁরা এই সংরক্ষণ লাভ করেন। এ কারণে তাদের দ্বারা আল্লাহর সাথে সামান্যতম অবাধ্যতা সংঘটিত হওয়া অসম্ভব।
নবী-রাসূল নিষ্পাপ মাসুম, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা মানবীয় প্রকৃতিই হারিয়ে ফেলেছেন। মানুষ স্বভাবতঃই ভুল-ভ্রান্তির প্রকৃতি সম্পন্ন। মানুষের ইচ্ছা শক্তি ও উদ্যম উদ্যোগ কোনো কোনো সময় দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এ যেমন সত্য, তেমনি সাময়িক ক্রোধ বা অভিমানে ভারাক্রান্ত হয়েও নবী রাসূল এমন কোনো কাজ হঠাৎ করতে পারেন, যা আল্লাহ তা'য়ালা অপছন্দ করেন।
এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাদেরকে সংশোধন করে দেন। সে ভুলকে স্থায়ী হতে দেন না। সে ভুলের প্রতিক্রিয়া বা পরিণতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এসব ক্ষুদ্র ভুলের ওপরে নবীগণ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকেন না। এমন হতে পারে যে, নবীকে আল্লাহ ভুল করার সুযোগ দিয়ে এ কথা প্রমাণ করেন যে, নবীগণ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ কারণে নবীগণ পাপী হন না বা তাদের মর্যাদাও ক্ষুন্ন হয় না।
সাময়িকের জন্য নবীগণ যে ভুল করতে পারেন বা মহান আল্লাহর বলে দেয়া কথা ভুলে যেতে পারেন, তার বড় প্রমাণ হযরত আদম (আ:)। তিনি ভুল করেছেন, এ উপলব্ধিবোধ তাঁর ভেতরে সৃষ্টি হবার সাথে সাথে তিনি ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন, মহান আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে নবুয়্যাত দান করেছেন। নবীগণ যাদু প্রভাবিত হতে পারেন। হযরত মূসা (আ:) এর সামনে যখন ফিরাউনের যাদুকররা যাদু নিক্ষেপ করেছিল, সে সময়ের চিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে-
قَالَ بَلْ أَلْقُواجِ فَإِذَا جِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى - فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خَيْفَةً مُوسَى -
যাদুর প্রভাবে তাঁর (মূসার) কাছে মনে হলো তাদের (যাদুর) রশি ও লাঠিগুলো বুঝি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে, (এতে মূসা তার অন্তরে কিছুটা ভয় (ও শঙ্কা) অনুভব করলো। (সূরা ত্বাহা-৬৬-৬৭)
আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে অভয় দান করে বলেছিলেন, কোনো ভয় নেই। তুমিই বিজয়ী হবে। তোমার হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো। তা এখনই তাদের মিথ্যা জিনিসগুলো গিলে ফেলবে। ওরা যা কিছু বানিয়ে এনেছে, তা যাদুকরের প্রতারণা ব্যতীত আর কিছুই নয়। আর যাদুকর কখনই সফলকাম হতে পারে না, তা ওরা যতই শক্তি দেখাক না কেনো।
সে সময় সাধারণ মানুষ যেমন যাদুর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, হযরত মূসা (আ:) এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কুরআন বলছে, তিনি ভয় পেয়েছিলেন। এই ভয় পাওয়া ছিল তাঁর মানবীয় দুর্বলতা। কিন্তু তিনি এই ভয়ের ওপর স্থায়ী ছিলেন না। ক্ষণিকের মধ্যেই তিনি নিজেকে ভয় মুক্ত করেছিলেন। পক্ষান্তরে যাদু কোনো নবীকে বিভ্রান্ত করতে বা তাঁর নবুয়্যাতের প্রতি বিরূপ কোনো ক্রিয়া করতে পারে না। স্বয়ং নবী করীম (সা:) এর ওপর দৈহিকভাবে যাদুর ক্রিয়া ঘটেছিল। এ কারণে তিনি তাঁর জীবনে বেশ কষ্ট অনুভব করেছেন।
হযরত ইউনুস (আ:) তাঁর জাতিকে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানালেন। তারা অস্বীকার করেছিল। তিনি তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখালেন। বললেন তিনদিনের মধ্যে আযাব আসবে। লোকজন আল্লাহ তা'য়ালার কাছে কাতর প্রর্থনা করেছিল। মহান আল্লাহ শাস্তি মওকুফ করে দিলেন। হযরত ইউনুস (আ:) চিন্তা করলেন, তিনদিনের ভেতরে যখন আযাব এলো না তখন এবার তাঁকে লোকজন মিথ্যাবাদী ধারণা করে তাঁকে হত্যা করবে।
তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশের অপেক্ষা না করে দেশ ত্যাগ করলেন। আল্লাহ তা'য়ালার আদেশ ব্যতীত কোনো নবীর জন্য তাঁর স্থান ত্যাগ করা নবুয়্যাত- মর্যাদার পরিপন্থী। সুতরাং মহান আল্লাহ তাকে গ্রেফতার করলেন। তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো। তাঁকে বিশাল এক মাছ-গ্রাস করেছিল। আল্লাহর কাছে তিনি ক্ষমা চাইলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন। এ ধরনের অনেক ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, নবীগণ সাময়িক ভুল করলেও মহান আল্লাহ তা সংশোধন করে দিতেন। কিন্তু তাদের সে ভুল মারাত্মক কিছু ছিল না। তা ছিল একেবারেই ক্ষুদ্র পর্যায়ের।
প্রত্যেক নবীর চরিত্রের সনদপত্র মহান আল্লাহ দান করেছেন। নবী করীম (সা:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا -
(হে মুসলমানরা,) তোমাদের জন্যে অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের (জীবনের) মাঝে (অনুকরণযোগ্য) উত্তম আদর্শ রয়েছে, (আদর্শ রয়েছে) এমন প্রতিটি ব্যক্তির জন্যে, যে আল্লাহ তা'য়ালার সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহী এবং যে পরকালের (মুক্তির) আশা করে, (সর্বোপরি) যে বেশি পরিমাণে আল্লাহ তা'য়ালাকে স্মরণ করে। (সূরা আহযাব-২১)
নবী করীম (সা:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। (সূরা ক্বালাম-৪)
সূরা ইয়াসিনের প্রথম আয়াতেই বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ করে আল্লাহ তা'য়ালা নবী করীম (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই আপনি সবচেয়ে সহজ-সরল এবং নির্ভুল পথের ওপরে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রেরিত নেতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। হযরত ইবরাহীম (আ:) ও আল্লাহর কাছে অতীব মর্যাদাবান নবী এবং মানবতার জন্য উত্তম আদর্শ ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন-
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ جِ
তোমাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর অনুসারীদের (ঘটনার) মাঝে রয়েছে ( অনুকরণযোগ্য) আদর্শ। (সূরা মুমতাহিনাহ-৪)
সূরা মরিয়মে হযরত ইবরাহীম (আ:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ একজন মর্যাদাবান নবী। একই সূরায় হযরত মূসা, হযরত ইদরীস ও হযরত ইসমাঈল (আ:) এর প্রশংসা করেছেন। নবী-রাসূল মানব জাতির জন্য উত্তম আদর্শবান ব্যক্তি ছিলেন। এ কারণে মহান আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন-
এরাই ছিলো সেসব লোক, যাদের আমি কিতাব, প্রজ্ঞা ও নবুয়্যাত দান করেছি, (আজ) যদি তারা তা অস্বীকার করে (তাতে আমার কোনো ক্ষতি নেই), আমি তো (অতীতে) এমন এক সম্প্রদায়ের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলাম, যারা কখনো (এগুলো) প্রত্যাখ্যান করেনি। আল্লাহ (এদের) সবাইকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন; (হে নবী) আপনি এদের পথেরই অনুসরণ করুন। (সূরা আনয়াম-৮৯-৯০)
প্রত্যেক নবীই ছিলেন মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাঁরা মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। বদরের প্রান্তরে নবী করীম (সা:) সিজদায় অবনত হয়ে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছেন। তিনি এ দাবী করেননি যে আমি একাই যথেষ্ট, আমার সামনে যে শত্রু আসবে সে জ্বলে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে। হযরত আইয়ুব (আ:) রোগে আক্রান্ত হয়ে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছেন। তিনি স্বয়ং এ. দাবী করেননি যে, আমি রোগ মুক্ত করতে সক্ষম।
0 Comments