আল্লাহ্ বলেনঃ
وَارْسَلْنَا الرِّيَاحَ .
আর আমি বায়ু প্রবাহিত করে থাকি যা মেঘকে পানি দ্বারা ভরে দেয়। (সূরা হজর)
অতঃপর আমি সেই পানি আসমান থেকে বর্ষণ করি, তা তোমরা এত পানি সঞ্চয় করতে সক্ষম নও।
আল্লাহ্ তাঁর অপার কুদরতে বায়ুকে পানি মিশ্রিত করে সৃষ্টি করেছেন। যদি এ বায়ু না হতো তবে শুষ্কতার কারণে জীবজন্তু ধ্বংস হয়ে যেত। বায়ুপ্রবাহ প্রাণীদেহে লেগে সেগুলির শরীরের উত্তাপ নিয়ন্ত্রিত করে। বায়ু স্থলচর প্রাণীর জন্য তেমনি অপরিহার্য, যেমনি জলচর প্রাণীদের জন্য পানি। বায়ু যদি শরীরে না লাগে আর দেহের অভ্যন্তরে না পৌঁছে অথবা অল্পক্ষণের জন্যও যদি বায়ু বন্ধ হয়, তবে সারা দেহের তাপ হৃদপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছে আর উত্তাপের আধিক্যে প্রাণনাশ হয়, যা আমরা শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার এবং বায়ুবদ্ধ হওয়ার ফল বলে প্রকাশ করে থাকি।
তারপর লক্ষ্য কর আল্লাহর কুদরতের প্রতি, যার ফলে বায়ু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চালিয়ে নিয়ে যায়। আর জলহীন ঊষর ভূমিকে বর্ষা দ্বারা সিঞ্চিত করে। এভাবে আল্লাহর কুদরতে আমাদের ফসলের জমি উর্বর হয়। যদি আল্লাহ্ বায়ু দ্বারা মেঘ নানা স্থানে পরিচালনা না করতেন তবে পানির ভারে হয়ত মেঘ এক স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকত অথবা একই স্থানে বর্ষা হতো। ফলে আমাদের বাগ-বাগিচা যেত শুকিয়ে ও ধ্বংস হয়ে।
বাতাসের সাহায্যে নদীতে ও সমুদ্রে জাহাজ চলাচল করে। এভাবে এক দেশের পণ্যদ্রব্য অন্য দেশে আমদানী ও রফতানী করা হয়। (বাষ্পযুগের পূর্বে সমুদ্রে বড় বড় জাহাজ বাদামের সাহায্যেই চলাচল করত)। যদি এভাবে জাহাজে মাল চলাচল না হতো তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হতো না এবং লোক তাঁদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানী রফতানী করতে পারত না। ফলে উদ্বৃত্ত দ্রব্যাদি অপচয় হতো। অন্য দেশের লোক হয়তো সে জিনিসের অভাবে কষ্ট ভোগ করতো।
দেখ! আল্লাহ্ বাতাসকে কিরূপ সূক্ষ্ম করে সৃষ্টি করেছেন। বায়ু অতি সূক্ষ্ম হওয়ার কারণে সহজেই সব জায়গায় তাহা প্রবেশ করতে পারে আর দুর্গন্ধ ও দুষিত বায়ু দূর করে স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে, অন্যথায় দুর্গন্ধে সারাদেশ পরিপূর্ণ হয়ে যেত। আর হাওয়া দুষিত হয়ে রোগ-ব্যাধি বিস্তার করত আর তা হতো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ধ্বংসের কারণ।
বায়ুপ্রবাহ ধূলি-বালি উড়িয়ে নিয়ে যায়, বাগানের উপর দিয়ে যখন সে বায়ু চলে, তখন গাছের পাতাগুলি পরিষ্কার করে দেয়। এতে পাতা সজীব ও জীবন্ত হয়ে উঠে। এমনিভাবে বায়ু পাহাড়ের উপর মাটির স্তর জমিয়ে দেয়, যাতে সেখানে কৃষি কাজ সম্ভব হয়। সমুদ্র উপকূলে বায়ু প্রবাহে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এতে আম্বর প্রভৃতি সুগন্ধিযুক্ত মূল্যবান দ্রব্য উৎপন্ন হয়।
বায়ুপ্রবাহে বৃষ্টির পানি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে আকাশে ছড়িয়ে গিয়ে সর্বত্র ছিটিয়ে পড়ে। যদি বায়ু এভাবে পানিকে বিক্ষিপ্ত না করতো তবে মেঘের পানি জমা হয়ে এক জায়গায় পড়তো, তাতে জানমালের ক্ষতি হতো। আল্লাহ্ তাঁর অসীম কুদরতে বায়ুর সাহায্যে পানি এত সহজে পৃথিবীতে ছিটিয়ে দেন যে, এতে কারো কোন প্রকার ক্ষতি হয় না। পানি এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটাগুলি ক্রমান্বয়ে বিস্তারিত ভূ-খণ্ডে বর্ষিত হয়ে নহর-নালার রূপ নিয়ে প্রবাহিত হয়। তারপর এর ব্যাপক কার্যকারিতা দেখ, আল্লাহর দোস্ত দুশমন সকলেরই এতে সমভাবে উপকার হয়ে থাকে। বায়ু যেমন জীবনের জন্য অপরিহার্য তেমনি আল্লাহ্ একে অফুরন্ত সৃষ্টি করেছেন। এর সীমাহীন উপকারিতার মধ্যে প্রতিভাত হয় আল্লাহর সীমাহীন কুদরত।
আল্লাহ্ বলেনঃ
আর আল্লাহ্ তোমাদের জন্য আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যা থেকে তোমরা পান কর, আর তা থেকে সৃষ্টি হয় লতা, তাতে তোমাদের পশুগুলি চড়াও আর বর্ষার পানিতে তোমরা ফসল উৎপাদন কর, জয়তুন, খেজুর, আঙ্গুর, সব রকমের ফল, নিশ্চয় এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য আল্লাহর একত্বেরনিদর্শন।
(সূরা নাহলঃ আয়াত ১০, ১১)
আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন দেখ। বর্ষার মওসুমে মাঝে মাঝে হয় বর্ষার বিরাম, আসমানে থাকে না মেঘের চিহ্ন, বায়ুও প্রশমিত। এতে লোকের জোটে সুযোগ আর অবকাশ। যদি সারা বর্ষাকালেই বৃষ্টি হতে থাকত, তবে মানুষ আর অন্য সব প্রাণী উঠতো অতিষ্ঠ হয়ে। এমনি যদি অবিরাম বায়ুপ্রবাহ বন্ধ থাকত তবে তা হতো সবার জন্য অশেষ কষ্টের কারণ। লোকের কাজ-কর্ম হয়ে পড়তো অচল। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, যখন বর্ষাধারা বিরামহীনভাবে পড়তে থাকে তখন ফসল নষ্ট হয়ে যায়, ঘরবাড়ী ধসে পড়ে, পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় পথ-ঘাট, যানবাহন চলাচল যায় বন্ধ হয়ে। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য দারুণ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
আর যদি শুরু হয় একাধারে অনাবৃষ্টি এবং বাতাস বন্ধ হয়ে যায়, তাতে শরীর যায় শুষ্ক হয়ে। ক্ষেতের ফসল সব জ্বলে পুড়ে যায়, খাল-বিল পুকুর ডোবার পানি যায় ফুরিয়ে আর যা অবশিষ্ট থাকে, তা হয়ে পড়ে দুষিত। এতে আবহাওয়া দুষিত হয়ে পড়ে, দেখা দেয় মহামারী। ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়, অথবা একদম বন্ধ হয়ে যায়, ফলে দেখা দেয় জিনিসপত্রের দুর্মূল্য। তৃণের অভাবে পশু হয়ে পড়ে শীর্ণ আর দুর্বল। চারণভূমি তৃণহীন শুষ্ক মাঠে পরিণত হয়। মৌমাছি আহরণ করতে পারে না মধু। মোটকথা, অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি যেটাই হোক, মানুষ-পশু-পাখী আর তৃণলতা, কীট পতঙ্গ সবারই জন্য তা হয় বিপর্যয়ের কারণ। এ কারণেই আল্লাহ্ বৃষ্টির পর খরা আর খরার পর বৃষ্টি বিধিবদ্ধ করেছেন, যাতে একটির ক্ষতি অপরটির দ্বারা পূরণ হয়। বায়ুমণ্ডলে ভারসাম্য সৃষ্টি হয় আবার তাতে দেখা দেয় নানা সুফল। আল্লাহর অসীম কুদরতের ফলে প্রকৃতিতে শৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
যদি কেউ জ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে এ প্রশ্ন করে বসে যে, উপরোক্ত অবস্থার শিকার হয়ে অনেক সময় ক্ষতি পোহাতে হয়। তাদের জন্য উত্তর এই যে, তার কারণ হলো মানুষের প্রতি আল্লাহ্র ইস্তেহান আর ঈমানের প্রতি আযমায়েশ। পরস্পর বিরোধী প্রাকৃতিক অবস্থা দ্বারা সৃষ্ট জীবের কিভাবে উপকার হচ্ছে একথা উপলব্ধি করানোই এ দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য। যা একমাত্র আল্লাহ্রই অনুগ্রহের ফলে সম্ভব হচ্ছে। নাফরমানদের চেতনা ফিরিয়ে আনা আর জুলুমবাজি থেকে বিরত করাও আল্লাহ্র উদ্দেশ্য এতে রয়েছে। নিশ্চয়ই দেখে থাকবে মানুষের যখন রোগ-ব্যাধি হয় তখন সে রোগ দূর করার জন্য কত তিক্ত ও বিস্বাদ ঔষধ ব্যবহার করে থাকে। তখন ক্ষণিকের জন্য তার এ চেতনা অবশ্যই জাগরিত হয় যে, আল্লাহ্ দুনিয়াতে কোন কিছুই বেকার সৃষ্টি করেন নি। যে জিনিস তিক্ত আর বিস্বাদ তার ভিতরে আল্লাহ্ রোগ নিরাময়ের রহস্য নিহিত রেখেছেন। আল্লাহই সে বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী।
ولكن ينزل بقدر ما يشاء وإِنه بِعِبَادِهِ خَب وإنه بعباده خبير بصير -
আর আল্লাহ্ পরিমাণ মতোই সব কিছু অবতীর্ণ করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি বান্দাদের বিষয় খবর রাখেন আর দেখেন। (সূরা শুরা)
0 Comments