পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে মানুষকে সম্বোধনের পৃথক কিছু বিষয় রয়েছে। প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে মানুষকে আহ্বান জানানো হয়। আমাদের দেশে অমুক চাচা, অমুক মামা, অমুক ভাই অথবা বড় চাচা, ছোট চাচা বা বড় মামা অথবা বড় ভাই ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে প্রথমে নাম তারপরে চাচা, মামা, খালু ইত্যাদি। পশ্চিমা বিশ্বে মিস্টার অমুক বলে সম্বোধন করা হয়। সাউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে পরিচিত বা অপিরিচিত মানুষকে ইয়া মুহাম্মাদ বা ইয়া আহমাদ, সাদিক বা হাবিব বলে সম্বোধন করা হয়। নবী করীম (সা:) যে যুগে পৃথিবীতে এসেছিলেন সে সময় অধিকাংশ লোকের গুণবাচক নাম ছিলো এবং মূল নামে না ডেকে গুণবাচক নামেই ডাকতো। কাউকে অমুকের সন্তান বলেও ডাকা হতো, যেমন ইবনে খাত্তাব বা খাত্তাবের সন্তান।
নবী করীম (সা:) এর নামকরণের বিষয়টি ঘটেছে সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ তা'য়ালার ইশারায়। তিনি যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন হযরত আমিনাকে স্বপ্নের মাধ্যমে জানানো হয়েছিলো তোমার সন্তানের নাম রাখবে 'আহ্মাদ'। নবী করীম (সা:) এর আগমনের কয়েক শতাব্দী পূর্বে হযরত ঈসা (আ:) এর মুখে এই 'আহমাদ' নামটি উচ্চারিত হয়েছিলো। তিনি তাঁর অনুসারীদের বলেছিলেন-
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُوْلُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرَامِ بِرَسُوْلِ يَأْتِي مِنمَ بَعْدِي اسْمُه أَحْمَدُ ط
(স্মরণ করো ঈসার কথা), যখন মারইয়াম পুত্র ঈসা তাদের বললো, হে বনী ইসরাঈলের লোকেরা, আমি তোমাদের কাছে পাঠানো আল্লাহর এক রাসূল, আমার আগের তাওরাত কিতাবে যা কিছু আছে আমি তার সত্যতা স্বীকার করি এবং তোমাদের জন্যে আমি হচ্ছি একজন সুসংবাদদাতা (তার একটি সুসংবাদ হচ্ছে), আমার পর এক রাসূল আসবেন, তাঁর নাম আহমাদ। (সূরা আস্ সফ-৬)
নবী করীম (সা:) ভূমিষ্ঠ হবার পরে দাদা আব্দুল মুত্তালিব প্রাণপ্রিয় নাতীকে চুমু দিয়ে চাদরে আবৃত করে কোলে নিয়ে পবিত্র কা'বা ঘরে এসে তাঁর সর্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনা করে আল্লাহ তা'য়ালার কাছে প্রাণভরে দোয়া করলেন। তারপর সপ্তম দিনে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করে প্রিয় নাতীর নামকরণ করলেন। আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ তৃপ্তি সহকারে আহার করে আব্দুল মুত্তালিবের কাছে জানতে চাইলো, 'আপনার নাতির কি নামকরণ করলেন?' তিনি বেশ গর্বভরে জবাব দিলেন, 'আমি আমার নাতির নামকরণ করেছি মুহাম্মাদ'।
সে যুগে 'মুহাম্মাদ' নাম তেমন কেউ রেখেছে বলে জানা যায় না। উপস্থিত লোকজন বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলো, 'আমাদের মধ্যে যে ধরনের নাম রাখা হয় তেমন নাম না রেখে ব্যতিক্রমধর্মী নাম রাখলে যে!' আব্দুল মুত্তালিব মৃদু হেসে জবাব দিলেন, 'আমি চাই যে, পৃথিবীর সকল সৃষ্টি এবং আকাশে আল্লাহ তাঁর সীমাহীন প্রশংসা করুন। আমার নাতি চিরদিন যেনো সর্বত্র প্রশংসিত হয় এবং এ জন্যেই আমি তাঁর নামকরণ করেছি মুহাম্মাদ'।
উল্লেখ্য, 'মুহাম্মাদ' শব্দের অর্থ অতি প্রশংসিত। অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা যাঁর প্রশংসা করেন এবং সকল সৃষ্টিকুল যাঁর প্রশংসা করে। অন্যান্য নবী-রাসূলের প্রতি দরূদ প্রেরণ করতে আল্লাহ তা'য়ালা আদেশ দেননি, কিন্তু নবী করীম (সা:) এর প্রতি দরূদ প্রেরণের আদেশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্বয়ং তাঁর মর্যাদাবান নবী-রাসূলের প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন এবং ফিরিশতারাও প্রেরণ করেন। এই নামটির মর্যাদা এতটাই উচ্চ যে, এই নামটি শোনার সাথে সাথে কেউ যদি 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম' না বলে অর্থাৎ দরূদ না পড়ে তাহলে স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা তার ওপর নারাজ হবেন। আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবীতে যত সংখ্যক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, তাদের সকলকেই তিনি নাম ধরে সম্বোধন করেছেন। হযরত আদম (আ:) মানব জাতির আদি পিতা। তিনিই প্রথম মানব, প্রথম নবী, প্রথম রাসূল এবং প্রথম বিজ্ঞানী। সেই আদম (আ:) কে সৃষ্টি করেই আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে নাম ধরে সম্বোধন করে বলেছিলেন-
وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ
হে আদম, তুমি এবং তোমার স্ত্রী এই জান্নাতে বসবাস করতে থাকো। (সূরা আল বাকারা-৩৫)
হযরত নূহ (আ:) যাঁকে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। কেননা প্রবল বন্যায় সকল কিছু নিঃশেষ হয়ে যাবার পর তাঁর থেকেই পুনরায় মানব বংশের বিস্তার ঘটেছে। তাঁর সন্তান ছিলো ইসলামের কঠিন দুশমনদের অন্তর্গত। তাঁর সেই সন্তান সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে ডেকে বললেন-
قَالَ يَا نُوْحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ
আল্লাহ তা'য়ালা বললেন, হে নূহ্, সে তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সূরা হূদ-৪৬)
বন্যার পানি নেমে যাবার পর আল্লাহ তা'য়ালা হযরত নূহ (আ:) কে ডেকে বললেন-
قِيلَ يَا نُوحُ اهْبِطْ بِسَلَامٍ مِّنَّا وَبَرَكَاتٍ عَلَيْكَ وَعَلَى أُمَمٍ مِّمَّنْ مَّعَكَ ط
হে নূহ্ (বন্যার পানি নেমে গেছে) এবার তুমি (নৌকা থেকে) নেমে পড়ো, তোমার ওপর, তোমার সাথে যারা আছে তাদের ওপর আমার দেয়া সালাম ও বরকতের সাথে। (সূরা হূদ-৪৮)
মহান আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে স্বপ্নে সবথেকে প্রিয় বস্তু কুরবানী দেয়ার নির্দেশ পেয়ে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আ:) নিজ সন্তান ইসমাঈল (আ:) কে কুরবানী করার উদ্যোগ নিলেন। এরপর মহান আল্লাহ তাঁকে আহ্বান জানালেন-
وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ لَا قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا جِ
তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি (আমার দেখানো) স্বপ্ন সত্য প্রমাণ করেছো। (সূরা আস্ সাফফাত ১০৪-১০৫)
হযরত মূসা (আ:) মহান আল্লাহর খুবই আদরের নবী ছিলেন। তিনি মাদাইন থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফেরার পথে কোনো এক শীতের রাতে উপত্যকায় আলো দেখে আগুন ধারণা করে পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তোমরা এখানে অপেক্ষা করো। আমি ওখানে গিয়ে দেখি আগুন আনতে পারি কিনা। তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন তখন আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে আহ্বান জানালেন-
يَا مُوسَى إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ لَا
হে মূসা, আমিই আল্লাহ- সৃষ্টিকুলের একমাত্র মালিক। (সূরা কাসাস-৩০)
وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَى -
হে মূসা, (বলো তো) তোমার ডান হাতে ওটা কি? (সূরা ত্বাহা-১৭)
হযরত দাউদ (আ:) কে মহান আল্লাহ বিশাল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। তাঁকে আল্লাহ তা'য়ালা ডেকে বললেন-
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلُّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ط
হে দাউদ, আমি তোমাকে এই যমীনে আমার খলীফা বানালাম, অতএব তুমি মানুষদের মাঝে ন্যায়বিচার করো এবং কখনো নিজের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করো না, তেমনটি করলে এ বিষয়টি তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। (সূরা ছোয়াদ-২৬)
হযরত জাকারিয়া (আ:) বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলো বন্ধ্যা। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁকে ডেকে বলেছিলেন-
يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَمٍ نِ اسْمُه يَحْى لا لَمْ نَجْعَلْ لَّهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا -
হে জাকারিয়া, আমি তোমাকে একটি ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহইয়া, এর পূর্বে এ নামে আমি কোনো মানুষের নামকরণ করিনি। (সূরা মারইয়াম-৭)
তাঁর এ সন্তান বড় হলো এবং মহান আল্লাহ যখন তাঁকে নবুয়্যাত দান করলেন তখন তাঁকে ডেকে বললেন-
يَا يَحْى خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ طَ وَآتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا لا
হে ইয়াহ্ইয়া, আমার কিতাবকে তুমি শক্তভাবে ধারণ করো, প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে ছেলে বেলায়ই বিচার-বুদ্ধি দান করেছিলাম। (সূরা মারইয়াম-১২)
হযরত ঈসা (আ:) যাকে মহান আল্লাহ তা'য়ালা পিতা ব্যতীত বিশেষ কুদরতের মাধ্যমে মাতৃগর্ভে পাঠালেন। তাঁকে ডেকে বললেন-
إِذْ قَالَ اللهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ وَعَلَى وَالدَتِكَ
হে মারইয়াম পুত্র ঈসা, আমার সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ করো যা আমি তোমাকে ও তোমার মা'কে দান করেছিলাম। (সূরা মায়েদা-১১০)
এভাবে মহান আল্লাহ তা'য়ালা যাদেরকে মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে ঘোষণা করে যাঁদের ভুয়সী প্রশংসা ও বিশেষ গুণ-বৈশিষ্টের প্রশংসা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন, সেই সকল নবী-রাসূলদের সকলকেই নাম ধরে ডেকেছেন। ব্যতিক্রম শুধু মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা:) এর ক্ষেত্রে, তাঁকে আল্লাহ তা'য়ালা কখনো নাম ধরে ডাকেননি। সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, মালিক, শাসক, প্রতিপালক, নিয়ন্ত্রক, আইনদাতা, একমাত্র ইলাহ মহান আল্লাহ তা'য়ালা। সেই তিনিই তাঁর অনুপম অদ্বিতীয় সৃষ্টি নবী করীম (সা:) কে এমন বিশাল মর্যাদা দান করেছেন যে, স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে নাম ধরে কখনো ডাকেননি। নবী করীম (সা:) এর মর্যাদার কারণে তাঁর অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীর মর্যাদা কত উচ্চে তা কল্পনা করা যায়!
যখন প্রয়োজন হয়েছে তখন আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবীব নবী করীম (সা:) কে এভাবে ডেকেছেন-
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ ط
হে রাসূল, যা কিছু আপনার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি অন্যের কাছে পৌঁছে দিন।
(সূরা মায়েদা-৬৭)
মানুষ মহান আল্লাহর বিধান ত্যাগ করে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এ অবস্থা দেখে নবী করীম (সা:) অসম্ভব পেরেশান হয়ে বিচলিত বোধ করতেন। মানসিক যন্ত্রণায় তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। প্রিয় হাবিব মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছেন, এ অবস্থা আল্লাহ তা'য়ালা বরদাস্ত করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন-
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ لَا يَحْزُنُكَ الَّذِينَ يُسَارِعُوْنَ فِي الْكُفْرِ -
0 Comments