কেনো নবুয়‍্যাতের প্রয়োজন?

 


        পৃথিবীর একজন বিজ্ঞানী একটি জটিল যন্ত্র প্রস্তুত করলেন। তারপর তা বিশ্ব বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারজাত করলেন। অসংখ্য মানুষ তা ক্রয় করে বাড়িতে এনে দেখলো এই যন্ত্রের ভেতরে (Operating Guide) অপারেটিং গাইড নেই। যে বিজ্ঞানী উক্ত যন্ত্র প্রস্তুত করেছেন তিনি কাউকেই উক্ত যন্ত্র পরিচালনা করা শিখাননি বা যন্ত্রের সাথে কোনো Operating Guide দেননি। তখন বাধ্য হয়েই ক্রেতা সাধারণ যে কোম্পানীর কাছ থেকে যন্ত্র ক্রয় করেছে সে কোম্পানীর কাছে ধর্ণা দেবে। কোম্পানী ধর্ণা দেবে যন্ত্রের প্রস্তুত কর্তার কাছে। অর্থাৎ যন্ত্রের আবিষ্কারকের দায়িত্ব হলো Operating Guide যন্ত্রের সাথে দিয়ে দেয়া।

        এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ মানুষ প্রেরণ করেছেন। এই মানুষকে সহজ সরল ও সত্য পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব হলো মহান আল্লাহর। মহান আল্লাহ বলেন-

وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيْلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ ط 

        আল্লাহ তা'য়ালার ওপরই (নির্ভর করে মানুষদের) সরল পথ নির্দেশ করা, (বিশেষ করে) যেখানে (অন্য পথের) মধ্যে কিছু বাঁকা পথও রয়েছে। (সূরা নাহল-৯)

        কেননা মহান আল্লাহ হলেন মানুষের রব বা প্রতিপালক। মানুষের জীবনের যতগুলো দিক রয়েছে, সকল দিকের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব হলো মহান আল্লাহ তা'য়ালার। পৃথিবীর মানুষের জন্য চিন্তা এবং চলার বহু ধরনের পথ অবলম্বন করা সম্ভব এবং বাস্ত বে তার অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু এ সকল পথের সবগুলো পথ কোনক্রমেই সত্য বা সহজ- সরল হতে পারে না। পারে মাত্র একটি পথ। আর একমাত্র সঠিক এবং সহজ সরল ও নির্ভুল জীবন দর্শন তাই হতে পারে যা সত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, সত্য পথ কোনটি তা অনুসন্ধান করে বের করা।

         এই বিষয়টি মানুষের জীবনের মৌলিক প্রয়োজন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাঁর জীবন ধারণের জন্য এই পৃথিবীতে যা কিছু প্রয়োজন হবে, মহান আল্লাহ তাকে প্রেরণের পূর্বেই এখানে প্রস্তুত করে রেখেছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য। কিন্তু এসব বস্তু মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যে নির্ভুল জীবন ব্যবস্থার, তা পূরণ করতে পারে না। এই জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজন যদি মানুষের পূরণ না হয় তাহলে মানুষের সমগ্র জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

        একটি বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার প্রয়োজন যে, মহান আল্লাহ তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষকে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করার পূর্বে মানুষের জীবন ধারণের জন্য সকল কিছুর আয়োজন করে রেখেছেন, সেই আল্লাহ মানুষের সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন যে জীবন ব্যবস্থার, সেই জীবন ব্যবস্থা দান করবেন না এটা কিভাবে চিন্তা করা যায়? কোনো বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এটা তো কল্পনাও করতে পারেন না। মহান আল্লাহ মানুষের এই প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করেছেন তাঁর নবুয়‍্যাত ব্যবস্থার মাধ্যমে।

        এখন কোনো মানুষ যদি গোটা নবুয়্যাত ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে আগ্রহী হয় তা সে হতে পারে এবং সে স্বাধীনতা তার রয়েছে। সেই সাথে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তার কাছে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করতে চায়, নবুয়‍্যাত ব্যবস্থা অস্বীকার করার পরে মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা'য়ালা আর কি ব্যবস্থা করেছেন, তা দয়া করে জানিয়ে দিতে হবে। তিনি হয়ত এই প্রশ্নের জবাবে বলবেন, সত্য পথ অনুসন্ধান করার জন্যই তো মহান আল্লাহ তাঁর সেরা সৃষ্টি এই মানুষকে জ্ঞান বিবেক-বুদ্ধি এবং অনুসন্ধানী দৃষ্টি দান করেছেন।

        আমরা আবারো তাকে বিনয়ের সাথে জানাতে চাই, সত্য সহজ সরল পথ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার প্রমাণ হলো, মানুষ ইতোমধ্যেই তার চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে বহু পথ ও মত আবিষ্কার করেছে। তারপরেও মানুষ আল্লাহর প্রতি এ অভিযোগ করতে পারে না যে, তিনি আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেননি। তিনি আমাদের জীবন ধারণের জন্য সকল কিছুর ব্যবস্থা এই পৃথিবীতে করেছেন, কিন্তু আমরা কোন্ জীবন দর্শন অনুসরণ করবো তা তিনি আমাদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করেননি। এই অভিযোগ মহান আল্লাহর প্রতি করার কোনো অবকাশ তিনি মানুষের জন্য রাখেননি।

        মহান আল্লাহ এই পৃথিবীর সকল সৃষ্টির পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা তার জন্মের সাথে সাথেই করেছেন। কেবল মাত্র ব্যতিক্রম হলো মানুষ। মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি জ্ঞান এবং স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন করে তিনি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এমন একটি স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করা, যে সৃষ্টি তার নিজের খেয়াল খুশী অনুসারে নির্ভুল অথবা ভুল যে কোনো পথ গ্রহণ করতে পারে। জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন। মানুষের এই স্বাধীনতা ব্যবহার করার জন্য মানুষকে জ্ঞান নামক হাতিয়ার দান করা হয়েছে। তার মধ্যে বুদ্ধি এবং চিন্তার জগৎ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে ইচ্ছা ও সংকল্প গ্রহণের শক্তি দান করা হয়েছে। মানুষ যেন তার ভেতরের এবং এই পৃথিবীর বস্তু নিচয় ব্যবহার করতে পারে এমন শক্তি ও জ্ঞান দান করা হয়েছে। সেই সাথে তার মনের জগতে এবং তার দেহের বাইরের জগতে এমন সব বস্তু রাখা হয়েছে, এসব কিছু তার সত্য পথ গ্রহণের ব্যাপারেও সাহায্য করতে পারে আবার ভুল পথ গ্রহণের ব্যাপারেও সহযোগিতা করতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী এবং বস্তুর ন্যায় মানুষকে জন্মগতভাবে জীবন ব্যবস্থা অবলম্বনকারী হিসেবে সৃষ্টি করে দিলে সৃষ্টির সকল কিছুই অর্থহীন হয়ে যেত।

        অন্যান্য বস্তুর মতো মানুষের যদি স্বাধীন ক্ষমতা না থাকতো, তাহলে মানুষের পক্ষে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করা কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। এ কারণে মহান আল্লাহ মানুষকে জন্মগতভাবে জীবন ব্যবস্থা অনুসরণকারী হিসেবে সৃষ্টি না করে এমন স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন, যেন মানুষের জন্য সত্য পথ প্রদর্শনকারীর প্রয়োজন হয়। এখানেই প্রয়োজন হয় নবুয়‍্যাত এবং রিসালাতের। এই জিনিস মানুষ গ্রহণ করে সত্য পথও অবলম্বন করতে পারে এবং তার স্বাধীনতাও বজায় থাকে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের প্রতি এতই অনুগ্রহশীল যে, তিনি পৃথিবীতে মানুষের চলার জন্যও পথ নির্দেশ দান করেছেন।

        মানুষ মরুপথে চলবে, সে যেন পথ হারিয়ে না ফেলে এ জন্য আকাশে তারকা সৃষ্টি করে তাকে পথের সন্ধান দান করেছেন। মরুপথে এবং পানি পথে মানুষ দিক ঠিক রাখে আকাশের তারকা দেখে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাঁর মহান অনুগ্রহের কথা মানুষকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পাহাড়ী এলাকা দিয়ে মানুষ পথ চলবে সে কারণে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহর জন্য পাহাড়ী এলাকায় চলার পথ সৃষ্টি করেছেন। মরুপ্রান্তরে মানুষ যেন পানির তৃষ্ণায় ইন্তেকাল না করে, একারণে মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে জলাশয় সৃষ্টি করেছেন। এমন ধরনের কতিপয় গাছ সৃষ্টি করেছেন যে গাছের ভেতর থেকে মানুষ পানি লাভ করতে পারে।

        মরুভূমিতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহর জন্য নানা ধরনের খাদ্য মওজুদ রেখেছেন। পাহাড়ে ঝর্ণা সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহর পানির অভাব দূর করেছেন। এতসব ব্যবস্থা যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের জন্য করেছেন সেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাহর জন্য পৃথিবীতে কোনো জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজন পূরণ করবেন না, এটা কি মেনে নেয়া যায়? বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে বা সাগর বক্ষে তাঁর বান্দাহ যেন পথ হারিয়ে না যায়, এ জন্য মহান আল্লাহ তা'য়ালা আকাশে তারকা প্রজ্জ্বলিত করেছেন, অথচ এই পৃথিবী নামক অন্ধকার গ্রহে তিনি মহাসত্যের তারকা প্রজ্জ্বলিত করবেন না এটা কি সুষ্ঠু বিবেক-বুদ্ধি মেনে নিতে পারে?

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা প্রতিটি বস্তু এবং প্রাণীর আকৃতি দান করেছেন এবং সকল বস্তুকে তিনিই পথ প্রদর্শন করে থাকেন। পথ প্রদর্শনের এই দায়িত্ব একান্তভাবেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের ক্ষমতায় রেখেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু এবং প্রাণীকে তার অবস্থা এবং প্রয়োজন অনুসারে পথ প্রদর্শন করছেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বিশ্বব্যাপী পথ নির্দেশকের মর্যাদার অপরিহার্য দাবী হলো এই যে, তিনি মানুষের সচেতন জীবনের পথ প্রদর্শনের জন্য এমন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন না, যে পদ্ধতি পশু পাখির জন্য নির্ধারিত। যে পদ্ধতি প্রাণী জগতের জন্য উপযোগী সে পদ্ধতি তিনি মানুষের জন্য অবলম্বন করেননি। তিনি মানুষের জন্য উপযোগী পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এই মানুষের ভেতর থেকেই একজনকে নবী বা রাসূল হিসেবে নির্বাচিত করে তাঁর মাধ্যমে পথ নির্দেশ দান করেন।

        নবী এবং রাসূল মানুষের জ্ঞান বিবেক এবং বুদ্ধির প্রতি আবেদন জানিয়ে তাদেরকে সহজ সরল পথ প্রদর্শন করেন। সুতরাং মহান আল্লাহ তা'য়ালা শুধু এই পৃথিবী এবং এর ভেতরে যা কিছু আছে তার স্রষ্টাই নন, তিনি সকলকিছুর পথ প্রদর্শক এবং করুণাময় শিক্ষকও বটে। তিনিই সকল সৃষ্টিকে শিক্ষা দান করে থাকেন। ভূমিষ্ঠ হবার পরে মানব শিশুকে অনুগ্রহ করে তিনিই শিক্ষা দান করেন, 'তোমার গর্ভধারিণীর বুকে আমি তোমার উপযোগী খাদ্য বহু পূর্বে প্রস্তুত করে রেখেছি। ওখানে মুখ দিয়ে চুষতে থাকো। উপাদেয় খাদ্য তুমি লাভ করবে'। এভাবে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর সকল সৃষ্টিকেই শিক্ষাদান এবং পথ প্রদর্শন করেন।

Post a Comment

0 Comments