রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি তায়েফবাসীদের অত্যাচার


        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ির চারদিকে যারা বসবাস করতো, অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের প্রতিবেশী যারা ছিল তাদের ভেতরে একমাত্র হাকাম ইবনে আ'স ব্যতীত আর কেউ ইসলাম কবুল করেনি। বিশ্বনবী যখন নিজের বাড়িতেই নামাযে দাঁড়াতেন তখন প্রতিবেশী উকবা, আদী এ ধরণের অনেকেই তাঁর ওপরে পশুর নাড়ি ভুড়ি ছুড়ে দিত। আল্লাহর নবী বাধ্য হয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে নামায আদায় করতেন। তিনি রান্নার জন্য চুলায় হাড়ি উঠাতেন আর তাঁরা সেই হাড়ির ভেতরেও আবর্জনা ছুড়ে দিত। বিশ্বনবী নিজ হাতে সেসব আবর্জনা পরিষ্কার করতেন। এভাবে হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা ও আবু তালিবের অভাবে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কাফেরের দল তাঁর নিজ বাড়ির ভেতরেও নির্যাতন করেছে। সে সমস্ত ঘটনা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আছে।

        আল্লাহর নবী মক্কায় যেন আর টিকতে পারেন না। মক্কায় ইসলাম বিরোধিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন। তাদের এই অত্যাচার থেকে কিভাবে মুক্ত থাকা যায় তিনি সে সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকলেন। অবশেষে তিনি চিন্তা করলেন, তায়েফের আবদে ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব এই তিনজন যদি ইসলাম কবুল করে তাহলে ইসলামী কাফেলার ওপর মক্কার কাফিররা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। উল্লেখিত তিন ব্যক্তি ছিল তায়েফের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্র সাকিফ গোত্রের তিন ভাই। তাঁরাই ছিল গোত্র প্রধান। এই তিনজন লোক যদি ইসলামের পক্ষে আসে তাহলে ইসলামী আন্দোলন অনেক শক্তিশালী হবে। তাদের মাধ্যমে আরো বড়বড় নেতাদের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌছে দেয়া যাবে। এ সবদিক চিন্তা করে আল্লাহর নবী হযরত যায়েদকে সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়েফ রওয়ানা দিলেন। তায়েফের ঐ নেতা তিন ভাইয়ের একজন মক্কার কুরাইশ বংশের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামও ছিলেন কুরাইশ বংশের, সুতরাং তাঁরা ছিল কুরাইশদের আত্মীয়। তাঁরা ইচ্ছা করলে নবীকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে। এই আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু তাকদির ছিল ভিন্ন ধরণের। তিনি তাদের কাছে গেলেন। তাদের তিন ভাইকে ইসলাম সম্পর্কে বুঝালেন। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।

         তিনি তাদেরকে ইসলাম সম্পর্ক বুঝিয়ে অনুরোধ করলেন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করা দূরে থাক, বিশ্বনবীকে অপমান করলো। একজন বললো, 'তোমাকেই আল্লাহ যদি রাসূল করে প্রেরণ করে থাকে তাহলে আল্লাহ কা'বা শরীফের গেলাফ খুলে ফেলুক।' এই হতভাগার কথার তাৎপর্য ছিল, আল্লাহ তাকে নবী বানিয়ে কা'বার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন।

        দ্বিতীয়জন বললো, 'তোমাকে ব্যতীত আর কাউকে কি আল্লাহ রাসূল বানানোর লোক খুঁজে পেলেন না?'

        তৃতীয়জন বললো, 'তুমি যদি তোমার দাবী অনুযায়ী সত্যই রাসূল হয়ে থাকো তাহলে তোমার সাথে কথা বলা বিপদজনক। আর যদি তোমার দাবীতে তুমি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমি কোন মিথ্যাবাদীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই, এ কারণে তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাইনা।'

        এসব কথা বলে তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। তাঁরা নবীর কথা সমস্ত লোকজনের ভেতরে বিদ্রুপের ভাষায় প্রকাশ করে দিল এবং এলাকার মূর্খ ও দুষ্ট লোকদেরকে নবীর পেছনে লেলিয়ে দিল। এসব লোক নবীর পেছন পেছন যেতে লাগলো আর তাকে বিদ্রুপ করতে লাগলো। তিনি যেদিকেই যান সেদিকেই তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে উৎপাত করতে থাকলো।

        আল্লাহর নবী দীর্ঘ দশ দিন যাবৎ তায়েফে অবস্থান করে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইসলাম বিরোধিরা অবশেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে রাস্তা দিয়ে যাবেন সে রাস্তার দু'দিকে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে গেল। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পাষন্ডের দল বৃষ্টির আকারে তাঁর ওপরে পাথর বর্ষণ করতে থাকলো। আল্লাহর নবী রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়লেন। তায়েফের জালিমরা নবীর পবিত্র পা দুটো লক্ষ্য করেই আঘাত করেছিল বেশী। আল্লাহর নবী যখন হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন তখন তিনি জ্ঞানহারা হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। এ অবস্থাতেও নিষ্ঠুর তায়েফবাসী পাথর বর্ষণ অব্যাহত রাখলো। আল্লাহর নবীর এই অবস্থা দেখে হযরত যায়েদ তাঁর ওপর থেকে পাথর সরিয়ে তাঁকে উঠালেন।

        নবীকে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত যায়েদও মারাত্মকভাবে আহত হলেন। আল্লাহর নবী হাঁটতে পারছেন না। কোন মতে অবশ পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছলো যে, নবীর জীবন নাশের আশংকা দেখা দিল। হযরত যায়েদ নবীকে নিয়ে দেয়াল ঘেরা একটি বাগানে প্রবেশ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের তখন জ্ঞানহীনের মত অবস্থা। হযরত যায়েদের সেবা-যত্নে তিনি একটু সুস্থ হয়েই তাঁকে বললেন নামাযের কথা। নামাযের প্রস্তুতির জন্য তিনি পায়ের জুতা খুলতে গেলেন। পারলেন না। পবিত্র রক্ত জুতায় প্রবেশ করে পায়ের সাথে জুতা এমনভাবে বসে গেছে যে জুতা মোবারক খুলতে কষ্ট করতে হলো।

        এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমি অক্ষম, আমি সহায় সম্বলহীন, আমার বিচক্ষণতার অভাব। মানুষ আমাকে অবজ্ঞা করে, আমাকে নগন্যভাবে, আমাকে উপেক্ষা করে এ জন্য আমি আপনার কাছে আবেদন করছি। যারা দুর্বল এবং সহায় সম্বলহীন আপনিই তাদের আশ্রয়দাতা প্রতিপালক। হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি মানুষের নিষ্ঠুরতা আর করুণাহীনতার ওপরে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? যে আমাকে শত্রু জ্ঞান করে আমার ওপর অত্যাচার করে আপনি তাঁর ওপর আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আপনি যদি আমার ওপর রহম করেন আমাকে নিরাপত্তাদান করেন তাহলে এটাই হবে আমার জন্য শান্তির কারণ। আমি আপনার সেই রহমতের আশ্রয় কামনা করি, যে রহমতের কারণে সমস্ত পৃথিবী উৎসব মুখর হয় এবং পৃথিবী ও আখিরাতের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়। আমার অক্ষমতার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার সাহায্য ব্যতীত আমি কোন কাজ সমাধা করতে পারবো না।'

        এভাবেই আল্লাহর নবীকে তায়েফ থেকে হতাশ আর অত্যাচারিত হতে হয়েছিল। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বিশ্বনবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'কোথায় আপনার ওপরে সবচেয়ে বেশী নির্যাতন করা হয়েছে?' আল্লাহর নবী তাকে জানিয়েছিলেন তায়েফের কথা। এ ধরণের নির্মম নির্যাতন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবনে আর কোথাও ঘটেনি। তিনি তায়েফ থেকে ফিরে মক্কার দিকে যাত্রা করলেন।

Post a Comment

0 Comments