কুরাইশদের প্রতিনিধি সুহায়েল ইবনে আমর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলোচনা শুরু করলো। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আলোচনা চললো। তারপর উভয় পক্ষের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আলোচনার বিষয় বস্তু ছিল, সন্ধির শর্ত নিয়ে। কারণ, এ সমস্ত শর্তের ভেতরে এমন কিছু শর্ত ছিল, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অবমাননাকর। এ কারণে সাহাবায়ে কেরাম এসব শর্ত গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। পক্ষান্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইশারা পেয়েছিলেন, এই অসম্মানজনক শর্তের ভেতরেই ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তিনি কুরাইশদের এসব শর্ত গ্রহণ করেই সন্ধি স্থাপন করলেন। তিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে সন্ধির বিষয় বস্তু লিখতে বললেন। সে সময় আরবে প্রথা ছিল, কোন কিছু লিখার শুরুতে তারা লিখতো, 'বিইছমিকা আল্লাহুম্মা'। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহ সন্ধি পত্রের শুরুতেই লিখলেন, 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'। এই ধরণের লিখার সাথে মক্কার পৌত্তলিকরা অপরিচিত ছিল। কুরাইশদের প্রতিনিধি 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' লিখা দেখে আপত্তি জানিয়ে বললো, 'বিইছমিকা আল্লাহুম্মা' লিখতে হবে।
আল্লাহর নবী তাদের দাবীই গ্রহণ করলেন। এরপর লিখা হয়েছিল, 'এই চুক্তিনামা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেনে নিয়েছেন।' কুরাইশদের প্রতিনিধি সুহায়েল ইবনে আমর 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দ লিখা দেখে আপত্তি জানিয়ে বললো, 'আমরা যদি আপনাকে রাসূল হিসাবেই স্বীকৃতি দিতাম তহালে তো এত কিছুর প্রয়োজনই হত না। এই 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দ আমরা গ্রহণ করতে পারি না। এখানে লিখতে হবে, 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ।'
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'হে সুহায়েল! তুমি অবিশ্বাস করছো? আল্লাহর কসম! মহান আল্লাহই আমাকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন।' এ কথা বলে তিনি হযরত আলীকে আদেশ দিলেন, 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'র পরিবর্তে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখো।'
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহ অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দটা তিনি নিজে হাতে মুছে দিবেন। এটা কি সম্ভব! তাঁর শরীরে প্রাণের স্পন্দন থাকা পর্যন্ত 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দ তিনি নিজের হাতে মুছে ফেলতে পারবেন না। বিনয়ে বিগলিত হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মৃদু কণ্ঠে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নাম মুছে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
আল্লাহর নবী তাঁর প্রিয় সাহাবীর মনের অবস্থা অনুভব করলেন। তিনি হযরত আলীকে বললেন, 'কোথায় সেই 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দটি আমাকে দেখিয়ে দাও, আমিই মুছে দিচ্ছি।'
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সন্ধি পত্রের ওপরে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' শব্দটির ওপরে নিজের হাতের আঙ্গুল রেখে দেখিয়ে দিলেন। আল্লাহর নবী স্বয়ং তাঁর নামের সাথে 'রাসূলুল্লাহ' শব্দটি মুছে দিলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মক্কার কুরাইশদের লিখিত সন্ধি হলো। এই সন্ধিকে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করে তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
(১) চলতি বছর মুসলমানগণ হজ্জ না করেই মদীনায় ফিরে যাবে। দশ বছরের জন্য পরস্পরের ভেতরে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।
(২) পরের বছর মুসলমানগণ ইচ্ছা করলে হজ্জ করতে আসতে পারবে। তবে কোন ধরণের অস্ত্র বহন করতে পারবে না। আত্মরক্ষার জন্য মুসলমানগণ যে অস্ত্র বহন করবে, সে অস্ত্রও কোষবদ্ধ থাকবে।
(৩) মুসলমানগণ হজ্জের তিনদিন মক্কায় অবস্থান করবে। এই তিনদিন কুরাইশরা মক্কার বাইরে অবস্থান করবে।
(৪) হজ্জের সময় মুসলমানদের প্রাণ ও সম্পদ নিরাপদে থাকবে। মক্কার ব্যবসায়ীগণ মদীনার পথে নিরাপদে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করবে। তাদেরকে আক্রমন করা যাবে না।
(৫) আরবের যে কোন গোত্র কুরাইশ বা মুসলমানদের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারবে। এ ব্যাপারে কোন পক্ষই আপত্তি করতে পারবে না।
(৬) মক্কার কোন লোক তাঁর অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মদীনায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাকে মক্কার কুরাইশদের কাছে প্রত্যার্পণ করতে হবে। কিন্তু মদীনার কোন মুসলিম মক্কায় চলে এলে তাকে প্রত্যার্পণ করা হবে না।
(৭) প্রথম থেকেই যে সমস্ত মুসলমান মক্কায় বাস করছে, তাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না এবং মক্কায় যারা থেকে যেতে চায় তাদেরকে বাধা দেয়া যাবে না। সন্ধির শর্ত সকল পক্ষ অনুসরণ করে চলবে।
0 Comments