নবুয়্যাত-রিসালাতের সূচনা কবে থেকে

        মহান আল্লাহ এই পৃথিবী সৃষ্টি করে এখানে মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন। প্রথম মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল হযরত আদম (আ:) কে। প্রথম সৃষ্টি মানুষ হযরত আদম (আ:) কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁকে নবুয়্যাত দান করা হয়েছিল এবং তিনি নবী-রাসূল ও বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর থেকেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতা শুরু করেন বা নবুয়‍্যাতের সূচনা হয়েছিল হযরত আদম (আ:) থেকেই। এই ধারার সমাপ্তি ঘটেছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) পর্যন্ত এসে। নবী করীম (সা:) এর পরে কিয়ামত পর্যন্ত যে বা যারা নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করবে, তাদের উক্ত দাবী অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।

        মহান আল্লাহ হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর থেকে আরেকজন মানুষ সৃষ্টি করলেন, যার নাম হযরত হাওয়া (আ:)। তাঁকে হযরত আদম (আ:) এর জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মনোনীত করা হলো। সূচনায় তাদেরকে জান্নাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। সৃষ্টি করা হয়েছিল এই পৃথিবীর জন্য। সুতরাং তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হলো। এরপর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বংশধারা চালু করলেন। হযরত আদম (আ:) এর সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করতে থাকলো।

        মানব বংশের যাত্রা শুরু হলো। এই দু'জন মানুষ থেকে ক্রমশঃ মানব জাতির বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কত বছরের ব্যবধানে মানব বংশ বৃদ্ধি লাভ করে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তার সঠিক হিসাব মহান আল্লাহই অবগত আছেন। সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমানে যত সংখ্যক মানুষ আছে এবং অতীতকালে যারা ছিল, সকলেই ঐ হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আ:) থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সকল জাতির ধর্মীয় বর্ণনা এবং ইতিহাস এ কথা প্রমাণ করে যে, বর্তমানে এই মানব জাতি হযরত আদম (আ:) এর বংশধর। তাঁর থেকেই মানব জাতির বংশধারার অবতারণা হয়েছে। ডারউইনের থিয়রী অর্থাৎ The theory of evolution বহু পূর্বেই পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞান এ পর্যন্ত কোনো নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হতে পারেনি। বিজ্ঞান এ কথাও বলতে সক্ষম হয়নি যে, এই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল।

        বরং অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা হলো, প্রথমে একজোড়া মানুষ থেকেই মানব বংশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পৃথিবীতে পূর্বে যত মানুষ ছিল এবং বর্তমানে যত মানুষ আছে, আগামীতে যত মানুষ আসবে, তা সবই হযরত আদম এবং হযরত হাওয়া (আ:) এরই বংশধর। বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কি Certificate দিচ্ছে তা আমাদের আলোচনা বা অনুসরণ করার বিষয় নয়। মহান আল্লাহ কি বলছেন সেটাই বিশ্বাস এবং অনুসরণ করা মূখ্য বিষয়।

        পবিত্র কুরআনে এই মানব জাতিকে মহান আল্লাহ তা'য়ালা আদম সন্তান হিসেবে আহ্বান করেছেন। হযরত আদম (আ:) কে দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরকে ইসলামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেন। তাদেরকে তিনি যেন সর্ব প্রথমে এ কথা শিক্ষা দেন, এই পৃথিবী এবং এর ভেতরে যা কিছু দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান সকল কিছুর স্রষ্টা হলেন মহান আল্লাহ তা'য়ালা। তিনি অসীম ক্ষমতাবান। কোনো কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলে তাঁর আদেশ মাত্র তা সৃষ্টি হয়ে যায়।

        কোনো কিছু ধ্বংস করতে ইচ্ছা করলে সেটাও তাঁর আদেশ মাত্র ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি এক অদ্বিতীয়। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সকল কিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেনি বরং তিনিই সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি কারো আইন মানতে বাধ্য নন, সে প্রয়োজনও তাঁর নেই। সকল সৃষ্টি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁর আইন মানতে বাধ্য। তাঁকে কারো কাছে জবাবদিহী করতে হয় না, বরং সকল সৃষ্টিকে তাঁরই কাছে জবাবদিহী করতে হয় এবং হবে। তিনি চিরঞ্জীব এবং সকল ধরনের দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত।

        তাঁর আইন ব্যতীত আর কারো আইন গ্রহণ করা যাবে না বা অনুসরণ করা যাবে না। তাঁর ইবাদাত ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করা যাবে না। তাঁর কাছেই কেবল সাহায্য চাইতে হবে। অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। তাঁর সামনেই মাথানত করতে হবে, অন্য কারো কাছে বা সামনে মাথানত করা যাবে না। কেবলমাত্র তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই জীবন পরিচালনা করতে হবে। নিজের খায়েস বা অন্য কারো মর্জি অনুসারে জীবন অতিবাহিত করা যাবে না। জীবনের সকল কাজের জবাব আল্লাহ তা'য়ালার কাছে দিতে হবে। তাঁর দেয়া বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করলে তিনি পুরস্কার দান করবেন আর তাঁর আদেশ অমান্য করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

        হযরত আদম (আ:) তাঁর সন্তানদেরকে এই শিক্ষা প্রদান করলেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একটি দল আদি পিতার শিক্ষা অনুসারে জীবন অতিবাহিত করতে থাকলো। আরেকটি দল আদি পিতার শিক্ষা থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে গেল। তাদের ভেতরে কেউ আকাশের চন্দ্র সূর্যকে মহাশক্তিমান কল্পনা করে তার পূজা করতে থাকলো। কেউ ধারণা করলো বৃক্ষ, তরু-লতাই হলো সর্বশক্তিমান। সুতরাং বৃক্ষ তরু-লতা পূজিত হতে থাকলো। কেউ পূজা করতে থাকলো নদী সাগর ইত্যাদীকে। কেউ মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করতে থাকলো। কেউ আগুনের কুণ্ড নির্মাণ করে তার পূজা করা শুরু করলো।

        ইতোমধ্যে সমগ্র পৃথিবীতে আদম সন্তান ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন বিভিন্ন জাতির উদ্ভব হলো। তারা তাদের ধর্ম হিসেবেও নানা ধরনের কল্পিত মতবাদ আবিষ্কার করলো। মানুষের নানা শ্রেণী, বর্ণ ও ভাষা হবার কারণে নিত্য নতুন প্রথার সৃষ্টি হলো। এভাবে মানুষ নানা বস্তুর পূজারী হবার ফলে মহান আল্লাহকে ভুলে গেল। হযরত আদম (আ:) যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, মানুষ কালক্রমে তা ভুলে গিয়েছিল। পরিণতি যা হবার ছিল তাই হলো। যাবতীয় দুষ্কৃতি সমাজ জীবনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

        সমাজের প্রতিটি স্তরে পুঞ্জিভূতাকারে অপকর্ম জমা হলো। এমন অনেক রীতি নীতিকে বিসর্জন দেয়া হলো, যা ছিল প্রকৃতই কল্যাণকর। আবার এমন অনেক রীতি পদ্ধতিকে একান্তই অনুসরণীয় করা হলো, যা মানব জাতির জন্য একান্তই ক্ষতিকর। পথ প্রদর্শকের অভাবে শত সহস্র ভ্রান্ত পথ ও মতের সৃষ্টি হলো। তারা সবাই দাবী করতে থাকলো, তাদের পথই একমাত্র অভ্রান্ত এবং অন্যদের পথ ও মত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এভাবে শুরু হলো দলাদলি। পরিণতিতে দাঙ্গা সৃষ্টি ও রক্তপাত হতে থাকলো।

        পবিত্র কুরআন ও গবেষণালব্ধ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ইসলামের সূচনা হযরত আদম (আ:) থেকে হয়েছিল। ইসলামের শত্রুরা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান মুসলিম সমাজে এ কথা প্রচলিত করে দিয়েছে যে, মুহাম্মাদ (সা:) ই ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। পবিত্র কুরআন-হাদীস এর বিপরীত কথা বলে। পৃথিবীতে প্রেরিত প্রত্যেক নবীর আদর্শই ছিল ইসলাম। তাঁরা সকলেই ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আল্লাহ তা'য়ালা কর্তৃক নির্বাচিত নেতা। প্রত্যেক নবীই ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। সর্বকালে সব দেশে মানব জাতির একমাত্র আদর্শ ছিল ইসলাম।

        পবিত্র কুরআন সম্পর্কে যারা অনভিজ্ঞ এবং কুরআন বাদ দিয়ে যারা ইতিহাস রচনা করেছে, তারা উল্লেখ করেছে যে, 'অংশীদারিত্বের অন্ধকারময় জগতে ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের গর্ভধারিণী মাতা হলো অংশীদারিত্ব। তারপর ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে শিরকের বা অংশীদারিত্বের অন্ধকার দূরিভূত হয়ে তাওহীদের তথা একত্ববাদের সৃষ্টি হয়। এভাবে মানুষের মধ্যে তাওহীদ বা একত্ববাদের ধারণার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে'।

        ডারউইন তার The theory of evolution-এর মাধ্যমে মানুষকে যে নাস্তিক্যবাদের দিকে আহ্বান জানিয়েছে, ধর্ম সম্পর্কে উল্লেখিত কথাটিও সেদিকেই মানব জাতিকে নিয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, আদম হাওয়া কল্পিত বিষয়। মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে পানির পোকা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তারপর তারা বন্যদের মত জীবন যাপন করতে থাকে। মানব প্রকৃতি বড় দুর্বল। চরম অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষ একটা শক্তিকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চায়। সুতরাং অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়ে মানুষ নানা ধরনের কল্পিত শক্তি আবিষ্কার করে। আর কল্পিত শক্তির নামই হলো স্রষ্টা। প্রকৃত স্রষ্টা বলতে কিছুই নেই।

        মানুষ কখনো চন্দ্র-সূর্যকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছে। তখন থেকেই তাদের পূজা শুরু হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন বস্তুকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে মানুষ তাদের পূজা করেছে আর এভাবেই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। এসব কিছু থেকে আরেকদল মানুষ আবিষ্কার করেছে এমন এক শক্তিকে, যাকে দেখা যায় না এবং অনুভবও করা যায় না। তার নাম দিয়েছে 'আল্লাহ' (নাউযুবিল্লাহ)। এভাবেই একত্ববাদের সৃষ্টি হয়েছে। যুগে যুগে কিছু ব্যক্তি এই একত্ববাদের সাথে নতুন কিছু জুড়ে দিয়ে মানুষকে তার অনুসারী বানিয়েছে।

        এক শ্রেণীর মানুষ নামের বিভ্রান্ত কিছু লোক উল্লেখিত কথাগুলোর জন্ম দিয়েছে, যেসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন, কোনো অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মানব জাতির যাত্রা শুরু হয়নি। পৃথিবীতে একজন মহামানব প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন সম্মানিত নবী-রাসূল এবং বিজ্ঞানী। এক আলোকিত উজ্জ্বল অবস্থা থেকে মানব জাতির সূচনা হয়েছিল এবং তারা যাত্রা শুরু করেছিল। তাঁরা সবাই ছিল এক অভ্রান্ত পথের যাত্রী। তাদের ভেতরে কোনো ধরণের দুষ্কৃতি বা দলাদলি ছিল না। ইতিহাসের ধারাপরিক্রমায় এই মানুষ প্রকৃত সত্য থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর তাদের ভেতরে নানা মত ও পথের আবিষ্কার হয়। যারা এই নানা ধরনের মত ও পথের আবিষ্কারক ছিল, তারা যে প্রকৃত সত্য জানতো না এমন নয়। সত্য জানার পরেও এক শ্রেণীর মানুষ নিজের বৈধ অধিকারের সীমা অতিক্রম করে পার্থিব সুবিধা লাভের জন্যই এই ধরনের বাতিল ভ্রান্ত পথের ও মতের জন্ম দিয়েছিল। তারা নিজেদের ভেতরে অন্যায় অত্যাচার আর সীমা লংঘনের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী ছিল। তাদেরকে এ সকল অপরাধ থেকে মুক্ত করে পুনরায় আল্লাহ তা'য়ালার দেয়া সহজ-সরল পথে ফিরিয়ে আনার জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী প্রেরণ করতে থাকেন।

        এ সকল নবীগণ পৃথিবীতে আগমন করে কিছু অনুসারী তৈরী করবেন তারপর একটি নতুন আদর্শের মাধ্যমে নিজের নামের অনুকরণে একটি ধর্মমত সৃষ্টি করবেন, ব্যাপার কিন্তু এমন ছিল না। মহান আল্লাহ এসব নবী-রাসূলকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, হযরত আদম (আ:) এর মাধ্যমে যে সত্য মানব জাতির জন্য দান করা হয়েছিল, সে সত্য মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। নবীগণ এসে সেই সত্য উদ্ধার করে মানুষকে পুনরায় সেই সত্যের অনুসারী তৈরী করবেন। সেই সত্য মানুষের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরবেন, তা পরিষ্কার করে বর্ণনা করবেন। তারপর তাদেরকে একটি জাতিতে পরিণত করবেন।

Post a Comment

0 Comments