নবী-রাসূলের অস্তিত্ব বর্তমান পৃথিবীতে শারীরিকভাবে থাকতেই হবে এ প্রশ্নের গুরুত্ব নেই, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নবী-রাসূলগণ যে শিক্ষা দান করেছেন, মহান আল্লাহর পক্ষ হতে যে বিধান তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল, তা বর্তমানে মওজুদ আছে কিনা। এই বিষয়টির ওপরে মানব জাতিকে গভীরভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। বর্তমানে নবীর আগমন আর ঘটবে না। কেননা নবী করীম (সা:) এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ নবুয়্যাতী ধারার সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন। তাঁর আনিত বিধান বর্তমানে অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।
তাঁর সমগ্র জীবনকাল এবং সকল কার্যাবলী মানুষের সামনে অবস্থান করছে। তাঁর আনিত বিধান এবং তাঁর কার্যাবলী পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী। সুতরাং তাঁকে অনুসরণ করা এবং তাঁর আনুগত্য করা তথা তাঁর আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করা মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তাঁকে নবী বলে স্বীকৃতি দেয়ার পর তাঁকে অনুসরণ না করা বা তাঁর আদর্শ গ্রহণ না করা মানব বুদ্ধির বিরোধী কাজ। কারণ তাঁকে নবী বলে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থই হলো আমরা একথার স্বীকৃতি দিলাম যে, তিনি যা কিছুই বলেছেন মহান আল্লাহর পক্ষ হতে বলেছেন, তিনি যা করেছেন তা মহান আল্লাহর ইশারায় করেছেন।
এই অবস্থায় তাঁর কোনো কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার সুস্পষ্ট অর্থ হলো, মহান স্রষ্টা আল্লাহর কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করা। নবীর কোনো কাজকে অপছন্দ করার অর্থই হলো মহান আল্লাহর নির্দেশকে অপছন্দ করা। নবীর কোনো কাজের সমালোচনা করার স্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো মহান আল্লাহর নির্দেশের সমালোচনা করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা। সুতরাং বুঝা গেল, নবী সম্পর্কে মনের গহিনে সামান্য প্রশ্ন সৃষ্টি করার অর্থই হলো স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি করা।
সুতরাং নবীকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরে কোনো ধরণের প্রশ্ন ব্যতীতই নবীর সকল নির্দেশ মাথা পেতে গ্রহণ করা এবং তা অনুসরণ করা। নবীর কোনো কথা বা নির্দেশ যদি আমাদের উপলব্ধিতে না আসে তার মানে এই নয় যে, নবীর কথা ভুল। বরং ভুল আমাদের উপলব্ধির জগতে। আমরা জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে নবীর কথা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছি। মনে রাখতে হবে, নবীর প্রতিটি কথা ও কাজের মধ্যেই মানব জাতির উন্নতি নিহিত রয়েছে। নবীর কথার প্রকৃত তাৎপর্য যদি আমাদের বোধগম্য না হয়, তবুও তা আমাদেরকে অনুসরণ করতে হবে। বরং এটা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
নবী কক্ষনো ভুল কথা বলেন না। কেউ যদি ধারণা করে যে, নবী মাঝে মধ্যে ভুল কথা বলেন এবং ভুল করে থাকেন, তাহলে তা হবে এক মারাত্মক অপরাধ। কারণ নবী আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত হন এবং তাঁর নির্দেশেই কথা বলেন। আমাদের ভেতরেই ভুল রয়েছে বলে আমরা নবীর কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি না। নবীর যে কথা বা কাজ অনুধাবন করতে পারি না সেটা আমরা অনুসরণ করবো না, এমন কোনো সুযোগ মুসলমানদের জন্য অবশিষ্ট নেই। যিনি যতবড় আলেমই হন না কেনো, তাঁর কোনো কথা বা কাজের অনুসরণ করতে হলে, তাঁর নির্দেশের সাথে বা কাজের সাথে নবীর কথার বা কাজের সাদৃশ্য আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে তবেই তা অনুসরণ করতে হবে।
একটি বিষয় অনুধাবন করতে হবে, যে ব্যক্তি কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নয়, সে কম্পিউটারের জটিল বিষয় বুঝতে পারবে না। কিন্তু কম্পিউটার বিশেষজ্ঞের কথা যদি সে একারণে গ্রহণ না করে যে, কম্পিউটার তার বোধগম্য হচ্ছে না। তাহলে তার জন্য এটা হবে বোকামীর পরিচয়। পৃথিবীর প্রতিটি কাজের জন্যই বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। কোনো কাজের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করার পরে তার কাজে হস্তক্ষেপ করার কোনো অবকাশ থাকে না।
সুতরাং প্রত্যেক মানুষ প্রতিটি কাজে বিশেষজ্ঞ হতে পারে না। পৃথিবীর সকল কাজ প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারে না। কোনো ব্যক্তি কোন্ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তা আমাদের যাচাই করে তার ওপরে নির্ভর করতে হয়। এরপর সেই ব্যক্তির কাজে হস্তক্ষেপ করা বা তাকে বারবার উত্যক্ত করা যে, 'আমাকে প্রথমে এই বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে হবে, নতুবা আমি তোমার কোনো কাজ বা কথা গ্রহণ করবো না'। এমন কথা যারা বলবে তাদেরকে মূর্খ ব্যতীত আর কিছুই বলা যায় না।
রোগী যখন ডাক্তারের কাছে যায় এবং সে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগীকে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে আর রোগী যদি ডাক্তারের কাছে আবদার জানায়, 'আপনি এই ওষুধ কেনো ব্যবহার করতে বললেন আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিন'। ডাক্তার তখন বাধ্য হয়েই রোগীকে তার চেম্বার থেকে বের করে দেবেন। রোগ নিরাময়ের জন্যে ডাক্তারের নির্দেশ অনুসরণ করা প্রয়োজন, বিশেষ ওষুধ ডাক্তার কেনো নির্বাচিত করলেন তার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া রোগীর জন্যে বোকামী বৈ আর কিছুই নয়।
আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ সম্পর্কে আমাদেরকে ঐটুকু জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যতটুকু জ্ঞান অর্জন করলে আমরা বুঝতে পারবো যে, কোন্ কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন আর কোন্ কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন। মহান আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে জীবন পরিচালনার পদ্ধতি কি, তা আমরা জানি না। জানার কোনো মাধ্যমও আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এটা আমরা জানতে ইচ্ছুক। সুতরাং এটা জানার জন্যই আমাদের প্রয়োজন নবীকে অনুসন্ধান করা। এই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে। আমাদেরকে জানতে হবে, নবুয়্যাতের ধারা কোথেকে শুরু হয়ে কোন্ পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। এই জ্ঞান যদি আমাদের না থাকে বা এই জ্ঞানের ভেতরে যদি কোনো ভ্রান্তি থাকে তাহলে আমরা যে ভুল পথে পরিচালিত হবো এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হযরত মুহাম্মাদ (সা:) যে শেষ নবী এবং তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবে না, তাঁর আনিত জীবন বিধানই যে কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণ করতে হবে, এই জ্ঞান মানুষের জন্য পরিপূর্ণভাবে স্বচ্ছ থাকতে হবে। নবী করীম (সা:) এবং তাঁর পবিত্র সাহাবায়ে কেরামের সাথে যে কাজের কোনোই সম্পর্ক ছিল না, সে কাজের বাইরের অবয়ব যতই সুন্দর হোকনা কেনো, তা গ্রহণ করা যাবে না।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, কোনো নবী এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করে কারো কবরের কাছে গিয়ে কোনো কিছুর জন্য কখনো ধর্ণা দেননি। সুতরাং এই কাজ আমাদের জন্য করার কোনো অবকাশ নেই। ঈমান রাখতে হবে যে, মানুষের সকল প্রয়োজন পূরণ করার মালিক হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি কোনো মাধ্যম ব্যতীতই তাঁর বান্দার আবেদন শোনেন, সে বান্দাহ যত বড় পাপীষ্ঠই হোক না কেনো। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ طَ أَإِلَهُ مَّعَ اللَّهِ طَ قَلِيْلًا مَّا تَذَكَّرُونَ
তিনি (শ্রেষ্ঠ) যিনি কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন, যখন (নিরূপায় হয়ে) সে তাঁকেই ডাকতে থাকে, তখন তার বিপদ-আপদ তিনি দূরীভূত করে দেন এবং তিনি তোমাদের এ যমীনে তাঁর প্রতিনিধি বানান; (এসব কাজে) আল্লাহ তা'য়ালার সাথে আর কোনো মা'বুদ কি আছে? (আসলে) তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা আন নামল-৬২)
0 Comments