পৃথিবীতে প্রেরিত কোনো নবী-রাসূলকেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা এমন কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করেননি যে, 'তোমার বর্তমান সময় থেকে ভবিষ্যৎকাল অধিক ভালো হবে বা তোমাকে এমন কিছু আমি দান করবো, যা পেয়ে তুমি খুশী হবে'। শুধু মাত্র এ মহান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে নবী করীম (সা:) কে এবং এ মর্যাদা কেবলমাত্র তাঁরই জন্যে নির্দিষ্ট। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
وللآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ اللأُولَى ط وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى ط
অবশ্যই আপনার পরবর্তীকাল আগের চেয়ে উত্তম, অল্পদিনের মধ্যেই আপনার মালিক আপনাকে (এমন কিছু) দিবেন যে, আপনি এতে খুশী হয়ে যাবেন। (সূরা দুহা-৪-৫)
লক্ষ্য করুন, সূরা হামিম সাজদার ৫৩ নং আয়াত যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, 'অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো' অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবের কাছে ওয়াদা দিয়েছেন এবং তা বাস্ত বায়নও করেছেন, আবার সূরা দুহার উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ যে ওয়াদা তাঁর প্রিয় বন্ধু নবী করীম (সা:) কে দিয়েছেন, এমন ওয়াদা মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির কাউকেও দেননি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে ওয়াদা দেয়া- এই উচ্চ মর্যাদায় নবী করীম (সা:) কে ভূষিত করা হয়েছে। মক্কী জীবনের সেই দুঃসহ দিনগুলোয় মহান আল্লাহ তাঁকে আগামী দিনের সুসংবাদ জানিয়ে বললেন, বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন প্রাথামিক পর্যায় অতিক্রম করছে এবং এই অবস্থায় আপনি যে প্রবল বাধার মুকাবিলা করছেন, সেই বাধা কখনো স্থায়ী হবে না। আগামীতে আপনার জন্য শুভ দিন অপেক্ষা করছে। যেমন রাত যতো গভীর হতে থাকে উজ্জ্বল সূর্যের আগমনী ঘন্টা ততই জোরে বাজতে থাকে- তেমনি বাধার তীব্রতা যতোই তীব্র হচ্ছে আপনি ততই সফলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। আর অল্প দিনের মধ্যেই আপনার অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
আল কুরআন ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ময়দানে বর্তমানে আপনি যে পর্যায় অতিক্রম করছেন, আগামীতে যে পর্যায়সমূহ আপনার সামনে প্রতিভাত হবে, তা পূর্বের পর্যায়ের তুলনায় অবশ্যই উত্তম হবে এবং এই পরিবর্তনের ধারা কখনো থেমে থাকবে না। এভাবে করে আপনি ক্রমশঃ একটি শুভ পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাবেন। সেই সোনালী সূর্য উদিত হবার আর বেশি দেরী নেই, যে সূর্যের উজ্জ্বল আলো অবলোকন করে আপনি আনন্দিত হবেন। আপনার প্রতি আপনার রব অনুগ্রহের ধারা বৃষ্টির মতোই বর্ষণ করতে থাকবেন। সেই দিনটি বেশী দূরে নয় যখন আপনিও দেহ-মনে তৃপ্তিদায়ক নিদ্রার পরমুহূর্তের মতোই প্রশান্তি অনুভব করবেন। আপনি আন্দোলনের দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করার পরে যখন সফলতা অর্জন করবেন তখন আপনার দেহ-মন থেকে যাবতীয় ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। আপনি শান্তি ও স্বস্তি অনুভব করবেন। একটি করে দিন আপনার জীবন থেকে অতিবাহিত হবে নতুন দিনের আগমন ঘটবে, সেই নতুন দিনটি আপনার কাছে পূর্বের তুলনায় উত্তম হবে।
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী করীম (সা:) এর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এমন সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে। পরবর্তীতে এ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণরূপে আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়িত হয়েছিল। অথচ যে অবস্থায় এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তখন তা যে বাস্ত বে পরিণত হবে এমন আশার আলো কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। সে সময় মক্কায় যে অসহায় ইয়াতিম এক ব্যক্তি গোটা জাতির জাহিলিয়াতের সাথে দ্বন্দু ও সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তার পক্ষে এতদূর সাফল্য লাভ কোনো সময় সম্ভব হবে তা কল্পনা করাও ছিলো অসম্ভব বিষয়।
ইসলামী আন্দোলনের শৈশবকাল। নবী করীম (সা:) আল্লাহর নির্দেশে একা এই পথে অগ্রসর হলেন। ক্রমশঃ মুষ্টিমেয় কিছু সঙ্গীসাথী জুটে গেল। আপন আত্মীয়-স্বজন তাঁকে শুধু দূরেই নিক্ষেপ করলো না, আন্দোলনের শত্রুদের সাথে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁর সাথে শত্রুতা করতে লাগলো। সমগ্র জাতি তাঁর দুশমনে পরিণত হলো। অন্ধকার! চারদিকে ঘোর অমানিশার অন্ধকার! কোথাও সফলতার সামান্যতম আলোর রেশটুকুও নেই। এই ঘন তমশার মধ্যে তাওহীদের প্রদীপ ক্ষীণ শিখায় আলো বিকিরণ করছিল আর সেই আলোর শিখাকে বিরোধীগোষ্ঠী ফুঁৎকারে নির্বাপিত করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ঠিক এই কঠিন মুহূর্তে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে নিশ্চয়তা দিলেন, আপনি মোটেও বিচলিত হবেন না। হতাশার বিন্দুমাত্রও যেন আপনাকে স্পর্শ করতে না পারে। আগামীতে আপনার জন্য শুভদিন অপেক্ষা করছে। অচিরেই সাফল্যের সোনালী সূর্য উদিত হবে এবং সেই সূর্যের আলোয় আন্দোলনের ময়দান থেকে অন্ধকার দূরিভূত হবে। আপনি চিন্তা করবেন না, যে জাহিলিয়াত আপনার সামনে পাহাড়ের মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছে তা নিজের ঘরেই আত্মহত্যা করবে। আজ যে সঙ্কটপূর্ণ দিন আপনি অতিবাহিত করছেন, তা অতিক্রম করে আগামী দিন হবে আপনার জন্য শুভক্ষণ। আপনি তো পরশ পাথর। আপনার স্পর্শে সকল কিছুই খাঁটি সোনায় পরিণত হবে। এই আন্দোলন এক সময় পৃথিবীর আনাচে কানাচে কম্পন সৃষ্টি করবে। কারো ক্ষমতা নেই তাওহীদের এই আমানত- এর ধারক-বাহকদের বুক থেকে মুছে ফেলার। যে কা'বা ঘরে আজ আপনাকে তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারণ করতে দিচ্ছে না, সেই দিন সামনে যখন তাওহীদের এই ধ্বনি কা'বা ঘরের চার দেয়াল অতিক্রম করে প্রান্তর ছাড়িয়ে অগাধ জলধী পেরিয়ে অপ্রতিহত বন্যার গতিতে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ধ্বনিত হতে থাকবে।
সমগ্র পৃথিবীর সবথেকে মর্যাদার আসন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনিই হবেন এই পৃথিবীর ভেতরে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। পৃথিবীব্যাপী আপনার নামটিই সবথেকে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত-
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ط
আমিই আপনার স্মরণকে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি। (সূরা ইনশিরাহ-৪)
শুধু পৃথিবীতেই নয়, কিয়ামতের ময়দানে আপনিই হবেন সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। কল্পনার অতীত নিয়ামাত দিয়ে আপনাকে সম্মানিত করা হবে। সুতরাং আপনি নিশ্চিত মনে আপনার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যান। পেছনে দৃষ্টি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, সামনের দিকে অগ্রসর হন। এমন এক সময় আসবে যখন আপনার বিরোধিদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে তারা আজ আপনাকে হুমকি দিচ্ছে, ঐ স্থান থাকবে আপনার পবিত্র পায়ের নীচে। যে মাথা আজ গর্বিত ভঙ্গিতে আপনার সামনে উঁচু হয়ে রক্তচক্ষু তুলে ধরছে, সেই মাথা আপনার পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়বে সেদিন বেশি দূরে নয়। এমন সময় আপনার সামনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে, যখন আপনার শত্রুপক্ষ আপনার কাছে শুধু করুণাই ভিক্ষা চাইবে-
إِن شَانِئَكَ هُوَ الأَبْتَرُع
নিশ্চয়ই আপনার নিন্দুকেরাই হবে শিকড়-কাটা অসহায়। (সূরা কাওসার-৩)
'সামান্য দিনের ব্যবধানে আপনার রব আপনাকে এমন সব নিয়ামাতের অধিকারী করবেন, যা লাভ করে আপনার খুশীর কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না'। আল্লাহ তা'য়ালার এই ওয়াদা নিছক শুধু কথার কথাই ছিল না। ইতিহাস সাক্ষী, মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর রাসূলের জীবনকালেই ওয়াদা বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর অবর্তমানে তাঁরই অনুসারীরা তাঁর আনীত আদর্শ ইসলামকে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করবে, সে চিত্রও রাসূলের সামনে মহান আল্লাহ তুলে ধরেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন নবী করীম (সা:) বলেছেন, 'আমার অবর্তমানে আমার উম্মত যেসব এলাকায় বিজয় কেতন উড্ডয়ন করবে সেসব এলাকা আমাকে দেখানো হয়েছে। তা দেখে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি'।
'হে মক্কা! এই পৃথিবীর সকল কিছুর থেকে তুমি আমার কাছে প্রিয়, কিন্তু তোমার নিষ্ঠুর সন্তানেরা আমাকে থাকতে দিলো না'। এই কথাগুলো বিশ্বনবী (সা:) এর। তাঁর মনে বড় সাধ ছিল মক্কায় অবস্থান করে প্রাণভরে বাইতুল্লাহর খেদমত করবেন। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা তাঁর আদর্শ ইসলামকে সহ্য করেনি। তাঁকে মক্কায় থাকতে দেয়নি। প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে মদীনার দিকে যাবার সময় অশ্রু সজল দৃষ্টিতে কা'বার দিকে তাকিয়ে তিনি উল্লেখিত কথাগুলো বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন। তাঁর শৈশব কৈশোর ও যৌবনের চারণভূমি মক্কা তিনি বিজয় করলেন। অত্যন্ত দ্রুত ইসলাম চারদিকে তার সৌরভ ছড়িয়ে দিলো। দক্ষিণ উপকূল থেকে উত্তরে রোমান সাম্রাজ্যের সিরিয়া ও পারস্য সাম্রাজ্যের ইরাকী সীমান্ত পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে পারস্যোপসাগর থেকে পশ্চিমে লোহিত সাগর পর্যন্ত সমগ্র আরবদেশ নবী করীম (সা:) এর শাসনাধীনে এলো। সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকার তিনি শাসক হলেন।
আরবের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই ভূখণ্ড এক সুসংবদ্ধ আইন ও শাসনের নিয়ন্ত্রণে আসে। নবী করীম (সা:) এতটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন যে, তৎকালীন দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্য যখনই রাসূল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তখনই তারা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চরমভাবে পর্যদুস্ত হয়েছে। তাওহীদের আওয়াজ গোটা সাম্রাজ্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মানব রচিত সকল মতবাদ মতাদর্শ গর্বিত মস্তক অবনমিত করে রাসূলের পদতলে লুটিয়ে পড়েছে। যেসব মানুষের মনমানসিকতায় শিরকের অন্ধকার পৃঞ্জিভূত ছিল, সে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে সেখানে তাওহীদের মশাল প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। নরখাদকের মতোই যারা নারীর ইজ্জতের ওপরে হামলা করতো, তারা সামান্য কিছু দিনের ব্যবধানে হয়ে পড়েছিল নারীর ইজ্জতের অতন্দ্রপ্রহরী। অগণিত মানুষের মন-মস্তিকে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবসাধিত হয়েছিল। জাহিলিয়াতের বর্বর অন্ধকারে যে জাতি ছিল নিমজ্জিত, মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানে সেই জাতি সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণীয় জাতিতে পরিণত হয়েছিল, পরিবর্তনের এই ধরনের ঘটনা গোটা বিশ্বের ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা এভাবেই তাঁর নবীকে খুশী করেছিলেন। শুধু তাই নয়, রাসূল (সা:) এর বিদায়ের পরে ইসলামী আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীর বাতিল শক্তির তত্ত্বে তাউসে যে কম্পন সৃষ্টি করেছিল, সে কম্পনের ফলে জাহিলিয়াতের বিশাল বিশাল দূর্গ ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল। ইউরোপ ও আফ্রিকার একটি বিশাল অংশের ওপরে ইসলাম অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর মানুষ জ্ঞানার্জন ও সভ্যতা শেখার জন্য ছুটে আসতো ইসলামের কাছে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা এভাবেই তাঁর নবীর কাছে দেয়া ওয়াদা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এই নিয়ামাত তিনি তাঁর নবীকে পৃথিবীতেই দিয়েছিলেন, আর আদালতে আখিরাতে তাঁকে যে কি ধরনের নিয়ামাত দানে ধন্য করবেন, তা কল্পনাও করা যায় না।
নবী করীম (সা:) কে 'আমিই আপনার স্মরণকে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি' অর্থাৎ একমাত্র আমিই আপনার নামটি পৃথিবীময় উচ্চকিত করেছি- সর্বত্র প্রশংসা আর শ্রদ্ধাভরে আপনার নামটি উচ্চারণের ব্যবস্থা আমিই করেছি। এ কথাটি মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর রাসূলকে যে সময়ে বলেছিলেন, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে একক ও নি:সঙ্গ একজন মানুষের সাথে প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন মুষ্টিমেয় কিছু লোক রয়েছে এবং যাদের অবস্থান মাত্র মক্কা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেই লোকের প্রশংসা, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা কিভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে! কিভাবে মানুষ পৃথিবী ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নামটি সবচেয়ে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করবে। কিন্তু মানুষ যা কল্পনা করতে অক্ষম মহান আল্লাহ এক বিস্ময়কর পদ্ধতিতে সেটাই বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা করলেন স্বয়ং তাঁরই শত্রুদের মাধ্যমে। কিভাবে সেটা করলেন, তার একটি পটভূমি রয়েছে।
সে পটভূমির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা দেখতে পাই, নবী করীম (সা:) এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হচ্ছে তবুও তাঁকে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিরত করা যাচ্ছে না, এ কারণে ইসলাম বিরোধী নেতৃত্বের মনে ধারণা হলো নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সা:) একটা কিছু অর্জন করতে চায় এ কারণে সে এবং তাঁর অনুসারীরা নির্যাতন সহ্য করেও তাদের কার্যক্রমে বিরতি এবং আদর্শ ত্যাগ করছে না। এই অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে ইসলাম বিরোধিদের নেতা ওতবা ইবনে রাবিয়া নবীর কাছে এসে প্রশ্ন করলো, 'হে মুহাম্মাদ (সা:)! বলো তো, প্রকৃত পক্ষে তোমার মনের ইচ্ছাটা কি? যদি মক্কার নেতৃত্ব কামনা করো তাহলে তা গ্রহণ করতে পারো। যদি আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে কামনা করো তাহলে আমরা ব্যবস্থা করে দেব। গোটা মক্কার ধনরত্ন চাও আমরা তোমার সামনে এনে দিচ্ছি। তবুও তুমি যা বলছো তা থেকে বিরত হও'।
বিশ্বমানবতার মহান মুক্তির দূত নিজের পক্ষ থেকে কোনো কথা না বলে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তাকে শুনিয়ে দিলেন। আয়াতের অর্থ হলো, 'হে রাসুল! আপনি বলে দিন, আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার কাছে মহান আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করেছেন যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো দাসত্ব করবে না। তোমরা তাঁকেই অবলম্বন করো এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা ভিক্ষা করো। আপনি তাদেরকে আরো বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহকে অস্বীকার করো? যিনি মুহূর্ত কালের মধ্যে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন আর তাঁর সাথেই তোমরা অংশীদার স্থাপন করছো? তিনিই হলেন গোটা পৃথিবীর প্রতিপালক'। বিশ্বনবীর মুখে পবিত্র কুরআন শুনে ওতবা থরথর করে সেদিন কেঁপে উঠেছিল। তাঁর মুখ থেকে আর একটি কথাও বের হয়নি। দ্রুত সে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সামনে থেকে সরে পড়েছিল।
ইসলামের শত্রুরা নবী করীম (সা:) কে নির্বংশ, নিঃসঙ্গ মনে করেছিল, ধারণা করেছিল তাঁর আদর্শ দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু মাত্র ১৩ বছরের মধ্যেই তারা দেখতে পেলো রাসূলের আদর্শ গ্রহণকারীদের একটি বিরাট দল তৈরী হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই আদর্শের প্রচার, প্রসার ও টিকিয়ে রাখার জন্য যে লোকগুলো প্রাণ বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়েছে, সেই লোকগুলো তাদেরই ভাই, বোন, চাচা, মামা এবং প্রাণপ্রিয় সন্তান। যারা রাসূলকে নির্বংশ বিশেষণে বিশেষিত করেছিলো, তারা দেখতে পেলো, বিরাট একটি দল প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে, যারা রাসূলের আদর্শ টিকিয়ে রাখার জন্য যে কোনো মুহূর্তে প্রাণ দিতে প্রস্তুত এবং একটির পরে আরেকটি যুদ্ধে ঐ লোকগুলো তার প্রমাণও দিয়ে দিলো।
নির্বংশ বিশেষণে তারা যাকে বিশেষিত করেছিল, মক্কার সেই ইয়াতিম বালকটি পরিণত বয়সে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যখন মক্কায় নিজ অধিকার আদায় করতে এলেন, তখন নির্বংশ বিশেষণ যারা দিয়েছিল তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা এমনকি মৌখিকভাবে সান্তনা দেয়ার মতো একটি লোকও আরবে খুঁজে পাওয়া গেল না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা নিতান্ত অসহায়ের মতো তাঁর কাছে আত্মত্মসমর্পণ করতে হলো। এরপর তারা দেখলো তদানীন্তন পৃথিবীর মানচিত্রের সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকার একচ্ছত্র শাসক হলেন ঐ লোকটি যাঁকে তারা শেকড় কাটা বলেছিল। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকলো, গোটা পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্র থেকে আগত প্রতিনিধি দল কিভাবে আল্লাহর রাসূলের পদচুম্বন করে। ইসলামের সাথে যারা বিরোধিতা করে, মহান আল্লাহ তা'য়ালা এভাবেই কালক্রমে তাদের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত করে দেন।
বিষয়টি এখানেই শেষ হলো না। ইসলাম বিরোধিদের জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। আরবেরই শুধু নয়, আরবসহ আরবের বাইরের জগৎ থেকে দলের পরে দল লোক এসে ঐ লোকটির হাতে হাত দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করছিল, যে লোকটিকে তারা শেকড় কাটা বলেছিল।
আবু জেহেল, আবু লাহাব, উমাইয়া ইবনে খালফ, উকবা ইবনে আবু মুয়ীত, উতাইবা, উম্মে জামীল প্রমুখ ইসলাম বিরোধী নেতৃবৃন্দের বংশধর অবশ্যই পৃথিবীতে রয়েছে। কিন্তু এ কথা কারো বলার মতো হিম্মত নেই যে, আমরা অমুকের বংশধর। আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের বংশধররা যেমন গৌরবের সাথে দাবী করে যে, আমরা অমুকের বংশধর। কিন্তু সে যুগের ইসলাম বিরোধী নেতাদের বংশধরদের মধ্যে এমন কারো সাহস নেই, যিনি বলবেন আমি আবু জেহেল বা আবু লাহাবের বংশধর।
ঘৃণিত লোকদের সাথে কারো সম্পর্ক রয়েছে, এই দাবী করা কেউ পছন্দ করে না। রাসূলের পর থেকে যারাই ইসলামের সাথে বিরোধিতা করেছে, ইসলামী আন্দোলনকে এই যমীন থেকে উৎখাত করতে চেয়েছে, স্বয়ং তাদেরই নাম-নিশানা এই পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, রাসূলের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীর যে দেশে এবং যেখানেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, সেই আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে আন্দোলনে আত্মনিবেদিত লোকদের ওপরে চলেছে পৈশাচিক নির্যাতন। কারাগারের অন্ধকার জীবনে তাদেরকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে। তারপরেও এই আন্দোলনের গতি রোধ করা যায়নি। যারা বিরোধিতা করেছে বরং তারাই আবু জাহিল আর আবু লাহাবদের মতো ধরা পৃষ্ঠ থেকে মুছে গিয়েছে এবং মুছে যেতে থাকবে।
হিজরতের পরে মদীনায় ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তাঁর সুষমামণ্ডিত নামটি আরব জাহানের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। পৃথিবীতে অবস্থানকালেই তিনি দেখলেন, মহান আল্লাহ কিভাবে তাঁর নামটিকে প্রতিটি জনপদে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রতিটি স্থানে গোপনে প্রকাশ্যে, নীরবে-নির্জনে মানুষ পরম শ্রদ্ধাভরে মমতা জড়িত ভাষায় কিভাবে তাঁর নামটির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে, তা তিনি জীবিত থাকাবস্থায়ই দেখে গেলেন। এরপর তাঁর বিদায়ের পরে তাঁরই অনুগত সাহাবায়ে কেরাম তাঁরই আনীত আদর্শ নিয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়লেন। পৃথিবীর আনাচে কানাচে প্রতিটি জনপদে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)' নামটি সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে উচ্চারিত হতে থাকলো। বর্তমান মুহূর্ত পর্যন্ত তা অব্যাহত গতিতে উচ্চারিত হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা হতেই থাকবে।
কোথায় নেই তাঁর পবিত্র নামের পরশ। পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন শুধুমাত্র পাঁচবার আজানেই পরম শ্রদ্ধাভরে উচ্চস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামটি। অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক এই নামটিকে কত অলঙ্কারেই না সজ্জিত করেছেন। কেউ বলেছেন, এই নামের পবিত্র পরশ পেয়েই বোধহয় গোলাপ অপূর্ব এই সুরভী লাভ করেছে। বুলবুলী আর কোকিল ঐ নামের পরশ লাভেই অপূর্ব কণ্ঠ লাভ করেছে। ঐ 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামের পরশ ব্যতীত বুলবুলীর গান আর কোকিলের কুহু ধ্বনিই বৃথা, ফুলের বাগানে আবদ্ধ কলির হাসিও বৃথা। বেগবান বন্যার অপ্রতিরোধ্য গতির মতোই 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামটি জগতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সুদূর চাঁদের বুকেও 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং যা স্বকর্ণে শ্রবণ করেছেন। পৃথিবীতে মসজিদ আর মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধিই পাচ্ছে আর সেই সাথে অসীম মমতায় উচ্চারিত হচ্ছে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামটি।
অমুসলিমদের মধ্যে বিখ্যাত অসংখ্য মনীষীগণ, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, ধর্মনেতা, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ ইত্যকার বিশেষণে তাঁকে বিশেষিত করে এত প্রশংসা করেছেন যে, তা একত্রিত করলে বিরাট আকারের গ্রন্থ রচিত হবে। ডঃ মাইকেল হার্ট লিখিত দি হান্ড্রেড (The Hundred) নামক গ্রন্থে 'মুহাম্মাদ' নামটিকেই সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। গোটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠসমূহের প্রবেশ পথে শ্রেষ্ঠ মনীষীদের নাম উল্লেখ করে যে নামফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ (Epitaph) স্থাপন করা হয়েছে, সে নামফলকের প্রথমেই শ্রেষ্ঠ আইনদাতা (Law Giver) হিসাবে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (সা:) নামটিকেই সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত আজান ও নামাজে তাঁর নবুয়্যাত ও রিসালাতের কথা উচ্চ কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে, তাঁর প্রশংসা বাণী ঘোষণা করা হচ্ছে এবং তাঁর জন্য দোয়া করা হচ্ছে অগণিত কণ্ঠে। সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা হচ্ছে।
এ সম্পর্কে একটি হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রা:) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল (সা:) স্বয়ং বলেছেন- 'হযরত জিবরাঈল (আ:) এসে আমাকে জানালেন, আমার রব ও আপনার রব জানতে চেয়েছেন যে, আমি কিভাবে আপনার নামকে উচ্চকিত করে দিয়েছি। আমি বললাম, সেটা মহান আল্লাহই ভালো জানেন। হযরত জিবরাঈল (আ:) বললেন, আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, যখন যেখানেই আমার নাম উচ্চারিত হবে, তখন সেখানেই আমার নামের সাথে আপনার নামও উচ্চারণ করা হবে'। পৃথিবীতে যেখানেই মহান আল্লাহ তা'য়ালার নাম তাঁর বান্দারা যখনই উচ্চারণ করছে, তখনই বিশ্বনবীর প্রিয় নামটিও পরম শ্রদ্ধাভরে পাশাপাশি উচ্চারণ করছে।
0 Comments