আল্লাহপাক দুনিয়াকে কিভাবে সৃষ্টি করেছেন

আল্লাহ্ বলেনঃ

وَالْأَرْضَ فَرَشْنَا هَا فَنِعْمَ الْمَا هِدُونَ -

        আর এই দুনিয়াকে আমি বিছানা করেছি-আমি কত সুন্দর শয্যা রচনাকারী।

(সূরা জারিয়াত)

        আল্লাহ্ এই পৃথিবীকে একটি উত্তম শয্যারূপে সৃজন করেছেন। আমরা এই শয্যার উপর পরম নিশ্চিন্তে জীবন-যাপন করি। এ ছাড়া আমাদের জীবন-যাপন হতো কঠিন। তারপর এখানে আমাদের জীবন ধারণের সব উপায়-উপকরণ এবং পানাহারের দরকারী জিনিসের জন্য এই পৃথিবীই হচ্ছে ভাণ্ডার। আমাদের প্রয়োজনের সব-সামান এই পৃথিবীতেই রয়েছে। শীত-তাপ থেকে বাঁচবার ব্যবস্থাও আমরা এখান থেকে করতে পারি। দুর্গন্ধময় জিনিস আর মৃত-পচা দ্রব্যাদির দুর্গন্ধ থেকে বাঁচবার জন্য আমরা সেগুলিকে মাটির ভেতরে পুঁতে দিয়ে রক্ষা পেয়ে থাকি।

আল্লাহ্ বলেনঃ

الَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ كِفَاتًا أَحْيَاء وَ أَمْوَاتٌ .

         আমি কি পৃথিবীতে জীবিত আর মৃতদেরকে ধারণ করার জন্য সৃষ্টি করিনি?

(সূরা মুরসালাত)

        পৃথিবীর বুকে আমাদের চলাফেরার জন্য পথ তৈয়ার করা হয়েছে, যাতে করে আমাদের জরুরী আসবাব, মাল-সামান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে আর একে অন্যের প্রয়োজন মেটাতে পারি। আমাদের পশুদের খাদ্যও এই জমিন থেকে লাভ করি। জমিনেই হয় আমাদের কৃষি কাজ। এজন্য আমরা জমিনেরই মুখাপেক্ষী। আল্লাহ্ এ সম্পর্কে কুরআনের একটি আয়াতে আমাদের অবহিত করেছেনঃ

اخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَ مَرْعُهَا - وَ الْجِبَالَ أَرْسَاهَا مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ

        জমিন থেকেই তাদের পানি আর খাদ্য বের করেছি, আর পর্বতগুলিকে প্রোথিত করেছি। এসব তোমাদের আর তোমাদের পশুগুলির কল্যাণের জন্য। (সূরা নাজিয়াতঃ আয়াত ৩১,৩২, ৩৩)

        জমিনকে আল্লাহ্ কোমল আর আমাদের ব্যবহার উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। এর উপর আমরা বসি, শয্যা বিছাই আর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করি। মাটিকে আমাদের প্রয়োজনের উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই আমরা এসব সহজে করতে পারি। যদি জমিন অত্যধিক নরম হতো বা চঞ্চল হতো তবে আমরা এর উপর না ঘর-বাড়ী তৈয়ার করতে পারতাম, না কৃষি কাজ করতে পারতাম, না পারতাম এর উপর স্থির হয়ে থাকতে, আর না পারতাম আরাম-আয়েশ করতে। যেমন ভূমিকম্পের ঝঙ্কায় আমরা হয়ে পড়ি ভীত বিচলিত তার ভয়ে পারি না কোন কাজ করতে। আল্লাহর নীতি হচ্ছে এই-তিনি তার নাফরমান বান্দাদের সতর্ক করার জন্যে আর সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি তাঁর শক্তি এভাবে প্রকাশ করে থাকেন। এও আল্লাহর এক কুদরতের নিদর্শন।

        জমিনকে আল্লাহ্ যেমন প্রয়োজনানুরূপে কোমল করে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি শুষ্ক আর শীতলও করেছেন। যদি জমিন হতো পাথরের ন্যায় কঠিন ও বন্ধুর, তবে না চলতো কৃষিকাজ আর না করতে পারা যেত ঘর-দরজা তৈয়ার। এটা আল্লাহরই অপার মহিমা আর কুদরত যে, তিনি জমিনকে তৈরী করেছেন প্রয়োজনানুরূপ কোমল, শুষ্ক ও শীতল, যাতে জমিনের অধিবাসীদের জন্য জমিন ব্যবহার সহজ হয়।

        তারপর আল্লাহ্ নিজ কুদরতে উত্তর দিকে দক্ষিণ দিকের চেয়ে কিছুটা উঁচু করে তৈরী করেছেন, যাতে পানি একদিক থেকে অন্য দিক বয়ে যেতে পারে, আর প্রাণী-জগৎ পানি লাভের সুযোগ পায়, পরে সে পানি গড়িয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। যদি তা না হতো, তবে পানি এক স্থানে দাঁড়িয়ে গিয়ে জমি তলিয়ে দিযে সমুদ্র সৃষ্টি করত। বন্ধ হয়ে যেতো লোকের চলাফেরা আর ব্যাহত হত লোকের সব কাজকর্ম। যেমন আমরা প্লাবনের সময় বিপন্ন হয়ে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে থাকি।

        এবার জমিনের অভ্যন্তরভাগের প্রতি লক্ষ্য কর। আল্লাহ্ এর গর্বে কত সম্পদ লুক্কায়িত রেখেছেন। কোথাও মণি-মুক্তার খনি, কোথাও সোনা-রূপার আকর, কোথাও ইয়াকুত-জমরুদের খনি, কোথাও বা লোহা, তামা, সীসা, গন্ধক, হরিতাল, মর্মর পাথর, চুনা, সিমেন্ট প্রভৃতির বিরাট সঞ্চয়। এগুলির বিস্তারিত বর্ণনা লিখতে গেলে যথেষ্ট সময় আর পৃষ্ঠার প্রয়োজন। এসব খনিজ সম্পদ আমরা আমাদেরই প্রয়োজনে ব্যবহার করি আর কতো কাজে লাগাই তার হিসাব নেই।

        পৃথিবী যদি পাহাড়ের ন্যায় উঁচু আর কঠিন হতো, তবে আমরা তার থেকে প্রয়োজন মেটাতে অসমর্থ হয়ে পড়তাম। আল্লাহ্ এ কারণে সমতল ভূমিকে আবশ্যক পরিমাণ কোমল শীতল আর শুষ্ক করে তৈরী করেছেন, যাতে আমরা সর্বাধিক উপকৃত হতে পারি।

        জমিন যদি পাহাড়ের ন্যায় কঠিন হতো, তবে কি করে জমিতে কৃষি কাজ করতে সক্ষম হতাম। কেননা কৃষিকাজ নরম এবং সমতল জমিতেই সম্ভব, কারণ ইহা দরকার মতো পানি ধারণ করতে পারে। আর কোমল অংকুর যেন জমি ভেদ করে গজাতে পারে। সেই কোমল অংকুর যখন কাণ্ড ও শাখা বিস্তার করে জমিনে দাঁড়ায়, তখন তার কোমল শিকড়গুলি মাটির অভ্যন্তরে চারদিকে বিস্তার লাভ করে বৃক্ষকে দাঁড় করিয়ে রাখে আর তাকে জীবন্ত ও সজীব রাখার জন্য মাটির ভিতর থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য আহরণ করে উদ্ভিদকে সজীব রাখতে পারে। জমিন কোমল হওয়ার নানা উপকারিতার মধ্যে এও একটি যে, আমরা যেখানে ইচ্ছা সহজেই কূপ, পুকুর ইত্যাদি খুদতে পারি। যদি মাটি প্রস্তরের ন্যায় কঠিন হতো, তবে তা খনন করা হতো প্রায় অসম্ভব। এমনি আমাদের চলাফেরাও হতো ভীষণ কঠিন, কেননা পাথর খুদে রাস্তা নির্মাণ করা হতো অসম্ভব আর নির্দিষ্ট রাস্তা বা পথ না হলে যাতাযাত হয়ে পড়তো সুকঠিন।

আল্লাহ্ বলেনঃ

وجعل لكم فيها سبلا لعلكم تهتدون .

        সেই আল্লাহ্ যিনি জমিনে তোমাদের জন্য চলার রাস্তা করে দিয়েছেন যাতে তোমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পার।

        পৃথিবীর মাটি কোমল হওয়ার আর একটি উপকারিতা এই যে, আমরা গৃহাদি নির্মাণে এর মাটি সহজে কাজে লাগাতে পারি। ইট তৈরী করি, সুরকি বানাই, পাত্রাদি নির্মাণে ব্যবহার করি-এমনি বহু প্রয়োজনে ব্যবহার করি।

هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مناكيه .

        তিনি তোমাদের জন্য জমিনকে অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা এর রাস্তার উপর চলাফেরা কর।        (সূরা মূলক )

        যেখানকার মাটি থেকে লবণ, ফিঙ্কারী, আর গন্ধক বের হয় সেখানের মাটি খুবই নরম হয়ে থাকে। নরম জমিতে নানা শ্রেণীর উদ্ভিদ জন্মায়। কঠিন আর পার্বত্য ভূমিতে তা জন্মান সম্ভব নয়। নরম মাটিতে বহু প্রাণী তাদের আশ্রয় ও বাসস্থান বানিয়ে তাতে বাস করে। মাটিতে বসবাসকারী প্রাণী গর্ত ও বাসা নির্মাণ করে তাতে বাস করে। মাটি নরম হওয়ার কারণে এ সুবিধা তারা ভোগ করে থাকে।

        জমিনের গর্তে খনি সৃষ্টি-আল্লাহর অপার মহিমার নিদর্শন। আল্লাহ্ হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ প্রকাশ প্রসঙ্গে এ বিষয়ে উল্লেখ করেনঃ

واسلنا له عين القطر

        আর আমি তার জন্য তামের কূপ প্রবাহিত করে দিয়েছি।        (সূরা সাবা)

        মহান কৌশলী সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর বুকে পর্বত সৃষ্টি করেছেন। এর সম্যক উপকারিতা এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ জানে না। তার উপকারিতাগুলির মধ্যে এক হচ্ছে, আল্লাহ্ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যা উদ্ভিদ আর প্রাণী জগতকে বাঁচিয়ে রাখার অবলম্বন। যদি পাহাড়গুলি না থাকত, তবে বায়ু আর সূর্যের তাপে পানি শুকিয়ে যেত। এমতাবস্থায জমিন খনন করা ছাড়া পানি পাওয়ার কোন উপায় থাকত না। আল্লাহ্ পরম কৌশলে দুনিয়ার বুকে পাহাড়গুলি তৈরী করেছেন। সেগুলির অভ্যন্তরে বিরাট জলাশয়ে পানি সঞ্চিত হয়ে থাকে আর সে পানি নদীনালার রূপ নিয়ে অল্প অল্প করে প্রবাহিত হয়। এভাবে দূর দূর ব্যাপী পানি সঞ্চিত হয়। গ্রীষ্মকালে এই পার্বত্য স্রোতধারা আরো বাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। আর বর্ষা নেমে আসার পূর্ব পর্যন্ত লোক সে পানির সাহায্য নেয়।

        'যে সকল পর্বতের ভিতরে পানি জমবার কোন ব্যবস্থা নেই, সেখানে বরফের আকারে পর্বতের উপর পানি সঞ্চিত করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সূর্যের উত্তাপে যে অল্প অল্প বিগলিত হয়ে নদীনালা আর স্রোতধারায় গিয়ে জমিনের বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটায়। পাহাড়ের উপর অনেক জায়গায় বড় বড় জলাশয় থাকে। সেখানে অনেক পানি সঞ্চিত থাকে, আর প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা দিয়ে প্রয়োজন মিটানো হয়। যেমন বড় বড় শস্য গুদাম থেকে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগান হয়।

        এছাড়া পাহাড় অঞ্চলে বিশেষ ধরনের বৃক্ষ আর লতা-গুল্মাদি পাওয়া যায়, যেগুলি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। পাহাড়ে অনেক বড় বড় বৃক্ষ জন্মে। দালান, নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি নির্মাণে সেই বৃক্ষের কাঠই বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। এ কাঠ অন্য কোন বৃক্ষ থেকে পাওয়া যায় না। পাহাড়ে সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থান রয়েছে। সেখানে মানুষ অবকাশ যাপন করে থাকে। শুধু মানুষই নয়, বরং চতুষ্পদ ও অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও পাহাড়ের উপর রয়েছে চারণভূমি আর বিশ্রামের জন্য খোলা প্রান্তর। মৌমাছিরা পাহাড় অঞ্চলে মৌচাক তৈরী করে। মৃতদেহ দাফন করার জন্য পাহাড়কে নিরাপদ স্থান বলে গণ্য করা হয়।

        আল্লাহ্ বলেনঃ

وَكَانُوا يَتَّخِذُونَ مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا آمِنِينَ . 

        আর তারা পাহাড়ে নিরাপদ গৃহ নির্মাণ করে থাকে। (সূরা হজর)

        পাহাড়ের আর একটি উপকারিতা এই যে, পথিকের পথঘাট নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের উপর বড় বড় নিশান গেড়ে দেওয়া হয়। ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের সময় পথ নির্ণয়ে এ দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য হয়ে থাকে।

        পর্বতের আর একটি উপকারিতা এই যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্যদল যারা শত্রুদের সাথে যুদ্ধে অপারগ, তারা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে থাকে, আর পাহাড়কে দুর্গের পরিবর্তে ব্যবহার করে শত্রুর হামলা থেকে আত্মরক্ষা করে।

        আল্লাহর অপার কুদরত লক্ষ্য কর; তিনি কি কৌশলে মাটির ভিতরে সোনার খনি সংরক্ষিত করেছেন। আর তা সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট পরিমাণ। অবশ্য তা পানির ন্যায় অফুরন্ত সৃষ্টি করেন নি। যদিও আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে পানির ন্যায়ই তা অফুরন্ত সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু এটাও আল্লাহ্র হিম্মত ও কুদরত যে, তিনি সোনা-রূপা নির্দিষ্ট পরিমাণ তৈরী করেছেন এবং এতেই রয়েছে কল্যাণ। আর সে রহস্য এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়।

আল্লাহ্ বলেনঃ

    আর আমার নিকট যে সকল জিনিস সঞ্চিত রয়েছে, আমি উহা নির্দিষ্ট পরিমাণ অবতীর্ণ করে থাকি। 
(সূরা হজরঃ আয়াত ২১)

Post a Comment

0 Comments