মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে নবী করীম (সা:) এর উচ্চ মর্যাদা

        ইতোপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি, ব্যক্তির অনন্য অসাধারণ যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্ম সম্পাদন এবং ব্যাপক পরিধিতে দায়িত্ব পালন ইত্যাদির কারণেই ব্যক্তি মর্যাদার আসনে আসীন হয় এবং এটাই পৃথিবীতে প্রচলিত সাধারণ নিয়ম। অনন্য সাধারণ গুরুত্বের কারণে পৃথিবীতে কতিপয় স্থানও মানুষের কাছে মর্যাদাকর স্থান বলে বিবেচিত হয়। এসব স্থানে যাতায়াত করাও মানুষ আভিজাত্যের প্রতীক ও সম্মানজনক বলে মনে করে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাসমূহ, শাসকবৃন্দের বাসভবন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মিলনায়তন ও দ্রব্যাদি ক্রয়ের বিপনীসমূহ, অবকাশ যাপন কেন্দ্র, চিত্তবিনোদনের স্থানসমূহ, ব্যয়বহুল হোটেলসমূহ ইত্যাদি মানুষের কাছে বিশেষ মর্যাদাকর স্থান বলে বিবেচিত হয়।

        ব্যক্তির অবস্থান ভেদেও কতিপয় ব্যক্তি সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি বলে বিবেচিত। এসব ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলা, সান্নিধ্যে যাওয়া, সম্পর্ক রাখা ও একত্রে ছবি তোলাও সাধারণ মানুষ মর্যাদাকর কাজ বলে মনে করে। এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ধরনের বিষয় হলো, সম্মানিত ব্যক্তি ও মর্যাদাবান স্থান নির্বাচনে মানুষ মূখ্য ভূমিকা পালন করে এবং নির্বাচকদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটলে সম্মানিত ব্যক্তিকে আস্তা কুড়োয় নিক্ষেপ করে এবং মর্যাদাবান স্থানও নিকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়।

        কোনো ব্যক্তি বা স্থানকে মর্যাদা প্রদান করা না করার ক্ষেত্রেও মানুষ দ্বিধা-বিভক্ত এবং মনোনয়ন সিদ্ধান্তে ঐক্য থাকে না। যেমন প্রাকৃতিক আশ্চর্যজনক বিষয় বা স্থান নির্বাচনে মানুষের মধ্যে ব্যাপক মত-পার্থক্য রয়েছে, এ বিষয়টি সুরাহা করার জন্যে বর্তমানে অনলাইনে ভোটের ব্যবস্থা করে সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

        শিক্ষা, জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ কোনো ব্যক্তি বা স্থানকে যখন মর্যাদা দেয় তখন সাধারণ মানুষ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সে স্থান বা ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং এটাই সাধারণ মানুষের রীতি। মানুষের ক্ষেত্রে যদি এই রীতি-নীতি অনুসৃত হয়ে থাকে, তাহলে সকল বিষয়ে যিনি একক ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী এবং সমগ্র সৃষ্টিসমূহের যিনি স্রষ্টা ও প্রতিপালক এবং নিয়ন্ত্রক, সেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁরই সৃষ্টি কতিপয় ব্যক্তিবর্গ, স্থান ও সময়কে যখন সর্বাধিক মর্যাদাবান বলে ঘোষণা করেন, সেই মর্যাদার গুরুত্ব ও উচ্চতা কতটা বিশাল তা মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন্ ব্যক্তিকে সর্বাধিক মর্যাদা দিবেন এবং কোন্ স্থান ও সময়কে মর্যাদায় ভূষিত করবেন, এ ব্যাপারে নিরঙ্কুশ একক ক্ষমতা কেবলমাত্র তাঁরই। কতিপয় ব্যক্তিবর্গ, স্থান ও সময়কে মর্যাদাকর মনে করা এবং সম্মান প্রদর্শন করা মানুষের 'সৃষ্টিগত স্বভাব। আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের স্বভাব- প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কতিপয় ব্যক্তি, স্থান ও সময়কে সর্বাধিক সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে কতক স্থানকে বিশেষত্ব প্রদান করে সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।

        যেমন মক্কা ও মদীনা নগরীকে মহান আল্লাহ অনন্য সাধারণ বিশেষত্ব দিয়ে মর্যাদা প্রদান করেছেন। এ দু'টো স্থান সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে মহান মালিক আল্লাহ তা'য়ালা কর্তৃক সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত স্থান। আবার এ দু'টো স্থানের মধ্যেও এমন কতকগুলো বিশেষ স্থান রয়েছে, যেগুলো আরো অধিক মর্যাদা লাভ করেছে। যেমন এ দুটো স্থানের মসজিদ- মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববী। মক্কায় বায়তুল্লাহ্ শরীফ, এর সাথে সংশ্লিষ্ট হাজরে আসওয়াদ, এর দরজা যার নাম মুলতাজিম, বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের স্থান যার নাম হাতিম, মীজাবে রহমত অর্থাৎ বৃষ্টি বর্ষণকালে বায়তুল্লাহর ছাদ থেকে যে স্থান থেকে বৃষ্টির পানি ঝরে, পশ্চিম- দক্ষিণ কোণে রুকুনে ইয়ামানী, পূর্ব পাশে মাক্কামে ইবরাহীম, কা'বা শরীফের চার দিকে যে স্থান দিয়ে তাওয়াফ করা হয়, এর নাম মাতাফ এবং ফিলিস্তীনে অবস্থিত মসজিদুল আক্কসা।

        পবিত্র মদীনা নগরীর সম্মানিত এলাকা, মসজিদে নববী, পবিত্র রওজা মুবারক, রিয়াজুল জান্নাত, পবিত্র মিম্বার শরীফ, মসজিদে কুবা, জাবালে ওহ্রদ বা ওহুদ পাহাড়, দারুস সালামসহ ইত্যাদি স্থান। মহান মালিক আল্লাহ তা'য়ালা কয়েকটি দিন, কিছু সময় ও মাসকেও সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত করে বিশেষত্ব দান করেছেন। যেমন মাসের মধ্যে সর্বাধিক মার্যাদাবান মাস রামাদান, এই রামাদান মাসের শেষ দশদিনের মধ্যে নিহিত রয়েছে সেই কদরের রাত- যে রাতকে মহান আল্লাহ অগণিত রাতের তুলনায় সর্বাধিক মর্যাদা প্রদান করেছেন। পবিত্র জুমুয়ার দিন এবং এ জুমুয়ার দিনে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বিশেষ এক সময়কে। এ জুমুয়ার দিনে এমন কতক মুহূর্ত রয়েছে যখন দোয়া কবুল করা হয়ে থাকে। আশুরার দিন, হজ্বের মৌসুমে আরাফার দিন, যিলহজ্ব মাসের দশদিন এবং প্রতি রাতের তৃতীয়াংশ অর্থাৎ শেষ রাতের মর্যাদা অধিক। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাতের শেষ অংশে মহান আল্লাহ একান্ত অনুগ্রহ করে প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদের নানা সমস্যার কথা উল্লেখপূর্বক আহ্বান করে একমাত্র তাঁরই কাছে আবেদন জানাতে বলেন।

        মহান আল্লাহ যা কিছুই সৃষ্টি করেছেন, এ সকল সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষকেই তিনি সর্বাধিক মর্যাদা প্রদান করেছেন। আবার এ মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচিত নবীগণকে অধিক মর্যাদা দান করেছেন। নবীগণের মধ্য থেকে যাঁরা রাসূল নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের মর্যাদা আরো অধিক। আবার নবী-রাসূলদের মধ্য থেকে মহান আল্লাহ কতক নবী-রাসূলকে বিশেষত্ব প্রদানপূর্বক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন এবং আরবী ভাষায় যাঁদেরকে 'উলুল আযম' বলা হয়।

         নবী-রাসূলদের মধ্যে 'উলুল আযম' বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অধিকারীদের মধ্যে কেবলমাত্র নবী করীম (সা:) কে বিশেষত্ব প্রদানপূর্বক সর্বাধিক মর্যাদায় অলংকৃত করেছেন। আবার ঠিক এ কারণেই অন্যান্য নবী-রাসূলের অনুসারীদের তুলনায় নবী করীম (সা:) এর অনুসারী তথা মুসলিম মিল্লাতকে বিশেষত্ব দিয়ে মর্যাদা প্রদান করেছেন। আবার মানবজাতির প্রথম প্রজন্ম ও পরের প্রজন্মের মধ্যে মুসলিম মিল্লাতকে বিশেষ বৈশিষ্টের অধিকারী নির্বাচিত করেছেন। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلاً

        আমি অবশ্যই আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে আমি ওদের চলাচলের বাহন দিয়েছি এবং তাদের পবিত্র (জিনিসসমূহ দিয়ে) আমি রিস্ক দান করেছি, অতপর আমি অন্য যতো কিছু সৃষ্টি করেছি তার অধিকাংশের ওপরই আমি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল-৭০)

        আবার এ আদম সন্তান তথা মানুষের মধ্যে নবী হিসাবে নির্বাচিত করে যাঁদেরকে নবুয়‍্যাত দান করা হয়েছে, তাঁদের মর্যাদা মানুষদের মধ্যে সর্বাধিক। হযরত ইবরাহীম (আ:) এর প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

        অত:পর আমি তাকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকুব (এর মতো দুই জন সুপুত্র); এদের সবাইকেই আমি সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলাম, (এদের) আগে আমি নূহকেও হিদায়াতের পথ দেখিয়েছি, অতঃপর তার বংশের মাঝে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইফসুফ, মূসা এবং হারুনকেও (আমি হিদায়াত দান করেছি); আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা এবং ইলইয়াসকেও (আমি সঠিক পথ দেখিয়েছিলাম); এরা সবাই ছিলো নেককারদের দলভুক্ত। (আরো পথ দেখিয়েছিলাম) ইসমাঈল, ইয়াসা, ইউনুস এবং ধৃতকেও; এদের সবাইকে আমি (নবুয়্যাত দিয়ে) সৃষ্টিকুলের ওপর বিশেষ মর্যাদা দান করেছি। (সূরা আল আনয়াম-৮৪-৮৬)

        অপরদিকে নবীদের মধ্যেও কতক নবীকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী বানানো হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّنَ عَلَى بَعْضٍ -

        আমি একেকজন নবীকে একেকজনের ওপর মর্যাদা দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল-৫৫)

        বিশেষভাবে রাসূল মনোনীত করা প্রসঙ্গে মহান মালিক আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلاً وَمِنَ النَّاسِ طَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيْعُم بَصِيرٌج 

        আল্লাহ তা'য়ালা (তাঁর ওহী বহন করার জন্যে) ফিরিশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক মনোনীত করেন, মানুষদের ভেতর থেকেও তিনি রাসূল মনোনীত করেন। অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও সবকিছু দেখেন।         (সূরা হজ্ব-৭৫)

        রাসূলদের মধ্যেও একের ওপর আরেকজনকে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِّنْهُم مَّنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ درجات ط

        এই (যে) নবী-রাসূলরা (রয়েছে), এদের কাউকে কারো ওপর আমি বেশি মর্যাদা দান করেছি। এদের মধ্যে এমনও (কেউ) ছিলো যাদের সাথে আল্লাহ তা'য়ালা কথা বলেছেন এবং (এর মাধ্যমে) কারো মার্যাদা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন।         (সূরা বাকারা-২৫৩)

        সকল নবী-রাসূলের মধ্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী করীম (সা:) কে অনন্য বৈশিষ্ট প্রদানপূর্বক সর্বাধিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। মহান মালিক আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের মর্যাদা আলোচনা করা অত্যন্ত কঠিন বিষয়। বিশেষ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষের পক্ষে তা নিতান্তই দূরহ বিষয়। তবে পবিত্র কুরআন-হাদীসে এ সম্পর্কে যতোটুকু আলোচনা করা হয়েছে, তার কিছু অংশ আমরা এ গ্রন্থে তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।

Post a Comment

0 Comments