শেষ নবী-রাসূলই বিশ্বনবী (সা:)

 


        নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাপরিক্রমায় মহান আল্লাহ তা'য়ালা এ পৃথিবীতে সবশেষে প্রেরণ করলেন নবী করীম (সা:) কে। অন্যান্য নবী-রাসূলকে আল্লাহ তা'য়ালা যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, সেই একই দায়িত্ব তাঁর প্রতি অর্পণ করা হলেও এ দায়িত্বের গুরুত্ব ও পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। নবী-রাসূল হিসাবে দায়িত্বের গুরুত্ব ও পরিধির ব্যাপকতার কারণে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁদের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য করেছেন। এ কথা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِّنْهُم مَّنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ درجات ط

        এই (যে) নবী-রাসূলরা (রয়েছে), এদের কাউকে কারো ওপর আমি বেশি মর্যাদা দান করেছি। এদের মধ্যে এমনও (কেউ) ছিলো যাদের সাথে আল্লাহ তা'য়ালা কথা বলেছেন' এবং (এর মাধ্যমে) কারো মার্যাদা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা বাকারা-২৫৩)

        গুরু দায়িত্ব অর্পণ এবং দায়িত্বের পরিধি বিস্তৃত করা হয় সর্বাধিক যোগ্যতম ব্যক্তির প্রতি- এটাই সাধারণ নিয়ম। মর্যাদাও আবর্তিত হয় যোগ্যতা ও দায়িত্বের পরিসরকে কেন্দ্র করে। প্রেরিত অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের দায়িত্বের পরিধি ছিলো সীমাবদ্ধ তথা সসীম। নবী করীম (সা:) এর পূর্বে প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসূলই দেশ, জাতি, সমাজ, এলাকা ও গোত্রভিত্তিক দায়িত্ব লাভ করে সেভাবেই দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে জাতি ও গোত্রগত এবং ভৌগলিক পরিধি অতিক্রম করার অনুমতি তাঁদেরকে দেয়া হয়নি। কিন্তু সমগ্র পৃথিবী এবং সৃষ্টিকুলের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে শুধুমাত্র নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি এবং তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব সর্বাধিক এবং পরিধিও অত্যন্ত ব্যাপক। তাঁর সম্মানিত দায়িত্বের পরিধি সম্পর্কে দায়িত্ব অর্পণকারী মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعًا الَّذِي لَهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ج لا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِ وَيُمِيتُ ص

        (হে মুহাম্মাদ স.), আপনি বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল (হিসাবে এসেছি), আল্লাহ তা'য়ালা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র মালিক, তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তিনিই জীবন দান করেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান। (সূরা আল আ'রাফ-১৫৮)

        আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র মালিক, যাঁর হাতে জীবন ও মৃত্যুর বাগডোর এবং যিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, তিনিই যাঁকে নবী-রাসূল হিসাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন, তিনি তাঁর দায়িত্বের পরিধিও জানিয়ে দিলেন। বিশেষ জনপদের অধিবাসী, জনগোষ্ঠী, গোত্র বা সম্প্রদায়ের লোকদেরকে তিনি আহ্বান জানাতে বললেন না যে, 'আমি শুধু তোমাদেরই জন্য নবী-রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি' বরং মহান মালিক তাঁকে বলতে বললেন, 'আপনি মানুষদেরকে জানিয়ে দিন, 'আমি তোমাদের সকলের জন্য নবী-রাসূল হিসাবে আগমন করেছি'। কথা অত্যন্ত স্পষ্ট, নবী করীম (সা:) সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্য প্রেরিত হয়েছেন এবং তাঁর দায়িত্বের পরিধি বিশ্বব্যাপী। আকাশমণ্ডলী, নদী, সমুদ্র অগাধ জলধী, ঘনারোণ্য, বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর, বিপদশঙ্কুল পাহাড়-পর্বত এবং মাটির অতল তলদেশেও যদি কোনো মানুষ অবস্থান করে, সেই মানুষটির জন্যেও তিনিই একমাত্র নবী-রাসূল এবং তাঁর সম্মানিত দায়িত্বের পরিধি ঐ পর্যন্তও বিস্তৃত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

        আমি আপনাকে মানুষদের জন্যে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি, আর সাক্ষী হিসাবে তো আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা নিসা-৭৯)

        নবী করীম (সা:) কে মহান আল্লাহ মহুমাত্রিক বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। এর মধ্যে দু'টো বিশেষণ হলো তিনি সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী। সমগ্র মানবমণ্ডলীকে তিনি যেমন সুসংবাদ দান করেছেন তেমনি শান্তি শৃঙ্খলার বিপরীত পথে চললে ধ্বংস গহ্বরে নিমজ্জিত হতে হবে এ সম্পর্কে সতর্কও করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা সমগ্র মানবজাতির কাছে তাঁর মর্যাদাবান পরিচিতি এভাবে তুলে ধরেছেন-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا -

        (হে নবী!) আমি আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্যে (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। (সূরা আস সাবা-২৮)

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَّنَذِيرًا لَا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنه وَسِرَاجًا مُنِيرًا -

        হে নবী। আমি আপনাকে (হিদায়াতের) সাক্ষী (করে) পাঠিয়েছি, (আপনাকে) বানিয়েছি (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারী, আল্লাহর অনুমতিক্রমে আপনি হচ্ছেন আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও (হিদায়াতের) সুস্পষ্ট প্রদীপ। (সূরা আল আহযাব-৪৫-৪৬)

إِنْ أَنْتَ إِلَّا نَذِيرٌ - إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًاط وَإِنْ مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فيهَا نَذِيرٌ -

        (আসলে) আপনি তো (জাহান্নামের) একজন সতর্ককারী বৈ আর কিছুই নন। অবশ্যই আমি আপনাকে সত্য জীবন ব্যবস্থাসহ একজন সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কখনো কোনো উম্মত এমন ছিলো না, যাদের জন্যে কোনো (না কোনো একজন) সতর্ককারী অতিবাহিত হয়নি। (সূরা ফাতির-২৩-২৪)

        সমগ্র সৃষ্টির জন্যে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে করুণার মূর্ত প্রতীক হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

        (হে নবী!) আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্যে রহমত বানিয়েই পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৭)

        তাঁর প্রতি অসীম মর্যাদার প্রতীক হিসাবে এমন এক মহান গ্রন্থ আল্লাহ তা'য়ালা অবতীর্ণ করেছেন, যে গ্রন্থ কিয়ামত পর্যন্ত সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য মানবজাতিকে দেখিয়ে দিবে- 

تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا -

        কতো মহান তিনি, যিনি তাঁর বান্দার ওপর (সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী এই) 'ফুরকান' অবতীর্ণ করেছেন, যাতে করে (তিনি এর মাধ্যমে) সৃষ্টিকুলের জন্যে সতর্ককারী হতে পারেন। (সূরা ফুরকান-১)

        উক্ত মর্যাদাবান গ্রন্থ সমগ্র মানবমণ্ডলীকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে মহাসত্যের আলোয় আলোকিত পথের ওপর এনে দাঁড় করাবে-

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِلا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ لَا

        (এ কুরআন এমন) এক গ্রন্থ, যা আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে আপনি (এর দ্বারা) মানুষদের তাদের মালিকের আদেশক্রমে (মূর্খতার) অন্ধকার থেকে (মহাসত্যের) আলোতে বের করে আনতে পারেন- তাঁর পথে, যিনি মহাপরাক্রমশালী ও যাবতীয় প্রশংসা পাবার যোগ্য। 
(সূরা ইবরাহীম-১)

        নবী করীম (সা:) এর নবুয়‍্যাত শতাব্দী, স্থান, কাল বা কোনো জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর নবুয়‍্যাত বিশ্বজনীন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের কর্তব্য রেসালাতে নববীর প্রতি আস্থা স্থাপন পূর্বক অনুসরণ করা। এ সম্পর্কে নবী করীম (সা:) স্বয়ং ঘোষণা করেছেন, 'হযরত জাবির (রা:) বর্ণনা করেন রাসূল (সা:) বলেছেন, প্রত্যেক নবী নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জন্যে বিশেষভাবে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু আমি সকল মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি'। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)

        তিনিই বিশ্বনবী এবং তাঁর মর্যাদাবান এ দায়িত্বের পরিধি সৃষ্টি জগতের সকল সীমা অতিক্রম করে পরকালীন জগতে জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত। ইন্তেকালের পরে মানুষ যখন কবর তথা আলমে বরযাখে প্রবেশ করবে তখন প্রথম প্রহরেই নবী করীম (সা:) কে দেখিয়ে বা তাঁর পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। এ প্রশ্নের যথাযথ জবাবের ওপর নির্ভর করবে উপস্থিত মুহূর্ত থেকে পরবর্তী স্তরসমূহ অতিক্রম করা সহজ হবে না কঠিন হবে। হাশরের ময়দানে মুসিবতের দিনে এবং হাউজে কাওসার থেকে শীতল সুস্বাদু পানি পান করিয়ে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছানো- সকল স্তরেই নবী করীম (সা:) অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।

        মর্যাদাগত, ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে আমরা নবী করীম (সা:) এর পবিত্র নাম মোবারকের পূর্বে 'বিশ্বনবী' বিশেষণটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু পকৃতপক্ষে এ বিশেষণটির মাধ্যমে তাঁর উচ্চ মর্যাদার শত সহস্র ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করা যায় না। অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের তুলনায় নবী করীম (সা:) এর মর্যাদা সর্বাধিক আর ঠিক এ কারণেই তাঁর দায়িত্বের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। অন্যান্য নবীর মিশন জারি রাখার জন্যে তাদের উম্মতদের মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচিত করা হয়নি। কিন্তু মুসলমানদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে নবী করীম (সা:) এর মর্যাদার কারণে।

        অন্য কোনো নবী-রাসূলের অনুসারীদেরকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে, তাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের নবী-রাসূলের আদর্শিক মিশন সমগ্র দুনিয়াব্যাপী সম্মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ব্যতিক্রম শুধু মুসলিম মিল্লাত। পবিত্র কুরআনে এ মুসলিম মিল্লাতকে 'মধ্যমপন্থা' অবলম্বনকারী মিল্লাত হিসাবে পরিচিতি দিয়ে নবী করীম (সা:) এর মিশনকে সম্মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তাঁর অতুলনীয় মর্যাদা ও তাঁর পরে দ্বিতীয় কোনো নবী-রাসূল পাঠানো হবে না এবং অতুলনীয় মর্যাদা সমুন্নত বা প্রতিষ্ঠিত রাখার লক্ষ্যেই আল্লাহ তা'য়ালা মুসলিম মিল্লাতের প্রতি এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments