নবী-রাসূলের সর্বপ্রধান কর্তব্য কি

 


        পৃথিবীতে নবী ও রাসূল প্রেরণ করা হয় পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ও সহজ-সরল পথ প্রদর্শনের লক্ষ্যে। তাদের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে পৃথিবীর মানুষকে সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়ে তাঁরই গোলামীর দিকে আহ্বান করা। একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালাকেই সকল শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করা, তাঁকেই প্রতিপালক হিসেবে মান্য করা, একমাত্র তাঁকেই নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের অধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াই হলো মানুষের কর্তব্য, এই কর্তব্য পালনের দিকেই মানুষকে আহ্বান করাই হলো পৃথিবীতে নবী-রাসূলের প্রধান দায়িত্ব। এই দায়িত্বই সকল নবী-রাসূল পালন করেছেন।

        প্রত্যেক নবীই তাঁর নিজের জাতিকে ভুলে যাওয়া পাঠ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে তাঁরা শিক্ষা দেন, দাসত্ব করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর। নবী-রাসূল তাঁর অনুসারীকে মূর্তি পূজা এবং শিরক থেকে হেফাজত করেন। সমাজে প্রচলিত মহান আল্লাহর অপছন্দনীয় প্রথা থেকে তাদেরকে বিরত রাখেন। তাঁর পছন্দনীয় পন্থায় জীবন যাপন করার পদ্ধতি শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর আইন প্রচলিত করে তা মেনে চলার জন্য উপদেশ দেন।

        পৃথিবীর এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে মহান আল্লাহ নবী প্রেরণ করেননি। প্রত্যেক নবীর প্রচারিত আদর্শ ছিল ইসলাম। তবে স্থান কাল পাত্রভেদে প্রত্যেক নবীর শিক্ষা পদ্ধতি এবং আইন-কানুনে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নবীগণ তাদের জাতির ভেতরে যেসব মূর্খতা অজ্ঞানতা কুসংস্কার এবং অনাচার প্রচলিত ছিল, সেগুলোর মূল উৎপাটনের ব্যাপারে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন। যে সব ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনা জাতিকে গ্রাস করেছিল, তা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তাঁরা সংগ্রাম করেছেন।

        জ্ঞান- বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে জাতি যখন প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করছিল তখন নবীগণ তাদেরকে আইন-কানুন দান করেছিলেন। তারপর ক্রমশঃ জাতি উন্নতির পথে এগিয়ে গিয়েছে, সেই সাথে তাঁরা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা ও আইন-কানুনও ব্যাপকভাবে দান করেছেন। মোট কথা নবী-রাসূল মানুষকে আল্লাহর গোলামে পরিণত করার জন্য ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। নবী করীম (সা:) ইন্তেকালের মাত্র কয়েক মিনিট পূর্বেও মানুষকে নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

        নবী করীম (সা:) এর এই কাজ কোনো নতুন কাজ নয়। এ কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বললেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُوْنِ

        আমি আপনার পূর্বে এমন কোনো নবী পাঠাইনি যার কাছে ওহী পাঠিয়ে আমি একথা বলিনি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং তোমরা সবাই আমারই দাসত্ব করো। (সূরা আম্বিয়া-২৫)

        পৃথিবীতে যারা নিজেদেরকে মনিব মনে করে সাধারণ মানুষকে নিজেদের দাস বানিয়ে রেখেছে, নিজেদের তৈরী আদর্শ, মতবাদ, আইন-কানুনের বেড়াজালে বন্দী করে রেখেছে, তাদেরকে যেন সাধারণ মানুষ অস্বীকার করে এই অনুপ্রেরণা মানুষের মধ্যে জাগ্রত করা এবং তাদেরকে সংগ্রাম মুখর করে গড়ে তোলাও নবীর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের কাছে ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন-

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ جِ

        আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি, যাতে করে (তাদের কাছে সে বলতে পারে,) তোমরা এক আল্লাহ তা'য়ালার দাসত্ব করো এবং তাঁর প্রতি বিদ্রোহী শক্তিসমূহকে বর্জন করো। (সূরা আন্ নাহল-৩৬)

        মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে জীবন বিধান রচনা করেছেন নবী-রাসূল তা মানুষের কাছে পৌছে দেবেন। এ দায়িত্ব পালন করেন নবীগণ এবং এটাই মহান আল্লাহর নিয়ম।তাঁর নিয়মের অধীনেই তাঁর আইন-কানুন মানুষের কাছে পৌঁছেছে। আল্লাহ তা'য়ালার নিয়ম হলো তিনি অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকেই একজনকে নবী হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং তাঁর কাছে ফেরেশতার মাধ্যমে জীবন বিধান প্রেরণ করেন। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁরা তাদের সমগ্র জীবনব্যাপী এই কঠিন দায়িত্ব পালন করে যান। এ দায়িত্ব পালনে তাঁরা সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন করেন না। মুহূর্তের জন্য তাঁরা ভুলে যান না কোন্ দায়িত্বসহ তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী করীম (সা:) কে আহ্বান করে বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ طَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رسالته ط

        হে রাসূল! যা কিছু আপনার ওপর অবর্তীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি (অন্যের কাছে) পৌঁছে দিন, যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি তো (মানুষদের কাছে) তাঁর বার্তা পৌঁছে দিলেন না! (সূরা আল মায়েদাহ-৬৭)

         নবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁরা সাধারণ মানুষকে ঐ পথের দিকেই আহ্বান জানাবেন, যে পথকে আল্লাহ তা'য়ালা সিরাতুল মুস্তাকিম নামে অভিহিত করেছেন। এই পথের পরিচয় নবীগণ মানুষকে জানাবেন, এ পথে চলতে সাহায্য করবেন, মানুষ যেন এ পথে অগ্রসর হয়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছতে পারে সেভাবে তিনি সহযোগিতা করবেন। সাধারণ মানুষ আল্লাহর পরিচয় জানে না। সত্য মিথ্যার পার্থক্য তাঁরা বোঝে না। কোনটি কল্যাণের আর কোনটি অকল্যাণের পথ তা মানুষ জানে না। মানুষকে এসব ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দান করবেন নবীগণ। মানুষ যেন নির্ভুলভাবে সহজ সরল পথে চলতে পারে এ কারণেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবীদের কাছে ওহী অবতীর্ণ করেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা ওহী প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন-

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِ لَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ لا

        (এ কুরআন এমন) এক গ্রন্থ যা আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে আপনি (এর দ্বারা) মানুষদের তাদের মালিকের আদেশক্রমে (মূর্খতার) অন্ধকার থেকে (মহাসত্যের) আলোতে বের করে আনতে পারেন, তাঁর পথে- যিনি মহাপরাক্রমশালী ও যাবতীয় প্রশংসা পাবার যোগ্য। (সূরা ইবরাহীম-১)

        উল্লেখিত আয়াতে মহান আল্লাহ নবী ও ওহী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। নবী করীম (সা:) কে প্রেরণ সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا لَا وَّدَاعِيًا إِلَى الله بإذنه وَسِرَاجًا مُنِيرًا -

        হে নবী! আমি আপনাকে (হিদায়াতের) সাক্ষী (করে) পাঠিয়েছি, (আপনাকে) বানিয়েছি (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) সতর্ককারী, আল্লাহর অনুমতিক্রমে আপনি হচ্ছেন আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও (হিদায়াতের) সুস্পষ্ট প্রদীপ।         (সূরা আল আহযাব-৪৫-৪৬)

        নবী দায়িত্ব লাভের পরে মানুষকে সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য বুঝিয়ে দিবেন। যারা নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামের পতাকাতলে শামিল হয়েছে, তাদেরকে তিনি পরকালে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবেন এবং যারা ইসলামের বিরোধিতা করেছে, ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদেরকে তিনি পরকালে জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করবেন। তিনি আল্লাহ তা'য়ালার আদেশেই মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান জানাবেন। তিনি নবুয়‍্যাতের আলো দিয়ে মূর্খতার সকল অন্ধকার দূরীভূত করবেন। মূর্খতার অন্ধকার বিদায় করে তাওহীদের জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বলিত করবেন। তাঁরাই হবেন একমাত্র অনুসরণযোগ্য নেতা। মহান আল্লাহ তাদেরকে যেমন উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন তেমনিভাবে তাঁরা হলেন পবিত্র। সুতরাং তাঁরাই হলেন মানবজাতির পথ প্রদর্শক এবং একমাত্র আদর্শ নেতা। প্রশ্নাতীতভাবে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তাদেরকেই অনুসরণ করতে হবে। এই নেতৃত্ব মানুষকে পরকাল সম্পর্কে অবহিত করবেন। পৃথিবীতে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে- এ সম্পর্কে মানুষকে অবগত করার দায়িত্ব নবী-রাসূলগণ পালন করেছেন।

        আদালতে আখেরাতে বিচারের পরে যে সকল মানুষকে জাহান্নামের দিকে নেয়া হবে তখন জাহান্নামের দ্বাররক্ষী প্রশ্ন করবে-

        যেসব লোক কুফুরী করেছে তাদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নেয়া হবে; এমনি (তাড়া খেয়ে) যখন তারা জাহান্নামের কাছে পৌঁছুবে তখন (সাথে সাথেই) তার (সদর) দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তার রক্ষী (ফিরিশতারা) ওদের বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্যে থেকে কোনো রাসূল আসেনি, যারা তোমাদের কাছে তোমাদের মালিকের (কিতাবের) আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করতো এবং তোমাদের এমনি একটি দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সতর্ক করে দিতো? (সূরা যুমার-৭১)

        মানুষের সকল কাজের হিসাব মহান আল্লাহর কাছে পেশ করতে হবে, এ কথা মানুষকে জানানোর দায়িত্ব নবী-রাসূলের। কারণ আদালতে আখেরাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে প্রশ্ন করবেন-

يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ يَقُصُّوْنَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا ط

        (আল্লাহ তা'য়ালা সেদিন আরো বলবেন, হে জ্বিন ও মানুষ সম্প্রদায় (বলো,) তোমাদের কাছে কি তোমাদেরই মধ্য থেকে আমার (এমন এমন) সব রাসূল আসেনি, যারা আমার আয়াতগুলো তোমাদের কাছে বর্ণনা করতো, (উপরন্তু) যারা তোমাদের ভয় দেখাতো যে, তোমাদের আজকের এ দিনের সম্মুখীন হতে হবে? (সূরা আনয়াম-১৩০)

        নবীগণ মানুষকে তাঁর আসল গন্তব্যের দিকে অগ্রসর করাবেন। মানুষকে জানাবেন, এই পৃথিবী তোমাদের চিরস্থায়ী বাসস্থান নয়, পরকালের জীবনই হলো প্রকৃত জীবন এবং সে জীবন হলো অনন্তকালের। সুতরাং ঐ অনন্তকালে যেন তোমরা সুখে শান্তিতে থাকতে পারো, সে পাথেয় এই পৃথিবী থেকেই তোমাদেরকে সংগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ নবী- রাসূল মানুষকে জড়বাদ আর নাস্তিক্যবাদী বস্তুবাদ থেকে সরিয়ে নৈতিকতাবাদীতে পরিণত করবেন আর এটাই ছিলো নবী-রাসূলের সর্বপ্রধান দায়িত্ব।

Post a Comment

0 Comments