আপাততঃ দৃষ্টিতে হোদায়বিয়ার সন্ধিপত্র কুরাইশদের স্বার্থের অনুকূলেই সম্পাদিত হয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু দূরদৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এর ফল ছিল সর্বতোভাবে মুসলিম স্বার্থের অনুকূলে এবং অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআন এই সন্ধিকে Evident Victory বা শ্রেষ্ঠ বিজয় হিসাবে উল্লেখ করেছে। এই সন্ধির (Treaty) ফলেই মুসলমানগণ একটি স্বাধীন সার্বভৌম শক্তিরূপে লিখিতভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এই সন্ধির (Treaty) ফলেই ইসলাম চারদিকে বিজয়ী শক্তিরূপে আত্ম প্রকাশ করেছিল। ইসলামের সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব অনুভব করতে পেরে আরবের জনগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিল। নবুওয়াত লাভের পর থেকে গত ১৯ বছরের অসীম ত্যাগ আর সাধনার পরে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১৪০০-তে। কিন্তু Treaty of Hudaybiah বা হোদায়বিয়ার সন্ধির মাত্র দুই বছর পরে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০,০০০-এ।
এ সম্পর্কে ইবনে হিশাম বলেছেন, The result of this treaty is that whereas Muhammad (sm) went forth to Hudaybiah with only 1,400 men, he was followed two years later, in the attack on Makkah, by ten thousand.
অর্থাৎ 'মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে ১৪০০ শত লোক নিয়ে হোদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র দুই বছর পরে ১০,০০০ হাজার লোক নিয়ে মক্কায় অভিযান করেন।'
এই সন্ধির ফলে খোজায়া সম্প্রদায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সন্ধি করে কুরাইশরা নিজেরাই নিজেদের জালে বন্দী হয়। তাদের শক্তি দিন দিন ক্ষয় হতে থাকে। আল্লাহর নবীর জীবনী রচয়িতা ইমাম যুহরী বলেন, There was no man of sense and judgment amongst the idolators who not led thereby to join Islam.
অর্থাৎ 'পৌত্তলিকদের মধ্যে এমন কোন বিবেচক ব্যক্তি ছিল না যে, সে ইসলামের ছায়াতলে আসতে প্রলুব্ধ হয়নি।'
পাশ্চাত্বের ঐতিহাসিকগণ হোদায়বিয়া সন্ধিকে Land mark অর্থাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে অভিহিত করেছে।
'ইসলামের কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকেই মুসলিম এবং অমুসলিমগণ একত্রে মিলেমিশে থাকতো না এবং চলতোও না। এই সন্ধি স্থাপনের ফলে তাদের ভেতর থেকে সমস্ত বাধা দূরিভূত হয়েছিল। উভয় পক্ষ মক্কা-মদীনায় যাতায়াত করতে পারতো। মক্কার অমুসলিমগণ মদীনায় এসে মাসের পরে মাস অবস্থান করতো। মদীনায় তারা নিজেদের বাড়ির পরিবেশেই অবস্থান করতো। ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে তাঁরা মুসলমানদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতো।
মক্কায় তাঁরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে ইসলামকে একটি মতাদর্শ হিসাবেই পেয়েছিল। কিন্তু মদীনায় সেই ইসলামকেই জীবন্ত আদর্শ হিসাবে পেয়ে তারা মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করতো। মদীনা থেকে মুসলমানগণ মক্কায় গমন করতো। মুসলমানদের চরিত্রে ইসলামের জীবন্ত রূপ প্ররিস্ফুটিত হতে দেখে বিবেকবান মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হত। এতদিন যারা ছিল অন্ধকারে, হোদায়বিয়ার সন্ধি তাদের সামনে মহাসত্যের আলোক শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিল। আলো দেখে পঙ্গপাল যেমন আলোর দিকে তীব্রবেগে ছুটে এসে আত্মহুতি দান করে, হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের আলোর দিকে তীব্রবেগে ছুটে এসে মহাসত্যের কাছে আত্মহুতি দান করছিল। তারা নতুন জীবন লাভে ধন্য হচ্ছিল।
সমস্ত ঐতিহাসিক একবাক্যে স্বীকার করেছেন, এই সন্ধির পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত যত সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল, ইতোপূর্বে গত ১৯ বছরে তা গ্রহণ করেনি। সন্ধি চুক্তিতে একটি শর্ত ছিল, কোন মুসলমান পুরুষ মক্কা থেকে মদীনায় আশ্রয় গ্রহণ করলে, তাকে মক্কায় ফেরৎ পাঠাতে হবে। সেখানে কোন মহিলার কথা উল্লেখ ছিল না।
এ সময় মহান আল্লাহ তাঁর নবী এবং মুসলমানদেরকে কোরআন অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন, 'যেসব মহিলা ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় আসবে তাদেরকে তোমরা কাফিরদের কাছে ফেরৎ দিও না। কোন কাফির নারী মুসলিম পুরুষের জন্য বৈধ নয় এবং কোন কাফির পুরুষ কোন মুসলিম নারীর জন্য বৈধ নয়। কাফির পুরুষগণ তাঁর মুসলিম স্ত্রীর জন্য যা খরচ করেছে, তোমরা তাদেরকে তা প্রদান করো। তারপর সেসব নারীর সাথে তোমরা মোহর আদায় করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারো। কোন কাফির মহিলাকে তোমরা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ রেখো না।'
মুসলিম নারীদের মধ্যে হযরত উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা (যিনি পরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী হবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন) মদীনায় চলে এলেন। তাঁকে ফেরৎ নেয়ার জন্য তাঁর দুই ভাই এসে আল্লাহর নবীর কাছে দাবী করলেন, তাদের বোনকে ফেরৎ দেয়ার জন্য। তিনি ফেরৎ দিতে অস্বীকার করলেন। কারণ চুক্তিতে কোন নারীকে ফেরৎ দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল না। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যাঁদের স্ত্রী অমুসলিম অবস্থায় মক্কায় ছিল, তাঁরা তাদের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুসলিম নারীকে গ্রহণ করলেন। মুসলিম নারীগণ তাদের কাফির স্বামীকে ত্যাগ করলেন।
যেসব মুসলমান বাধ্য হয়ে মক্কায় অবস্থান করতেন, তাঁরা মদীনায় আসতে শুরু করলেন। তাঁরা ছিলেন মক্কার কুরাইশ কর্তৃক অত্যাচারিত। হযরত আবু বাসির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু পালিয়ে মদীনায় এলেন। তাঁকে ফেরৎ নেয়ার জন্য মক্কা থেকে লোক চলে এলো। আল্লাহর নবী চুক্তি মোতাবেক তাঁকে আদেশ করলেন, 'তোমাকে ফিরে যেতে হবে।' হযরত বাসির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু রাসূলের কাছে আবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে তাদের কাছে পুনরায় যেতে বলেন, যারা আমাকে ইসলাম বিরোধী কাজ করতে বাধ্য করবে?' আল্লাহর নবী তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার একটি ব্যবস্থা করে দেবেন।'
হযরত বাসির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু মক্কার লোক দু'জনের সাথে ফিরে চললেন। পথিমধ্যে কৌশলে তাদের একজনকে তিনি হত্যা করে পুনরায় রাসূলের কাছে ফিরে এলেন। ইতোমধ্যে মক্কার দু'জনের মধ্যে যে লোকটি জীবিত ছিল, সেও ফিরে এসে রাসূলকে তার সাথীকে হত্যার সংবাদ জানালেন। হযরত বাসির আল্লাহর নবীকে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল। চুক্তি মোতাবেক আপনি আমাকে ফেরৎ পাঠিয়েছেন। এখন আর এ ব্যাপারে আপনার কোন দায়-দায়িত্ব নেই।'
এরপর হযরত বাসির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আর মদীনায় অবস্থান করলেন না। তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বাস করতে লাগলেন। মক্কার অত্যাচারিত মুসলমানগণ যখন জানতে পারলেন, তাদের যাবার মত একটি স্থান হয়েছে, তখন তাঁরা মক্কা থেকে পালিয়ে হযরত বাসির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা ঈস নামক স্থানে চলে আসতে লাগলেন। এভাবে সেখানে মুসলমানদের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল।
মক্কা থেকে যেসব ব্যবসায়ী কাফেলা সিরিয়া যেতো এবং কুরাইশদের যেসব বাণিজ্য বহর সিরিয়া থেকে আসতো, ঈস নামক এলাকার জনগোষ্ঠী তাদের ওপরে আক্রমন করে সমস্ত সম্পদ ছিনিয়ে নিত। এভাবে তাঁরা গণীমতের সম্পদ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। মক্কার ইসলাম বিরোধিরা এবার সত্যই প্রমাদ গুনলো। এ ব্যাপারে তারা আল্লাহর নবীকেও দায়ী করতে পারছে না, অথচ তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- সহ্যও করতে পারছে না। তখন তারা বাধ্য হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর একটি বিহিত করার জন্য এলো।
আল্লাহর নবীর কাছে তারা আবেদন করলো, চুক্তি থেকে এই কথাগুলো বাদ দিতে হবে, 'মক্কার কোন লোক তাঁর অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মদীনায় আশ্রয় গ্রহণ করলে তাকে মক্কার কুরাইশদের কাছে প্রত্যার্পণ করতে হবে। কিন্তু মদীনার কোন মুসলিম মক্কায় চলে এলে তাকে প্রত্যার্পণ করা হবে না। প্রথম থেকেই যে সমস্ত মুসলমান মক্কায় বাস করছে, তাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না এবং মক্কায় যারা থেকে যেতে চায় তাদেরকে বাধা দেয়া যাবে না।'
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ কথা গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি ঈস নামক এলাকার মুসলমানদেরকে লিখে জানালেন, তোমরা এবার মদীনায় এসে বসবাস করতে পারো। হযরত বাসির যে সময় আল্লাহর নবীর নির্দেশ পেলেন তখন তিনি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। নবীর প্রেরীত পত্র পাঠ করে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর একক প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফলে ইসলাম বড় উপকৃত হয়েছিল। হযরত আবু জান্দাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর নামাযে জানাযা আদায় করে এই অকুতোভয় সাহসী সৈনিককে কবরে রেখে আল্লাহর নবীর কাছে সকলকে নিয়ে মদীনায় এলেন। এবার কুরাইশরাও নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসার পথে যাতায়াত করার সুযোগ পেলো। হোদায়বিয়ার সন্ধি এভাবেই মুসলমানদের ভাগ্য খুলে দিয়েছিল।
হোদায়বিয়ার সন্ধির কারণে আরবের অন্যান্য গোত্রের ইসলাম বিরোধিরা একটি দৃষ্টি ভঙ্গী নিয়ে অপেক্ষা করছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আদর্শিক কারণে মক্কার কুরাইশদের ওপরে বিজয়ী হতে পারেন তাহলে তারাও ইসলাম গ্রহণ করবে। কুরাইশদের ওপরে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত তাদের ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা ছিল কুরাইশরা। তখন ইয়াহুদীদের সমস্ত শক্তির কেন্দ্র ছিল খায়বর। এই সন্ধির তিন মাসের মধ্যে খায়বর মুসলমানদের পদতলে এলো। ইয়াহুদীদের সমস্ত শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। বিশাল এলাকা মুসলমানদের পদতলে এসে গেল।
ইয়াহুদীদের সাথে যারা জোট গঠন করেছিল তারা এখন মুসলিম জোটভুক্ত হলো। সে সময় মক্কার কুরাইশরা যেন সম্পূর্ণ একা বা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হলো। মাত্র দুই বছরের ভেতরে গোটা আরব ভূ-খন্ডে শক্তির ভারসাম্য এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেল যে, ইসলাম বিরোধিদের আর সামান্যতম শক্তি অবশিষ্ট রইলো না।
0 Comments