নবী-রাসূলদের মর্যাদা কেমন

        নবী ও রাসূল এ দু'টো শব্দই আরবী এবং শব্দ দু'টোর অর্থও পৃথক। নবী শব্দের অর্থ সম্পর্কে অভিধানবিদগণের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। কেউ কেউ 'নবী' শব্দটিকে আরবী 'নাবা' শব্দ থেকে গঠিত বলেছেন এবং এর অর্থ করেছেন 'সংবাদ'। কেউ কেউ বলেছেন, আরবী 'নাবুউ' ধাতু থেকে 'নবী' শব্দের উৎপত্তি এবং অর্থ হচ্ছে 'উন্নতি ও উচ্চতা'। এ অর্থের দিক থেকে এর মানে হয় 'উন্নত মর্যাদা' ও 'সুউচ্চ অবস্থান'। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মূলত শব্দটি 'নাবী' শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং এর অর্থ 'পথ'। আর তাদেরকে এ জন্যে 'নবী' বলা হয়েছে যে, তাঁরা হচ্ছেন মানুষের সাথে মহান আল্লাহর সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়ার পথ বা তাঁরা হলেন মহান মালিক আল্লাহ তা'য়ালার দিকে যাবার পথ।

        আরবী 'রাসূল' শব্দের অর্থ 'প্রেরিত'। এ অর্থের দিক থেকে আরবী ভাষায় দূত, পয়গম্বর, বার্তাবাহক ও রাষ্ট্রের দূতের জন্যেও এ 'রাসূল' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর পবিত্র কুরআনে এ শব্দটি এমনসব ফিরিশতার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে যাদেরকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় অথবা এমন সব উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মানুষকে 'রাসূল' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে যাদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের কাছে নিজের বাণী পৌঁছানোর জন্য নিযুক্ত করেছেন।

        পবিত্র কুরআনে সাধারণত এ শব্দ দু'টি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে দেখা যায়, একই ব্যক্তিকে কোথাও শুধু নবী বলা হয়েছে এবং কোথাও বা শুধু রাসূল বলা হয়েছে। অথবা কোথাও নবী-রাসূল একই সাথে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো স্থানে রাসূল ও নবী শব্দ দুটো এমনভাবেও ব্যবহৃত হয়েছে যা থেকে অনুভব করা যায়, এ উভয়ের মধ্যে মর্যাদা বা কাজের ধরনের দিক দিয়ে কোনো পারিভাষিক পার্থক্য রয়েছে। সূরা হজ্জ-এর ৫২ নং আয়াতে নবী ও রাসূল শব্দ দুটি পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

        সূরা হজ্জ-এর উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে নবী ও রাসূল শব্দ দু'টির পার্থক্যের ধরন কি তা নিয়ে কুরআন ব্যাখ্যাতাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কেউই চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে নবী ও রাসূল-এর মধ্যে পৃথক মর্যাদা চিহ্নিত করতে পারেননি। গবেষকগণ শুধু এ নিশ্চয়তা সহকারে বলেছেন, রাসূল শব্দটি নবী শব্দের তুলনায় বিশিষ্টতাসম্পন্ন। অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূল নবী হন কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল হন না। অর্থাৎ নবীদের মধ্যে রাসূল শব্দটি এমন সব নবীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে যাদেরকে সাধারণ নবীদের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো।

        ইতোপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি, মর্যাদা নিরুপণ হয় জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি, উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মের কারণে। নবুয়‍্যাত পূর্ব জীবনে নবী-রাসূলের চিন্তাধারা, নৈতিক চরিত্র ও বাস্তব জীবনধারা ছিলো সর্বোচ্চ মানের। কারণ হঠাৎ করেই কোনো মানুষকে নবী-রাসূল হিসাবে মনোনীত করা হয় না। রূহের জগতেই ফায়সালা হয়ে যায় আল্লাহ তা'য়ালা কোন্ ব্যক্তিকে নবী হিসাবে মনোনীত করবেন। যেমন হযরত জাকারিয়া (আ:) কে আল্লাহ তা'য়ালা জানিয়েছিলেন-

يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَمِنِ اسْمُه يَحْى لا لَمْ نَجْعَل لَّهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا - 

        হে জাকারিয়া, আমি তোমাকে একটি ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহ্ইয়া, এর পূর্বে এ নামে আমি কোনো মানুষের নামকরণ করিনি। (সূরা মারইয়াম-৭)

        কোনো দিক থেকে ত্রুটি সম্পন্ন কোনো মানুষকে মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবী-রাসূল নির্বাচিত করেননি। নবী-রাসূল নির্বাচিত হয়েছেন এমন ধরনের মানুষ যারা চেহারা, সুরত, ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার দিক দিয়ে হয়েছেন সর্বোত্তম, যাদের ভেতর বাইরের প্রতিটি দিক অন্তর ও দৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছে। কোনো নবী-রাসূলকে এমন কোনো দোষ সহকারে পাঠানো হয়নি যে কারণে তিনি লোকদের মধ্যে হাস্যাস্পদ হন অথবা লোকজন তাকে হেয়-প্রতিপন্ন করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, হযরত মূসা (আ:) তো তোতলা ছিলেন।

        এ প্রশ্নের জবাবে আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, হযরত মূসা (আ:) এর নামে প্রচলিত এ কথাটি কুরআন-হাদীসের নয়। ইয়াহুদী খৃষ্টানদের রচিত বাইবেল ও তালমুদ থেকে এ কথাটি গ্রহণ করা হয়েছে। বাইবেলের যাত্রা পুস্তকে ৪: ১০- মূসা (আ:) এর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, 'হায় সদাপ্রভু! আমি বাকপটু নহি, ইহার পূর্বেও ছিলাম না, বা এই দাসের সহিত তোমার আলাপ করিবার পরেও নহি। কারণ আমি জড়মুখ ও জড় জিহ্বা'। তালমুদে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, শৈশবে হযরত মূসা যখন ফিরআউনের গৃহে লালিত পালিত হচ্ছিলেন তখন একদিন তিনি ফিরআউনের মাথার মুকুট নামিয়ে নিজের মাথায় পরেন। এতে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, এ শিশুটি এই কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে না এটি শিশুর শিশুসুলভ চপলতা। এ প্রশ্নের মীমাংসা করা হয় এভাবে যে, শিশুর সম্মুখে স্বর্ণ ও আগুন রাখা হবে। সিদ্ধান্ত অনুসারে তাই রাখা হলো। শিশু মূসা আগুন উঠিয়ে মুখে দিলেন। এতে তাঁর জিহ্বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হলো এবং তিনি তোতলা হয়ে গেলেন।

        এই কাহিনী বাইবেল ও তালমুদ থেকে কুরআনের কতিপয় তাফসীরে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি এ কথা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। কারণ শিশু যদি আগুনেও হাত দেয় তাহলে সে আগুন উঠিয়ে মুখে দেয়া তার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ আগুনের তাপ বা দহন জ্বালা অনুভব করার সাথে সাথেই তো শিশু তা ফেলে দিবে অথবা হাত সরিয়ে নিবে।

        কুরআনের বর্ণনা থেকে আমরা স্পষ্ট অনুভব করতে পারি যে, হযরত মূসা (আ:) নবুয়‍্যাত লাভের পরে দাওয়াতী কাজের লক্ষ্যে যে ধরনের বাগ্মীতার প্রয়োজন তা মূসা (আ:) নিজের মধ্যে অভাব অনুভব করছিলেন। অর্থাৎ তিনি প্রথম দিকে বাকপটু ছিলেন না। ইতোপূর্বে তিনি কখনো বক্তৃতা দেননি আর বিষয়টি ফিরআউনের জানা ছিলো, কেননা তিনি ফিরআউনের ঘরেই প্রতিপালিত হয়েছিলেন। বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস যাদের নেই, তারা বক্তৃতা দিতে গেলে স্বভাবসুলভ সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যেই তিনি মানুষকে আল্লাহর দ্বীন বুঝানোর মতো শব্দ চয়ন করে মূল বিষয়টি বোধগম্য ভাষায় পরিবেশন করার যোগ্যতা আল্লাহর কাছে চেয়েছিলেন।

        হযরত হারুন (আ:) ছিলেন বাকপটু, এ কারণে তিনি হযরত হারুন (আ:) কে নিজের সহযোগী হিসাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। পরবর্তীতে হযরত মূসা (আ:) এর এ দুর্বলতা দূর হয়ে গিয়েছিলো। হযরত মূসা (আঃ) কে আল্লাহ কত উচ্চে মর্যাদা দিয়েছিলেন যে, মূসা (আ:) যেনো পৃথিবীর আলো বাতাসে আসতে না পারেন এ জন্যে ফিরআউন অগণিত গর্ভবতী নারীকে হত্যা করেছিলো। অসংখ্য সদ্যজাত শিশু সন্তানকে হত্যা করেছিলো। নিজের রাষ্ট্র ক্ষমতা নিরাপদ করার উদ্দেশ্যেই ফিরআউন এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। শিশু মূসাকে দেখার সাথে সাথে তো তাঁকে হত্যা করার কথা।

        কিন্তু মহান আল্লাহ ফিরআউনসহ অন্যান্য সকলের মনে হযরত মূসার প্রতি গভীর মমতা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে আল্লাহ তা'য়ালা কি বিশাল মর্যাদা দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁকে জানিয়ে দিলেন, তুমি আমার দৃষ্টির সম্মুখেই ছিলে। মহান আল্লাহর রহমতের দৃষ্টির সম্মুখে থাকা যে কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার তা কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةٌ مِّنِّي جِ وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي 

        হে মূসা, আমি আমার পক্ষ থেকে ফিরআউন ও অন্য মানুষদের মনে তোমার জন্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিলাম, যেনো তুমি আমার চোখের সামনেই বড় হতে পারো।     (সূরা ত্বাহা-৩৯)

        হযরত ইউসুফ (আ:) কৈশরে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা নিজ পিতা হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর কাছে বর্ণনা করার পর তিনি নিজ সন্তানকে বলেছিলেন-

وَكَذَالِكَ يَحْتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ - 

        এমনি করেই তোমার মালিক তোমাকে (নবুয়‍্যাতের জন্যে) মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা (সহ দুনিয়ার জ্ঞান) শিক্ষা দিবেন।         (সূরা ইউসুফ-৬)

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা হযরত ইউসুফ (আ:) কে এভাবে উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। হযরত ইয়াহইয়া (আ:) এর প্রশংসা করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-

        (ইয়াহইয়া যখন বড় হলো, তখন আমি তাকে বললাম) হে ইয়াহইয়া, আমার কিতাবকে তুমি শক্তভাবে ধারণ করো, প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে ছেলে বেলায়ই বিচার বুদ্ধি দান করেছিলাম। সে আমার একান্ত কাছ থেকেই হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা লাভ করলো, সে ছিলো আসলেই একজন পরহেযগার ব্যক্তি। তদুপরি সে ছিলো পিতা-মাতার একান্ত অনুগত, কখনো অবাধ্য ও নাফরমান ছিলো না। তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হয়েছিলো যেদিন তাকে জন্ম দেয়া হয়েছে, (শান্তি বর্ষিত হবে সেদিন) যেদিন সে মৃত্যুবরণ করবে এবং যেদিন পুনরায় সে জীবিত হয়ে পুনরুত্থিত হবে। (সূরা মারইয়াম-১২-১৫)

        প্রত্যেক নবী-রাসূলই মহান আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তবে তাদের মর্যাদার ধরণ ছিলো পৃথক। হযরত ঈসা (আ:) কে আল্লাহ তা'য়ালা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই কথা বলার মর্যাদাসহ অন্যান্য মর্যাদা দান করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হবার পর লোকজন যখন নানা ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করেছিলো তখন তিনি উপস্থিত লোকদের বলেছিলেন-

        আমি আল্লাহ তা'য়ালার বান্দাহ, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেনো তিনি আমাকে তাঁর অনুগ্রহভাজন করবেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন আমি জীবিত থাকি ততদিন যেন আমি নামাজ প্রতিষ্ঠা করি এবং যাকাত প্রদান করি। আমি যেন মায়ের প্রতি অনুগত থাকি, আল্লাহর শোকর, তিনি আমাকে নাফরমান করে পয়দা করেননি। আমার ওপর শাস্তি, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, শাস্তি সেদিন যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো। (সূরা মারইয়াম-৩০-৩৩)

        হযরত ইবরাহীম (আ:) কে আল্লাহ তা'য়ালা উচ্চ মর্যাদা দান করে তাঁকে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হিসাবে ঘোষণা করেছেন-

هُوَ اخْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ طَ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ طَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ لا

        তিনি (পৃথিবীর নেতৃত্বের জন্যে) তোমাদেরই মনোনীত করেছেন এবং (এ) জীবন বিধানের ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো সঙ্কীর্ণতা রাখেননি, (তোমরা প্রতিষ্ঠিত থেকো) তোমাদের (জাতির) পিতা ইবরাহীমের দ্বীনের ওপর; সে আগেই তোমাদের 'মুসলিম' নাম রেখেছিলো। (সূরা হজ্জ-৭৮) 

        মহান মালিক আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ:) এর প্রশংসা করে বলেছেন-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ طَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَّبِيًّا -

        এই কিতাবে তুমি ইবরাহীমকে স্মরণ করো, অবশ্যই সে ছিলো এক সত্যবাদী নবী।

 (সূরা মারইয়াম-৪১)

وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَه مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ

        আমি পূর্বেই ইবরাহীমকে ভালোমন্দ বিচারের জ্ঞান দান করেছিলাম এবং আমি সে সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম।         (সূরা আম্বিয়া-৫১)

        তাঁর পিতা ছিলেন নমরুদ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সরকার, দেশের জনগণ ও নিজ পিতাকে পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত দেখে তিনি পিতাকে বলেছিলেন-

يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا -

        হে আমার পিতা, আমার কাছে (আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে) যে জ্ঞান এসেছে তা তোমার কাছে আসেনি, অতএব তুমি আমার কথা শোনো, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাবো। (সূরা মারইয়াম-৪৩)

        হযরত লূত (আ:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-

        (ইবরাহীমের মতো) আমি ধৃতকেও প্রজ্ঞা দান করেছিলাম, তাকেও আমি এমন একটি জনপদ থেকে উদ্ধার করে এনেছি যার অধিবাসীরা অশ্লীল কাজ করতো; সত্যিই তারা ছিলো জঘন্য বদ ও গোনাহগার জাতি, আর আমি তাকে আমার অনুগ্রহভাজন করেছি, সে ছিলো একজন সৎকর্মশীল।

  (সূরা আম্বিয়া-৭৪-৭৫)

        হযরত ইসহাক (আ:) ও হযরত ইয়াকুব (আ:) সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-

وَكُلًّا جَعَلْنَا نَبِيًّا وَوَهَبْنَا لَهُم مِّنْ رَّحْمَتِنَا وَجَعَلْنَا لَهُمْ لِسَانَ صِدْقٍ عَلِيَّاعِ 

        এদের সবাইকে আমি নবী বানিয়েছি। আমি তাদের ওপর আমার আরো বহু অনুগ্রহ দান করেছি এবং মানুষদের মধ্যে আমি তাদের সুউচ্চ সম্মানও দান করেছি। (সূরা মারইয়াম-৪৯-৫০)

        হযরত ইসমাঈল (আ:) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ وَ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُوْلًا نَّبِيًّاج وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَوةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِنْدَ رَبِّهَ مَرْضِيًّا

        এ কিতাবে তুমি ইসমাঈলের কথাও স্মরণ করো, নিশ্চয়ই সে ছিলো যথার্থ প্রতিশ্রুতি পালনকারী, আর সে ছিলো রাসূল ও নবী। সে তার আপনজনদের নামাজ প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় করার আদেশ দিতো, সে ছিলো তার মালিকের (আল্লাহর) একান্ত পছন্দনীয় ব্যক্তি। (সূরা মারইয়াম-৫৪-৫৫)

        হযরত ইদরীস (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِدْرِيسَ رَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَّبِيًّا قِ لا وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا -

         তুমি এ কিতাবে ইদরীসের কথাও স্মরণ করো, সেও ছিলো একজন সত্যবাদী নবী। আমি তাকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করেছিলাম। (সূরা মারইয়াম-৫৬-৫৭)

وَوَهَبْنَا لِدَاوُودَ سُلَيْمَانَ طَ نِعْمَ الْعَبْدُ طَ إِنَّهُ أَوَّابٌ

        আমি দাউদকে ছেলে হিসাবে সুলাইমানকে দান করেছি, সে ছিলো আমার উত্তম একজন বান্দা, সে অবশ্যই ছিলো তার মালিকের প্রতি নিষ্ঠাবান। (সূরা ছোয়াদ-৩০)

وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا الْكِفْلِ ط كُلٌّ مِّنَ الصَّابِرِينَ جِ وَأَدْخَلْنَاهُمْ فِي رَحْمَتِنَا ط إِنَّهُم مِّنَ الصَّالِحِينَ

        ইসমাঈল, ইদরীস ও যুলকিফল, এরা সবাই আমার ধৈর্যশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। আমি তাদের আমার রহমতের মধ্যে দাখিল করলাম, কারণ তারা ছিলো নেককার মানুষদের দলভুক্ত। 
(সূরা আম্বিয়া-৮৫-৮৬)

وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّنَ عَلَى بَعْضٍ

        আমি একেকজন নবীকে একেকজনের ওপর মর্যাদা দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল-৫৫)

        নবী-রাসূলদের অসীম মর্যাদা দিয়েছেন আল্লাহ তা'য়ালা। তাদের সাথে বিরোধিতা বা তাদের কথা অমান্য করা অথবা তাদের সাথে কোনো প্রকার বেয়াদবি করা মহান আল্লাহর সাথে বিরোধিতা করার শামিল বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে-

وَمَنْ يُشَاقِقِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

        আর যারাই এভাবে আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, তাদের জানা উচিত আল্লাহ তাদের কঠোর আযাব দিবেন। (সূরা আনফাল-১৩)

          নবী-রাসূলদের আল্লাহ তা'য়ালা এত উচ্চে মর্যাদা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয় তাদের প্রতি প্রেরিত নবী-রাসূলের মাধ্যমে। একটি জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেয়া হবে অথবা তাদেরকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হবে, তা নির্ধারণ করার জন্যই নবী-রাসূল প্রেরণ করা হয়। জাতি যদি তাদের প্রতি প্রেরিত নবী- রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে, তাহলে সে জাতিকে আল্লাহ তা'য়ালা উন্নতি সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিবেন এবং তাদের জীবনের প্রত্যেক স্তরে বিরাজ করবে শান্তি। অমুসলিম দুনিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সর্বত্র অশান্তির দাবানলে জ্বলতে জ্বলতে জীবনকে নিজেদের জন্যে এক দুর্বিষহ বোঝা মনে করছে, আর এ জন্যেই তারা 'স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার' এর জন্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে।

        জাতি যদি নবীর শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় তাহলে তাদের জীবনে নেমে আসবে অশান্তির দাবানল। জাতি যদি নবীর সাথে ইনসাফ করে অর্থাৎ নবীর আনুগত্য করে, তাহলে সে জাতি আল্লাহ তা'য়ালার কাছ থেকে ইনসাফ লাভের অধিকারী হয়ে যায় এবং মহান আল্লাহ সে জাতির প্রতি ইনসাফ করেন। আর জাতি যদি নবী বা নবীর আনিত আদর্শের সাথে ইনসাফ না করে তাহলে তাদের ভাগ্যে অশান্তিই নির্ধারিত হয়। এর সবথেকে বড় প্রমাণ হলো বর্তমানে মুসলিম মিল্লাত। পৃথিবীতে প্রচুর অর্থবিত্ত, সম্পদ ও জনশক্তির অধিকারী হয়েও এরা আজ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপমানিত, অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত।

        কারণ মুসলিম মিল্লাতের ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে নবী করীম (সা:) এর মর্যাদার সাথে। তিনি যে আদর্শ উপহার দিয়েছেন, সেই আদর্শের প্রতি যতদিন মুসলিম মিল্লাত সম্মান প্রদর্শন করে তা অনুসরণ করেছে, ততদিন এ মিল্লাত পৃথিবীতে মর্যাদার আসনে আসীন ছিলো। যখনই তারা এ আদর্শের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেছে, তখনই তাদের ললাটের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্মম নির্যাতন আর নিষ্পেষন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন- 

         প্রত্যেক উম্মতের জন্যেই একজন রাসূল আছে, অতপর যখনি তাদের কাছে তাদের রাসূল এসে যায়, তখন সিদ্ধান্ত করার কাজটি ইনসাফের সাথে সম্পন্ন হয়ে যায়, তাদের ওপর কখনো যুলুম করা হবে না। (সূরা ইউনুস-৪৭)

        মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিম মিল্লাতের ভাগ্যে যে ইনসাফের বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, তাহলো মুসলিম মিল্লাত যদি নবী করীম (সা:) এর আদর্শ অনুসরণ করে তাহলে তাদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে মর্যাদার সুউচ্চ আসন। আর যদি তারা এ আদর্শের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে তাহলে তাদের জন্যে রয়েছে দাসত্বের জীবন। আর এটাই হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইনসাফ, এ ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের প্রতি সামান্যতম যুলুম করা হয়নি এবং আগামীতেও হবে না।

        ইতিহাস কথা বলে, যে জাতির প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং প্রেরিত নবী-রাসূলের মর্যাদাগত কারণে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী সেই একই ইনসাফ করেছেন। যে জাতি নবী-রাসূলের প্রতি ইনসাফ করেনি, তারা অভিশাপগ্রস্ত হয়েছে আর যারা ইনসাফ করেছে তারা মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments