আল্লাহ চতুষ্পদ প্রাণীকে কিভাবে সৃষ্টি করেছে

আল্লাহ্ বলেনঃ

وَ الْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوا هَا وَزِينَةً .

        'আল্লাহ্' ঘোড়া, খচ্চর আর গাভীও সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তার উপর সওয়ার হও আর সেগুলি তোমাদের সৌন্দর্যের জন্যও।

(সূরা নাহলঃ আয়াত নং-৮)

        আল্লাহ্ চতুষ্পদ প্রাণী সৃষ্টি করে মানুষের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। এগুলি মানুষের খুব কাজে আসে। এগুলির দৈহিক গঠন এমন যে, না বেশী শক্ত, যাতে আমরা সহজেই সেগুলি কাজে লাগাতে পারি। আল্লাহ্ এগুলির গোস্ত, হাড়, শিরা, চামড়া প্রভৃতি খুব মজবুত করে তৈরী করেছেন। যাতে আমরা সেগুলিকে যানবাহনের কাজে ব্যবহার করতে পারি। তাদের সারা দেহ সংরক্ষণের জন্য চামড়াগুলি খুব মজবুত করে সৃষ্টি করেছেন। ফলে বাইরের চাপ ও আঘাত থেকে গোস্ত রক্ষা পায়। এই পশুগুলিকে কান ও চক্ষু দিয়েছেন, যাতে মানুষ তাদের দ্বারা পূর্ণভাবে কাজ নিতে পারে। যদি এসব প্রাণীর চোখ, কান না থাকতো তবে এগুলির দ্বারা কাজ নেওয়া কষ্টকর হতো। আবার এগুলিকে জ্ঞান-বুদ্ধিও তেমন বেশী দেওয়া হয় নাই, যাতে সেগুলি মানুষের অনুগত আর বাধ্যগত থাকে। যদি এদের জ্ঞান-বুদ্ধি বেশী থাকতো তবে হালচাষ করতে, ভারী বোঝা বহনে, চাকা ঘুরানো প্রভৃতি কষ্টকর কাজ করতে অবাধ্য হতো আর তাদের বশে রাখা যেত না।

        আল্লাহ্ খুব ভাল জানেন যে, মানুষের এসব কাজের প্রয়োজন হবে অথচ এগুলি মানুষের শক্তির বাইরে। আল্লাহ্ যদি এসব কাজের জন্য মানুষকে বাধ্য করতেন, তার ফল হতো এই যে, এক দিকে মানুষের পক্ষে এসব কাজ হতো দুঃসাধ্য, অন্যদিকে এসব কাজ করতে গিয়ে তার সব শক্তি যেত নিঃশেষ হয়ে, ফলে জ্ঞান, বিদ্যা অর্জন, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য লাভ, পদমর্যাদা উন্নয়ন ও পূর্ণতা অর্জন, যেগুলি মানুষের বৈশিষ্ট্য আর যার জন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা ও সম্মানিত সেসব থেকে মানুষ বঞ্চিত হতো। এমনকি মানুষ তার নিজের জন্য সম্মানজনক উপায়ে নিজের রুজী রোজগার করতে একেবারে অসহায় হয়ে পড়তো। সুতরাং পশুকে এভাবে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ মানুষের প্রতি অপার করুণা আর অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন, যা সব কাজে লাগানো যায় আর কোন কাজে সে অবাধ্য হয় না।

        প্রাণী ও পশুগুলির শ্রেণীবিভাগ আর সেগুলির প্রয়োজনীয়তা এবং কাজের উপযোগিতার বিষয়, দৃষ্টান্তস্বরূপ মানুষই দেখ না কেন। আল্লাহ্ মানুষকে জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। শিল্প কাজের দক্ষতা ও শক্তি দান করেছেন। আর তাদের জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার তাকিদে কাপড় তৈরী, গৃহাদি নির্মাণ ও লোহার কাজ প্রভৃতি করাও তার প্রয়োজন। এসব কাজের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, উদ্ভাবনী শক্তি মস্তিষ্ক আর মননশক্তি দান করেছেন।

        শরীরের গঠন ও কাঠামোতেও এসব কাজের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। হাতে আংগুলী আর পাঞ্জা সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে সে কোনো জিনিস ধরতে পারে। আর শিল্প কাজ ও অন্যান্য কাজ করার সময় হাতিয়ার ঠিকভাবে ধরে তা' ব্যবহার করতে পারে। যে সব জন্তু মাংস আহার করে সেগুলির সৃষ্টিনৈপুণ্য লক্ষ্য কর। তাদেরকে শিকার করার আর তা' ধরার পূর্ণ শক্তি ও উপযোগিতা দান করেছেন। সেগুলির হাত পায়ে ধারালো নখ আর পাঞ্জা সৃষ্টি করেছেন, যাতে সুযোগমতো শিকার ধরে কাবু করতে পারে। তারপর তা চিরে-ফেড়ে নিজের আহার সংস্থান করতে পারে।

        তৃণভোজী পশুগুলির প্রতি লক্ষ্য কর। কতগুলি পশুর পা এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছে যে, কঠিন জমিনের উপর আহারের সন্ধানে চলাফেরার সময় জমির বন্ধুরতা আর কাঁকর প্রভৃতির ঘর্ষণ থেকে যাতে রক্ষা পায়। আর পাথুরে মাটি পা ক্ষত-বিক্ষত না করে। এমনি কোনো কোনো পশুর খুর গোল আর গর্ত বিশিষ্ট করা হয়েছে, যাতে সে জমিনে উত্তমরূপে ভর করতে পারে। আর সওয়ারী বা বোঝা বহনের সময় পা দৃঢ়ভাবে রাখতে পারে।

        মাংসভোজী জন্তুগুলির গঠনের প্রতি লক্ষ্য কর। তার দাঁত আর মাড়ি কিরূপ তীক্ষ্ম আর ধারালো করে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। আর তার মুখের ব্যাদান কত বড় করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাকে যে হাতিয়ার দান করেছেন তার সাহায্যে নিজের অন্য শিকার করতে পারে। এর বিপরীত যদি তৃণভোজী প্রাণীর থাবা আর ধারালো দাঁত হতো আর ধারালো মাড়ি হতো তবে তা হতো একেবারেই বেকার। কেননা তার না শিকার করতে হয় না তার গোস্ত খাওয়ার প্রয়োজন যে, সে সব ধারালো জিনিসের সাহায্য নেবে। তেমনি যদি মাংসাশী পশুর তৃণভোজী পশুর ন্যায় চামড়া ওয়ালা চোয়াল হতো, যা ঘাস খাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয়, তবে তাদের জীবনে ভারী অসুবিধা সৃষ্টি হতো আর তার পক্ষে শিকার করে খাওয়া সম্ভব হতো না।

        সুতরাং এবার চিন্তা করে দেখ, আল্লাহ্ প্রত্যেক প্রাণীকে তার প্রয়োজন মাফিক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শক্তি আর শারীরিক গঠন দান করেছেন। এবার চতুষ্পদ প্রাণীর শাবকগুলির প্রতি লক্ষ্য কর। তারা জন্ম হওয়ার পরই মায়ের সাথে সাথে চলাফেরা করে। মানব শিশুর মতো তাদের লালন পালনের দরকার হয় না এবং কোলে কাঁখে নিয়েও ফিরতে হয় না। এ কারণে মানব শিশু লালন পালনে মা- বাপের যে যত্নাদি ও শিক্ষার প্রয়োজন পশুর বেলায় সে জ্ঞান বুদ্ধির প্রয়োজন নেই আর মানুষের কাজে অন্য যে হাত আর অংগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে পশুদের জন্য তারও দরকার নেই। পশুর বাচ্চাদের জন্মের পর স্বাধীনভাবে চলাফেরার শক্তি আল্লাহ্ দান করেছেন। নিজ নিজ শক্তিতেই তাদের মায়েদের সাথে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়েই জন্মে।

        পাখীর মধ্যে মুরগী, তিত প্রভৃতি পাখীর বাচ্চাগুলি দেখ, তারা ডিম থেকে ফুটবার সাথে সাথেই দানা, খুদ প্রভৃতি খুটে খেতে শুরু করে। আর যে বাচ্চা দুর্বল হয় আর মায়ের সাথে সাথে দানা প্রভৃতি খেতে অক্ষম, যেমন কবুতরের বাচ্চা প্রভৃতি, তাদের মাকে আল্লাহ্ তাদের প্রতি এতটা মেহেরবানী করেছেন যে, তারা নিজেরা সন্তানগুলিকে খাইয়ে পেট ভরায়। নিজের মুখে চিবিয়ে বাচ্চাগুলিকে খাওয়ায়। যতদিন বাচ্চাগুলি নিজেরা চলে ফিরে দানা প্রভৃতি খেতে না পারে ততদিন এভাবেই তাদের খাওয়ান চলতে থাকে। আল্লাহ্ এভাবে প্রত্যেক প্রাণীর ভিতরেই সন্তানের প্রতি কম বেশী মমতা দান করেছেন।

        চতুষ্পদ প্রাণীর পাগুলি দেখ! চলাফেরা আর দৌড়ের সময় কি ভাবে তারা সম্মুখের আর পিছনের পা পরস্পর জমিনে ফেলে, যাতে সে টিকে থাকতে পারে। জমিনের পশুগুলি তাদের পা দ্বারা যে কাজ করে পানির জীবগুলো তাদের দেহের অংশ বিশেষ দ্বারা সে কাজ করে থাকে। দু'পা ওয়ালা জীব চলার সময় যখন এ পা তুলে তখন অন্য পায়ের সাহায্যে মাটির উপর টিকে থাকে; তেমনি চতুষ্পদ বিশিষ্ট প্রাণী চলার সময় যখন দু'পা আগে বাড়ায় তখন পিছের দুপায়ের সাহায্যে টিকে থাকে। আর তা তোলার রীতি হচ্ছে এই যে, সামনের পায়ের যেখানা তুলে পিছনের দিক থেকে তার বিপরীত দিকের একখানা তুলে কেননা একই সময় যদি আগে পিছের এক দিকের পা উঠায় তবে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। যেমন চৌকি প্রভৃতি এক দিকে দুপায়ের উপর টিকে থাকতে পারে না। এমন যদি পশু একবার সামনে দু'পা তোলে আর একবার পিছের দু'পা তাতে চলার ব্যতিক্রম ঘটবে আর যানবাহনের কাজ সুষ্ঠু ভাবে চলবে না। এ কারণে আল্লাহ্ তাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন যে, সামনের দিকের ডান পায়ের সাথে পিছনের বাম পা তুলবে। তাতে সামনে পিছনের বিপরীত পায়ের উপর শরীরের ভার ন্যস্ত থাকবে। তাতে সে সহজে এবং স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে। গাধা বোঝা বহন আর চাক্কি ঘুরানোর কাজে আসে। ঘোড়া দ্বারা কেউ এ কাজ নেয় না। আবার উট যদি বেয়াড়া হয় তবে কয়েকজন মিলেও তাকে কাবু করতে পারে না আর যখন তা বাধ্য থাকে তখন ছোট বালকের হাতে লাগাম দিয়ে দাও, সে পিছে পিছে চলে আসবে। অবাধ্য বলদের গর্দানে গরম লোহা দ্বারা দাগ না লাগান পর্যন্ত সে কাবুতে আসবে না। এর পরই তাকে হালে জুড়ে জমি চাষ করান যাবে। ঘোড়া দ্বারা বহনের কাজ হয় এবং যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রাদি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে খাটান হয়। ছাগলের পাল একটি ছোট বালকও মাঠে নিয়ে চরায় আবার যখন তা চারদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তাদের একত্র করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এমনি সব পশুরই এক অবস্থা অর্থাৎ তাদেরকে আল্লাহ্ ততটা জ্ঞান ও চেতনা দান করেছেন যাতে মানুষের সেবার বেলায় তারা কোনো প্রতিবন্ধক না হয। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি তেমন থাকলে কখনো তারা মানুষের বাধ্যগত হতো না, তা যতোই চেষ্টা সাধ্য করতো না কেন।

        হিংস্র জন্তুগুলির বেলায়ও তাই। যদি তাদের জ্ঞান বুদ্ধি তেমনি থাকতো তবে অহরহ মানুষের প্রতি হামলা করতো। তাদের ঠেকাতে মানুষের খুবই বেগ পেতে হতো। বিশেষ করে যখন সেগুলি ক্ষুধার তাড়নায় ঘুরে বেড়াতো তখন মানুষের পক্ষে বাইরে বের হওয়া দুঃসাধ্য হতো। এ কারণে তাদের শক্তি ও সামর্থ্য বেশী দিলেও জ্ঞান থেকে বঞ্চিত রেখেছেন আর তাদের অন্তরে মানুষের ভীতি দান করে মানুষের প্রতি খুবই দয়া করেছেন।

        কুকুর দেখ। তাও এক প্রকার হিংস্র প্রাণী; তা মানুষের কত অনুগত হয়ে থাকে। মনিবের ঘর পাহারা দেয়, মনিবের জন্য তারা রাত জেগে থাকে, এমনিক প্রাণ দেয়। প্রতিটি আশংকা আর ভয়ের ক্ষেত্রে মালিককে তারা ঘেউ ঘেউ শব্দে সজাগ করে রাখে। মালিক সজাগ সচেতন হয়ে সাবধান সতর্ক হয়ে নিজেকে আশংকা আর বিপদ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। কুকুরের কি ধৈর্য, কয়েক বেলাও না খেয়ে কাটাতে পারে। কিন্তু নিজ মালিককে ছেড়ে যাওয়া পছন্দ করে না। মালিক তার প্রতি যতোই জুলুম করুক বা মারুক পিটুক তা' সত্ত্বেও সে মালিককে ছেড়ে যায় না। মানুষের উপকারের জন্য আল্লাহ্ কুকুরের মধ্যে এসব গুণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। শিকারের বেলায় কুকুর খুবই কাজে আসে। শিকারকে দাঁত আর নখ দ্বারা মনিবের জন্য আটকে রাখে। মানুষের উপকারের জন্য খোদা কুকুরের মধ্যে এসব গুণ দিয়েছেন।

        দেখ চতুষ্পদ প্রাণীর পিঠ আল্লাহ্ কিরূপ সমতল আর চার পায়ের উপর দৃঢ়ভাবে তৈরী করেছেন, যাতে যানবাহনের ক্ষেত্রে সওয়ারী বা মালপত্র গড়িয়ে পড়ে না যায়।

        পশুর যোনীদেশ পশ্চাৎ দিকে খোলা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পুরুষ পশু সহজে সংগম করতে পারে। যদি মানুষের ন্যায় ভিতর দিকে যোনী-হতো তবে পশুর পক্ষে সঙ্গম করা অসম্ভব হতো। পশু সংগমের বেলায় সামনা সামনি হয়ে আসে না। যেমন মানুষের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যদিও হস্তিনীর যোনী ভিতরের দিকে কিন্তু তা সংগমের সময় বাইরে নিয়ে আসে যাতে পুরুষ হস্তী সহজে সংগম করতে পারে।

        পশুর যোনীদেশ আল্লাহ্ এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন সেই হিসাবে তাদের কতগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যও দান করেছেন, যাতে তাদের সংগম কাজ সহজ আর তাদের বংশধারা অব্যাহত থাকে।

        পশুর দেহ কিভাবে পশম দ্বারা আবৃত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে তারা শীততাপ থেকে রক্ষা পায়। পা গুলিতে দৃঢ় খুর আর নখ সৃষ্ট করা হয়েছে, যাতে সুদূর বন্ধুর পথে চলার সময় পা ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে যায়।

        পশুগুলিকে জ্ঞান, বুদ্ধি, হাত, অঙ্গুলি, প্রভৃতি দান করা হয়নি, যেগুলি তার কাজে আসতে পারতো, কিন্তু আল্লাহ্ তাকে সে অভাব মোচন করে দিয়ে তার অসুবিধা লাঘব করেছেন। তার পোশাক, পরিচ্ছদ তার দেহের সংগেই সৃষ্টি করেছেন যা কখনো খোলা বা পরিধান করার প্রয়োজন নেই, আর নেই পরিবর্তন করার ঝামেলা। মানুষের বেলায় এর বিপরীত-আল্লাহ্ তাকে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন, দিয়েছেন হাত পা যা দ্বারা সে তার সব কাজ সমাধা করতে পারে। এ কারণে তার কাজ কর্মও তেমনি। তার মধ্যে ভাল মন্দের প্রেরণা দিয়েছেন, তবে ভালোর চেয়ে মন্দের প্রবণতা অধিক। মানুষের মধ্যে এমন গুণ ও যোগ্যতা সৃষ্টি করেছেন যাতে সে ধ্বংস আর বিপদ হতে রক্ষা পেতে পারে।

        মানুষকে আল্লাহ্ সকল প্রাণী ও সৃষ্টির মধ্যে সম্মানিত ও সেরা করেছেন। তাকে বহু কল্যাণ ও অনুগ্রহে ধন্য করেছেন। তার মধ্যে রুচি ও পছন্দ দান করেছেন। বস্ত্র ও পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে যেটি তার রুচি মাফিক সেটি সে পরিধান করে, যেটি যখন ইচ্ছা পরিবর্তন করে। এবাবে সে নিজেকে সুন্দর হতে সুন্দরতর করে সাজাতে পারে। তারপর পারে অধিক সাজ গোছের জন্য তার বন্ধুর স্বজনের সমাবেশে দামী দামী সৌখিন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে আতর, সুগন্ধি প্রভৃতি ব্যবহার করে। এসব আল্লাহরই মহা অনুগ্রহ। মানুষের সাজ-সজ্জার জন্য কত যে উপকরণ সৃষ্টি করেছেন আর সে সব ব্যবহারের জন্য মানুষকে দিয়েছেন জ্ঞান আর বৃদ্ধি, আর তার ইখতিয়ারও দিয়েছেন। অন্যান্য প্রাণীর বেলায় রয়েছে এর ব্যতিক্রম। তাদেরকে আল্লাহ্ এসব গুণ থেকে বঞ্চিত রেখেছেন।

        দেখ পশুগুলিকে আল্লাহ্ আত্মরক্ষার জন্য কিরূপ জ্ঞান দান করেছেন। তারা আত্মরক্ষার জন্য বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। যদি সামান্য ভয়ের কারণ দেখা দেয় তবে অতি গোপন স্থানে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। আর আমরণ সেখানে লুকিয়ে থাকে। এ যদি মিথ্যা হবে তবে সহস্র সহস্র প্রকারের বিরাটকায় হিংস্র আর অহিংস্র পশুগুলি কোথায়? তুমি তালাশ কর। বহু চেষ্টা করেও একটির সন্ধান পাবে না। আর এও সত্য নয় যে, তাদের সংখ্যা একেবারে কম এ কারণে দেখা যায় না। বরং যদি কেউ বলে যে, তাদের সংখ্যা মানুষের চেয়ে বেশী তা বাড়াবাড়ি হবে না। কেননা বড় বড় বিশাল অরণ্যগুলি হিংস্র প্রাণী বন্য গাই এবং গাধা খচ্চর, বকরী, শূকর, চিতা, সহস্র প্রকারের কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ প্রাণী আর নানা জাতীয় পাখীতে পরিপূর্ণ। এগুলি রোজ হাজার হাজার জন্ম নিচ্ছে আর, মরছে, অথচ এদের কংকালগুলোও দেখা যায় না বা তাদের মরে পড়ে থাকতেও নজরে পড়ে না। আল্লাহ্ তাদের প্রকৃতি এমনি তৈরী করেছেন যে, যদি কোথাও তাদের জীবন নাশের সামান্য আশংকা হয় তবে তারা একান্ত গোপনীয় স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয় আর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই কাটায়। এবার ভেবে দেখ, এসব বিরাট জন্তু তাদের মৃতদেহে দাফন করার কি পন্থা অবলম্বন করে থাকে। আল্লাহ্ তাদেরকে কি কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন।

        এসব চতুষ্পদ প্রাণীর তীক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তির প্রতি লক্ষ্য কর। তারা দূর থেকে পথের বাধা-গুহা গর্তে পড়ে জীবন হারানো থেকে নিজকে রক্ষা করে, সামনে যদি কোন বিপদজনক কিছু দেখতে পায় সহসা সেদিক থেকে অন্যদিকে মোড় নেয় এবং নিজকে রুখে নেয়। তাদের অনেকগুলি পিছনের বিপদ সম্পর্কে খবরদার থাকে না, যা অবশ্য তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং প্রকাশ্য দৃষ্টিতে তা দেখতে পায় না। যাই হোক, আল্লাহ্ তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সতর্কতা আর দূরদর্শিতা আবশ্যক পরিমাণ দান করেছেন, যাতে তারা বিপদ ও মুত্যুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে।

        এদের মুখের গঠনের প্রতি লক্ষ্য করে দেখ। নীচের দিকটা কিরূপ খোলা, যাতে খাদ্য, দানা প্রভৃতি সহজে চর্বণ করতে পারে। যদি তাদের মুখের গ্রাস মানুষের ন্যায় হতো তবে তারা মাটি থেকে কোন জিনিস খেতে পারতো না। আবার খাওয়ার সময় জিনিস মুখে তুলতে ঠোঁটের সাহায্যের জন্য তা বিশেষ ধরনের সৃষ্টি করা হয়েছে। ঠোঁটের সাহায্যে নিকটের খাদ্য তুলে নিতে পারে আর যা খাদ্য নয়, তা সরিয়ে দিতে পারে। এদের পানি পান করা লক্ষ্য কর, কত ধীর শান্তিভাবে চুমুক দিয়ে পানি পান করে। তাদের মুখের উপর লোমগুলি সৃষ্টির রহস্য চিন্তা কর। পানি পানের সময় পানির সাথে খড়কুটো ভেসে থাকে। তা সেই লোমের দ্বারা পৃথক করে দেয়। আর তার বিশেষ নড়া-চড়ায় পানিকে পরিষ্কার করতে থাকে। ফলে ঘোলা ময়লা পানি এদিকে সেদিকে সরে যায় আর পরিষ্কার পানি পান করতে পায়। পশুর লেজের রহস্য ভেবে দেখ। আল্লাহ্ ওটা তার একটা পর্দা বা আবরণস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন, যাতে পশম রয়েছে, যা পশুযোনীর পর্দার কাজ করে। তা ছাড়া যোনী-অংগে আর পাছায় কিছুটা ময়লা লেগে থাকার কারণে মশা মাছি এসে পড়ে, লেজ দ্বারা সেগুলি বিতাড়িত করা হয়। পশুর লেজ অনেকটা লম্বা ছড়ির ন্যায়। তা দ্বারা সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাছি বা কীট পতঙ্গ তাড়ায়ে দেয়। মুখের দিকে মশা মাছি বসলে তা মস্তক নেড়ে তাড়ায়। চতুষ্পদ প্রাণীর দেহে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন যে, সে শরীরের যে স্থানে লেজ পৌঁছতে পারে না বা মাথা নাড়িয়ে তাড়াতে পারে না, সে স্থানে সে সঞ্চালন করতে পারে যাতে মশা মাছি উড়ে যায়। এটা আল্লাহর এক বিশেষ কৌশল। যেখানে লেজ বা মাথা পৌঁছে না সেখানের মশা-মাছি এভাবে তাড়িয়ে থাকে।

        এসব চতুষ্পদ প্রাণীর মধ্যে আল্লাহ্ আর একটি গুণ দিয়েছেন। তা হচ্ছে এই যে, তাদের খুব ক্লান্তি আর অবসাদ বোধ হলে দেহের ডান ও বাম পার্শ্ব সঞ্চালিত করে থাকে। এতে তাদের অনেকটা ক্লান্তি কেটে যায়। তাদের সারাটা শরীর হাত পায়ের উপর অবস্থিত। কাজেই তাদের শরীরে মশা মাছি বসলে চুলকানো সম্ভব হয় না। সুতরাং তাদের লেজ ও দেহ সঞ্চালনের মধ্যে আল্লাহ্ শরীর চুলকানোর ব্যবস্থা রেখেছেন। এরূপ অবস্থায় খুব দ্রুত লেজ সঞ্চালন করে নেয়, যাতে দীর্ঘ সময় চুলকানীর ক্লেশ ভোগ করতে না হয়।

        এদের আর একটা স্বভাব লক্ষণীয় যে, যখন এরা কাদা পানির সম্মুখীন হয়ে পড়ে এবং তা এড়িয়ে চলার উপায় না থাকে, তখন তারা লেজ উচিয়ে চলে, যাতে লেজ কাদা পানিতে মেখে না যায়। আবার যখন এদের কোন ঢালু স্থান থেকে নামতে হয় আর পিঠে বোঝা চাপানো থাকে তখন তা পড়ে যাওয়ার আশংকা হয়। তখন এরা মাথা এমনভাবে গুটিয়ে রাখে, যেন মাথাটি বাঁচতে পারে আর লেজ দ্বারা বোঝাগুলি আগলিয়ে রাখে, যাতে তা পড়ে না যায়। যদি ঘটনাক্রমে বোঝা পড়েও যায় তবুও যেন মাথায় আঘাত না পায়। আল্লাহ্ এদের মধ্যে এ জ্ঞান ও অনুভূতি দান করেছেন, যা তার নিজের বাঁচার জন্য প্রয়োজন।

        হাতির শুঁড় দেখ। কিভাবে তার দ্বারা হাতের কাজ হইতেছে। এরই সাহায্যে তার খাদ্য আর দানা-পানি মুখে তুলে দেয়। যদি তা না হতো তবে তার ভারী অসুবিধা হতো। মাটি থেকে কিছু তুলতেই পারত না। কেননা হাতি অন্যান্য পশুদের ন্যায় মাথা নাড়াতে পারে না। এ কারণে আল্লাহ্ তাকে শুঁড়টি দিয়ে বড় অনুগ্রহ করেছেন। আবার শুড় পাত্রের কাজ দেয়। হাতি শুঁড়ে পানি পুরে মুখে নিয়ে যায়। আবার এটি নাকের কাজ করে। এরই মাধ্যমে শ্বাস গ্রহণ করে। আবার এটি তার হাতের কাজ করে। এর সাহায্যে বোঝা তুলে পিঠের উপর রাখে। আবার সওয়ারী অনেক সময় শুঁড় ধরে পিঠের উপর আরোহণ করে। জিরাফ, যার ঘাড় অতি দীর্ঘ, দেখতে অনেকটা উটের মতো। তা আফ্রিকার গহীন অরণ্যে বাস করে উঁচু উঁচু বৃক্ষের ঘন জংগলে তার বাস বলে। আল্লাহ্ তার গর্দান খুব লম্বা করেছেন, যাতে সে উঁচু বৃক্ষের পাতা আর ফল খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারে।

        খেঁকশিয়াল মাটির ভিতরে গর্ত খুঁড়ে তাতে বাস করে। গর্তে আসা যাওয়ার দুটি পথ থাকে। গর্তটি খুবই সংকীর্ণ করে তৈরী করে। দুটি রাস্তা এ কারণে যে, যদি একদিক থেকে তাকে কেউ পাকড়াও করার চেষ্টা করে, তবে অপর রাস্তা দিয়ে সে বেরিয়ে পালায়। যদি উভয় পথ দিয়ে তাকে আটক করার চেষ্টা করা হয় তখন সে একটি পথ মাথা দ্বারা আটকিয়ে দেয় আর তার নীচ দিয়ে এমনই গর্ত খুঁড়ে রাখে যা দিয়ে সে পালাতে পারে। দেখ, আল্লাহ্ এই ইতর প্রাণীকে নিজ জীবন রক্ষার জন্য কতটা হুঁশিয়ারি আর জ্ঞান দান করেছেন।

        মোটকথা এই যে, আল্লাহ্ এই সব প্রাণীদেরকে বিভিন্ন প্রকৃতি, ভিন্ন ভিন্ন হিকমত ও কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। যে সব পশুর গোস্ত আল্লাহ্ মানুষের জন্য হালাল করেছেন, সেগুলোকে আল্লাহ্ অনেক শান্ত ও নিরীহ করে সৃষ্টি করেছেন, যাতে সহজেই মানুষের বশে আসে। যেসব পশুকে আল্লাহ্ যানবাহনের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোকেও নিরীহ করে পয়দা করেছেন। সেগুলির ক্রোধ ও বেয়াড়ামী নামমাত্র। সেগুলির গঠন ও কাঠামো যানবাহনের উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেসব জন্তুর মধ্যে বেয়াড়াপনা এবং ক্রোধ বেশী, সেগুলির মধ্যে মানুষের বশ মানার প্রকৃতি দিয়ে আল্লাহ্ পয়দা করেছেন। যাতে সেগুলি মানুষের উপকারে আসে এবং শিকার ও পাহাড়িয়া কাজে লাগান যায়। এমনি হাতি খুবই বুদ্ধিমান প্রাণী, বশ মানার ও শিক্ষা গ্রহণের বিশেষ গুণ রয়েছে। এদেরকে যানবহন আর যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ ও অস্ত্রাদি বহনের কাজে খাটানো যায়। যেসব জন্তুর মধ্যে বেয়াড়াপনা আর অবাধ্যতা কম, সেগুলির মধ্যে অন্যান্য পশুর তুলনায় প্রভুভক্তি অধিক, যা মানুষের বিশেষ কাজে আসে। যেমন বিড়াল প্রভৃতি। পাখীর মধ্যে এমন কতগুলি পাখী আছে যে মানুষের বেশ উপকারে আসে। এদের কতগুলির মধ্যে অসাধারণ ভালবাসা ও অনুরক্তি লক্ষ্য করা যায়। কবুতর এদের মধ্যে অন্যতম, যারা নিজেদের বাসা কখনো তুলে না। কবুতর দ্বারা সংবাদ আদান-প্রদানের কাজ নেয়া চলে। প্রয়োজনের সময় সেগুলি খুব কাজে আসে। আবার এগুলি খুব বেশী বাচ্চা দেয়। বাজ পাখীর মধ্যে ভালবাসার গুণ রয়েছে আবার তার মধ্যে হিংস্রতাও বিদ্যমান। বাজ যেহেতু শিকার ধরার কাজে আসে এজন্য তার মধ্যে বশ মানার গুণ দিয়ে আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছেন। ফলে তার মধ্যে বশ মানার প্রবণতাটা বেশী আর সে প্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী কাজও করে। আর শিকার ধরার বেলায় খুব কাজে লাগে। আরো কত গুণ ও বৈশিষ্ট্য আর রহস্য এ সব প্রাণীদের মধ্যে নিহিত রয়েছে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

Post a Comment

0 Comments