আল্লাহ্ বলেনঃ
وَ الْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوا هَا وَزِينَةً .
'আল্লাহ্' ঘোড়া, খচ্চর আর গাভীও সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তার উপর সওয়ার হও আর সেগুলি তোমাদের সৌন্দর্যের জন্যও।
(সূরা নাহলঃ আয়াত নং-৮)
আল্লাহ্ চতুষ্পদ প্রাণী সৃষ্টি করে মানুষের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। এগুলি মানুষের খুব কাজে আসে। এগুলির দৈহিক গঠন এমন যে, না বেশী শক্ত, যাতে আমরা সহজেই সেগুলি কাজে লাগাতে পারি। আল্লাহ্ এগুলির গোস্ত, হাড়, শিরা, চামড়া প্রভৃতি খুব মজবুত করে তৈরী করেছেন। যাতে আমরা সেগুলিকে যানবাহনের কাজে ব্যবহার করতে পারি। তাদের সারা দেহ সংরক্ষণের জন্য চামড়াগুলি খুব মজবুত করে সৃষ্টি করেছেন। ফলে বাইরের চাপ ও আঘাত থেকে গোস্ত রক্ষা পায়। এই পশুগুলিকে কান ও চক্ষু দিয়েছেন, যাতে মানুষ তাদের দ্বারা পূর্ণভাবে কাজ নিতে পারে। যদি এসব প্রাণীর চোখ, কান না থাকতো তবে এগুলির দ্বারা কাজ নেওয়া কষ্টকর হতো। আবার এগুলিকে জ্ঞান-বুদ্ধিও তেমন বেশী দেওয়া হয় নাই, যাতে সেগুলি মানুষের অনুগত আর বাধ্যগত থাকে। যদি এদের জ্ঞান-বুদ্ধি বেশী থাকতো তবে হালচাষ করতে, ভারী বোঝা বহনে, চাকা ঘুরানো প্রভৃতি কষ্টকর কাজ করতে অবাধ্য হতো আর তাদের বশে রাখা যেত না।
আল্লাহ্ খুব ভাল জানেন যে, মানুষের এসব কাজের প্রয়োজন হবে অথচ এগুলি মানুষের শক্তির বাইরে। আল্লাহ্ যদি এসব কাজের জন্য মানুষকে বাধ্য করতেন, তার ফল হতো এই যে, এক দিকে মানুষের পক্ষে এসব কাজ হতো দুঃসাধ্য, অন্যদিকে এসব কাজ করতে গিয়ে তার সব শক্তি যেত নিঃশেষ হয়ে, ফলে জ্ঞান, বিদ্যা অর্জন, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য লাভ, পদমর্যাদা উন্নয়ন ও পূর্ণতা অর্জন, যেগুলি মানুষের বৈশিষ্ট্য আর যার জন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা ও সম্মানিত সেসব থেকে মানুষ বঞ্চিত হতো। এমনকি মানুষ তার নিজের জন্য সম্মানজনক উপায়ে নিজের রুজী রোজগার করতে একেবারে অসহায় হয়ে পড়তো। সুতরাং পশুকে এভাবে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ মানুষের প্রতি অপার করুণা আর অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন, যা সব কাজে লাগানো যায় আর কোন কাজে সে অবাধ্য হয় না।
প্রাণী ও পশুগুলির শ্রেণীবিভাগ আর সেগুলির প্রয়োজনীয়তা এবং কাজের উপযোগিতার বিষয়, দৃষ্টান্তস্বরূপ মানুষই দেখ না কেন। আল্লাহ্ মানুষকে জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। শিল্প কাজের দক্ষতা ও শক্তি দান করেছেন। আর তাদের জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার তাকিদে কাপড় তৈরী, গৃহাদি নির্মাণ ও লোহার কাজ প্রভৃতি করাও তার প্রয়োজন। এসব কাজের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, উদ্ভাবনী শক্তি মস্তিষ্ক আর মননশক্তি দান করেছেন।
শরীরের গঠন ও কাঠামোতেও এসব কাজের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। হাতে আংগুলী আর পাঞ্জা সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে সে কোনো জিনিস ধরতে পারে। আর শিল্প কাজ ও অন্যান্য কাজ করার সময় হাতিয়ার ঠিকভাবে ধরে তা' ব্যবহার করতে পারে। যে সব জন্তু মাংস আহার করে সেগুলির সৃষ্টিনৈপুণ্য লক্ষ্য কর। তাদেরকে শিকার করার আর তা' ধরার পূর্ণ শক্তি ও উপযোগিতা দান করেছেন। সেগুলির হাত পায়ে ধারালো নখ আর পাঞ্জা সৃষ্টি করেছেন, যাতে সুযোগমতো শিকার ধরে কাবু করতে পারে। তারপর তা চিরে-ফেড়ে নিজের আহার সংস্থান করতে পারে।
তৃণভোজী পশুগুলির প্রতি লক্ষ্য কর। কতগুলি পশুর পা এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছে যে, কঠিন জমিনের উপর আহারের সন্ধানে চলাফেরার সময় জমির বন্ধুরতা আর কাঁকর প্রভৃতির ঘর্ষণ থেকে যাতে রক্ষা পায়। আর পাথুরে মাটি পা ক্ষত-বিক্ষত না করে। এমনি কোনো কোনো পশুর খুর গোল আর গর্ত বিশিষ্ট করা হয়েছে, যাতে সে জমিনে উত্তমরূপে ভর করতে পারে। আর সওয়ারী বা বোঝা বহনের সময় পা দৃঢ়ভাবে রাখতে পারে।
মাংসভোজী জন্তুগুলির গঠনের প্রতি লক্ষ্য কর। তার দাঁত আর মাড়ি কিরূপ তীক্ষ্ম আর ধারালো করে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। আর তার মুখের ব্যাদান কত বড় করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাকে যে হাতিয়ার দান করেছেন তার সাহায্যে নিজের অন্য শিকার করতে পারে। এর বিপরীত যদি তৃণভোজী প্রাণীর থাবা আর ধারালো দাঁত হতো আর ধারালো মাড়ি হতো তবে তা হতো একেবারেই বেকার। কেননা তার না শিকার করতে হয় না তার গোস্ত খাওয়ার প্রয়োজন যে, সে সব ধারালো জিনিসের সাহায্য নেবে। তেমনি যদি মাংসাশী পশুর তৃণভোজী পশুর ন্যায় চামড়া ওয়ালা চোয়াল হতো, যা ঘাস খাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয়, তবে তাদের জীবনে ভারী অসুবিধা সৃষ্টি হতো আর তার পক্ষে শিকার করে খাওয়া সম্ভব হতো না।
সুতরাং এবার চিন্তা করে দেখ, আল্লাহ্ প্রত্যেক প্রাণীকে তার প্রয়োজন মাফিক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শক্তি আর শারীরিক গঠন দান করেছেন। এবার চতুষ্পদ প্রাণীর শাবকগুলির প্রতি লক্ষ্য কর। তারা জন্ম হওয়ার পরই মায়ের সাথে সাথে চলাফেরা করে। মানব শিশুর মতো তাদের লালন পালনের দরকার হয় না এবং কোলে কাঁখে নিয়েও ফিরতে হয় না। এ কারণে মানব শিশু লালন পালনে মা- বাপের যে যত্নাদি ও শিক্ষার প্রয়োজন পশুর বেলায় সে জ্ঞান বুদ্ধির প্রয়োজন নেই আর মানুষের কাজে অন্য যে হাত আর অংগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে পশুদের জন্য তারও দরকার নেই। পশুর বাচ্চাদের জন্মের পর স্বাধীনভাবে চলাফেরার শক্তি আল্লাহ্ দান করেছেন। নিজ নিজ শক্তিতেই তাদের মায়েদের সাথে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়েই জন্মে।
পাখীর মধ্যে মুরগী, তিত প্রভৃতি পাখীর বাচ্চাগুলি দেখ, তারা ডিম থেকে ফুটবার সাথে সাথেই দানা, খুদ প্রভৃতি খুটে খেতে শুরু করে। আর যে বাচ্চা দুর্বল হয় আর মায়ের সাথে সাথে দানা প্রভৃতি খেতে অক্ষম, যেমন কবুতরের বাচ্চা প্রভৃতি, তাদের মাকে আল্লাহ্ তাদের প্রতি এতটা মেহেরবানী করেছেন যে, তারা নিজেরা সন্তানগুলিকে খাইয়ে পেট ভরায়। নিজের মুখে চিবিয়ে বাচ্চাগুলিকে খাওয়ায়। যতদিন বাচ্চাগুলি নিজেরা চলে ফিরে দানা প্রভৃতি খেতে না পারে ততদিন এভাবেই তাদের খাওয়ান চলতে থাকে। আল্লাহ্ এভাবে প্রত্যেক প্রাণীর ভিতরেই সন্তানের প্রতি কম বেশী মমতা দান করেছেন।
চতুষ্পদ প্রাণীর পাগুলি দেখ! চলাফেরা আর দৌড়ের সময় কি ভাবে তারা সম্মুখের আর পিছনের পা পরস্পর জমিনে ফেলে, যাতে সে টিকে থাকতে পারে। জমিনের পশুগুলি তাদের পা দ্বারা যে কাজ করে পানির জীবগুলো তাদের দেহের অংশ বিশেষ দ্বারা সে কাজ করে থাকে। দু'পা ওয়ালা জীব চলার সময় যখন এ পা তুলে তখন অন্য পায়ের সাহায্যে মাটির উপর টিকে থাকে; তেমনি চতুষ্পদ বিশিষ্ট প্রাণী চলার সময় যখন দু'পা আগে বাড়ায় তখন পিছের দুপায়ের সাহায্যে টিকে থাকে। আর তা তোলার রীতি হচ্ছে এই যে, সামনের পায়ের যেখানা তুলে পিছনের দিক থেকে তার বিপরীত দিকের একখানা তুলে কেননা একই সময় যদি আগে পিছের এক দিকের পা উঠায় তবে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। যেমন চৌকি প্রভৃতি এক দিকে দুপায়ের উপর টিকে থাকতে পারে না। এমন যদি পশু একবার সামনে দু'পা তোলে আর একবার পিছের দু'পা তাতে চলার ব্যতিক্রম ঘটবে আর যানবাহনের কাজ সুষ্ঠু ভাবে চলবে না। এ কারণে আল্লাহ্ তাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন যে, সামনের দিকের ডান পায়ের সাথে পিছনের বাম পা তুলবে। তাতে সামনে পিছনের বিপরীত পায়ের উপর শরীরের ভার ন্যস্ত থাকবে। তাতে সে সহজে এবং স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে। গাধা বোঝা বহন আর চাক্কি ঘুরানোর কাজে আসে। ঘোড়া দ্বারা কেউ এ কাজ নেয় না। আবার উট যদি বেয়াড়া হয় তবে কয়েকজন মিলেও তাকে কাবু করতে পারে না আর যখন তা বাধ্য থাকে তখন ছোট বালকের হাতে লাগাম দিয়ে দাও, সে পিছে পিছে চলে আসবে। অবাধ্য বলদের গর্দানে গরম লোহা দ্বারা দাগ না লাগান পর্যন্ত সে কাবুতে আসবে না। এর পরই তাকে হালে জুড়ে জমি চাষ করান যাবে। ঘোড়া দ্বারা বহনের কাজ হয় এবং যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রাদি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে খাটান হয়। ছাগলের পাল একটি ছোট বালকও মাঠে নিয়ে চরায় আবার যখন তা চারদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তাদের একত্র করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এমনি সব পশুরই এক অবস্থা অর্থাৎ তাদেরকে আল্লাহ্ ততটা জ্ঞান ও চেতনা দান করেছেন যাতে মানুষের সেবার বেলায় তারা কোনো প্রতিবন্ধক না হয। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি তেমন থাকলে কখনো তারা মানুষের বাধ্যগত হতো না, তা যতোই চেষ্টা সাধ্য করতো না কেন।
হিংস্র জন্তুগুলির বেলায়ও তাই। যদি তাদের জ্ঞান বুদ্ধি তেমনি থাকতো তবে অহরহ মানুষের প্রতি হামলা করতো। তাদের ঠেকাতে মানুষের খুবই বেগ পেতে হতো। বিশেষ করে যখন সেগুলি ক্ষুধার তাড়নায় ঘুরে বেড়াতো তখন মানুষের পক্ষে বাইরে বের হওয়া দুঃসাধ্য হতো। এ কারণে তাদের শক্তি ও সামর্থ্য বেশী দিলেও জ্ঞান থেকে বঞ্চিত রেখেছেন আর তাদের অন্তরে মানুষের ভীতি দান করে মানুষের প্রতি খুবই দয়া করেছেন।
কুকুর দেখ। তাও এক প্রকার হিংস্র প্রাণী; তা মানুষের কত অনুগত হয়ে থাকে। মনিবের ঘর পাহারা দেয়, মনিবের জন্য তারা রাত জেগে থাকে, এমনিক প্রাণ দেয়। প্রতিটি আশংকা আর ভয়ের ক্ষেত্রে মালিককে তারা ঘেউ ঘেউ শব্দে সজাগ করে রাখে। মালিক সজাগ সচেতন হয়ে সাবধান সতর্ক হয়ে নিজেকে আশংকা আর বিপদ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। কুকুরের কি ধৈর্য, কয়েক বেলাও না খেয়ে কাটাতে পারে। কিন্তু নিজ মালিককে ছেড়ে যাওয়া পছন্দ করে না। মালিক তার প্রতি যতোই জুলুম করুক বা মারুক পিটুক তা' সত্ত্বেও সে মালিককে ছেড়ে যায় না। মানুষের উপকারের জন্য আল্লাহ্ কুকুরের মধ্যে এসব গুণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। শিকারের বেলায় কুকুর খুবই কাজে আসে। শিকারকে দাঁত আর নখ দ্বারা মনিবের জন্য আটকে রাখে। মানুষের উপকারের জন্য খোদা কুকুরের মধ্যে এসব গুণ দিয়েছেন।
দেখ চতুষ্পদ প্রাণীর পিঠ আল্লাহ্ কিরূপ সমতল আর চার পায়ের উপর দৃঢ়ভাবে তৈরী করেছেন, যাতে যানবাহনের ক্ষেত্রে সওয়ারী বা মালপত্র গড়িয়ে পড়ে না যায়।
পশুর যোনীদেশ পশ্চাৎ দিকে খোলা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পুরুষ পশু সহজে সংগম করতে পারে। যদি মানুষের ন্যায় ভিতর দিকে যোনী-হতো তবে পশুর পক্ষে সঙ্গম করা অসম্ভব হতো। পশু সংগমের বেলায় সামনা সামনি হয়ে আসে না। যেমন মানুষের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যদিও হস্তিনীর যোনী ভিতরের দিকে কিন্তু তা সংগমের সময় বাইরে নিয়ে আসে যাতে পুরুষ হস্তী সহজে সংগম করতে পারে।
পশুর যোনীদেশ আল্লাহ্ এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন সেই হিসাবে তাদের কতগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যও দান করেছেন, যাতে তাদের সংগম কাজ সহজ আর তাদের বংশধারা অব্যাহত থাকে।
পশুর দেহ কিভাবে পশম দ্বারা আবৃত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে তারা শীততাপ থেকে রক্ষা পায়। পা গুলিতে দৃঢ় খুর আর নখ সৃষ্ট করা হয়েছে, যাতে সুদূর বন্ধুর পথে চলার সময় পা ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে যায়।
0 Comments