নবী করীম (সা:) কে পৃথিবীতে প্রেরণের উদ্দেশ্য কী

        পৃথিবীতে এটি বাস্তব সত্য যে, কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সে আদর্শের ভিত্তিতে একটি সুসংগঠিত দল বা সংস্থা গঠন করতে হয়। সে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকে। সমগ্র দেশে থাকে স্থানীয় কার্যালয়। কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় যে সকল নির্দেশ ঐ স্থানীয় কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয় তা ঐ আদর্শের অনুসারী নেতা-কর্মীগণ বাস্তবায়ন করে থাকেন। তেমনি মুসলিম একটি মিল্লাতের নাম এবং এ মিল্লাতের আদর্শ ইসলাম। এই মিল্লাতের জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ:)।

        আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে তিনি এই মিল্লাতের জন্য একটি কেন্দ্র নির্মাণ করলেন। কেননা, এই মিল্লাতের যিনি বিশ্বনেতা তাঁর আগমনের সময় সমাগত। হযরত ইবরাহীম (আ:) ও তাঁর আগমনের জন্য আল্লাহ তা'য়ালার কাছে এভাবে দোয়া করলেন-

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ . وَيُزَكِّيهِمْ طَ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

        হে আমাদের মালিক! তাদের (বংশের) মধ্যে তাদের নিজেদের মাঝ থেকে তুমি (এমন) একজন রাসূল পাঠাও, যে তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনাবে, তাদের তোমার কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দিবে, উপরন্তু সে তাদের পবিত্র করে দিবে, কারণ তুমিই মহাপরাক্রমশালী ও পরম কুশলী। (সূরা বাকারা-১২৯)

        সুতরাং ইবরাহীম (আ:) যে ঘর পুনঃনির্মাণ করলেন তা কোনো সাধারণ ঘর ছিল না। এই ঘর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটিই ছিল, সমগ্র বিশ্বে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এখান থেকেই পরিচালিত হবে, এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখেই হযরত ইসমাঈল (আ:) ও তাঁর মা'কে জনমানবহীন এই প্রান্তরে রেখে যাওয়া হয়েছিল, ইসমাঈল (আ:) এর কুরবানীও ছিল ঐ একই উদ্দেশ্যে এবং কা'বার নির্মাণও ছিল ঐ একই লক্ষ্যে।

        সমগ্র পৃথিবীতে যারা তাওহীদের মশাল বহন করবে, তারা যেন প্রতি বছরে একবার হজ্জ নামক বিশ্ব সম্মেলনে এসে সমবেত হয়, একত্রে সমস্বরে এক আল্লাহর দাসত্বের ঘোষণা বজ্রকণ্ঠে দিতে পারে, পারস্পরিক পরিচিতি লাভ করতে পারে, একে অপরের সমস্যা সম্পর্কে অবগত হয়ে তা সমাধানের বাস্তব পন্থা অবলম্বন করতে পারে, আল্লাহ বিরোধী শক্তির মুকাবিলা কিভাবে করা যায় এবং সমগ্র পৃথিবীতে কিভাবে এক আল্লাহ তা'য়ালার বিধান প্রতিষ্ঠা করা যায়-এ সকল কার্যক্রম গ্রহণ করার লক্ষ্যেই সেদিন কা'বা নির্মাণ করে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ:) বিশ্বনবী তথা বিশ্বনেতাকে প্রেরণের দোয়া করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষকে সে ঘরের দিকে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন।

        পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানেই কা'বাঘর সম্পর্কে মহান আল্লাহ এই ঘর বানানোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন, 'এই ঘর হিদায়াতের কেন্দ্র, এখান থেকেই একত্ববাদের বাণী সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে'। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ:) এর দোয়ার প্রতি লক্ষ্য করলে কতকগুলো বিষয় আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে যায়।

        ১. এমন এক ব্যক্তিত্বকে বিশ্বনবী বা বিশ্বনেতা হিসাবে প্রেরণ করা হোক, যিনি মানবমণ্ডলীরই একজন। অর্থাৎ মানুষের বাইরের কোনো সত্তা নয়। মানুষের সকল ইচ্ছা, আকাক্সখা, কামনা-বাসনা, ব্যথা-বেদনা, মায়া-মমতা তথা সকল অনুভূতি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে সক্ষম কেবলমাত্র মানুষই। এ জন্যেই মানুষের মধ্য থেকেই বিশ্বনেতাকে নির্বাচিত করার আবেদন করা হয়েছিলো।

        ২. তিনি মহান আল্লাহর সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিবেন, সৃষ্টি হিসাবে স্রষ্টার প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য কি তা বিশদভাবে মানুষকে জানিয়ে দিবেন এবং স্বয়ং আল্লাহই যে একমাত্র ইলাহ ও রব অর্থাৎ তিনিই আইনদাতা, বিধানদাতা এবং সকল বিষয়ের প্রতিপালক- এ বিষয়টিও মানুষের কাছে স্পষ্ট করে দিবেন।

        ৩. পৃথিবীতে মানুষ ভারসাম্যমূলক জীবন-যাপন করবে এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ- যে সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর কিতাবের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন, এ সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান বিশ্বনবী তথা বিশ্বনেতা মানবজাতিকে শিক্ষা দিবেন। অর্থাৎ প্রগতির ফল্গুধারায় আপুত শোষণমুক্ত, শান্তিপূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, বস্তুর কল্যাণকর কর্মে ব্যবহারকারী এবং উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির অধিকারী দেশ, জাতি ও সমাজ বিনির্মাণে যা কিছু প্রয়োজন, তা কাংখিত বিশ্বনেতা শিক্ষা দিবেন।

        ৪. দোয়ায় বলা হয়েছিলো, 'এমন এক বিশ্বনেতা প্রেরণ করুন, যিনি মানুষকে পবিত্র করে দিবেন'।

        যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ সৃষ্টি করে তার যাবতীয় জীবনোপকরণ দিয়েছেন, সেই আল্লাহর দাসত্ব করার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নিহিত এবং মানুষ ক্রমশ মর্যাদার উচ্চ শিখরে আরোহণ করে। সম্মানের এমন এক পর্যায়ে এ মানুষ পৌঁছে যায় যে, যেখানে স্বয়ং ফিরিশতাও পৌঁছতে সক্ষম নয়। আবার এ মানুষ নিজের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান ভুলে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নিজের মহান মালিক আল্লাহকে ত্যাগ করে তার অনুরূপ আরেক সৃষ্টির, কোনো জড়পদার্থের বা নিজ হাতে গড়া কল্পিত কোনো শক্তির দাসত্ব করে, তখন সে মানুষের মর্যাদা শূন্যের কোঠা অতিক্রম করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর প্রাপ্য মর্যাদাও হারিয়ে ফেলে। আর এ অবস্থায়ই একজন সম্মানিত মানুষের জন্য অপবিত্রতার মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া বুঝায়।

        যখন মানুষ তার প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে উদাসীনতার পরিচয় দেয়, নিজের সম্মানকে অবহেলা করে আত্মমর্যাদা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে বলেই সে মানুষ তারই অনুরূপ আরেকজন মানুষকে নিজের বিধানদাতা, আইনদাতা, মুক্তিদাতা এবং যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে বরণ করে। অথবা কোনো জড়পদার্থকে নিজের মনস্কামনা পূরণকারী হিসাবে বরণ করে বা নিজ হাতে গড়া কোনো কল্পিত বস্তুর দাসত্ব করে। তারই অনুরূপ সৃষ্টি আরেকজন মানুষ তাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান দিবে এবং মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির উপকরণ দিবে, যাবতীয় নীতিমালা রচনা করে দিবে আর সে তা অবলীলাক্রমে মেনে চলবে- এ ধরনের মর্যাদাহীনতার অপবিত্রতা থেকে সকল মানুষকে পবিত্র করবেন, 'এমন একজন বিশ্বনবী বা বিশ্বনেতা প্রেরণ করুন' এ দোয়াই হযরত ইবরাহীম (আ:) করেছিলেন।

        মানুষের চিন্তাধারা, চেতনা, অভ্যাস, স্বভাব-চরিত্র, চলমান জীবনধারা, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন ও মতবাদ মতাদর্শকে ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত করে সকল কিছুকে পরিশুদ্ধ করবেন বিশ্বনবী (সা:) এ কামনাই মহান আল্লাহর কাছে করেছিলেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ:) এবং তাঁর পবিত্র এ দোয়ারই উত্তর স্বরূপ নবী করীম (সা:) প্রেরিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে ইবরাহীম (আ:) এর চাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে বলছেন-

        (এই সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যেই) আমি এভাবে তোমাদের কাছে তোমাদের মাঝ থেকেই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছি, যে ব্যক্তি (প্রথমত) তোমাদের কাছে আমার 'আয়াত' পড়ে শোনাবে, (দ্বিতীয়ত) সে তোমাদের (জীবন) পরিশুদ্ধ করে দিবে এবং (তৃতীয়ত) সে তোমাদেরকে আমার কিতাব ও (তার অন্তর্নিহিত) জ্ঞান শিক্ষা দিবে, (সর্বোপরি) সে তোমাদের এমন বিষয়সমূহের জ্ঞান দান করবে, যা তোমরা কখনো জানতে না। (সূরা বাকারা-১৫১)

        মানুষ নিজেকে কিভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখবে, নিজের প্রতি, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদির প্রতি মানুষের দায়িত্ব- কর্তব্য কি, এসব বিষয় সম্পর্কে মানুষ ছিলো সম্পূর্ণ অন্ধকারে। মহাকাশের শূণ্য মার্গে, অগণিত গ্রহ-নক্ষত্রে, অদৃশ্য বায়ুমণ্ডলে এবং অন্যান্য স্তরে, শূন্য মার্গের অদৃশ্য কৃষ্ণ গহ্বরে (Black hole), ওজন স্তরে, মহাশূন্যে ঘূর্ণয়মান পাথরের সাম্রাজ্যে, পাতালপুরীর কৃষ্ণ বিবরে, অগাধ জলধীর বিভিন্ন স্তরসহ অতল তলদেশে, মাটির তলদেশে খনিসমূহের স্তর অতিক্রম করে উত্তপ্ত গলিত লাভার স্তরে, পর্বতের সৃষ্টি কৌশল ও অবস্থানে, পশুদলের মাঝে, অরোণ্যের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে নবী- রাসূলগণই সর্বপ্রথম মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন বস্তুর ব্যবহার। বিজ্ঞান যে সকল বিষয় বর্তমানে মানুষকে জানাচ্ছে, এসব বিষয় সম্পর্কে নবী করীম (সা:) পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মানুষকে অবগত করেছেন। বস্তুর ধ্বংস নেই, বস্তু অবিনাশী। মানুষেরও ধ্বংস নেই, ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে মৃত্যুর পরে আরেকটি অনন্তকালের জীবন রয়েছে এবং সেখানে পৃথিবীর জীবনের যাবতীয় কিছুর হিসাব দিতে হবে- এ সকল বিষয় ছিলো মানুষের অজানা। অর্থাৎ মানুষ যা জানতো না তাই নবী করীম (সা:) মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।

        এ জন্যেই হাদীস শরীফে দেখা যায়, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাঃ)-এর কাছে জানতে চেয়েছেন-

لِمَا بُعِثْتَ

'কী কারণে আপনার আগমন?'

জবাবে তিনি জানিয়েছেন-

بعثتُ مُعَلِّمًا -

'আমি প্রেরিত হয়েছি শিক্ষক হিসাবে'।

        মানুষের প্রয়োজনীয় সকল কিছুর শিক্ষক ছিলেন নবী করীম (সা:), এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

        আল্লাহ অবশ্যই তাঁর ঈমানদার বান্দাদের ওপর এই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের মাঝ থেকে একজন ব্যক্তিকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের আয়াতসমূহ পড়ে শোনায় এবং (সে অনুযায়ী) সে তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে, (সর্বোপরি) সে (নবী) তাদের আল্লাহর কিতাব ও (তাঁর গ্রন্থলব্ধ) জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়, অথচ এরা সবাই ইতোপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিলো। (সূরা আলে ইমরান-১৬৪)

        এ আয়াতে নবী করীম (সা:) কে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষাদাতা হিসাবে পরিচিতি দান করেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সকল বিষয়ের এই মহান শিক্ষককে 'ধর্মনেতা' পরিচয়ে আবদ্ধ রেখে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাগুরু হিসাবে গ্রহণ করেছি নীতি নৈতিকতাহীন উশৃংখল প্রকৃতির কিছু সংখ্যক বিভ্রান্ত মানুষকে। ধর্মীয় নীতিমালার সামান্য কিছু অংশ শেখার জন্যে আমরা নবী করীম (সা:) এর দিকে হাত প্রসারিত করি, আর জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে অন্যান্য সকল নীতিমালা গ্রহণ করার জন্যে নবী করীম (সা:) এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বার্থান্বেষী চরিত্রহীন ধুরন্ধর বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত লোকদের প্রতি মুখাপেক্ষী হই।

        নবী করীম (সা:) ব্যতীত অভ্রান্ত, নির্ভুল ও প্রকৃত সত্য জ্ঞান, সিদ্ধান্ত এবং কৌশল অন্য কোনো মানুষ কখনোই দিতে পারে না এবং সেটা কোনো মানুষের জানাও নেই, এ বিষয়টি মহান আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এভাবে যে, 'তিনি এসব বিষয়ে মানবজাতিকে অবগত করানোর পূর্বে তারা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিলো'। আরেক আয়াতে বিষয়টি আল্লাহ তা'য়ালা এভাবে বলছেন-

         هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الأُمِّيِّنَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ فِي وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَلٍ مُّبِينٍ

        তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি (একটি) সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে থেকে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের আল্লাহর আয়াতসমূহ পড়ে শোনাবে, তাদের জীবনকে পবিত্র করবে, তাদের (আমার) গ্রন্থের (কথা ও সে অনুযায়ী পৃথিবীতে চলার) কৌশল শিক্ষা দিবে, অথচ এ লোকগুলোই (রাসূল আসার) আগে (পর্যন্ত) এক সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিলো। (সূরা আল জুমুয়া-২)

        মানুষ তার নিজের সত্তার দিক দিয়েই একটি জগৎ বিশেষ। তার এই জগতের মধ্যে অসংখ্য শক্তি, যোগ্যতা ও কর্ম-ক্ষমতা বিদ্যমান। তার এই জগতের মধ্যে জাগ্রত রয়েছে কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, আবেগানুভূতি, ভাবাবেগ, ঝোঁক-প্রবণতা, কাম, ক্রোধ, জেদ, হঠকারিতা, হিংসা-বিদ্ধেষ ইত্যাদি। মানুষের দেহ ও মনের রয়েছে অসংখ্য দাবি। মানুষের আত্মা, প্রাণ ও স্বভাবের রয়েছে সীমাহীন জিজ্ঞাসা। প্রতিনিয়ত তার মধ্যে অসংখ্য প্রশ্নমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব প্রশ্নের জবাব লাভের জন্য সে অস্থির হয়ে ওঠে। এটাই হলো মানুষের জটিল অবস্থা।

        এই জটিল অবস্থাসম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে মানব সমাজ গড়ে ওঠে, সে সমাজও নানা ধরনের জটিল সম্পর্কের ভিত্তিতেই গঠিত হয়। মানব সমাজ অসীম ও অসংখ্য জটিল সমস্যার সমন্বয়ের ভিত্তিতেই গঠিত হয়েছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ লাভের সাথে সাথে এসব জটিলতা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে।

        এসব সমস্যা ছাড়াও পৃথিবীতে মানুষের জীবন ধারণের জন্য যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী মানুষের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, তা ব্যবহার করা এবং মানবীয় সংস্কৃতিতে তা ব্যবহার উপযোগী করে প্রয়োগ করার প্রশ্নেও মানুষের ভেতরে ব্যক্তিগত ও সামগ্রিকভাবে অসংখ্য জটিলতার সৃষ্টি করে। মানুষ তার নিজের দুর্বলতার কারণেই তার সমগ্র জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে একই সময়ে পূর্ণ ও সামঞ্জস্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে না। এ কারণে মানুষ নিজের জন্য জীবনের এমন কোন পথ স্বয়ং সে নিজেই রচনা করতে পারে না, যে পথ নির্ভুল হতে পারে।

        এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটি জগৎ রয়েছে এবং সে জগৎ অসংখ্য জটিল বিষয় সমন্বিত, অসংখ্য শক্তি-সামর্থ সে জগতে ক্রিয়াশীল রয়েছে। সুতরাং মানুষ স্বয়ং যে বিধি-বিধান, মত-পথ রচনা করবে, সে বিধান স্বয়ং মানুষের অন্তর্নিহিত যাবতীয় শক্তি-সামর্থের সাথে পূর্ণ ইনসাফ করবে, তার সমস্ত কামনা-বাসনার সাথে প্রকৃত অধিকার বুঝিয়ে দিবে, তার আবেগ-উচ্ছ্বাস ও প্রবণতার সাথে ভারসাম্যমূলক আচরণ করবে, তার দেহের ভেতরের ও দেহের বাইরের যাবতীয় প্রয়োজন সঠিকভাবে পূরণ করবে, তার সমগ্র জীবনের যাবতীয় সমস্যার দিকে পরিপূর্ণভাবে দৃষ্টি দিয়ে সেসব কিছুর এক সুষম ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান বের করবে এবং বাস্তব জিনিসগুলোও ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনে সুবিচার, ইনসাফ ও সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যবহার করবে, এসব কোনো কিছুই মানুষের পক্ষে কক্ষনো সম্ভব হবে না।

        প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বয়ং যখন নিজের পথ-প্রদর্শক, আইন-কানুন, বিধান রচয়িতার ভূমিকা পালন করে, তখন নিগূঢ় সত্যের অসংখ্য দিকের মধ্য থেকে কোনো একটি দিক, জীবনের অসংখ্য প্রয়োজনের মধ্য থেকে কোনো একটি প্রয়োজন, সমাধানযোগ্য সমস্যাবলীর কোনো একটি সমস্যা তার চেতনার জগতে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে, মানুষ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক- অন্যান্য দিক ও প্রয়োজন এবং সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সে দৃষ্টি দিতে সক্ষম হয় না।

        কারণ তার চেতনার জগৎ তো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে বিশেষ একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে। এভাবে বিশেষ মানুষের ওপরে বিশেষ কোনো মত বা আদর্শ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়ার কারণে জীবনের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে সামঞ্জস্যহীনতার এক চরম পর্যায়ের দিকে তা বক্র গতিতে চলতে থাকে।

        মানব জীবনের এই চলার বাঁকা গতি যখন শেষ স্তরে গিয়ে উপনীত হয় তখন মানুষের জন্য তা অসহ্যকর হয়ে জীবনের যেসব দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার দিকে ইতোপূর্বে দৃষ্টি দেয়া হয়নি, সেসব দিক তরিৎ গতিতে বিদ্রোহ করে এবং সেসব প্রয়োজন পূরণ করতে বলে, সমস্যাগুলো সমাধানের দাবি করতে থাকে। কিন্তু তখন আর মানুষের পক্ষে সেসব প্রয়োজন পূরণ করা ও সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হয় না। কারণ পূর্বানুরূপ সামঞ্জস্যহীন কর্মনীতি পুনরায় চলতে থাকে।
    
        পূর্বে যেসব সমস্যা সমাধান ও প্রয়োজনগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি, সামঞ্জস্যহীন কর্মনীতির ফলে মানুষের যেসব দাবি ও আবেগ-উচ্ছ্বাসকে ভয়-ভীতি ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে রাখা হয়েছিল, তা পুনরায় মানুষের ওপর প্রচণ্ড গতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এবং তাকে নিজের বিশেষ দাবি অনুযায়ী বিশেষ একটি লক্ষ্যের দিকে গতিবান করে তোলার চেষ্টা করে।

        এ সময় অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলোর সাথে পূর্বের ন্যায় আচরণই করতে থাকে। এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে মানুষের জীবন কখনো সঠিক, সত্য, সহজ-সরল পথে একনিষ্ঠভাবে চলার মতো পরিবেশ লাভ করে না। সমস্যার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে সে ক্রমশঃ ডুবে যেতে থাকে। একটি ধ্বংস গহ্বর থেকে কোনক্রমে সে উঠতে সক্ষম হলেও ছুটতে গিয়ে অন্য আরেকটি ধ্বংস গহ্বরে সে আছড়ে পড়ে। মানুষ এমনি চারিত্রিক বৈশিষ্টে পরিপূর্ণ এক জীব যে, কোনো কাজ করতে গেলে সর্বপ্রথম তাকে নির্ধারণ করে নিতে হয় তার কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অন্য কোনো জীবের ন্যায় এ মানুষ লক্ষ্যহীন কাজ করতে পারে না আর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে গেলেই তার সামনে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, কোন্ আদর্শের ওপর ভিত্তি করে, কোন্ আদর্শের দেয়া নিয়ম অনুযায়ী সে তার কাজগুলো সম্পাদন করবে।

        মানুষের নিজের রচনা করা কোনো মতবাদ মানুষকে আদর্শের সন্ধান দেয় না বিধায় মানুষ চরম হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মানব চরিত্র এমনি যে, কোনো মতবাদ যখন মানুষকে আদর্শহীন অবস্থায় পৃথিবীতে ছেড়ে দেয় তখন স্বাভাবিক কারণেই মানুষের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন শূন্যতা। পক্ষান্তরে আদর্শহীন অবস্থায় চিন্তা ও চেতনার শূন্যতা নিয়ে, মানুষ জীবন ধারণ করতে পারে না বলে জীবন যাত্রা নির্বাহের জন্য আদর্শের সন্ধানে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে। ফলে চিন্তা ও চেতনার জগতের শূন্যতা পূরণ করার জন্য তার সামনে বিচিত্র ও মানব চিন্তার বিপরীতমুখী আদর্শের সমাবেশ ঘটতে থাকে। এ অবস্থায় মানুষের যে কি করুণ পরিণতি ঘটে তা একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হতে পারে।

        কোনো একজন মানুষের অনেকগুলো বন্ধু ছিলো। বন্ধুদের মধ্যে কেউ শুকনো কাঠ ব্যবসায়ী, কেউ তুলা ব্যবসায়ী, কেউ কাপড় ব্যবসায়ী, কেউ পেট্রোল ব্যবসায়ী, কেউ কেরেসিন তৈল ব্যবসায়ী, কেউ খড় ব্যবসায়ী, কেউ ছিলো কাগজ ব্যবসায়ী। হঠাৎ একদিন দেখা গেলো, গভীর রজনীতে ঐ অনেকগুলো বন্ধুর অধিকারী ব্যক্তিটির আপন বাসগৃহে আগুন লেগেছে। তখন ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে তার বন্ধুদের কাছে সাহায্য চেয়ে বলছে, 'আমার এই চরম বিপদের মুহূর্তে তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করো'।

        লোকটির এই করুণ আর্তনাদে সাড়া দিয়ে তার সকল বন্ধুরা ছুটে এলো। কাঠ ব্যবসায়ী বন্ধু প্রচুর কাঠসহ ছুটে এসে অগুনের ভেতরে তা ছুড়ে দিলো। কাপড় ব্যবসায়ী বন্ধু কতকগুলো কাপড়ের থান এনে তা আগুনের ভেতরে ছুড়ে মারলো। খড় ব্যবসায়ী বন্ধু কয়েক বোঝা খড় এনে তা আগুনের ভেতরে ছুড়ে দিল। এভাবে কাগজ ব্যবসায়ী বন্ধু কাগজ, পেট্রোল ব্যবসায়ী বন্ধু পেট্রোল, কেরোসিন ব্যবসায়ী বন্ধু কেরোসিন আগুনের ভেতরে ছুড়ে দিলো। ফল যা হবার তাই হলো। আগুন নির্বাপিত হবার পরিবর্তে আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সকল বন্ধুর কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে সাহায্য করা অর্থাৎ বন্ধুর ঘরের আগুন নিভিয়ে ফেলা। পক্ষান্তরে বিপদগ্রস্ত বন্ধুর জন্য এই লোকগুলো যা করলো তাতে করে বিপদগ্রস্ত বন্ধুর বিপদ বৃদ্ধি বৈ কমলো না।

        প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজের জন্য যত আদর্শ, মতবাদ-মতাদর্শ রচনা করেছে তা সবই আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নীচু বলে প্রতিভাত হয়েছে। ভুল দিক থেকে তার গতি শুরু হয় এবং ভুল দিকেই তা উপনীত হয়ে সমাপ্তি লাভ করে এবং সেখান থেকে পুনরায় অন্য কোনো ভুল পথের দিকেই অগ্রসর হতে থাকে। এসব অসংখ্য বাঁকা ও ভ্রান্ত পথের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে অবস্থিত এমন একটি পথ একান্তই আবশ্যক। যেন মানুষের সমস্ত শক্তি ও কামনা-বাসনার প্রতি, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, স্নেহ, প্রেম-প্রীতি ও আবেগ- উচ্ছ্বাসের প্রতি, মানুষের আত্মা ও শারীরিক দাবির প্রতি এবং জীবনের যাবতীয় সমস্যার প্রতি যথাযথ-ন্যায়-নিষ্ঠ আচরণ করা, যে আচরণে কোনো ধরনের বক্রতা ও জটিলতা থাকবে না, বিশেষ কোনো দিকের প্রতি অযথা গুরুত্ব আরোপ ও অন্যান্য দিকগুলোর প্রতি অবিচার ও জুলুম করা হবে না।

        বস্তুত মানব জীবনের সুষ্ঠু ও সঠিক বিকাশ এবং তার সাফল্য ও সার্থকতা লাভের জন্য এটা একান্তভাবে অপরিহার্য। মানুষের মূল প্রকৃতিই এই সত্য-সঠিক পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকিম লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। পৃথিবীর কোনো অমুসলিম বা ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তানায়ক এ কথার প্রতি স্বীকৃতি দিক আর না-ই দিক, এ কথা অকাট্য সত্য যে, অসংখ্য বাঁকা-চোরাপথ, ভ্রান্তপথ থেকে বারবার বিদ্রোহ ঘোষণার মূল কারণ হলো, মানব প্রকৃতি সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সহজ-সরল পথের সন্ধানেই ছুটতে থাকে।

        পক্ষান্তরে এ কথা সর্বজনবিদিত ও অকাট্য সত্য যে, মানুষ স্বয়ং মুক্তির এই রাজপথ আবিষ্কার করতে ও চিনতে সক্ষম হয় না এবং সিরাতুল মুস্তাকিম রচনা করতে পারে না- শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই সিরাতুল মুস্তাকিম রচনা করার মতো জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনিই তা রচনা করতে সক্ষম। ঠিক এই উদ্দেশ্যসাধন করার জন্যেই আল্লাহ তা'য়ালা নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, মানুষকে মুক্তির রাজপথে নিয়ে আসা তথা আল্লাহর গোলামীর পথ, 'সিরাতুল মুস্তাকিম' কোনটি তা প্রদর্শন করা।

        আল্লাহর কুরআন এই মহামুক্তির মহান পথ সিরাতুল মুস্তাকিমকে 'সাওয়া আস- সাবীল' নামেও মানুষের সামনে পেশ করেছে। পৃথিবীর এই নশ্বর জীবন থেকে শুরু করে আলমে আখিরাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের জীবন পর্যন্ত অসংখ্য বাঁকা-চোরা এবং অন্ধকারে আচ্ছন্ন পথের মাঝখান দিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিম বা মহামুক্তির মহান পথ সরল রেখার মতোই আল্লাহর জান্নাতের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সুতরাং এই পথের যিনি পথিক হবেন, তিনি এই পৃথিবীতে নির্ভুল-অভ্রান্ত পথের পথিক হবেন এবং আলমে আখিরাতের জীবনে পরিপূর্ণভাবে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হবেন।

        আর যে ব্যক্তি এই পৃথিবীতে সিরাতুল মুস্তাকিমের অভ্রান্ত পথ চিনতে ব্যর্থ হবে বা হারিয়ে ফেলবে সে ব্যক্তি এই পৃথিবীতেও বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট ও ভুল পথের যাত্রী আর আলমে আখিরাতে তাকে অনিবার্যরূপে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। কারণ সিরাতুল মুস্তাকিম বা সাওয়া-আস সাবীল ব্যতিত অন্য সকল বাঁকা পথের শেষ প্রান্ত আল্লাহ তা'য়ালার সৃষ্টি জাহান্নাম পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে।

        বস্তুবাদ আর জড়বাদের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত একশ্রেণীর চিন্তানায়কগণ বর্তমান মানুষের জীবনকে ক্রমাগতভাবে একটি প্রান্ত থেকে বিপরীত দিকের আরেকটি প্রান্তে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখে এই ভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দ্বান্দ্বিক কার্যক্রম (Dialectical process) মানুষের জীবনের ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক স্বভাবসম্মত পথ। এসব চিন্তাবিদগণ নিজেদের অজ্ঞতার কারণে বুঝে নিয়েছেন যে, প্রথমে এক চরমপন্থী দাবী (Thesis) মানুষকে একদিকের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাবে, ঠিক অনুরূপভাবে সে ঐ প্রান্ত থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আরেকটি চরমপন্থী দাবী (Antithesis) তাকে বিপরীত দিকের শেষ প্রান্তে নিয়ে পৌঁছাবে। এভাবে উভয় প্রান্তের আঘাতের সংমিশ্রণে মানুষের জন্য তার জীবন বিকাশের পথ (Synthesis) স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসবে আর এটাই হচ্ছে মানুষের ক্রমবিকাশ লাভের একমাত্র অভ্রান্ত পথ।

        ভোগবাদে বিশ্বাসী এসব জড়বাদীদের আবিষ্কার করা ক্রমবিকাশ লাভের এই পথকে ক্রমবিকাশ লাভের পথ না বলে চপেটাঘাত খাওয়ার পথ বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ মানুষের জীবনের সঠিক বিকাশের পথে এই পথ বারংবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, মানব জীবন বিকাশের পথে এ পথ অর্গল তুলে দেয়। প্রতিটি চরমপন্থী দাবী মানুষের জীবনকে তার কোনো একটি দিকে ঘুরিয়ে দেয় ও তাকে কঠিনভাবে টেনে নিয়ে যায়। এভাবে বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হতে হতে যখন সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে তা অনেক দূরে চলে যায়, তখন স্বয়ং জীবনেরই অন্যান্য যেসব সমস্যার প্রতি কোনো গুরুত্ব প্রদান করা বা সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়নি, তা বিদ্রোহ শুরু করে।

        এভাবে একটির পর একটি দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে, মানুষের জীবন থেকে শান্তি সুদূর পরাহত হয়ে যায়। এই অন্ধদের দৃষ্টি সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে যেতে বাধা দেয় তাদের সীমাহীন ভোগ বিলাস। এ জন্য তারা দেখতে পায় না, সিরাতুল মুস্তাকিমই হলো মানব জীবনের ক্রমবিকাশ লাভের একমাত্র সত্য-সঠিক পথ। আর বিশ্বনবী (সা:) এই সিরাতুল মুস্তাকিমের পথটিই মানব জাতিকে প্রদর্শন করেছেন এবং এ উদ্দেশ্যেই তাঁকে প্রেরণ করা হয়ছিলো। এই বিস্তারিত আলোচনায় নবী করীম (সা:) কে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, পৃথিবীতে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষ সম্পূর্ণ অজ্ঞ। শান্তি, শৃংখলা, উন্নতি, সমৃদ্ধি, প্রগতি সম্পর্কে মানুষ সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে এবং পরস্পর বিরোধী ভ্রান্ত চিন্তাধারায় তাড়িত ছিলো। অন্ধকারের কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বের করে আলোর জগতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ একান্ত অনুগ্রহ করে নবী করীম (সা:) কে অতুলনীয় মর্যাদা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments