নবী-রাসূলকে কেনো বিশ্বাস করতে হবে?

        জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধির বিচারে যখন একথা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, প্রকৃত সত্য জানার কোনো মাধ্যম আমাদের কাছে নেই। প্রকৃত সত্য অবগত হবার একমাত্র মাধ্যম হলো নবী-রাসূল। আমরা এ কথাও জানি যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী- রাসূল মানুষের জন্য সহজ সরল পথ প্রদর্শন করেন, তখন একথাও আমাদের কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়, নবীর ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা, তাঁর যে কোনো আদেশ পালন করা, তাঁর প্রদর্শিত পথ যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে অনুসরণ করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

        নবীর বিধান বর্তমান অবিকৃত উপস্থিত থাকার পরেও যদি কোনো ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তি অনুযায়ী জীবন যাপন করে অন্য কোনো মানুষের আদর্শ অনুসরণ করে, তাহলে সে যে পথভ্রষ্ট হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের ভেতর থেকেই আরেকজন মানুষ যদি মানুষকে পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হতো, তাহলে নবী প্রেরণের তো কোনো প্রয়োজনই হতো না। জীবন ব্যবস্থা প্রদানের কাজ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বিধায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী প্রেরণের ব্যবস্থা করেছেন এবং নবীর মাধ্যমে জীবন ব্যবস্থা দান করেছেন।

        একশ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে যারা নবুয়‍্যাত এবং রিসালাতের বিশ্বজনীন ধারণাকে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের ধারণা হলো, নবীকে কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বাস করতে হবে বটে, তাঁর আনিত আদর্শও ছিল অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু তা ছিল তাঁর যুগের উপযোগী। নবীর আদর্শ সার্বজনীন নয়। বর্তমানে চলার জন্য আদর্শ রচনা করতে হবে বা নবীর আদর্শে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন একটি আদর্শ দাঁড় করিয়ে তা অনুসরণ করতে হবে। এদের জ্ঞানের দৈন্যতা দেখলে এদের ওপর করুণা হয়। আরেক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা দাবী করে নবীকে অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজনই নেই। কারণ আমাদের জ্ঞান বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে আমরা সত্য পথের সন্ধান করতে সক্ষম। এই শ্রেণীর মানুষ মারাত্মক ভ্রমে নিমজ্জিত। এরা বুঝতে চায় না যে, জ্যামিতিতে একটি বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দু পর্যন্ত সরল রেখা মাত্র একটিই হয়। এছাড়া যত রেখা অঙ্কন করা হবে তা সরল রেখা হবে না। সুতরাং নবীদের আনীত পথই হলো সহজ-সরল পথ। এই পথ ব্যতীত অন্য কোনো পথ সহজ-সরল হয় না, হতে পারে না। সুতরাং মানুষ যদি নবীর আনিত সহজ- সরল পথ ত্যাগ করে অন্য পথ অবলম্বন করে, ব্যক্তি তা করতে পারে। এ স্বাধীনতা তার রয়েছে। কিন্তু এই পথ মানব মনের চাহিদা অনুসারে তাকে শান্তি দিতে পারবে না।

        সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাস এ কথার সাক্ষী। পৃথিবীর দু'একটি দেশে যেখানে নবীর আনিত আদর্শের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্রাংশ বাস্তবায়িত রয়েছে, আর যেখানে সামান্যতমও নেই, এই দুই স্থানের অপরাধের পার্থক্য দেখলেই অনুধাবন করা যায় নবীর আনিত আদর্শ অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। মানুষ মুখে স্বীকৃতি না দিলেও তার মনের চাহিদা এবং বিবেকের দাবী হলো, সে সত্য সহজ-সরল পথে চলতে আগ্রহী। যে পথে কোনো কন্টক নেই, কোনো বাধা নেই, কোনো ধরনের সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। কিন্তু মানুষ পার্থিব স্বার্থে এবং অহমিকা বশতঃ সেই পথেই চলতে গিয়ে ধ্বংসের অতলে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

        মানুষ দেখেও শিখে না। প্রাণী জগতের দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সে দেখতে পায়, একটি ইতর প্রাণীও তার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য সহজ সরল পথ অনুসরণ করে। কিন্তু সৃষ্টির সেরা এই মানুষ বড়ই বিচিত্র। এরা সহজ সরল পথ দেখলে চিন্তা করে এই পথে চলতে গেলে পার্থিব স্বার্থে আঘাত আসবে এবং আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবো। সুতরাং আমরা নিজেরাও এই পথে চলবো না অন্য কাউকেই এই পথে চলতে দেব না। আল্লাহ তা'য়ালার কোনো নেক বান্দাহ যখন এদেরকে সহজ সরল পথের দিকে সহানুভূতির সাথে আহ্বান জানায় তখন সে ঘাড় বাঁকা করে থাকে। নিজের আবিষ্কার করা ভুল পথের ওপরেই সে দৃঢ় থাকে।

        এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার যে, নবীকে অস্বীকার করে বা তাঁর আনুগত্য করতে অস্বীকার করে কোনো ব্যক্তি বা জাতি সহজ সরল পথ লাভ করতে পারে না এবং মানুষ তার কাংখিত শাস্তিও লাভ করতে পারে না। নবীকে ত্যাগ করেও কোনো ব্যক্তি আল্লাহ তা'য়ালা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। পৃথিবী এবং আলমে আখেরাতে শান্তি লাভ করতে হলে তাকে অবশ্যই নবীর ওপর ঈমান এনে নবীকে অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ মানুষের সামনে উন্মুক্ত নেই।

        কোনো ব্যক্তি বা জাতি সহজ-সরল পথ অবলম্বন করতে চায় অথচ সে ব্যক্তি বা জাতি একজন নবীর মতো সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সত্ত্বার কথা গ্রহণ করতে অস্বীকার করছে, সেই ব্যক্তির বা জাতির যে বুদ্ধির বৈকল্য ঘটেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ মস্তিষ্ক বিকৃতি না ঘটলে, বুদ্ধি ভ্রষ্ট না হলে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সত্য বিমুখ হওয়া সম্ভব নয়। তার জ্ঞান বিবেক বুদ্ধির দৈন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, তার মনের জগতে অহংকার নামক নিকৃষ্ট স্বভাব বাসা বাঁধতে পারে, অথবা সে স্বয়ং বাঁকা স্বভাবের হতে পারে, যে কারণে তার মন মানসিকতা সত্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় না।

        এ সকল কারণেই সে তার পূর্ব পুরুষ যা করে এসেছে তারই অন্ধ অনুসরণ করে। সমাজে বা বংশে শতাব্দী ধরে যে প্রথা চলে আসছে তা অনুসরণ করে। পূর্ব পুরুষ যা করে এসেছে এবং দেশ ও সমাজে কয়েক শতাব্দী ধরে যে প্রথা চলে আসছে, এ সবের বিরুদ্ধে সে কথা শুনতে চায় না। এমন ব্যক্তি ধারণা করতে পারে, পৃথিবীতে আমি যা খুশী তাই করবো, যেভাবে খুশী জীবন যাপন করবো, আমি নবীকে অনুসরণ করলে আমার সে স্বাধীনতা থাকবে না। সুতরাং আমি নবীকে অনুসরণ করবো না।

        নবীকে অনুসরণ না করার ওপরে উল্লেখিত কারণগুলো যদি কোনো ব্যক্তি বা জাতির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে সেই জাতি বা ব্যক্তির পক্ষে কোনক্রমেই সহজ-সরল পথে চলা সম্ভব হবে না। ধর্মের নামে সে ব্যক্তি যতই পীরের দরবারে পড়ে থাক না কেনো, মাজারে মাথা ঠুকতে ঠুকতে সে ব্যক্তি যদি নিজেকে রক্তাক্তও করে, তবুও তার পক্ষে আল্লাহ তা'য়ালা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হবে না। নবীর প্রদর্শিত পথ ব্যতীত কোনো মানুষের পক্ষে সত্য লাভ করা সম্ভব নয়।

        মনে রাখতে হবে, নবুয়‍্যাত বা রিসালাত দাবী করে বা চেষ্টা-সাধনা করে লাভ করার কোনো জিনিস নয়। এ সম্পর্কে আমরা এই গ্রন্থের প্রথম দিকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সুতরাং যিনি নবী প্রেরণ করেছেন, তিনিই আদেশ দিয়েছেন নবীর আনুগত্য করার জন্য বা নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। নবীর প্রতি যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য না করে, সে ব্যক্তি যে আল্লাহ তা'য়ালার প্রতি বিদ্রোহী এতে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

        সাধারণ মানুষ যে দেশের নাগরিক এবং যে সরকারের প্রজা, সেই সরকারের নিযুক্ত প্রশাসকের আনুগত্য করতে হবে, এটা করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। কেউ সরকারকে মানবে আর সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসককে মানবে না, বিষয়টি পরস্পর বিরোধী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন সকল সৃষ্টির বাদশাহ। তাঁর সৃষ্টি মানুষকে পথ প্রদর্শন করার জন্য তিনি যাকে খুশী নিযুক্ত করতে পারেন। তিনি যাকেই নিযুক্ত করেছিলেন, যার আনুগত্য করার জন্য মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর আনুগত্য করা সকল মানুষের জন্য অবধারিত কর্তব্য।

        নিজেকে সকলের আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে একমাত্র নবীর আনুগত্য করা প্রতিটি মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক। মানুষ যদি তা না করে তাহলে সে নিজেকে কিছুতেই আল্লাহ তা'য়ালার গোলাম হিসেবে পরিচয় দিতে পারে না। একজন মানুষ স্রষ্টা আল্লাহ তা'য়ালাকে স্বীকার করবে অথচ তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলকে স্বীকার করবে না, এমন হতে পারে না। এ ধরনের ব্যক্তির জন্য আল্লাহকে স্বীকৃতি দেয়া না দেয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

Post a Comment

0 Comments